তাকওয়া অর্জনে রোজা


২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:৩১

॥ অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ॥
কুরআন মাজিদে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেন ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর সাওম ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপরÑ যেন তোমরা তাক্ওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সূরা আল-বাকারা : ১৮৩)। রহমত, গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস মাহে রমজান মুমিনের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস, যা বছরে একবার আসে। গুনাহ মাফ পাবার মহাসুযোগ।
রোজা রাখার দিনগুলো
রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজানে পুরো মাস রোজা রাখতেন। চাঁদ অনুযায়ী কোনো সময় ৩০ অথবা ২৯ রোজা রাখতেন। রজব মাসে ১০টি রোজা রাখতেন, শাবান মাসে ২০টি রোজা রাখতেন। (দারিমি)।
এক দিন পরপর রোজা রাখাকে সওমে দাউদ বলে। দাউদ (আ.) এভাবে রোজা রাখতেন। প্রতি মাসে তিন দিন করে রোজা রাখাই বছরজুড়ে রোজা রাখা। সাহাবী বললেন, আমি এর চেয়ে বেশি সামর্থ্য রাখি। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তাহলে তুমি দাউদ (আ.)-এর রোজা রাখো। তিনি এক দিন রোজা রাখতেন আর এক দিন রোজা ছেড়ে দিতেন।
সপ্তাহের রোজা : সপ্তাহের প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা রাসূল (সা.) পছন্দ করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার (বান্দার) আমল (আল্লাহর কাছে) উপস্থাপিত হয়। আমি পছন্দ করি যে রোজা অবস্থায় আমার আমল উপস্থাপন হোক। (তিরমিযী)। আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সোমবারের রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, সেদিন আমি জন্মেছি এবং সেদিন আমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। (মুসলিম)।
মাসের রোজা : প্রতি আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজাকে আইয়্যামে বিজের রোজা বলে। নিয়মিতভাবে এই তিন দিনের রোজা সারা বছর রোজা রাখার সমতুল্য। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আমার বন্ধু নবী (সা.) আমাকে তিনটি অসিয়ত করেছেন। ১. প্রতি মাসে তিন দিন করে রোজা রাখা, ২. চাশতের দুই রাকাত নামাজ পড়া এবং ৩. ঘুমানোর আগে বিতর নামাজ আদায় করা। (বুখারি)।
আশুরার রোজা : মহররম মাসের ১০ তারিখ হলো আশুরা। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ফরজ ছিল। মহররম মাসের ১০ তারিখ আশুরার রোজার ক্ষেত্রে তার আগে বা পরে এক দিন মিলিয়ে দুটি রোজা রাখার কথা নবী (সা.) বলেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, রমজানের পর সবচেয়ে উত্তম রোজা হলো আল্লাহর মাস মহররম মাসের রোজা অর্থাৎ আশুরার রোজা। আর ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো রাতের নামাজ অর্থাৎ তাহাজ্জুদ নামাজ। (মুসলিম)।
শাবান মাসের রোজা : নবী (সা.) শাবান মাসে খুব বেশি পরিমাণে রোজা রাখতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, নবী (সা.) শাবান মাসের চেয়ে কোনো মাসে বেশি রোজা পালন করেননি। তিনি প্রায় পুরো শাবান মাসই রোজা পালন করতেন। (বুখারি ও মুসলিম)।
শাওয়াল মাসের রোজা : ঈদুল ফিতরের পর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখার বিষয়ে হাদিসে বর্ণিত আছে। সে রোজাগুলো লাগাতার বা ভেঙে ভেঙে রাখা যায়। আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে রমজানের রোজা রাখে, অতঃপর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখে, সে যেন বছরজুড়ে রোজা রাখে। (মুসলিম)।
জিলহজ মাসের রোজা : জিলহজ মাসের প্রথম থেকে নবম দিন পর্যন্ত মোট ৯টি রোজার ব্যাপারে হাদিসে উৎসাহিত করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহর কাছে অন্য কোনো দিনের ইবাদত অতটা বেশি পছন্দনীয় নয়, যতটা বেশি পছন্দনীয় জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের ইবাদত। এর প্রত্যেক দিনের রোজা এক বছর রোজার সমতুল্য আর এর প্রত্যেক রাতের ইবাদত কদরের রাতের ইবাদতের সমতুল্য। (তিরমিযী)।
জিলহজ মাসের নবম দিন হলো আরাফাতের দিন। সেদিনের রোজার ফজিলত আরো বেশি। আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি আশা করি, আরাফাতের দিনের রোজা তার পূর্ব ও পরের এক বছরের পাপ মোচন করে দেবে। (মুসলিম)।
নবী (সা.)-এর নিয়মিত আমল- সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা পালন করা। তাছাড়া মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ রোজা পালন করা। মাসজুড়ে বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া। বিশেষ করে তাহাজ্জুদ, ইশরাক, চাশত-দোহা, জাওয়াল, আউয়াবিন, তাহিয়্যাতুল অজু, দুখুলুল মাসজিদ ইত্যাদি নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া খুবই জরুরি।
আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, জিবরাইল (আ.) দোয়া করেছেন, ‘ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যে বৃদ্ধ অবস্থায় মাতা-পিতাকে পেল, অতঃপর সে তাদের খেদমত করে নিজের গুনাহ ক্ষমা করিয়ে জান্নাত অর্জন করতে পারল না, ‘ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি যে পুরো রমজান মাস পাওয়া সত্ত্বেও নিজের গুনাহ ক্ষমা করাতে সক্ষম হলো না।’ ‘ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যার সামনে আমার নাম আলোচিত হলো অথচ সে আমার ওপর দরূদ শরিফ পাঠ করল না,’ হজরত জিবরাইলের এ তিনটি বদদোয়ার প্রতিটি দোয়ার সময় বলেছি ‘আমিন’। [তিরমিযী]।
আরেকটি হাদিসে বলা হয়েছে, জিবরিল আমীন (আ.) রাসূল (সা.)-এর ঐ বদ দু’আতে আমিন! আমিন! বলেছিলেন। [ইবনে খুযাইমা]।
রোজা না রাখার শাস্তি
আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘একদিন আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমি ওপরে ওঠা শুরু করি এবং পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছি। সেখানে প্রচণ্ড চিৎকারের শব্দ শোনা যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কীসের শব্দ? তারা বলল, এটা জাহান্নামিদের আওয়াজ। এরপর তারা আমাকে এমন কিছু লোকের কাছে নিয়ে যায়, যাদের পায়ের টাখনুতে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের গাল ছিন্নভিন্ন, তা হতে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা এমন রোজাদার যারা (অকারণে রমজান মাসের) রোজা শেষ না করেই ভঙ্গ করত।’ (সহিহ ইবনে খুজাইমা)।
আরেক হাদিসে আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘একদিন আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, একটি সম্প্রদায় উল্টোভাবে ঝুলছে। তাদের গলাটি ফাড়া এবং তা থেকে রক্ত ঝরছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? বলা হলো, এরা ঐসব ব্যক্তি, যারা বিনা ওজরে রমজান মাসের সাওম ভঙ্গ করেছিল।’ (সহীহ ইবনে খুযাইমা)।
রোজা সম্পর্কে ভুল ধারণা
মুসলিমদের মধ্যে রোজা নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা আছে। অনিচ্ছাকৃত ভুল আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দেন। রোজার কোনো ক্ষতি হয় না কিন্তু কেউ কেউ এগুলোকে রোজা ভঙ্গের কারণ মনে করেন। যেমন- ১. ভুলক্রমে কিংবা অনিচ্ছাকৃত পানাহার করলে রোজা ভঙ্গ হয় না।
২. গলার ভেতর ধোঁয়া; এমনকি মশা-মাছি প্রবেশ করলেও রোজা ভঙ্গ হয় না। এমনকি আতর সুগন্ধি ব্যবহার বা ফুলের ঘ্রাণ নিলেও রোজা ভঙ্গ হয় না।
৩. তাছাড়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রোজাদার যদি থুথু গিলে ফেলেন; তাহলে রোজা ভঙ্গ হবে না।
এছাড়া শরীর বা মাথায় তেল ব্যবহার করলে রোজা নষ্ট হয় না। অনিচ্ছাকৃত কানে পানি প্রবেশ করলেও রোজা ভাঙবে না। তাছাড়া অনিচ্ছাকৃত বমি হলে রোজা ভাঙবে না; তবে যদি ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ভরে বমি হলে রোজা ভেঙে যাবে। চোখে ওষুধ বা সুরমা ব্যবহারেও রোজা ভাঙে না।
ঘুমের মধ্যে স্বপ্নদোষ হলে রোজা ভাঙে না। ঠাণ্ডার জন্য গোসল বা মেসওয়াক করলেও রোজা ভাঙে না। কোনোরকম ইনজেকশন ইনসুলিন বা টিকা নিলেও রোজা ভঙ্গ হয় না। এমনকি গ্লুকোজযুক্ত ইনজেকশন নিলেও রোজার কোনো ক্ষতি হয় না।
* একটি ভ্রান্ত কথা প্রচলিত আছে যে, রোজাদারের খাবারের কোনো হিসাব নেই। এটিও ভ্রান্ত কথা। খাদ্যের হিসাব-নিকাশের সাথে রমজান ও রোজার কোনো সম্পর্ক নেই। হালাল খাবার সর্বদা হালাল আর হারাম সর্বদা হারাম, অপচয়কারী সবসময় শয়তানের ভাই।
* যাকাত শুধু রমজান মাসেই দিতে হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন, এটিও একটি বিভ্রান্তি। যাকাতের সম্পর্ক বর্ষপূর্তির সাথে, রমজানের সাথে নয়।
* রমজানের চাঁদ দেখায় সংশয় হলে অথবা রমজানকে স্বাগত জানাতে দু-একদিন আগে থেকেই রোজা শুরু করা একটি বিভ্রান্তি, যার ব্যাপারে হাদিসে নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
* সাহরিতে ডাকার জন্য মাইকে দীর্ঘ সাইরেন বাজানো, ঢোল পেটানো, হইহুল্লোড় ইত্যাদি মানুষের কষ্টের কারণ বলে পরিত্যাজ্য। কাউকে সন্দেহ এড়ানো বা সতর্কতার জন্য ইফতার দেরিতে করতে দেখা যায়, এটিও একটি ভুল। রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহরি দেরিতে ও ইফতার দ্রুত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
রোজা রেখে কাজগুলো করা যায়
* চোখে ওষুধ দিলে রোজা ভাঙবে না।
* মেসওয়াক করা। যে কোনো সময়ে হোক, মেসওয়াক করা সুন্নত।
* শরীরে, দাড়িতে বা পোশাকে তেল, সুরমা লাগানো, সুগন্ধি ও তাঁর ঘ্রাণ নেয়া।
* ভুলক্রমে পানাহার করা, স্বপ্নদোষ হওয়া।
* ইনজেকশন, টিকা বা স্যালাইন লাগালে।
* শরীর থেকে ইনজেকশনের সাহায্যে রক্ত বের করলে। এতে রোজা রাখার শক্তি চলে না গেলে মাকরুহও হয় না। (আহসানুল ফাতাওয়া, ৪র্থ খণ্ড)।
* রান্নার সময় খাবার চেঁখে দেখা, তবে অবশ্যই তা কণ্ঠনালি পর্যন্ত পৌঁছা যাবে না।
খতম তারাবির ইমামের সাথে টাকার চুক্তি করা বৈধ নয়। হাদিয়া দেয়া যেতে পারে। ধৈর্যের সাথে স্পষ্ট করে পড়তে না পারলে সূরা তারাবি পড়া উচিত। তবুও কুরআনের হক নষ্ট করা উচিত নয়।
* চার রাকাত পরপর যে বিরতি নেয়া হয়, তা মূলত বিশ্রামের জন্য।
* লাইলাতুল কদর।
* রমজানের একটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ রাত্রি হল লাইলাতুল কদর। তবে এ রাত্রি রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোর যে কোনো একটি। কদরকে শুধুমাত্র ২৭-এর রাত্রিতে নির্দিষ্ট করা একটি ভ্রান্তি। মূল কথা হলো কদর কোনো নির্দিষ্ট রাত নয়, বরং শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোয় ঘুরে ঘুরে আসে।
* এ রাতে গোসল করার ফজিলত সম্পর্কে অনেকে অনেক কথা বর্ণনা করে থাকেন, যার সবই বানোয়াট এবং বিভ্রান্তি।
* এ রাত উপলক্ষে মসজিদে আলোকসজ্জা করা, হালুয়া-রুটি, মিষ্টান্ন বিতরণ এসবই বিদ’আত। সব নফল সালাতের মতো এ রাতের সালাতও ঘরে একাকী পড়া উত্তম।
রোজার সময় অপ্রয়োজনীয় কাজ
১. শেষ রাতে মাইকে তেলাওয়াত, গজল, ইসলামী সঙ্গীত, অনবরত ডাকাডাকি, সম্মিলিত কণ্ঠে গজল বা কাওয়ালী গেয়ে ঢোল বাজিয়ে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে চাঁদা আদায়। ২. সাহরি খাওয়ার সময় নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা। ৩. বিলম্বে ইফতার করা, ৪. রমজানের নতুন চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছু লোক চাঁদের দিকে হাত উঁচু করে শাহাদাত আঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করে থাকে। এটা বিদ’আত। নতুন চাঁদ দেখলে দোয়া- আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমানি ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলাম, রাব্বী ওয়া রাব্বুকাল্লাহ”। অর্থ: হে আল্লাহ, এ চাঁদকে আমাদের মাঝে বরকত, ঈমান, শান্তি-নিরাপত্তা ও ইসলামের সাতে উদিত কর, আমার ও তোমার রব আল্লাহ।” [মুসনাদে আহমাদ, আল্লামা আলবানীর মতে এটি সহীহ।]।
৫. রমজান মাসে শেষ রাতে মুয়াজ্জিনগণ মাইকে উচ্চ আওয়াজে কুরআন তিলাওয়াত, গজল, ইসলামী সঙ্গীত ইত্যাদি গাওয়া শুরু করে। অথবা টেপ রেকর্ডার চালিয়ে বক্তাদের ওয়াজ, গজল বাজাতে থাকে। এলাকার কিছু যুবক রমজানের শেষ রাতে মাইক নিয়ে এসে সম্মিলিত কণ্ঠে গজল বা কাওয়ালী গেয়ে মানুষের বাড়ির দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে চাঁদা আদায় করে। শেষ রাতে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নিচের আসমানে নেমে আসেন। এটা দুয়া কবুলের সময়। আল্লাহ তায়ালার নিকট এ সময় কেউ দুয়া করলে তিনি তা কবুল করেন। মুমিন বান্দাগণ এ সময় তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন, কুরআন তেলাওয়াত করেন, মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে রোনাজারি করে থাকেন। সুতরাং এ সময় মাইক বাজিয়ে, গজল গেয়ে এ মূল্যবান সময়ে ইবাদতে বিঘ্নিত করা নিঃসন্দেহে গুনাহের কাজ।
সুন্নত হচ্ছে, ফজরের আগে সাহরির জন্য আলাদা একটি আজান দেওয়া। এই আজান হলো সাহরি খাওয়ার জন্য এবং তারপর ফজর সালাতের জন্য আরেকটি আজান দেওয়া। এজন্য রাসূল (সা.)- এর পক্ষ থেকে দুজন মুয়াজ্জিনও নিয়োগ করা ছিল। যেমন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, “বেলাল রাতে আজান দেয়। অতএব তোমরা বেলালের আজান শুনলে পানাহার করতে থাক ইবনে উম্মে মাকতুমের আজান দেওয়া পর্যন্ত।” [বুখারি, অনুচ্ছেদ: ফজরের আগে আজান দেওয়া।]
মুখে উচ্চারণ নয়, মনে মনে নিয়ত করা
রাসূল (সা.) বলেছেন, “সকল আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।” (সহীহ বুখারি)। তাই রোজা রাখার জন্য নিয়ত থাকা অপরিহার্য। তাই নবী (সা.) বলেছেন, “যে রাতে (ফজরের আগে) রোজা রাখার নিয়ত করে নি তার রোজা হবে না।” (সুনান নাসাঈ, আল্লামা আলবানী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।) নিয়ত মানে মনে মনে সিদ্ধান্ত, মুখে উচ্চারণ নয়।
ইমাম নববী রাহ. বলেন, মনের মধ্যে কোনো কাজের ইচ্ছা করা বা সিদ্ধান্ত নেয়াকেই নিয়ত বলা হয়। সুতরাং রোজা রাখার কথা মনে মধ্যে সক্রিয় থাকাই নিয়তের জন্য যথেষ্ট। মুখে উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই। কেননা ইসলামী শরিয়তে কোনো ইবাদতের নিয়ত মুখ দিয়ে উচ্চারণের কথা আদৌ প্রমাণিত নয়।
বিলম্বে ইফতার করা
কিছু রোজাদারকে দেখা যায়, স্পষ্টভাবে সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও অতি সতর্কতার কারণে আরও কিছুক্ষণ পর ইফতার করে। এটি স্পষ্ট সুন্নতবিরোধিতা। কারণ নবী (সা.) বলেছেন, মানুষ ততদিন কল্যাণে ওপর থাকবে, যতদিন তাড়াতাড়ি ইফতার করবে।” (বুখারি ও মুসলিম)।
কুরআন তেলাওয়াত দ্রুত পড়া
অনেক মসজিদে রমজানে তারাবির নামাযে খুব তাড়াতাড়ি কুরআন তেলাওয়াত করে বা তাড়াহুড়া করে নামাজ শেষ করে। যার কারণে তেলাওয়াত ঠিকমতো বোঝাও যায় না। নামাযে ঠিকমতো দোয়া-জিকিরও পাঠ করা যায় না। এটা নিঃসন্দেহে সুন্নত পরিপন্থী। কেননা আল্লাহর নবী (সা.)- এর রাতের কিয়ামুল লাইল হতো অনেক দীর্ঘ এবং ধীরস্থির।
ফিতরা প্রদান
খাদ্যদ্রব্য না দিয়ে টাকা দিয়ে অথবা কাপড় কিনে ফিতরা দেওয়া সুন্নতের বরখেলাপ। কারণ হাদিসে ফিতরা হিসেবে খাদ্যদ্রব্য প্রদান করার কথাই বর্ণিত হয়েছে। যেমন- ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) মুসলমানদের প্রত্যেক স্বাধীন, দাস, পুরুষ অথবা নারী সকলের ওপর এক সা (প্রায় আড়াই কেজি) পরিমাণ খেজুর অথবা জব যাকাতুল ফিতর হিসেবে আবশ্যক করেছেন।” (বুখারি ও মুসলিম)। এখানে খাদ্যদ্রব্যের কথা সুস্পষ্ট।
তাছাড়া নবী (সা.)-এর যুগেও দিনার-দিরহামের প্রচলন ছিল, কিন্তু তিনি অথবা তার কোনো সাহাবী দিনার-দিরহাম দ্বারা ফিতরা আদায় করেছেন বলে কোনো প্রমাণ নাই। তাই সুন্নত হলো, আমাদের দেশের প্রধান খাদ্যদ্রব্য (যেমন চাল) দ্বারা ফিতরা আদায় করা।
ফিতরা রমজান শেষ হবার দু-তিন দিন আগে আদায় করার নিয়ম, সাহাবীদের আমল লক্ষ করা যায়, যাতে ঈদের খাবার তারা প্রস্তুত করতে পারে। হাদিসে বলা হয়েছে, কেউ যেন ফিতরা আদায় না করে ঈদগাহের জামাতে না আসে।
মানুষের অন্তরে তাকওয়া অর্থাৎ আল্লাহভীতি সৃষ্টি হলেই কেবল শোষণ, জুলুম, নির্যাতন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, অন্যের অধিকার হরণ, লোভ-লালসাসহ যাবতীয় ব্যক্তিগত ও সামাজিক কুসংস্কার, অবিচার, অন্যায়, গর্ব-অহংকার তথা দাম্ভিকতার করালগ্রাস থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। রাসূলে কারিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি সাওম পালন করেও মিথ্যা কথা বলা, পরনিন্দা ও অন্যান্য পাপাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলো না, তার পানাহার পরিত্যাগ করা আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’
রোজা ও মেশক
হাদিসে কুদসিতে আছে, রাসূল (সা.) বলেন, যার হাতে আমার প্রাণ, তার শপথ, রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ মেশকের তুলনায় আল্লাহ তায়ালার নিকট অধিক প্রিয়। সে আমার উদ্দেশে তার পানাহার ও প্রবৃত্তিকে পরিত্যাগ করে, রোজা আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান। পুণ্যকর্মের প্রতিদান দশগুণ। (বুখারি)।
ইসলামী চিন্তাবিদরা বলছেন, দাঁত ব্রাশ করলে রোজা ভাঙে না। কারণ টুথপেস্ট তো কেউ খায় না। তবে ব্রাশ করার সময় সতর্ক থাকতে হবে যে পেস্ট পেটে চলে না যায়। ইসলামী চিন্তাবিদদের পরামর্শ সবচেয়ে ভালো সমাধান হচ্ছে গাছের সরু ডাল থেকে তৈরি মেসওয়াক বা দাঁতন ব্যবহার।
সুনানে আবু দাউদে যায়েদ বিন খালেদ আলজুহানী (রা.)-এর বরাতে এক হাদিসে তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি- আমার উম্মতের জন্য কষ্টের আশঙ্কা না হলে তাদের ওপর মেসওয়াককে প্রতি নামাজের জন্য ফরজ করে দিতাম।
রোজার মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা মজবুত হোক, বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য, শক্তি, শান্তি-সমৃদ্ধি গড়ে উঠুক, আখিরাতে জান্নাতুল ফেরদাউসে বসবাস করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : নায়েবে আমীর, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও সাবেক এমপি।