সরকার শিক্ষা সংস্কার কমিশন প্রশ্নে নীরব কেন?
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:৩৫
॥ সৈয়দ খালিদ হোসেন ॥
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষার্থীরা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রাখেন। প্রতিষ্ঠানে যা শেখানো হয়, শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তা স্মরণে রেখে চলেন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কর্মমুখী শিক্ষার যেমন অভাব, তেমনি নৈতিক শিক্ষার অভাব। ফলে একজন শিক্ষার্থী দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করলেও অনেক ক্ষেত্রে বেকার থাকছেন এবং নৈতিকতা মেনে চলতে পারছেন না। শিক্ষিত লোকেরাই সুযোগ পেয়ে দুর্নীতিতে জড়ায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির নেপথ্যে থেকে ভূমিকা পালন করে। এর কারণ আমাদের বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা যখন যারা প্রণয়ন করেছেন, তারা দীর্ঘমেয়াদি কোনো চিন্তা করেননি। আবার যখন যেমন সরকার ছিল, তখন তেমন করে তারা শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছেন। ফলে অনেকটা তালগোল পাকানো একটা অবস্থা দাঁড়ায়। গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র মেরামতের অংশ হিসেবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে শিক্ষা খাতেও সংস্কারের উদ্যোগ ছিল, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বিভিন্ন খাতে সংস্কারে কমিশন গঠিত হলেও থমকে আছে শিক্ষা খাতে সংস্কারের উদ্যোগ। কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়ে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।
অথচ শিক্ষা খাতের বিভিন্ন স্তরে বিরাজমান ঘাটতি, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি ও বিভিন্ন পরীক্ষায় উচ্চ জিপিএ অর্জনকারী ছাত্রছাত্রীদের যোগ্যতা প্রমাণে ব্যর্থতা, বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয় এবং এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকা এবং এ সকল কারণে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকসহ বিজ্ঞজনদের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা দূর করে আশার আলো জাগাতে সবার আগে শিক্ষা খাতের সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া খুবই জরুরি ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। কখন হবে তারও কোনো নিশ্চিয়তা নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একেবারেই নিশ্চুপ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এবং শিক্ষা উপদেষ্টার একান্ত সচিব মো. আবু ওয়াদুদ গত ১৭ ফেব্রুয়ারি এ প্রতিবেদককে স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, শিক্ষা সংস্কারে কমিশন গঠন বা এ জাতীয় কোনো কার্যক্রম নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। কেন গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে সংস্কারের উদ্যোগ থেমে আছে, তারও কোনো ব্যাখ্যা কারো জানা নেই। প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় থাকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল ইসলাম দুই মাস আগে জানিয়েছিলেন, আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষা সংস্কার কমিশন ঘোষণা করবে। দেশে-বিদেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনন্য, সুপরিচিত, মেধাবী ও দক্ষতাসম্পন্ন লোকদের নিয়ে শিক্ষা কমিশন গঠন করা হবে। সাভারের বিরুলিয়ায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তিনি আশার কথা জানান। কিন্তু তার কথার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল পাওয়া গেল না। অন্যান্য খাতে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশন ইতোমধ্যে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা খাত সংস্কারে কোনো কোনো কমিশনই গঠিত হলো না।
শিক্ষা খাতে সংস্কার খুবই জরুরি, কিন্তু সরকার এ বিষয়ে কমিশন গঠন না করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। তিনি বলেছেন, ‘অবাক হয়ে লক্ষ করছি, সরকার প্রচুর কমিশন গঠন করেছে, কিন্তু শিক্ষা কমিশন করেনি।’ তিনি বলেন, ‘শিক্ষার গুণগত সংস্কার করতে হবে। শিক্ষার সংস্কার খুবই জরুরি ছিল। সরকার যেকোনো কারণে হোক, এখনো এটা করেনি। কিন্তু করতে হবে। কারণ (শিক্ষার মানোন্নয়নে) এটাই একমাত্র উপায়।’ তিনি বলেন, ‘ভারতীয় উপমহাদেশসহ বেশিরভাগ দেশে শিক্ষায় জিডিপির ৪ শতাংশ বরাদ্দ আছে। বাংলাদেশে বহুদিন ২ দশমিক ১ শতাংশ ছিল। এখন তা আরও কমে ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আপনি শিক্ষা সম্পর্কে আলাপ করবেন, আলাপ একটাই। রাষ্ট্রের কাছে চাওয়া একটাই। অন্তত ৪ শতাংশ, আমাদের উপমহাদেশে যা আছে।’ তিনি বলেন, ‘আপনি ইন্ডিয়ার মতো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় চান? এশিয়ার ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ইন্ডিয়ার ২০টা আছে। আপনার (বাংলাদেশের) একটাও নেই। পাকিস্তানের ১০-১২টা আছে। আপনি লজ্জা পান তো। তাদের (ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের) বাজেটটা একটু দেখেন। তারা মাস্টারদের কী পরিমাণ টাকা দেয়। শিক্ষা খাতে তাদের বার্ষিক বাজেট কত।’ প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের বেতন কমের বিষয়টি উল্লেখ করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক বলেন, ‘প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকদের বেতন ১৭ হাজার টাকা। আমাদের হাইস্কুলে সে স্ট্যান্ডার্ড টিচার নেই, ইউনিভার্সিটিতে স্ট্যান্ডার্ড টিচার নেই, ইউনিভার্সিটির অবকাঠামো নেই, এগুলোর বড় কারণ, টাকা খুবই কম।’ শিক্ষকরা নৈতিকতার কারণে ভালো পড়াবেন, এগুলো বাজে চিন্তা বলেও মন্তব্য করেন তিনি। নতুন বাংলাদেশ চাইলে প্রয়োজন শিক্ষা সংস্কার। এক্ষেত্রে বাড়াতে হবে বরাদ্দও, এ বিষয়ে সব অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদের সঙ্গে আলাপ করে রোডম্যাপ তৈরি করতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানান তিনি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সাহারিয়ার রহমান রাজু মনে করেন, শিক্ষাকে আধুনিক বিশ্বে সমাজের অগ্রগতির মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং উন্নত দেশগুলো শিক্ষায় বিনিয়োগের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে বহু আগেই। কিন্তু বাংলাদেশে এ চিত্র ভিন্ন। এখানে শিক্ষা খাত বরাবরই অবহেলিত। সরকারি তহবিল এবং পরিকল্পনা এখানে মূলত অবকাঠামো, প্রতিরক্ষা এবং বাণিজ্য খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে, যখন শিক্ষা খাতকে গৌণ হিসেবে দেখা হয়েছে। অন্যান্য খাতের অগ্রাধিকার এবং শিক্ষার প্রতি অবহেলার এ বৈপরীত্যের কারণে একটি স্থবির ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, যেখানে পর্যাপ্ত সম্পদ, যোগ্য শিক্ষক এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। অথচ এ দুর্বল অবকাঠামোতেই বিগত সরকার একের পর এক নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খুলে অবস্থা আরও সঙ্গীন করে ফেলেছে। মূলত এর কুফল দীর্ঘমেয়াদি ও অনেক ক্ষেত্রেই এর ক্ষতি অপূরণীয় গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করছে। এরই মধ্যে দীর্ঘসময় অতিবাহিত হয়েছে এবং পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে সরকার এখন নানারকম কমিশনের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এ পর্যন্ত অনেক কমিশন ঘোষিত হলেও শিক্ষা খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কার নিয়ে সরকারপক্ষের কেউ কোনো কথা বলছেন না। অথচ এ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রধান উপদেষ্টা, শিক্ষা উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টাসহ কয়েকজন অধ্যাপক রয়েছেন, যাদের কাছ থেকে ছাত্র-জনতার শিক্ষা খাতে সংস্কার নিয়ে অনেক বেশি আশা ছিল। পারতপক্ষে এ মুহূর্তেই শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন এবং কৌশলগত মনোযোগ সর্বাগ্রে দেওয়া প্রয়োজন ছিল; যাতে দীর্ঘমেয়াদে ভালো ফল পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকভাবে যেখানে অন্য খাতে যথেষ্ট মনোযোগ এবং বরাদ্দ থাকে, বাংলাদেশের শিক্ষা খাত বার বার অবহেলিত হয়েছে এবং পূর্ববর্তী সরকারগুলো এক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী সংস্কার কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে এবং বহু বছরের জমে থাকা ঘাটতি দূর করতে তাই একটি স্বাধীন শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা হবে এমনটাই ভেবেছিল ছাত্র-জনতা। উদ্যোগ গ্রহণ হলে এ কমিশন দীর্ঘমেয়াদি কৌশল তৈরি, প্রয়োজনীয় আর্থিক এবং কাঠামোগত সহায়তা নিশ্চিত এবং একটি শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতো। বস্তুত প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা, সর্বক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা ও মনোযোগের অভাবে বাংলাদেশ এখন মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়েছে এবং এর জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কা রয়েছে।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগের উপদেষ্টা ও প্রক্টর এম এ মতিন মনে করেন, শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্যবই পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে মূল্যবোধ শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, বিনয় ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করার দীক্ষা অবশ্যই আমাদের শিক্ষকদের দিতে হবে। মনে রাখতে হবে শিক্ষক কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, তিনি সমাজেরও শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষানির্ভরতা কমিয়ে মানসিক চাপমুক্ত করতে সহায়তা করা শিক্ষকের একান্ত দায়িত্ব। পরীক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলতা হারাচ্ছে। পরীক্ষানির্ভরতা কমিয়ে, মেধা যাচাই করে প্রাথমিক স্তরেই ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম, পরোপকারিতা ও ন্যায়পরায়ণতা, নাগরিক গুণাবলি ইত্যাদি শেখানো উচিত। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পরীক্ষার ক্ষেত্রে বার বার নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলে বা নিয়ম চালু হলে তাতে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা জ্ঞানবৃদ্ধির জন্য সবার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এতে শিক্ষার্থীরা যেমন একটি-পরিচ্ছন্ন বিদ্যালয় পাবে, তেমনি তারা কর্মঠ, উদ্যমী ও স্বাবলম্বী হবে এবং পরিচ্ছন্ন থাকার জ্ঞান লাভ করবে। আমাদের শিক্ষার মানোন্নয়নে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। শিক্ষকদের ছাত্র শাসনের ব্যাপারে বিশেষ নিয়মে আবদ্ধ করা যাবে না। সেজন্য শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষকদের কোমলমতি মন নিয়ে ভালোবাসা দিয়ে যত্নসহকারে পড়াতে হবে। পাশাপাশি অভিভাবকদের শিক্ষকদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। সবকিছু মিলিয়ে প্রশাসনিক দিক থেকে তৃণমূল পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজালে আমাদের শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব।
খেলাধুলা, আবৃত্তি, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। সেজন্য গ্রন্থাগার ক্লাশ ও গ্রন্থাগার থেকে পুস্তক ধার করার নিয়ম চালু করতে হবে। মোটামুটিভাবে এ সকল কার্যক্রম গ্রহণ ও চালু কার্যক্রম শক্তিশালী করার ব্যাপারে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগের যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ডুয়াল মোড অব এডুকেশন অর্থাৎ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদানের পাশাপাশি অনলাইন পদ্ধতি চালু রাখা যেতে পারে। সেই সাথে অনলাইন সেবা চালু করা যায়। উন্নত বিশ্বে বেশ আগে থেকেই এ অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষাদান কার্যক্রম চলে আসছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম মনে করেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে রোবট, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এবং ইন্টারনেট অব থিংসের মতো প্রযুক্তির সমাজে প্রযুক্তিতে বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন। তাই ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে কারিগরি শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নিতে হবে। উন্নত দেশগুলোর টেকসই উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে কারিগরি শিক্ষা। যেমন- জার্মানিতে ৭৩, জাপানে ৬৬, সিঙ্গাপুরে ৬৫, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০, চীনে ৫৫, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০ শতাংশ মানুষ কারিগরি শিক্ষায় জড়িত ও দক্ষ। তাই বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষায় ব্যাপক উন্নয়ন হতে হবে। এর ফলে আমাদের দেশে বেকারের সংখ্যা কমে আসবে। তা দেশের টেকসই উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। সবাইকে উচ্চশিক্ষায় না গিয়ে কারিগরি শিক্ষায় পড়ার সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে- যেন অনেক শিক্ষার্থী এ শিক্ষায় পড়াশোনা করতে আগ্রহী হয়। প্রয়োজনে এক্ষেত্রে প্রণোদনা দেওয়া উচিত বলে মনে করি। আমরা উচ্চশিক্ষার হার বাড়িয়েছি। অথচ ভারত বা শ্রীলঙ্কা থেকে আমাদের কর্মী নিয়োগ দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ সফট স্কিল্ড লোকের সংখ্যা কম। তাই শিল্পপ্রতিষ্ঠান দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে ভুগছে। আমাদের শিক্ষার্থীকে সফট স্কিল বৃদ্ধি করার জন্য শিক্ষক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে দেশে মোট বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। তবে এ সংখ্যা প্রশ্নবিদ্ধ। বাস্তবে বেকারের সংখ্যা অনেক। তাই বেকারের সংখ্যা হ্রাস করতে শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার জরুরি।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এ খাতে আমাদের যত ঘাটতি আছে, তা পূরণে সংস্কার জরুরি। স্বাধীনতার পর বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে অন্তত ৯টি শক্তিশালী শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে গঠিত হয় কুদরত-ই-খুদা কমিশন ও সর্বশেষ ২০০৯ সালে কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশন। সকল কমিশনই তাদের প্রতিবেদন যথাসময়ে সরকারের নিকট দাখিল করেছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার কবীর চৌধুরী রিপোর্টকে পাশ কাটিয়ে (যদিও বা আওয়ামী লীগ সরকারই এ কমিশন গঠন করেছিল) সম্ভবত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও সর্বশেষ ২০২১ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও চালু করে, যা নিয়ে গোটা দেশের মধ্যে চরম বিতর্ক ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। অবশেষে অন্তর্বর্তী সরকার এ শিক্ষানীতি স্থগিত ঘোষণা করে ইতঃপূর্বেকার ২০১২ সালের সৃজনশীল শিক্ষাক্রম চালু রেখেছে।
প্রসঙ্গত, সরকার প্রথমে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়। পরে স্বাস্থ্য গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করে। কিন্তু শিক্ষা খাতে সংস্কারে কোনো কমিশন গঠন করেনি।