বছরে ৪ শতাংশ শিশু যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:২৬
॥ হামিম উল কবির ॥
অবহেলিত শিশুদের যক্ষ্মা নীরবে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করছে। সমস্যা জানাতে পারে না বলে সঠিক সময়ে চিকিৎসাও হয় না। যক্ষ্মা একটি অতি উচ্চ সংক্রামক রোগ। একজন যক্ষ্মা রোগী তার আশপাশের অসংখ্য মানুষকে সংক্রমিত করে থাকে। তবে সমাজের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে রোগটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকে বলে যক্ষ্মার সুপ্ত জীবাণু নিয়ে ঘুরে বেড়ালেও লক্ষণ প্রকাশিত হয় না। শিশুদের শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে বলে শিশুরা সহজেই আক্রান্ত হয়। বিশ্বব্যাপী মোট যক্ষ্মা রোগীর ১২ শতাংশ শিশু, বাংলাদেশে চার শতাংশের কাছাকাছি। চিকিৎসকরা বলছেন, এ হার আরো বেশি হতে পারে। বয়স্ক কিংবা শিশু সবক্ষেত্রে যক্ষ্মার ওষুধ সঠিকভাবে সেবন করলে এ রোগ থেকে ৯৬ শতাংশ ক্ষেত্রে সুস্থ হওয়া যায়। শিশুসহ সব ধরনের যক্ষ্মা রোগীদের মধ্যে বাংলাদেশে বছরে ৪২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে। সেই হিসাবে দেশে প্রতি ১২ মিনিটে একজন যক্ষ্মা রোগী মারা যায়। ২০২০ সালে দেশে ১৫ বছরের নিচে প্রায় ৩৩ হাজার শিশু যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়েছিল এবং এদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শিশু এ প্রতিরোধ ও নিরাময়যোগ্য রোগে প্রাণ হারিয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে শিশু স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তারপরও শিশুদের অসুস্থতা এবং মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ হিসেবে রয়ে গেছে যক্ষ্মা। সরকার ২০৩৫ সালের মধ্যে দেশ থেকে যক্ষ্মা নির্মূল করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে যক্ষ্মা নির্মূল করতে হলে চিকিৎসায় এখন থেকে আরো কয়েকগুণ প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
শিশু যক্ষ্মার উপসর্গ
যক্ষ্মা হলে বড়দের থেকে শিশুদের উপসর্গ কিছু পার্থক্য থাকে এবং শিশুরা প্রকাশ করতে পারে না বলে সেগুলো নির্ণয় করা অনেকটা কঠিন। নিয়মিত খাওয়া-দাওয়ার পরও শিশুর ওজন কমে গেলে অথবা শিশুর যেভাবে ধারাবাহিক ওজন বাড়ার কথা সেরকম বাড়ছে না, খাওয়ার রুচি চলে গেলে শিশুর যক্ষ্মার উপসর্গ থাকতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, অন্য কোনো লক্ষণ নেই, কিন্তু শিশু দুর্বল হয়ে পড়ছে, খেলছে না, সারা দিন ঝিম ধরে বসেও থাকতে পারে, সারাক্ষণ শুয়ে থাকতে চায়, মেজাজ খিটখিট থাকে। কোনো শিশুর দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে একনাগাড়ে হালকা জ্বর থাকলে, খুসখুসে কাশি থাকলে, কফ, ঠাণ্ডা, সর্দি এগুলো সাথে থাকলেও শিশুর যক্ষ্মা হতে পারে। যক্ষ্মা হলে জ্বর সাধারণত ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মতো ওঠে, এর বেশি ওঠে না। এ জ্বর সাধারণত সন্ধ্যার দিকে বা রাতে বেশি হয়ে থাকে। এমন হলে শিশুকে নিয়ে প্রাথমিকভাবে শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে, না পাওয়া গেলে মেডিসিনের অথবা বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে। যক্ষ্মা ধরা পড়লে চিকিৎসাটি বক্ষব্যাধির চিকিৎসকই ভালো করবেন। যে যক্ষ্মা ফুসফুসের ক্ষতি করে, সেটি পালমোনারি টিউবারকিউলোসিস। টিবি মেনিনজাইটিস-কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। হাড় আক্রান্ত করে এমন যক্ষ্মাকে বলা হয় স্কেলেটন টিবি বা পটস ডিজিজ। এটি শরীরের গিট ও হাঁটু আক্রান্ত করে। এছাড়া এক প্রকার যক্ষ্মা রয়েছে লিম্ফনোড টিবি, যা লসিকা গ্রন্থিকে প্রভাবিত করে। খুব বেশি খারাপ পর্যায়ে গেলে যক্ষ্মা মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে শিশু মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে পারে। চোখ ও কানসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যক্ষ্মা শরীরের সকল অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে।
শিশুদের যক্ষ্মা দেরিতে শনাক্ত হওয়ার কারণ
আইসিডিডিআর’বির ইমার্জিং ইনফেকশানস প্রোগ্রামের প্রধান ডা. সায়েরা বানু বলছেন, ফুসফুস ছাড়া দেহের অন্যান্য অঙ্গে যে যক্ষ্মা রয়েছে, সেগুলো শিশুদের বেশি হয়। ফুসফুসের বাইরের যক্ষ্মায় কাশি হয় না। সে কারণে শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্ত হতে দেরি হয়। বড়দের ক্ষেত্রে সাধারণত ফুসফুসের যক্ষ্মা বেশি হয়ে থাকে। লিম্ফনোড টিবি হলে ঘাড়ে, গলায়, বগলের নিচে ছোট ছোট গোটা হয়ে থাকে। হাড়ের টিবি হলে পিঠে গুটির মতো হয়। এ গুটিতে তেমন ব্যথা থাকে না। যে কারণে যক্ষ্মা হয়েছে মনে হয় না। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে গেলে ধরা পড়ে। ফুসফুসের টিবি ছাড়া অন্য যেসব যক্ষ্মা রয়েছে, সেগুলো শনাক্ত করার পদ্ধতি বাংলাদেশের সব জায়গায় নেই। ডা. সায়রা বানু বলেন, বেশিরভাগ মানুষ ধরেই নেয় যক্ষ্মা মানেই ফুসফুস, অনেক দিন ধরে কাশি, কাশির সাথে রক্ত। তাহলে মনে করা হয় যক্ষ্মা হয়েছে।
যক্ষ্মায় যে অঙ্গ আক্রান্ত হয়
মাইকোব্যাক্টেরিয়াম নামে একটি ব্যাকটেরিয়ার কারণে যক্ষ্মা হয়ে থাকে। সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে, তার হাঁচি, কাশি বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। কথা থেকেও বাতাসে যক্ষ্মার জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে। একজন মানুষের কফ ছায়াহীন জায়গায় ফেললে বহুদিন জীবাণু বেঁচে থাকে। অপরিচ্ছন্ন, বদ্ধ, আলো বাতাসহীন ঘরে এটি বেশি ছড়ায়। এক ঘরে বেশি মানুষ থাকলে এটি দ্রুত ছড়ায়।
কীভাবে যক্ষ্মা নির্ণয় করা হয়
একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পরিবারে কারো যক্ষ্মা আছে কি না, সে ইতিহাস প্রথমেই জেনে নেন। এরপর শিশুর যক্ষ্মা নির্ণয়ে পাকস্থলির রস বের করে পরীক্ষা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে নমুনা নেয়ার জন্য শিশুকে বমিও করানো হয়। কারণ শিশুরা কফ গিলে ফেলে বলে যক্ষ্মার জীবাণু পেটে পাওয়া যায়। এক্স-রে, বাচ্চাদের ত্বকে একটি পরীক্ষা করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, শিশুদের শরীর থেকে নমুনা নিলেও জীবাণুর উপস্থিতি বড়দের চেয়ে কম থাকে। শিশুরা বড়দের থেকে খুব দ্রুত আক্রান্ত হয়, কিন্তু নিজেরা যক্ষ্মা ছড়ায় খুব কম, কারণ তারা কফ ফেলে না। শিশুর শরীরে যক্ষ্মার জীবাণুর উপস্থিতি কম থাকে, এদের যক্ষ্মা ফুসফুসের বাইরে হয় বলে জীবাণু ছড়ায় না।
শিশুর চিকিৎসা অনেক সময় লক্ষণ দেখে করা হয়
শিশুর যক্ষ্মা শনাক্ত করা সবসময় হয় না। সে কারণে নমুনা পরীক্ষা করতে না পারলে যক্ষ্মার লক্ষণ মিলে গেলে এবং সন্দেহ হলে চিকিৎসকরা ওষুধ শুরু করে দেন। শিশু যক্ষ্মার চিকিৎসা সাধারণত ছয় সপ্তাহের। মোট চারটি ওষুধ দেয়া হয়। শিশুদের ওষুধগুলো লিকুইড এবং ওভাবেই বানানো হয়Ñ যাতে খেতে ভালো লাগে। ঠিকমতো ওষুধ না খেলে যক্ষ্মার ওষুধ জীবাণু প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে। সেক্ষেত্রে যক্ষ্মার জীবাণু রোগ প্রতিরোধী (ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট) হয়ে উঠতে পারে। এমন অবস্থায় আরো অনেক কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদি হয়ে পড়ে। চিকিৎসার পাশাপাশি ঘরে বাতাস প্রবেশ করার ব্যবস্থা করা, ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ খাবার, সুষম খাবার খাওয়ানো, পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতে হবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। জন্মের সময় বাংলাদেশে বিসিজি নামে একটি টিকা দেয়া হয়। সেটি যক্ষ্মা পুরো ঠেকাতে না পারলেও প্রকট উপসর্গগুলো প্রতিরোধ করে। পরিবারে, আশপাশে কোথাও অথবা স্কুলে কারো যক্ষ্মা হয়েছে শুনলে শিশুকে সেখান থেকে দূরে রাখতে হবে। ডা. সায়রা বানু বলেন, কোনো পরিবারের পাশের বাড়িতে যক্ষ্মা আক্রান্ত কোনো শিশু থাকলে ওই শিশুটির যক্ষ্মা নাও হতে পারে, তবুও যক্ষ্মা হওয়া ঠেকাতে শিশুটিকে তিন অথবা ছয় মাসের ‘টিবি প্রিভেনটিভ থেরাপি’ নামক ওষুধ দেয়া হয়।
বাংলাদেশের যক্ষ্মা পরিস্থিতি
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুসারে, যক্ষ্মা বাংলাদেশের একটি ঘাতক ব্যাধি এবং অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা। যক্ষ্মা প্রবণ বিশ্বের ২২ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ নম্বরে। বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ মানুষের যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২.১৬ শতাংশ। জাতীয় যক্ষ্মা জরিপ ২০১৫-১৬ থেকে জানা যায়, বছরে মোট যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা প্রতি লাখে ২৬০ জন আর নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি লাখে ২২১ জন। যদিও তা গত বছরগুলোর অনুমাননির্ভর পরিসংখ্যানের চাইতে কম কিন্তু এখনো যক্ষ্মায় মৃত্যুহার প্রতি লাখে ৪৫ জন। ‘জাতীয় যক্ষ্মা জরিপ ২০১৫-১৬’ থেকে জানা যায়, গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে যক্ষা রোগের প্রকোপ বেশি; বিশেষ করে যেসব স্থানে জনসংখ্যার ঘনত্ব অধিক, ঠাসাঠাসি করে বসবাস করতে হয় এবং আবাসস্থলে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে না, সেসব স্থানে। বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে রোগী শনাক্ত এবং চিকিৎসা সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করলেও গ্রামের চেয়ে শহরাঞ্চলে চিকিৎসার হার অনেক কম।
ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা সমস্যা
যক্ষ্মার চিকিৎসার সাথে চিকিৎসা অবহেলা আরেকটি বিষফোড়া বাংলাদেশে দৃশ্যমান, তা হলোÑওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগী সঠিকভাবে শনাক্ত হয় না বলে বাংলাদেশে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রধান অন্তরায়। ২০১৭ সালের হিসাব মতে দেশে শনাক্তকৃত মোট যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা ২ লাখ ২৩ হাজার ৯২২ জন। এর মধ্যে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার ৭০০ জন বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি বলে ধারণা করছেন চিকিৎসকরা। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা শনাক্তকরণ শেষে তাদের চিকিৎসার আওতায় আনা গেছে প্রায় এক হাজার রোগীকে। বাকি প্রায় ৯ হাজার রোগী নিজেদের অজান্তেই ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং তাদের থেকে যে যক্ষ্মা রোগী হচ্ছে, তারাও ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে যাচ্ছে। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা হলে সাধারণ ওষুধে সুস্থ হয় না। সাধারণ যক্ষ্মা রোগীকে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা দেয়া যায়। কিন্তু ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগীকে কিছুদিন হাসপাতালে রাখতে হয়। তাদের ওষুধের দামও অনেক বেশি। অজ্ঞতা ও দেশের সব জায়গায় হাতের নাগালে রোগ পরীক্ষার আধুনিক ব্যবস্থা না থাকায় অনেক রোগী জানেই না, তারা যক্ষ্মায় আক্রান্ত।