বিকল্প নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা অর্পণে সম্মত হাসিনা : ক্ষমা চেয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আসার চিন্তা

হাসিনার রাজনীতির দ্বার রুদ্ধ হচ্ছে


২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:১৭

॥ ফারাহ মাসুম ॥
শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার রাজনীতিতে ফেরার সব রাস্তা রুদ্ধ হতে চলেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে তার সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার জোরালো প্রমাণসহ জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর স্বাভাবিক অবস্থায় রাজনীতিতে ফেরার কোনো পথ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের জন্য থাকছে না। এর মধ্যে পরিবারের বাইরে তুলনামূলক কম বিতর্কিত আওয়ামী লীগের একজন নেতার হাতে দলের নেতৃত্ব সমর্পণের ব্যাপারে তিনি সম্মতির বিষয় জানিয়েছেন। দলের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় ছাত্র গণহত্যা ও রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার কর্মকাণ্ডের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়েও নতুন নেতৃত্বের প্রতি সবুজ সংকেত দিয়েছেন। এ প্রক্রিয়ায় পরবর্তী নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে সীমিতভাবে হলেও আওয়ামী লীগের জন্য অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের ও রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সাথে একটি বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ও কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের প্রতিনিধির অন্তরালে আলোচনা চালানোর খবর পাওয়া যাচ্ছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতৃত্ব আওয়ামী লীগকে জার্মানি ও ইতালির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়ের ফ্যাসিবাদের সাথে তুলনা করে তাদের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছে। বৈষম্যবিরোধীদের একটি অংশ অবশ্য শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে দেশের মানুষকে তিন মেয়াদে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, একই প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগকে অন্তত তিন মেয়াদে নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে। এ বিষয়টি বিচারিক প্রক্রিয়ায় কার্যকর হতে পারে বলেও তাদের কেউ কেউ মনে করেন।
তবে বাংলাদেশের পশ্চিমা কূটনৈতিক অংশীদারদের মধ্যে বড় একটি অংশ মনে করেন, নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দলকে রাখা সঠিক হবে না। তবে বিগত সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ধ্বংসের সাথে সরাসরি জড়িতদের দলের নেতৃত্ব থেকে দূরে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকার ও এর প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে যা খুশি তা বলা ও সহিংসতায় উসকানি দেয়ার বর্তমান রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে তাকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলে একটি সূত্র উল্লেখ করেছে।
সেই সূত্র অনুসারে, রাজনীতির সাথে সম্পর্ক ত্যাগের ঘোষণা দিয়ে তিনি জীবনের বাকি সময় তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রে কাটানোর বিষয় নিয়ে ঘনিষ্ঠদের সাথে পরামর্শ করছেন। এর মধ্যে তিনি দেশে জেলের বাইরে থাকা তুলনামূলক স্বচ্ছ ইমেজের একজন নেতাকে রিকনসিলিয়েশন প্রক্রিয়ার জন্য কূটনীতিকদের সাথে কথা বলতে সবুজ সংকেত দিয়েছেন। এ বিষয়ে আরো অগ্রগতি হলে এ নেতা তার আনুষ্ঠানিক তৎপরতা একই ধরনের আরো কিছু নেতাকে সাথে নিয়ে শুরু করতে পারেন। তবে এ প্রক্রিয়ার দুই শর্তের একটি হলো গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারিক প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। দ্বিতীয়ত, সহিংসতায় উসকানি দেয়ার পথ হাসিনা ও অন্যদের পরিত্যাগ করে আইনি মোকাবিলার স্বাভাবিক রাস্তায় আসতে হবে।
হাসিনা দেশে ফিরবেন?
শেখ হাসিনা নিরাপদে বাকি জীবন কাটানোর জন্য কূটনৈতিক বলয়ের মাধ্যমে দরকষাকষি এবং জেলের বাইরে থাকা নেতাদের সাথে কথা বললেও প্রকাশ্যে ভিন্ন ভূমিকায় রয়েছেন। এর একটি কারণ হলো আওয়ামী লীগকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আনতে ছাড় দেয়ার জন্য এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করা। দ্বিতীয়ত, দলের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করা। চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতের চ্যানেল-১৮-এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে হাসিনা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে দাবি করে আওয়ামী কর্মীদের উদ্দেশে বক্তব্যে তিনি দেশে ফিরবেন এবং তাদের ‘শহীদদের’ প্রতিশোধ নেবেন বলে উল্লেখ করেন।
৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার দ্বিতীয় ভার্চুয়াল বক্তব্যে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক সহিংসতায় ‘শহীদ’ বলে অভিহিত করে আওয়ামী লীগ ক্যাডার এবং কিছু পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শেখ হাসিনা গত সাত মাস ধরে ভারতে রাজনৈতিক নির্বাসিত জীবনযাপনকালে এসব তৎপরতা চালাচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের (ইউরোপ চাপ্টার) সভাপতি নজরুল ইসলামের পরিচালনায় একটি অধিবেশনে একটি অজ্ঞাত স্থান থেকে কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পাঁচজন বিধবা ও তাদের সন্তানদের সাথে জুম লিঙ্কের মাধ্যমে সংযুক্ত হন। সেটি প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে চলতে থাকে। ইউটিউব লাইভটি বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার লোক দেখেন।
হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে এ ধরনের সহিংসতা ও অবিচারের জন্য ‘দোষী’ হিসেবে অভিযুক্ত করে বলেন, “আল্লাহ আমাকে দ্বিতীয় জীবন (পালিয়ে যেতে সক্ষম হওয়া) দিয়েছেন এবং আমি বিশ্বাস করি, এটি একটি কারণে ঘটেছে। এর আগেও তারা আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল এবং সেদিন (৫ আগস্ট) তারা আমাকে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি বেঁচে গেলাম, আবার ফিরে আসার জন্য। আমি ন্যায়বিচার করব।”
তার এ বক্তব্যের পর বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকারী যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপরাষ্ট্রদূত ড্যানিলোভিজ এক্স বার্তায় বলেছেন, এখন যেহেতু ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক প্রকাশ্যে বাংলাদেশে ফিরে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, ‘‘ভারতের তাকে আশ্রয় দেওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি পরামর্শ দিচ্ছি বাংলাদেশ একটি ভিভিআইপি বিমান পাঠিয়ে নয়াদিল্লি থেকে যেন তাকে তুলে নিয়ে আসে। যেন তিনি দেশে এসে তার ভক্তদের সাথে দেখা করতে পারেন। সারা দেশ ‘আপার’ প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায়।’’ ড্যানিলোভিজের এ বক্তব্যকে ব্যঙ্গ হিসেবেই মনে করেছেন অনেক পর্যবেক্ষক।
এর আগে হাসিনা দেশে এসে গোপালগঞ্জে থাকতে চান বলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়। কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, হাসিনা কোনোভাবেই আর দেশে আসতে চান না। তার দেশে ফেরার কথা ৫ আগস্ট পালানোর দিন দুই আগে ‘হাসিনা পালায় না’ ধরনের বক্তব্য। তিনি যা বলেন, অনেক সময় তার উল্টোটা করেন। এখানে তার বক্তব্য ধরে নিতে হবে ‘আমি আর দেশে আসছি না।’
জবাবদিহিতায় সমর্থন করবে জাতিসংঘ
শেখ হাসিনার জন্য সবচেয়ে ভয়ানক হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক মানবাধিকার প্রতিবেদন। জাতিসংঘের এ নতুন প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের সাবেক সরকারের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা পরিষেবা প্রায় ১,৪০০ জনকে হত্যা করেছে, যার মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ শিশু ছিল। আর এর বাইরে ১১ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে নির্বিচারে গ্রেফতার বা আটক করা হয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক বলেছেন, ‘জনগণের বিরোধিতার মুখে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নৃশংস প্রতিক্রিয়া ছিল একটি পরিকল্পিত ও সুসমন্বিত কৌশল। বিক্ষোভ দমন করার কৌশলের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জ্ঞান, সমন্বয় ও নির্দেশনায় শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ব্যাপক নির্বিচারে গ্রেফতার ও আটক এবং নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে।’
তুর্ক জানান, বিক্ষোভ চলাকালীন মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অপব্যবহারের নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের অনুরোধের পর নিযুক্ত বিশেষজ্ঞদের একটি দল এ ফলাফলগুলো তৈরি করেছে। মানবাধিকার তদন্তকারীদের একটি দল, একজন ফরেনসিক চিকিৎসক এবং একজন অস্ত্র বিশেষজ্ঞকে সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল।
তিনি জানান, বিক্ষোভ বিভিন্ন আর্থসামাজিক, পেশাগত এবং ধর্মীয় পটভূমি থেকে নারী ও শিশুসহ হাজার হাজার বাংলাদেশিকে জাগিয়ে তুলেছিল, যারা অর্থপূর্ণ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের আহ্বান জানিয়ে বিক্ষোভে যোগ দেয়। সাবেক সরকার ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকায় এটি তার নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা যন্ত্রগুলো ব্যবহার করে। সেইসাথে আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হিংসাত্মক উপাদান এবং অন্যান্য সশস্ত্র অভিনেতাদের চক্র। ক্ষমতায় থাকার জন্য ধীরে ধীরে আরও সহিংস এবং সামরিক উপায়ে প্রতিবাদকে পদ্ধতিগতভাবে দমন করার চেষ্টা করে।
জাতিসংঘের সত্য অনুসন্ধানকারী দলটি ভুক্তভোগী, সাক্ষী, ছাত্র এবং অন্যান্য প্রতিবাদী নেতা, সুশীল সমাজের অভিনেতা, চিকিৎসা পেশাজীবী এবং অন্যান্য বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে ২৩০টি গোপনীয় গভীর সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে তার সিদ্ধান্তে পৌঁছে। ঊর্ধ্বতন সরকার, নিরাপত্তা সেক্টর এবং রাজনৈতিক কর্মকর্তাদের সাথে আরও ৩৬টি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারের ফরেনসিক চিকিৎসক ২৯ ভুক্তভোগীকে পরীক্ষা করেছেন এবং ১৫৩টি মেডিকেল কেস ফাইল পর্যালোচনা করেছেন, যখন অস্ত্র বিশেষজ্ঞ হাজার হাজার অডিওভিজুয়াল সামগ্রী বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র, কম মারাত্মক অস্ত্র এবং গোলাবারুদ ব্যবহারের তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকারের তদন্ত সহায়তা বিভাগের প্রধান অ্যালেক্স এল-জুন্ডি বলেছেন, ‘আমরা ডিজিটাল ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে উপলব্ধি সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করেছি প্রাপ্ত তথ্য যাচাই করতে এবং যে কোনো অনুসন্ধান আমাদের পদ্ধতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা, তা নিশ্চিত করার জন্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি’ প্রমাণের মান, প্রতিবেদনে জোর দেওয়া হয়েছে, ফৌজদারি কার্যধারায় পৃথক অপরাধ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় মানদণ্ডের চেয়ে কম, তবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দ্বারা আরও ফৌজদারি তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে। এটি প্রথমবার নয় যে, হাইকমিশনার নিজের ম্যান্ডেটে তদন্ত শুরু করেছেন। তবে এটিই প্রথম যে, আমরা তথ্য বিশ্লেষণের জন্য সব অতিরিক্ত দক্ষতা এবং উচ্চ-গ্রেড ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার করে কাজ করেছি।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবাদী নেতৃবৃন্দসহ মহিলারা বিক্ষোভের অগ্রভাগে থাকায় নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা নির্বিচারে গ্রেফতার, নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার এবং হামলার শিকার হন। এ সহিংসতা প্রায়ই লিঙ্গভিত্তিক ছিল, যার মধ্যে শারীরিক আক্রমণ এবং ধর্ষণের হুমকি ছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল নারীদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখা। অধিকন্তু প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে এবং অননুমোদিতভাবে বিক্ষোভকারীদের হত্যা বা পঙ্গু করে তদন্তে এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর সাথে নির্বিচারে ছররা গুলি করার ঘটনাও ঘটে।
এল-জুন্ডি বলেন, প্রতিবেদনে অন্য ঘটনার সাথে সাথে ২৩ বছর বয়সী ছাত্র আবু সাঈদের ঘটনা বিশদভাবে পরীক্ষা করা হয় নৃশংসতার প্রকৃতি বুঝতে। সাঈদ ১৬ জুলাই ২০২৪ তারিখে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিক্ষোভের সময় কোনো কারণ ছাড়াই গুলিতে নিহত হন। ঘটনাটি যাচাইয়ের প্রক্রিয়ার শুরুতে সেদিন যারা উপস্থিত ছিলেন, যারা এর শিকার হন এবং যারা প্রত্যক্ষদর্শী তাদের সাক্ষাৎকার নেয় দলটি। সেইসাথে প্রাপ্ত ডিজিটাল তথ্যগুলো দেখে, যার মধ্যে আবু সাঈদের বিভিন্ন কোণ থেকে ছবি অন্তর্ভুক্ত ছিল, তিনি নিরস্ত্র ছিলেন এবং যখন তাকে হত্যা করা হয়েছে, তখন তার কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না।
তিনি আরও বলেন, ‘সেদিন প্রাপ্ত তথ্যগুলো অস্ত্র বিশেষজ্ঞের দ্বারা সাঈদের আঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছিল, সেইসাথে ব্যবহৃত অস্ত্রের ছবিগুলোও। তাতে এ উপসংহারে আসা হয় যে, তাকে পুলিশ বাহিনী বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে।’
প্রতিবেদনে আরও পাওয়া গেছে যে, পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী নির্বিচারে রাইফেল ও প্রাণঘাতী গোলাবারুদ বোঝাই বন্দুকের নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শিশু বিক্ষোভকারীদের হত্যা ও পঙ্গু করেছে। সেইসাথে শিশুদের নির্বিচারে গ্রেফতার এবং অমানবিক পরিস্থিতি ও নির্যাতনের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে। নিরাপত্তাকর্মীরা জীবনরক্ষায় চিকিৎসা সেবায় বাধা, প্রায়ই হাসপাতালে রোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ, আহত ব্যক্তিদের গ্রেফতার এবং চিকিৎসা কর্মীদের ভয় দেখিয়েছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘প্রসিকিউটরিয়াল কর্তৃপক্ষ বা বিচার বিভাগ কোনো অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়নিÑ যাতে নির্বিচারে আটক ও নির্যাতনের ক্রিয়াকলাপ এবং অনুশীলনগুলো বন্ধ করা যায় অথবা এ ধরনের কাজ করে এমন কোনো কর্মকর্তাকে জবাবদিহি করা হয়।’
ভবিষ্যতের দায়বদ্ধতার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে জাতিসংঘ
বিগত সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং নিয়মিত আদালতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অবমাননার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা শুরু করে। এ প্রচেষ্টাগুলো আইন প্রয়োগকারী এবং বিচার খাতের পূর্বে বিদ্যমান কাঠামোগত ঘাটতির কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।
এল-জুন্ডির জন্য ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং টিমের মূল উদ্দেশ্য ছিল দৃষ্টান্তমূলক কেসগুলো দেখে তথ্য প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত [প্রতিবেদনে উল্লেখিত] প্রত্যেক ভুক্তভোগীর পরিচয় জানতে পারেনি, তবে সেখানে প্রচেষ্টা ছিল এ ঘটনাগুলোর সময় সব লোকের দ্বারা ভুক্তভোগীদের ওপর চালানো ভুলগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়ার। লোকদের এগিয়ে আসা, আমাদের সাথে কথা বলা এবং তাদের তথ্য ভাগ করে নেওয়া এবং একটি প্রতিবেদনে এ তথ্যটি আপনার কাছে প্রকাশ করার জন্য ইচ্ছুক হওয়া ছাড়া এটি করা যেত না।’
এল-জুন্ডি আরও উল্লেখ করেছেন, দলটি সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করেছে এবং বিশ্লেষণ করেছে, তা ভবিষ্যতের জবাবদিহি প্রক্রিয়াগুলোকে সমর্থন করার লক্ষ্যে করা হয়েছে। আর এটি করার জন্য সংগৃহীত এবং সংরক্ষিত সব তথ্য আন্তর্জাতিক মানের যাচাই করা হয়েছে। আমরা প্রাপ্ত ডিজিটাল তথ্য সংরক্ষণের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছি।
প্রতিবেদনে নিরাপত্তা ও বিচার বিভাগের সংস্কার, নাগরিক ও রাজনৈতিক ভিন্নমতকে দমিয়ে রাখার জন্য ডিজাইন করা অনেক দমনমূলক আইন ও প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তি এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক শাসন ব্যবস্থায় বৃহত্তর পরিবর্তন বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশের একটি বিশদ বিবরণ প্রদান করা হয়েছে।
তুর্ক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা যে সাক্ষ্য এবং প্রমাণ সংগ্রহ করেছি, তা ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সহিংসতা এবং টার্গেট কিলিংয়ের একটি নির্মম চিত্র তুলে ধরে, যা মানবাধিকারের সবচেয়ে গুরুতর লঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে এবং যা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করা। জাতীয় সংকট উত্তরণে এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অপরিহার্য।’
তিনি বলেন, ‘আমার অফিস (জাতিসংঘ) এ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় জবাবদিহি এবং সংস্কার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করার জন্য প্রস্তুত।’
হাসিনার জন্য বড় আঘাত
জাতিসংঘের এ প্রতিবেদন শেখ হাসিনার জন্য অনেক বড় আঘাত। এটি তাকে আশ্রয়দানকারী ভারেতের জন্যও বিব্রতকর। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর তাদের জন্য এ চাপ আরো বাড়তে থাকবে। ঢাকার কূটনৈতিক মিশনের সাথে জড়িত একজন বলেছেন, বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ছেড়ে জাতির কাছে ক্ষমা চাইলে দলের জন্য তা হবে কল্যাণকর। তবে যে অপরাধ তিনি করেছেন, সেটির জন্য জবাবদিহি তিনি এড়াতে পারবেন না কোনোভাবেই।