অপারেশন ডেভিল হান্ট, শয়তান শিকার


১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৬:০৯

॥ একেএম রফিকুন্নবী ॥
আগস্ট বিপ্লবের পর দেশের মানুষ নতুন স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। নিরাপদে, নিঃসংকোচে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করছে। হঠাৎ করে পুলিশের ধরা খাওয়া, গুম, খুন, জেলের ভয়ে রাস্তায় চলতে হচ্ছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গুণ্ডামির আশঙ্কা নেই বললেই চলে।
অন্তর্বর্তী সরকার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৬ মাসের বেশি শাসনভার চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দুর্নীতি না থাকলেও উপদেষ্টারা খাওয়া পার্টি নয় বলে অভিজ্ঞতার অভাব থাকলেও চুরি-চামারি, চাঁদাবাজি, লুটতরাজে বা টাকা পাচারের কোনো অভিযোগ ছাড়াই যার যার মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন। মানুষের আশার চেয়ে পাওয়া কম হলেও জনমনে আশার সঞ্চার হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে শুধু নির্বাচনের তাগিদ নিয়েই। ভোটার লিস্টের কাজ চলছে। জনগণকে আহ্বান জানাব- তারা যেন সবাই ভোটার হন। বিশেষ করে যুবক-তরুণরা যাদের পূর্বে ভোট দেয়ার অভিজ্ঞতা নেই, তারা যাতে ভোটার হতে পারে। আমরা যারা সচেতন নাগরিক, তারা নিজের বাড়ি, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব সবাই যাতে ভোটার হতে পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। কারণ সঠিক-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সঠিক ভোটার লিস্ট অত্যন্ত জরুরি।
সংস্কার কমিটিগুলো তাদের সুচিন্তিত মতামতসংবলিত রিপোর্ট ইতোমধ্যেই প্রধান উপদেষ্টার কাছে পৌঁছে দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার দফতর থেকে রিপোর্টগুলো অনলাইনে দিয়ে দিয়েছেন। মানুষ যাতে বুঝতে পারে দেশের কী কী পরিবর্তন আসছে। উপদেষ্টারা ঘোষণা দিয়েছেন, ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেয়া শুরু করবেন। ভালো উদ্যোগ। আমরা আশা করি, দেশের মানুষের ৫৩ বছরের না পাওয়ার গ্লানি থেকে বের হওয়ার একটি পথ এখান থেকে বের হয়ে আসবে। সবার মত এক না হলেও চলার মতো মতে মিল হলেও উপদেষ্টারা তাদের কাজের দিকনির্দেশনা পাবেন এবং সামনে চলার পথ বের হবে।
ইতোমধ্যেই হঠাৎ হাসিনার পালানোর ৬ মাস পূর্তিতে গর্ত থেকে সাপের ডাক দিয়ে দেশে আবার অরাজকতার বিষ ছড়ানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। পালানো অবস্থায় প্রতিবেশী দেশ থেকে হাসিনা ও তার দোসররা আওয়াজ দিতে শুরু করেছে দেশটাকে আবার লাইনচ্যুত করার। দেশের মানুষ কিন্তু আর বোকার স্বর্গে বাস করে না। হাসিনার ১৬ বছরের দুঃশাসন মানুষ ভুলে যায়নি।
হাসিনার কথায় রাগান্বিত হয়ে গাজীপুরের মানুষ ফুঁসে উঠে মোজাম্মেলের বাড়ি তছনছের সময় হাসিনার লোকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। প্রায় ১৫ জন আহত হয়। সজাগ ছাত্র-জনতার ঘুম ভেঙে যায়। তারা আক্রমণকারীদের রুখে দেয়ার উদ্যোগ নেয়। ‘মার্চ টু গাজীপুর’ ছাত্র-জনতা ঘোষণা করে। মুহূর্তের মধ্যে তারা গাজীপুরে বিশাল সমাবেশ করে। আওয়ামীদের রুখে দেয়ার ঘোষণা দেয়। ছাত্র-জনতা আবার ৫ আগস্টের মতো জেগে ওঠে। শুরু হয়ে যায় ঢাকাসহ জেলায় জেলায় আওয়ামী ও তার দোসরদের তাড়ানোর উদ্যোগ। ভেঙে ফেলে আওয়ামী আস্তানা। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে মুজিবের আস্তানা। শত শত লোক এতে অংশগ্রহণ করে। দেশের সব জায়গায়ই হাসিনার দোসরদের বাড়িঘর তছনছ করা শুরু করে।
সরকার ঘোষণা করে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শয়তান নির্মূল অভিযান। গাজীপুর থেকে আওয়ামী দোসরদের প্রায় ১০০ জনকে গ্রেফতার করে। গোটা দেশেই ‘শয়তান নির্মূল’ অভিযানে যৌথবাহিনী তাদের অপারেশনের কাজ শুরু করে দিয়েছে সিরিয়াসলি। প্রায় এক হাজার লোককে গ্রেফতার করেছে। ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর ৬ মাসে মনে হচ্ছিল আওয়ামীরা ছাড়া পাওয়া শুরু করেছে। না! হাসিনার হুঙ্কারে তার দোসররা ডাক মারার সাথে সাথে ছাত্র-জনতা, যৌথবাহিনী আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গোটা দেশটাই এখন শয়তান নির্মূলের কাজ শক্তভাবে শুরু হয়ে গেছে। আবার হাসিনার দোসররা গর্ত থেকে বের হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া শুরু করেছে। আবার তাদের নিরাপদ স্থান পাশের দেশে চলে যাওয়া শুরু করেছে। সীমান্তে বেশকিছু মাস্তান ধরা পড়েছে। সাঁড়াশি অভিযানে কাউকেই ছাড়া যাবে না। সব দেশদ্রোহীকে সাজার আওতায় আনতে হবে।
ইতোমধ্যে ছোট-বড় আওয়ামী নেতা-পাতিনেতা ধরার কাজ শুরু হয়ে গেছে। ছাত্র-জনতা আর যৌথবাহিনী জোরেশোরেই ‘শয়তান নির্মূলের’ কাজ করছে। আমরা আর ১৮ কোটি মানুষের ক্ষতিকারক কোনো দল বা জনগোষ্ঠীর আস্তানা রাখতে চাই না। তাদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
সরকারকেও বলব, আর নরম হওয়া যাবে না। শক্ত হাতে দেশদ্রোহীদের নির্মূল করতে হবে। আমরা কোনো নির্দোষ ব্যক্তির ভোগান্তি চাই না। চোরের শাস্তি ভালোর রক্ষাকারী হিসেবে আমাদের কাজ করতে হবে।
ভারত ও তাদের অনুসারীরা মানবতার কথা বলে আমাদের কাজে বাধা দিতে পারে। বিশেষ করে ভারতের মিডিয়াগুলো বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি দেখতেই চায় না। শুধু চায় তাদের অনুগত হাসিনার পুনর্বাসন। তারা জানে না, বাংলাদেশের মানুষ ক্ষেপলে কোনো দাদাগিরির প্রশ্রয় এ দেশে হবে না।
ইতোমধ্যে থলের বিড়াল বেরিয়ে এসেছে। ভারতের ২৬ লাখ লোক বাংলাদেশে অবৈধভাবে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। অথচ আমাদের দেশের ছাত্র-জনতা প্রায় ১ কোটি লোক বেকার। কাজ পাচ্ছে না। আমরা এর অবসান চাই। আমাদের দেশের লোকেরা বিভিন্ন দেশে গিয়ে বড় বড় কাজ করছে। তাই আমাদের লোকদের দিয়েই বেকার সমস্যা দূর করে শিল্পকারখানা চালাতে চাই। আমেরিকা যেমন ভারতীয়দের হাতকড়া দিয়ে দেশে পাঠাতে শুরু করেছে। আমরা হাতকড়া পড়াতে চাই না। সম্মানের সাথেই অবৈধ লোকদের বিদায় করে আমাদের দেশের লোকদের কর্মসংস্থান করতে চাই।
দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে আহ্বান জানাতে চাই, আমরা দেশের স্বার্থে সব ভেদাভেদ ভুলে বিদেশিদের বিতাড়ন করে হাসিনা ও তার দোসরদের মূলোৎপাট করে দেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে দুনিয়ার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই। এখন মূল কাজ হলো ‘ডেভিল হান্ট’ শয়তান নির্মূলের কাজ যথাযথভাবে যাতে যৌথবাহিনী করতে পারে, তাতে আমাদের ছাত্র-জনতাকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। ভালো কাজের প্রসার ঘটাতে হবে। মন্দকে সমাজ, রাষ্ট্র থেকে বিতাড়ন করতে হবে। বিশৃঙ্খলা কখনোই ভালো ফল বয়ে আনে না। শয়তান তাড়াতে গিয়ে যেন ভালো লোক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এ দেশের ১৮ কোটি মানুষ আমাদের ভাই-বোন। তাদের কল্যাণই আমাদের কাম্য।
হাসিনার আমলের শহীদ ও আহতের পাশে দাঁড়াতে হবে। জামায়াতে ইসলামী কয়েকদিন আগে শহীদদের তালিকার লিস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবে প্রকাশ করে মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান করে জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। ৬ মাসের মধ্যে প্রায় সব শহীদের তালিকা ও আহতদের অবস্থান খোঁজ নিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। আমরা এ কাজে সহযোগিতা চাই। বাংলাদেশের ৫৩ বছরে আজও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পাওয়া যায়নি। মুখে মুখে গণনা চলছে। ভাতা দেয়া হচ্ছে। এর বিহিত হওয়া প্রয়োজন।
হাসিনার দোসরদের বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত ও স্বচ্ছতার আলোকে শেষ করার জাতীয় দাবি। আমরা ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’ দেখতে চাই। দুষ্ট লোক দেশের ক্ষতিকারক, খুন, গুমের সাথে জড়িত, টাকা লুটপাটকারীদের বিচারের আওতায় দ্রুত আনতে হবে। পাচার করা টাকা দেশে ফেরত আনার চেষ্টা বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক বন্ধুদের এ কাজে লাগাতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের ইমেজ কাজে লাগিয়ে দেশ-বিদেশে বন্ধুদের কাছে টানতে হবে। ভারতীয়রা তাদের মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের ‘শয়তান নির্মূলের’ কাজ যাতে ব্যাহত করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। আমাদের মিডিয়াগুলোকে কাজে লাগাতে হবে সত্য উদ্ঘাটনের জন্য। হাসিনার দোসরদের মিডিয়া যাতে দেশদ্রোহীদের সহযোগিতা করতে না পারে, তার শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের টার্গেট ১৮ কোটি মানুষের উন্নয়ন-অগ্রগতি এবং দেশে-বিদেশে আমাদের গৌরবগাথা তুলে ধরা। আমরা বীরের জাতি। আমরা কারও কাছে মাথানত করব না।
‘শয়তান নির্মূলের’ ব্রিফিং মাঝেমধ্যেই হতে হবে। শয়তানদের দোসররা বসে নেই। তাদের শত বাধায় যেন আমাদের কাজ বাধাগ্রস্ত না হয়। আর কোনো প্রশ্রয় নয়। দেশদ্রোহের শাস্তি তাদের পেতেই হবে।
বিচার বিভাগের মাধ্যমে আমাদের শত্রুদের বিচার দ্রুত সারতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গোছাতে হবে। খারাপ লোক বিদায় করে নতুন লোক নিয়োগ দিতে হবে। সৎ, চরিত্রবান লোক আমাদের দেশে অভাব নেই। তাদের বাছাই করে পুলিশ বিভাগকে ঢেলে সাজানোর কাজ দ্রুত করতে হবে।
আমরা শয়তান নির্মূলের কাজ দ্রুত এগোনোর পথে সব বাধা দূর করে এর সাফল্য কামনা করছি। সাথে সাথে ছাত্র-জনতাকে এ অভিযান পরিচালনায় সার্বিক সহযোগিতার আহ্বান জানাচ্ছি। এ অভিযানের সাফল্যে জাতি হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন মুক্ত হবে। আমরা গর্বিত জাতি হিসেবে পরিচয় দিতে সক্ষম হব। হাসিনার শাসন আর কোনেদিন আলোর মুখ দেখবে না, ইনশাআল্লাহ।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।