মায়ের কাছে মেয়ের খোলাচিঠি


৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৯:৪৫

॥ মাহমুদা সিদ্দিকা ॥
আমার এ চিঠি মনের আকুলি-বিকুলি তোমার কাছে পৌঁছাবে কিনা, আমি জানি না। তবু আমি আজ কিছু কথা লিখব। কী করব বল?
তোমার সাথে কথা বলার আর তো কোনো উপায় নাই। অনেক ভেবেচিন্তে আমি এ পথ বেছে নিলাম, নিজের মনটাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। একটু ভালো থাকার জন্য।
আমি জানি না, আমার মতো এমন অনুভূতি আর কারো হয় কি না।
মাগো, তুমি তো জান, তোমার এ মেয়েটা আর দশজনের মতো নয়। একটু আলাদা। একটু বেশিই আবেগপ্রবণ। যার পুরো জগৎটাই ছিল তোমাকে ঘিরে।
মাগো, তুমি কেমন আছো?
আশা করি, ভালো আছো। জান্নাতের ফুল বাগানে আছো।
আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
কিন্তু তুমি যেখানে নাই, সেখানে আমি ভালো থাকি কী করে?
মাগো, আব্বাকে হারিয়ে তোমাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচেছিলাম। কিন্তু এখন তোমাকে হারিয়ে কী নিয়ে বাঁচি বলো। তোমার মতো আর কাউকে পাই না আঁকড়ে ধরার জন্য। জানি পাবও না। মা তুমি তো চলে গেছো আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে। আমি যে একা হয়ে গেছি।
জান মা, আমার চারপাশে সবাই আছে, শুধু তুমি নাই। তোমার অভাবশূন্যতা আমাকে তীব্রভাবে গ্রাস করে।
মা, তোমার মনে আছেÑ আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় তোমার কাছে ছুটে যেতাম সকালে ফিরে আসতাম। তখন আমার কোনো অসুখ হয়নি মা। দিব্যি সুস্থ ছিলাম। ভালো ছিলাম। মনে ভীষণ আনন্দ ছিল।
জান মা, তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে আমি ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েছি। অনেকগুলো ওষুধ খেতে হয় নিয়ম মেনে। আমার ভালো লাগে না এত ওষুধ খেতে।
মাগো, তুমি থাকতে আমার মন ছিল ফুরফুরে স্বচ্ছ নীল আকাশের মতো। আর সেই আকাশে আজ কালো মেঘের ঘনঘটা। যেদিকে তাকাই সবই এলোমেলো মনে হয়। যখন-তখন কালবৈশাখী ঝড় এসে আমাকে আঘাত করে। আমি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাই। আবার একটু একটু করে জোড়াতালি দিয়ে উঠে দাঁড়াই।
জান মা, আমার চোখের সামনে সবসময় তোমার আর আব্বার ছবি ঝলমল করে। যখনই ঘুমাই, তখনই তুমি আর আব্বা চলে আস আমার কাছে। আমার খুব ভালোলাগে। কিন্তু ঘুম ভেঙে গেলেই তোমরা চলে যাও কোন অজানায়।
মা জান, তোমার একটা শাড়ি একটা ম্যাক্সি আমি নিয়ে এসেছি। খুব যতনে আলমারিতে রেখে দিয়েছি। যখনই ইচ্ছা করে নাকের কাছে ধরি। তখন তোমার শরীরের মিষ্টি গন্ধ আমাকে আকুল করে তোলে। কি এক অদ্ভুত ভালোলাগায় আমি আচ্ছন্ন হয়ে থাকি।
মাগো, তোমাকে হারিয়ে যখন বুক ভেঙে যাচ্ছিল, বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু বাঁচতে হবে তো তাই ভাবছিলাম কী করলে তোমাকে একটু ভুলে থাকতে পারব?
কীভাবে মনটাকে একটু ব্যস্ত রাখা যায়। তখনই মনে হলে ছোটবেলায় তো আমি গল্প কবিতা লিখতাম। সেসব তো ভুলেই গেছিলাম। আবার লেখা শুরু করলে কেমন হয়?
জান মা, তোমার স্মৃতি ভুলে থাকার জন্য তোমার কলিজার টুকরো তামান্না আমাকে ফেসবুক আইডি খুলে দেয়। তারপর সেখানে আমি একটু একটু করে লেখা শুরু করি। পত্রিকায় ছাপা হতে লাগলো আমার লেখা। তখন আমার মনের মেঘ কেটে গেল। আমি নতুন করে বাঁচতে শিখলাম। নিজেকে নিয়ে ভাবতে শিখলাম। ভালোই যাচ্ছিল আমার দিনকাল।
কিন্তু এখন আবার আমি একা হয়ে গেছি। লেখালেখি ভালোলাগে না। শুধু তোমাকেই মনে পড়ে। কী হবে লেখালেখি করে! আব্বা দেখল না, তুমি দেখলা না।
মাগো, এমন কেন হয়?
তোমার মতো করে কেউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় না। সেদিন বড় ভাইকে বললাম ভাইয়া আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও।
মা মাগো, আমি এমন কেন?
এখনো বাস্তবতা বুঝি না। আবেগ দিয়ে কথা বলি। আবেগ দিয়ে পথ চলি। এসব আমার জন্য একটুও মানানসই না জানি, কিন্তু কী করব?
নিজেকে শক্ত করার, মনোবল বৃদ্ধি করার অনেক চেষ্টা করেছি।
মা আমি ব্যর্থ হয়েছি বার বার। চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছি।
আমার মনটা আমার কথা শোনে না। শিশুর মতো কাঁদতে চায়, হাসতে চায়। ফুল আর পাখিদের নিয়ে সময় কাটাতে চায়।
মাগো, তুমি বলে দাও আমি কী করব?
কীভাবে আমি বাস্তব বুদ্ধি দিয়ে কথা বলতে পারব।
মা মাগো, বিশ্বাস করো সেই যে সকালে ফজরের পরে আর মাগরিবের পরে মোবাইল নিয়ে ফোন করে তোমার সাথে কথা বলতাম, এখনো মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকি আর ভাবি আম্মাকে একটা ফোন দিই!
মা, আমার এসব লেখা দেখলে অনেকেই আমাকে পাগল বলবে। বলুক। তাতে আমার কিচ্ছু যায়-আসে না।
মা, আমি আজ মন খুলে তোমার সাথে কথা বলব।
অনেক কথা। বুকের ভেতর জমানো সব কথা আজ তোমাকে বলে দেব।

ইতি তোমার মেয়ে
মাহমুদা সিদ্দিকা