রহমানের বান্দার পরিচয় : পর্ব-১

ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার ও নিরাপত্তা


৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:৪৮

॥ ড. মুহাম্মদ খলিলুর রহমান মাদানী ॥
ভূমিকা: ইসলাম মানুষের চিন্তা ও আকিদা-বিশ্বাস থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আন্তর্জাতিক সকল বিষয়ের পরিপূর্ণ একমাত্র সুষ্ঠু সমাধান ও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার ও নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাই রহমানের বান্দাগণ তাদের অধীনস্থ ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বদা সজাগ, সচেতন, সতর্ক ও দায়িত্ববান থাকবেÑ এটিই ইনসাফের দাবি। আমরা জানি, ইসলামী রাষ্ট্র ও দেশে দেশে প্রচলিত জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মাঝে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র একটা আদর্শবাদী রাষ্ট্র [ওফবড়ষড়মরপধষ ঝঃধঃব]। এর ধরন ও প্রকৃতি প্রচলিত জাতীয় গণতান্ত্রিক [ঘধঃরড়হধষ উবসড়পৎধঃরপ] রাষ্ট্র থেকে একেবারেই ভিন্ন। ইসলামী রাষ্ট্র ওহিভিত্তিক নৈতিকতার ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত।
ইসলামী রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য
১. যে আদর্শ ও মূলনীতির ওপর ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত, তাকে কে মানে আর কে মানে না, সে হিসেবেই ইসলামী রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বিভক্ত করে থাকে। ইসলামী পরিভাষায় উক্ত দুই ধরনের জনগোষ্ঠীকে যথাক্রমে মুসলিম ও অমুসলিম বলা হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হলে তা অমান্য করা, অস্বীকার করা এবং না মানার কোনো সুযোগ নেই! বরং দ্বিধাহীন চিত্তে সবাই আল্লাহ এবং রাসূল সা. প্রদর্শিত সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে হবে।” (সূরা নিসা : ৬৫)।
২. ইসলামী রাষ্ট্র চালানো তার আদর্শ ও মূলনীতিতে বিশ্বাসীদের কাজ। এ রাষ্ট্র স্বীয় প্রশাসনে অমুসলিমদের সেবা গ্রহণ করতে পারে বটে, তবে নীতিনির্ধারক ও প্রশাসনের পদ তাদের দিতে পারে না। রাসূলুল্লাহ সা. চার খলিফা এবং পরবর্তীতে এরই ধারাবাহিকতায় মুসলিম উম্মাহর আমীর-উমরাগণ মজলিসে শূরা, পরামর্শ সভা, আহলুল হিল্লি ওয়াল উকাদ ইত্যাদি বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী বডির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। যেখানে সদস্য হতেন ন্যায়পরায়ণ ঈমানদার যোগ্য ব্যক্তিগণই। (আল কাদা ফি হাদিস উমার রা. ২/১৯৭)।
৩. ইসলামী রাষ্ট্র মুসলিম ও অমুসলিমদের সুস্পষ্টভাবে দুই ভাগে বিভক্ত করতে বাধ্য। অমুসলিমদের কী কী অধিকার দিতে পারবে আর কী কী অধিকার দিতে পারবে না, তা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়া তার পক্ষে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। যেমন আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘দীনের মধ্যে, ইসলামের মধ্যে জোরজবরদস্তি বলে কিছু নেই।’ অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মুশরিক অমুসলিমদের কেউ যদি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, নিরাপত্তা চায় তাহলে তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা সহকারে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিন। যাতে তারা আল্লাহর কালাম আল্লাহর বিধান ইসলামের সৌন্দর্য শুনতে পারে, বুঝতে পারে।’ (সূরা তাওবা : ৬)।
৪. ইসলামী রাষ্ট্র তার প্রশাসনে অমুসলিমদের উপস্থিতি জটিলতার সমাধান এভাবে করে যে, তাদের সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকারের কার্যকর নিশ্চয়তা [এঁধৎধহঃবব] দিয়ে সন্তুষ্ট করে দেয়। নিজেদের নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থাপনায় তাদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করে এবং তাদের জন্য সবসময় এ ব্যাপারে দরজা খোলা রাখে যে, ইসলামী আদর্শ যদি তাদের ভালো লেগে যায়, তাহলে তারা তা গ্রহণ করে শাসক দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে।
৫. ইসলামী রাষ্ট্র অমুসলিম সংখ্যালঘু নাগরিকদের শরীয়ত প্রদত্ত অধিকারগুলো দিতে বাধ্য। এসব অধিকার কেড়ে নেয়া বা কমবেশি করার এখতিয়ার কারো নেই। এসব অধিকার ছাড়া অতিরিক্ত কিছু অধিকার যদি মুসলমানরা নিতে চায়, তবে ইসলামের মূলনীতির পরিপন্থী না হলে তা দিতে পারে। আমরা জানি, ইসলাম ইমাম, দায়িত্বশীল নেতা, রাষ্ট্রপ্রধানের ওপর অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিম্মাদারি অর্পণ করেছে। এজন্য রাষ্ট্রপ্রধান বা ইমাম সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে শরীয়ত নির্ধারিত বিধানাবলির ব্যাপারে কোনো কমবেশি করা যাবে না ঠিকই। এর পাশাপাশি সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য কিছু জিনিস ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধানের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে, যা আইনের পরিভাষায় বলা হয়, “মাউকুলুন ইলাল ইমাম।” এসব কিছু ইমামের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মদখোরের শাস্তি ৮০টি বেত্রাঘাত। রাষ্ট্রপ্রধান, বিচারক বা ইমাম যদি মনে করেন সামগ্রিক শৃঙ্খলার স্বার্থে আরও বেশি বেত্রাঘাত নির্ধারিত আসামির জন্য প্রয়োজন, তাহলে ইমামের পক্ষ থেকে সেটি সিদ্ধান্ত দেয়া শরয়ী আইনের বিপরীত নয়।
প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য
১. প্রচলিত সমাজে ইসলামবিবর্জিত গোষ্ঠীসমূহ সম্পূর্ণ অনৈতিক, ভারসাম্যহীন, বৈষম্যপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন করেছে, যা জনগণের শোষণের হাতিয়ার রূপে প্রভাব ফেলছে।
প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ মনে করে, যে জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, কারা সেই জাতির বংশোদ্ভূত আর কারা তা নয়, তার ভিত্তিতেই একটা জাতীয় রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বিভক্ত করে ফেলে। আধুনিক পরিভাষায় উক্ত দুই ধরনের জনগোষ্ঠীকে যথাক্রমে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু বলা হয়ে থাকে। মহান আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মাঝে যিনি বেশি মুত্তাকি-আল্লাহওয়ালা, তিনিই সবচেয়ে বেশি সম্মানিত।’ মর্যাদা, সম্মান, ইজ্জত, পদ-পদবি এসব কিছুই নির্ভর করবে তাকওয়া ন্যায়নীতি ইত্যাদি গুণাবলির ভিত্তিতে ইসলামী আইনে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু বলতে কোনো মৌলিক পরিভাষা নেই। অথচ প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ সংখ্যাগুরুসংখ্যালঘু বলে একটি বৈষম্যপূর্ণ নীতিমালা প্রচলন করেছে, যা সম্পূর্ণ নৈতিকতাবিবর্জিত।
২. প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে জাতীয় রাষ্ট্র স্বীয় নীতিনির্ধারণ ও প্রশাসনের কাজে শুধু আপন জাতির লোকদের ওপরই নির্ভর করে। অন্য সংখ্যালঘু নাগরিকদের এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য মনে করা হয় না। এ কথাটা স্পষ্ট করে বলা না হলেও কার্যত এটাই হয়ে থাকে। সংখ্যালঘুদের কোনো ব্যক্তিকে যদি কখনো কোনো শীর্ষস্থানীয় পদ দেয়াও হয়, তবে তা নিছক লোকদেখানো ব্যাপার হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে তার কোনোই ভূমিকা থাকে না।
৩. জাতীয় রাষ্ট্রের পক্ষে এরূপ দ্বিমুখী আচরণ করা নিতান্তই সহজ কাজ যে, সে দেশের সকল অধিবাসীকে নীতিগতভাবে এক জাতি আখ্যায়িত করে কাগজে-কলমে সকলকে সমান অধিকার দিয়ে দেবে। কিন্তু কার্যত সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু ভেদাভেদ পুরোপুরি বহাল রাখবে এবং সংখ্যালঘুদের বাস্তবিক কোনো অধিকারই দেবে না।
৪. একটি জাতীয় রাষ্ট্র স্বীয় রাষ্ট্রকাঠামোয় বিজাতীয় লোকদের উপস্থিতিজনিত জটিলতার সমাধান তিন উপায়ে করে। প্রথমত, তাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তাকে ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত করে নিজেদের জাতিসত্তার বিলীন করে নেয়। দ্বিতীয়ত, তাদের জাতিসত্তাকে নির্মূল করার জন্য হত্যা, লুটতরাজ ও দেশান্তরিতকরণের নিপীড়নমূলক কর্মপন্থা অবলম্বন করে। তৃতীয়ত, তাদের নিজেদের ভেতরে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে রেখে দেয়। দুনিয়ার জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোয় এ তিনটি কর্মপন্থা ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে এবং এখনো গৃহীত হয়ে চলেছে। আজকের ভারতে খোদ মুসলমানদের এসব নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
৫. যুগে যুগে দেখা গেছে শ্রেণিসংগ্রাম, শ্রেণিবৈষম্য, কৌলিন্যের বাহাদুরী ইত্যাদি। কে কোন বংশের, কে কোন গোত্রের, কে কোন প্রদেশের? এসব অহংকারপূর্ণ দাপট ইসলামী বিধানে নেই অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের যে অধিকারই দেয়া হয়, তা সংখ্যাগুরুর দেয়া অধিকার। সংখ্যাগুরুরা ওসব অধিকার যেমন দিতে পারে, তেমনি তাতে কমবেশি করা বা একেবারে ছিনিয়ে নেয়ারও অধিকার রাখে। এ ধরনের রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুরা পুরোপুরিভাবে সংখ্যাগুরুর করুণার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। তাদের জন্য মৌলিক মানবাধিকার পর্যন্ত।
এরই মাধ্যমে পরিষ্কার হলো ইসলামের রাষ্ট্র এবং প্রচলিত রাষ্ট্রের মৌলিক ধারণা ও গুণগত পার্থক্য।
উল্লেখিত মোলিক পার্থক্যগুলো থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়, অমুসলিম সংখ্যালঘুদের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের আচরণ এবং সংখ্যালঘু জাতির সাথে জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আচরণে কি আকাশ-পাতাল ব্যবধান। এ ব্যবধানকে বিবেচনায় না আনলে মানুষ এ ভুল বোঝাবুঝি থেকে মুক্ত হবে না যে, আধুনিক যুগের জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো সংখ্যালঘুদের সমানাধিকার দেয় আর ইসলাম এ ব্যাপারে ভারসাম্য ও ইনসাফপূর্ণ কার্যকর বিধান জারি করেছে।
১. অমুসলিম নাগরিকের প্রকারসমূহ
সহি হাদিসে মহানবী সা. অমুসলিম নাগরিকদের তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। মুয়াহাদা, জিম্মি, হরবী।
এক. মুয়াহাদা : চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিক।
দুই. জিম্মি : যুদ্ধে বিজিত অমুসলিম নাগরিক-যারা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
তিন. হরবী : যারা যুদ্ধ কিংবা সন্ধি ছাড়া অন্য কোনো পন্থায় ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
যদিও উক্ত তিন প্রকারের নাগরিকরাই সংখ্যালঘু অমুসলিমদের জন্য নির্ধারিত সাধারণ অধিকারগুলোয় সমভাবে অংশীদার।
১. চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিক : যারা যুদ্ধ ছাড়া অথবা যুদ্ধ চলাকালে বশ্যতা স্বীকার করতে সম্মত হয়ে যায় এবং ইসলামী সরকারের সাথে সুনির্দিষ্ট শর্তাবলি স্থির করে সন্ধিবদ্ধ হয়, তাদের জন্য ইসলামদের বিধান এই যে, তাদের সাথে সকল আচরণ তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির শর্তানুযায়ী করা হবে। আজকালকার সভ্য জাতিগুলো এরূপ রাজনৈতিক ধড়িবাজিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে যে, শত্রুপক্ষকে বশ্যতা স্বীকারে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কিছু উদার শর্ত নির্ধারণ করে নেয়। তারপর যেই তারা পুরোপুরি আয়ত্তে এসে যায়, অমনি শুরু হয়ে যায় ভিন্ন ধরনের আচরণ। কিন্তু ইসলাম এটাকে হারাম ও মহাপাপ গণ্য করে। কোনো জাতির সাথে যখন কিছু শর্ত স্থির করা হয়ে যায় (চাই তা মনপূত হোক বা না হোক) এখন তাতে চুল পরিমাণও হেরফের করা যাবে না। চাই উভয় পক্ষের আপেক্ষিক অবস্থান, শক্তি ও ক্ষমতায় [জবষধঃরাব ঢ়ড়ংরঃরড়হ] যতই পরিবর্তন এসে থাক না কেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘যদি তোমরা কোনো জাতির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হও, বিজয়ী হও এবং সেই জাতি নিজেদের ও নিজেদের সন্তানদের প্রাণ রক্ষার্থে তোমাদের মুক্তিপণ দিতে রাজি হয় (অপর বর্ণনায় আছে যে, তোমাদের সাথে কোনো সন্ধিপত্র সম্পাদন করে), তাহলে পরবর্তী সময়ে ঐ নির্ধারিত মুক্তিপণের চেয়ে কণা পরিমাণও বেশি নিও না। কেননা সেটা তোমাদের জন্য বৈধ্য হবে না।’ [আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ]।
অপর হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘সাবধান! যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ নাগরিকের ওপর জুলুম করবে কিংবা তার প্রাপ্য অধিকার থেকে তাকে কম দেবে, তার সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি বোঝা তার ওপর চাপাবে অথবা তার কাছ থেকে কোনো জিনিস তার সম্মতি ছাড়া আদায় করবে, এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন আমি নিজেই ফরিয়াদি হবো।’ [আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ]।
উক্ত উভয় হাদীসের ভাষা ব্যাপক অর্থবোধক। তাই ঐ হাদীস দুটি থেকে এই সাধারণ বিধি প্রণয়ন করা হয় যে, চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকদের সাথে সন্ধিপত্রে যেসব শর্ত নির্ধারিত হবে, তাতে কোনোরকম কমবেশি করা কোনোক্রমেই জায়েজ হবে না। তাদের ওপর করা খাজনাও বাড়ানো যাবে না। তাদের জমিজমাও দখল করা যাবে না, তাদের ঘরবাড়ি, দালান-কোঠাও কেড়ে নেয়া যাবে না। তাদের ওপর কড়া ফৌজদারি দণ্ডবিধিও চালু করা যাবে না, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতায়ও হস্তক্ষেপ করা যাবে না। তাদের ইজ্জত-সম্মানের ক্ষতি করা যাবে না এবং তাদের সাথে এমন কোনো আচরণ করা যাবে না, যা জুলুম, অধিকার হরণ, সামর্থ্যের মাত্রাতিরিক্ত বোঝা চাপানো অথবা সম্মতি ব্যতিরেকে সম্পত্তি হস্তগত করার পর্যায়ে পড়ে। এ নির্দেশাবলির কারণেই ফকীহগণ সন্ধি বলে বিজিত জাতিগুলো সম্পর্কে কোনো আইন প্রণয়ন করেননি, বরং শুধুমাত্র একটি সাধারণ সংক্ষিপ্ত বিধি প্রণয়ন করেই ক্ষান্ত থেকেছেন। সেটি এই যে, তাদের সাথে আমাদের আচরণ হুবহু সন্ধির শর্তানুসারে পরিচালিত হবে। ইমাম আবু ইউসুফ লিখেছেন, ‘তাদের সন্ধিপত্রে যা নেয়া স্থির হয়েছে, তাদের কাছ থেকে শুধু তাই নেয়া হবে। তাদের সাথে সম্পাদিত সন্ধির শর্ত পূরণ করা হবে। কোনো কিছু বাড়ানো হবে না।’ [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৩৫]।
২. যুদ্ধে বিজিত অমুসলিম নাগরিক : দ্বিতীয় প্রকারের অমুসলিম নাগরিক হচ্ছেÑ যারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুসলমানদের সাথে লড়াই করেছে এবং ইসলামী বাহিনী যখন তাদের সকল প্রতিরোধ ভেঙে তাদের আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করেছে, কেবল তখনই অস্ত্র সংবরণ করেছে। এ ধরনের বিজিতদের যখন ‘সংরক্ষিত নাগরিকে’ (জিম্মি) পরিণত করা হয়, তখন তাদের কয়েকটি বিশেষ অধিকার দেয়া হয়। ফিকহ শাস্ত্রীয় গ্রন্থাবলিতে এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। নিম্নে এ সকল বিধির একটা সংক্ষিপ্তসার দেয়া হচ্ছে। এ থেকে এ শ্রেণির অমুসলিম নাগরিকদের সাংবিধানিক মর্যাদা ও অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যাবে।
১. মুসলমানদের সরকার তাদের কাছ থেকে জিজিয়া গ্রহণ করা মাত্রই তাদের সাথে সংরক্ষণ চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যাবে এবং তাদের জান ও মালের হেফাজত করা মুসলমানদের জন্য ফরজ হয়ে যাবে। কেননা জিজিয়া গ্রহণ করা মাত্রই প্রমাণিত হয় যে, জান ও মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। [বাদায়েউস্ সানায়ে, ৭ম খণ্ড, ১১১ পৃষ্ঠা]।
এরপর মুসলিম সরকারের বা সাধারণ মুসলমানদের এ অধিকার থাকে না যে, তাদের সম্পত্তি দখল করবে বা তাদের দাসদাসী বানাবে। হযরত ওমর রা. হযরত আবু উবায়দাকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছিলেন, ‘যখন তুমি তাদের কাছ থেকে জিজিয়া গ্রহণ করবে, তখন তোমার আর তাদের ওপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার থাকবে না। [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৮২]।
২. ‘সংরক্ষিত নাগরিকে’ (জিম্মি) পরিণত হয়ে যাওয়ার পর তাদের জমির মালিক তারাই হবে। সেই জমির মালিকানা উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তরিত হবে এবং তারা নিজেদের সম্পত্তি বেচাকেনা, দান করা ও বন্ধক রাখা ইত্যাদির নিরঙ্কুশ অধিকারী হবে। ইসলামী সরকার তাদের বেদখল করতে পারবে না। [ফাতহুল কাদীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫৯]।
৩. জিজিয়ার পরিমাণ তাদের আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। যারা ধনী, তাদের কাছ থেকে বেশি; যারা মধ্যবিত্ত, তাদের কাছ থেকে কিছু কম এবং যারা দরিদ্র, তাদের কাছ থেকে অনেক কম নেয়া হবে। আর যার কোনো উপার্জনের ব্যবস্থা নেই অথবা যে অন্যের দান-দক্ষিণার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে, তার জিজিয়া মাফ করে দেয়া হবে। জিজিয়ার জন্য যদিও কোনো বিশেষ পরিমাণ নির্দিষ্ট নেই, তবে তা অবশ্যই এভাবে নির্ধারিত হওয়া চাইÑ যাতে তা দেয়া তাদের পক্ষে সহজ হয়। হযরত ওমর রা. ধনীদের ওপর মাসিক এক টাকা, মধ্যবিত্তদের ওপর মাসিক ৫০ পয়সা এবং গরিব লোকদের ওপর মাসিক ২৫ পয়সা জিজিয়া আরোপ করেছিলেন। [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৩৬]।
৪. জিজিয়া শুধুমাত্র যুদ্ধ করতে সক্ষম লোকদের ওপর আরোপ করা হবে। যারা যুদ্ধ করতে সমর্থ নয়, যথা শিশু, নারী পাগল, অন্ধ, পঙ্গু, উপাসনালয়ের সেবক, সন্ন্যাসী, ভিক্ষুক, খুনখুনে বৃদ্ধ। বছরের উল্লেখযোগ্য সময় রোগে কেটে যায় এমন রোগী এবং দাসদাসী ইত্যাদিকে জিজিয়া দিতে হবে না। [বাদায়ে, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১১-১১৩; ফাতহুল কাদীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৩, ৩৭২; কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৭৩]।
৫. যুদ্ধের মাধ্যমে দখল করা জনপদের উপাসনালয় দখল করার অধিকার মুসলমানদের রয়েছে। তবে সৌজন্যবশত এ অধিকার ভোগ করা থেকে বিরত থাকা এবং উপাসনালয়গুলোকে যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায় বহাল রাখা উত্তম। হযরত ওমর রা.-এর আমলে যত দেশ বিজিত হয়েছে, তার কোথাও কোনো উপাসনালয় ভাঙা হয়নি বা তাতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হয়নি। ইমাম আবু ইউসুফ লিখেছেন, ‘সেগুলোকে যেমন ছিল তেমনভাবেই রাখা হয়েছে। ভাঙা হয়নি বা তাতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হয়নি।’ [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৮৩]। তবে প্রাচীন উপাসনালয়গুলোকে ধ্বংস করা কোনো অবস্থায়ই বৈধ নয়। [বাদায়ে,৭/ ১১৪]। [ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার ও ইসলামী রাষ্ট্রের রূপরেখা ইত্যাদি বইয়ে বিস্তারিত পাওয়া যাবে]
অমুসলিম নাগরিকদের সাধারণ অধিকার
উল্লেখিত তিন শ্রেণির নাগরিকদের সকলেই নিম্নোক্ত অধিকারগুলোয় সমান অংশীদার।
১. প্রাণের নিরাপত্তার অধিকার: অমুসলিম নাগরিকদের রক্তের মূল্য মুসলমানদের রক্তের মূল্যের সমান। কোনো মুসলমান যদি অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করে, তাহলে একজন মুসলমান নাগরিককে হত্যা করলে যেমন তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো, ঠিক তেমনি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। রাসূল সা.-এর আমলে জনৈক মুসলমান অমুসলিমকে হত্যা করলে তিনি খুনিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তিনি বলেন, ‘যে নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়া হয়েছে, তার রক্তের বদলা নেয়ার দায়িত্ব আমারই।’ [ইনায়া শরহে হিদায়া, ৮ম খণ্ড, ২৫৬ পৃষ্ঠা]।
হযরত ওমর রা.-এর আমলে বকর বিন ওয়ায়েল গোত্রের এক ব্যক্তি জনৈক হীরাবাসী অমুসলিম জিম্মিকে হত্যা করে। তিনি খুনিকে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের হাতে সমর্পণের আদেশ দেন। অতঃপর তাকে উত্তরাধিকারীদের হাতে সমর্পণ করা হলে তারা তাকে হত্যা করে। [বুরহান শরহে মাওয়াহিবুর রহমান, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৭]। উসমান রা.-এর আমলে হযরত ওমরের ছেলে উবায়দুল্লাহকে হত্যার পক্ষে ফতোয়া দেয়া হয়। কেননা তিনি হযরত ওমর রা.-এর হত্যার সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে হরমুযান ও আবু লুলুর মেয়েকে হত্যা করেন। আলী রা. আমলে জনৈক মুসলমান জনৈক অমুসলিমের হত্যার দায়ে গ্রেফতার হয়। যথারীতি দোষ সাব্যস্ত হওয়ার পর তিনি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। এ সময় নিহত ব্যক্তির ভাই এসে বললো, ‘আমি মাফ করে দিয়েছি।’ কিন্তু তিনি তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে বললেন, ‘ওরা বোধ হয় তোমাকে ভয় দেখিয়েছে।’ সে বললো, ‘না, আমি রক্তপণ পেয়েছি এবং আমি বুঝতে পেরেছি যে, ওকে হত্যা করলে আমার ভাই ফিরে আসবে না।’ তখন তিনি খুনিকে ছেড়ে দিলেন এবং বললেন, ‘আমাদের অধীনস্থ অমুসলিম নাগরিকদের রক্ত আমাদের রক্তের মতোই এবং তাদের রক্তপণ আমাদের রক্তপণের মতোই।’ [বুরহান, ২য় খণ্ড, ২৮২ পৃষ্ঠা]।
অপর এক বর্ণনা মোতাবেক হযরত আলী রা. বলেছিলেন, ‘তারা আমাদের নাগরিক হতে রাজি হয়েছেই এই শর্তে যে, তাদের সম্পত্তি আমাদের সম্পত্তির মতো এবং তাদের রক্ত আমাদের মতো মর্যাদাসম্পন্ন হবে।’
এ কারণেই ফকীহগণ এ বিধি প্রণয়ন করেছেন যে, কোনো অমুসলিম নাগরিক কোনো মুসলমানের হাতে ভুলক্রমে নিহত হলে তাকেও অবিকল সেই রক্তপণ দিতে হবে, যা কোনো মুসলমানের নিহত হবার ক্ষেত্রে দিতে হয়। [দুররুল মুখতার, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২০৩]।
২. ফৌজদারি দণ্ডবিধি অধিকার : ফৌজদারি দণ্ডবিধি মুসলিম-অমুসলিম সকলের জন্য সমান। অপরাধের যে সাজা মুসলমানকে দেয়া হয়, অমুসলিম নাগরিককেও তাই দেয়া হবে। অমুসলিমের জিনিস যদি মুসলমান চুরি করে কিংবা মুসলমানের জিনিস যদি অমুসলিম চুরি করে, তাহলে উভয় ক্ষেত্রেই চোরের হাত কেটে ফেলা হবে। কারো ওপর ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ আরোপ করলে অপবাদ আরোপকারী মুসলমানই হোক আর অমুসলমানই হোক, উভয়কেই একই শাস্তি দেয়া হবে। অনুরূপভাবে ব্যভিচারের শাস্তিও মুসলিম ও অমুসলিমের জন্য একই রকম। তবে মদের বেলায় অমুসলিমদের অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। [কিতাবুল খারাজ, পৃ. ২০৮, ২০৯; আল-মাব্সূত, ৯ম খণ্ড, পৃ. ৫৭-৫৮]। ইমাম মালেকের মতে, অমুসলিমকে মদের ন্যায় ব্যভিচারের শাস্তি থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ইমাম মালেকের অভিমতের উৎস হলো হযরত ওমর রা. ও হযরত আলী রা. এই সিদ্ধান্ত যে, অমুসলিম নাগরিক ব্যভিচার করলে তার ব্যাপারটা তাদের সম্প্রদায়ের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। অর্থাৎ তাদের ধর্মীয় বা পারিবারিক আইন অনুসারে কাজ করতে হবে।] (চলবে)