ইসলামী দাওয়াত : একটি ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ব


৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:৪৭

॥ আশরাফ নুয়াইম ॥
ইসলাম একটি শান্তি ও কল্যাণময় জীবনব্যবস্থা, যা শুধু ব্যক্তি নয়, সমাজ এবং সমগ্র মানবজাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। ইসলামী দাওয়াত হলো সেই পন্থা, যার মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান জানানো হয়। পবিত্র কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস দাওয়াতকে প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব হিসেবে নির্ধারণ করেছে। আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান জানাবে, সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে। তারাই সফলকাম।” (সূরা আলে-ইমরান: ১০৪)।
দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সৎপথে ফিরিয়ে আনা এবং তাদের অন্তরকে আল্লাহর দিকে উন্মুখ করা। তবে বর্তমান যুগে দাওয়াতের প্রকৃত অর্থ হারিয়ে যেতে বসেছে। আমরা দাওয়াতকে একটি পেশা হিসেবে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি, যা চিন্তার দৈন্যদশা ও সামাজিক অবক্ষয়ের ইঙ্গিত বহন করে।
ক. দাওয়াতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
★ কুরআন ও হাদিসের আলোকে দাওয়াতের গুরুত্ব
পবিত্র কুরআন দাওয়াতকে প্রতিটি মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক দায়িত্ব হিসেবে উল্লেখ করেছে। আল্লাহ বলেন, “তোমার রবের পথে মানুষকে আহ্বান কর প্রজ্ঞার সঙ্গে এবং উত্তম উপদেশ দিয়ে।” (সূরা আন-নাহল : ১২৫)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোনো মন্দ কাজ দেখবে, সে তা তার হাত দিয়ে পরিবর্তন করবে। যদি তা না পারে, তাহলে তার জিহ্বা দিয়ে। আর যদি এটাও না পারে, তাহলে অন্তত অন্তরে তা ঘৃণা করবে। আর এটি হলো ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর।” (সহীহ মুসলিম)।
★ ব্যক্তি ও সমাজের উন্নয়নে দাওয়াতের ভূমিকা
ইসলামের দাওয়াত একটি মানুষকে নৈতিকতা, মানবিকতা এবং সত্য পথে পরিচালিত করার কার্যকর মাধ্যম। উদাহরণস্বরূপ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দাওয়াত কার্যক্রমের ফলে মক্কার সমাজ, যা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, তা একটি আলোকিত ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজে পরিণত হয়।
বাস্তব উদাহরণ
ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তিনি ছিলেন ইসলামের ঘোরতর বিরোধী। তবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দাওয়াত ও কুরআনের প্রভাব তার অন্তরকে পরিবর্তন করে দেয়। ওমর (রা.) ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা যিনি ছিলেন ন্যায়বিচারের প্রতীক।
★ দাওয়াতের অভাবে সমাজের অবক্ষয়
যে সমাজে দাওয়াতের অভাব থাকে, সেখানে নৈতিকতা ও সততার সংকট দেখা দেয়। অন্যায়, দুর্নীতি এবং সামাজিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ হিসেবে আজকের বিশ্বে যেখানে নৈতিক শিক্ষা ও দাওয়াত কার্যক্রম অপ্রতুল, সেখানে অন্যায়, ব্যভিচার এবং বিভ্রান্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
খ. দাওয়াত একটি ব্যক্তিগত দায়িত্ব
প্রত্যেক মুসলিমই একজন দাঈ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করবে।’ (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)। এমনকি একটি ছোট পরিমাণ জ্ঞান থাকলেও সেটি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করার গুরুত্ব রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘আমার কাছ থেকে একটি আয়াত হলেও প্রচার করো।’ (সহীহ বুখারি)।
★ দাওয়াতের ব্যক্তিগত দিক
দাওয়াত শুধুমাত্র বড় পরিসরে নয়; বরং এটি ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যেও হতে পারে। এর বাস্তব উদাহরণ মুসআব ইবনে উমাইর (রা.) : রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় দাওয়াতের জন্য তাকে প্রেরণ করেন। মুসআব (রা.) তার প্রজ্ঞা, ধৈর্য এবং সুন্দর আচরণের মাধ্যমে বহু মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন থেকে শিক্ষা
রাসূলুল্লাহ (সা.) ধৈর্য, নম্রতা এবং আন্তরিকতার মাধ্যমে দাওয়াত দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি তায়েফে দাওয়াত দিতে গিয়ে কঠিন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন। তাকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তাদের জন্য দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! এ জাতিকে সৎপথে পরিচালিত করুন। কারণ তারা জানে না।’
গ. দাওয়াত ও চিন্তাগত দৈন্যদশা
দাওয়াতের প্রকৃত অর্থ ভুলভাবে বোঝার ফলে এটি অনেকের কাছে একটি আনুষ্ঠানিক পেশা বা সীমিত কাজ বলে মনে হয়। সমাজের একটি বড় অংশ মনে করে, দাওয়াত শুধুমাত্র আলেম বা বিশেষজ্ঞদের কাজ। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে এটি প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব। কুরআনের নির্দেশ, “তোমরা সৎকর্মের আদেশ দাও এবং অসৎকর্ম থেকে বিরত রাখো।” (সূরা তাওবা : ৭১)।
উদাহরণ
একজন সাধারণ মুসলিম যদি তার পরিবারের সদস্যদেরও সৎপথে পরিচালিত করার চেষ্টা করে, তবে সেটি দাওয়াতের একটি রূপ। যেমন, এক মাতা তার সন্তানদের নৈতিকতা শেখানোর মাধ্যমে তাদের কল্যাণের পথে আহ্বান করেন।
★ পেশা বনাম দায়িত্ব
আমাদের সমাজে দাওয়াতকে অনেক সময় পেশার সাথে তুলনা করা হয়। বক্তৃতা বা মাহফিলে বক্তব্য দেওয়া দাওয়াতের একমাত্র মাধ্যম নয়; বরং এটি ব্যক্তিগত আচরণ ও দৈনন্দিন জীবনের মাধ্যমে শুরু হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র ভালো এবং যার আচরণ অন্যদের জন্য কল্যাণকর।’ (সহীহ বুখারি)।
উদাহরণ
হযরত আবু বকর (রা.) ইসলাম গ্রহণের পরপরই তার বন্ধুবান্ধবদের ইসলাম গ্রহণে আহ্বান করেছিলেন। তিনি এক পেশাদার বক্তা ছিলেন না, বরং তার আন্তরিকতা ও আচরণের মাধ্যমেই মানুষকে দাওয়াত দিয়েছিলেন।
★ চিন্তার দৈন্যদশা দূর করার উপায়
দাওয়াত সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় দাওয়াতের গুরুত্ব তুলে ধরা প্রয়োজন। প্রত্যেক মুসলিমকে বোঝাতে হবে যে, দাওয়াত শুধু বক্তৃতা বা ধর্মীয় উপদেশ নয়; এটি তাদের জীবনের প্রতিটি কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে।
কুরআনের নির্দেশ, ‘প্রজ্ঞার সাথে তোমার রবের পথে মানুষকে আহ্বান কর।’ (সূরা আন-নাহল : ১২৫)।
ঘ. দাওয়াত ও সমাজ গঠন
★ সমাজের জন্য দাওয়াতের গুরুত্ব
ইসলামের দাওয়াত সমাজে শৃঙ্খলা, শান্তি এবং মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি সমাজ যখন নৈতিকতার ভিত্তিতে গঠিত হয়, তখন সেটি কল্যাণমুখী ও সমৃদ্ধশালী হয়।
কুরআনের নির্দেশ : ‘তোমরা কল্যাণের কাজে একে অপরকে সাহায্য করো এবং পাপ ও অন্যায়ে সহযোগিতা করো না।’ (সূরা মায়েদা : ২)।
উদাহরণ
মদিনায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দাওয়াতের ফলাফল হিসেবে মুহাজির ও আনসারের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এর মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠিত হয়েছিল।
★ সামাজিক ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের সেতুবন্ধন
দাওয়াত মানুষকে বিভেদ থেকে দূরে রেখে একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে। এটি সমাজের প্রতিটি স্তরে সেতুবন্ধন তৈরি করে।
উদাহরণ : হযরত বিলাল (রা.), যিনি দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে ইসলামের দাওয়াতের কারণে মুসলিম সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হন। তার প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সম্মান দেখিয়ে সমাজে বর্ণবৈষম্যের অবসান ঘটানো হয়।
★ সুন্দর সমাজ গঠনে দাওয়াতের ভূমিকা
দাওয়াত শুধু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নয়। এটি সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে; যেমন শিক্ষা, পরিবার, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে।
কুরআনের নির্দেশ, ‘তোমরা উত্তম কাজের আদেশ দাও এবং পাপ কাজ থেকে বিরত রাখো।’ (সূরা আল ইমরান: ১১০)।
ঙ. দাওয়াতের চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
★ বর্তমান যুগে দাওয়াতের চ্যালেঞ্জগুলো
আজকের বিশ্বে দাওয়াতের কাজ নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। যেমনÑ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা। মিডিয়া এবং প্রযুক্তির অপব্যবহার। ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা : অনেক সংস্কৃতি ইসলামিক দাওয়াতকে একটি আগ্রাসী কার্যক্রম বলে মনে করে। এমনকি মুসলিম সমাজেও কেউ কেউ দাওয়াতের গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হয়।
উদাহরণ
দেশে ও বিদেশে অনেক সময় মুসলিমদের দাওয়াত কার্যক্রমকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। তবে আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং সঠিক তথ্য দিয়ে এটি মোকাবিলা করা সম্ভব।
★ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইসলামের নির্দেশনা
দাওয়াতের কাজ করতে হলে ধৈর্য ও প্রজ্ঞার প্রয়োজন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ নম্রতাকে পছন্দ করেন এবং প্রতিটি কাজে নম্রতা থাকা উচিত।’ (সহীহ বুখারি)।
চ. সফল দাওয়াতের উপায়
কৌশল ও প্রয়োজনীয় দক্ষতা।
প্রজ্ঞা এবং সঠিক তথ্য।
ধৈর্য এবং নম্রতা।
অন্যের সংস্কৃতি ও মতামতকে সম্মান করা।
★ দাওয়াতের ভাষা ও শিষ্টাচার
দাওয়াতের ভাষা এমন হতে হবে, যা মানুষের হৃদয়ে স্পর্শ করে। কঠোর বা বিদ্বেষপূর্ণ ভাষা ব্যবহার দাওয়াতকে ব্যর্থ করতে পারে।
কুরআনের নির্দেশ, ‘তোমরা মানুষের সঙ্গে উত্তম কথা বলো।’ (সূরা বাকারা: ৮৩)।
ছ. প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার
আজকের যুগে দাওয়াতের কাজ সহজ করার জন্য প্রযুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার এবং অন্যান্য সামাজিকমাধ্যম ব্যবহার করে লাখো মানুষকে ইসলামের বার্তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।
উদাহরণ
বিশ্ববিখ্যাত দাঈ ইউসুফ আল কারজাভি, আহমেদ দিদাত, ড. জাকির নায়েক তাদের বক্তব্য এবং যুক্তির মাধ্যমে লক্ষাধিক মানুষকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করেছেন।
অন্তিম কথা
ইসলামের দাওয়াত শুধু একটি দায়িত্ব নয়; এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আমানত। এটি সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ গঠনের মাধ্যম। প্রত্যেক মুসলিমের উচিত নিজের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দাওয়াতের চর্চা করা এবং অন্যদের কল্যাণের পথে আহ্বান জানানো। দাওয়াতের মাধ্যমে আমরা একটি শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ গড়ে তুলতে পারি। তাই আসুন, আমরা সকলে আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করি এবং ইসলামের সত্য বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দেই।
রাব্বুল আলামিন আমাদের তাঁর সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমীন।
লেখক : শিক্ষার্থী, মাস্টার্স, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়।