দাবি-দাওয়া, বিক্ষোভ : জনজীবনে দুর্ভোগ
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:৪৭
॥ একেএম রফিকুন্নবী ॥
বাংলাদেশে আগস্ট বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তী সরকার ২৪ জন উপদেষ্টা নিয়ে দেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছে। গত ৫৪ বছরে জঞ্জালে ভরে গেছে দেশ। এমন কোনো বিভাগ নেই, যেখানে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, লুটতরাজ নেই। দেশ স্বাধীন হয়েছিল দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য। বৈষম্যহীন একটি সমাজের প্রত্যাশা ছিল সাধারণ জনগণের। কিন্তু বাকশাল কায়েম থেকে শুরু করে গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সভাপতি হাসিনা কর্তৃত্ববাদ কায়েম করে ‘চোরতন্ত্রের’ দেশ বানিয়ে শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। জনগণ; এমনকি তাদের কর্মী বাহিনীকেও কোনো দিকনির্দেশনা দিয়ে যায়নি।
দেশ এক দুঃশাসন থেকে রেহাই পেয়েছে। মানুষ স্বাধীনভাবে নিশ্বাস ফেলছে। গুম-খুন, জেল-জরিমানার ভয় আর জনগণকে তাড়া করছে না। হাসিনার স্বৈরশাসনের জঞ্জাল পরিষ্কার করার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদ কাজ করে যাচ্ছেন। উপদেষ্টারা সবাই দেশ চালানোর অভিজ্ঞ না হওয়ায় জঞ্জাল পরিষ্কার করতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে।
এর মধ্যেই পতিত হাসিনার দোসররা বিভিন্ন নামে দেশে অরাজকতা করার পাঁয়তারা করছে। গত ৬ মাসে উপদেষ্টারা বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করে জনমতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ কমিশন, জনপ্রশাসন কমিশন, শ্বেতপত্র কমিশনসহ কমিশনের লোকেরা কাজ করে যাচ্ছেন। কমিশনগুলো তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে এবং জনগণের সাথে আলাপ করে এ মাসের মধ্যেই রিপোর্ট দিতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশেষ করে গুম, খুন, চাঁদাবাজি, টাকা লুটপাট, ব্যাংক খালি করে টাকা বিদেশে পাঠানোর চাঞ্চল্যকর তথ্য আসছে। হাসিনার আমলের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, গুম, খুনের খবর জেনে; বিশেষ করে আয়নাঘরের কাহিনী জেনে মানুষ স্তম্ভিত হয়েছে, যা এখন বিচারের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।
এদিকে আমাদের চিরশত্রু ভারতের কার্যকলাপ এবং তাদের পত্রপত্রিকা আমাদর দেশের বিরুদ্ধে কল্পকাহিনী ছাপিয়ে দেশ ও জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে। আমাদের দেশের দুর্নীতিবাজ, টাকা পাচারকারী, পুলিশ বাহিনীর অনৈতিক কাজে সাহায্যকারীদের ভারতে আশ্রয় দিয়ে জঘন্য ঘৃণার কাজ করেছে। হাসিনা-রেহানাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের লোকদের কাছে তারা চিরশত্রুতার স্বাক্ষর রেখেছে।
আগেই বলেছি, পতিত স্বৈরাচারদের দোসররা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দাবি-দাওয়াকে কেন্দ্র করে সড়ক-রেলপথ বন্ধ করে দিয়ে দেশে অরাজকতার চেষ্টা করছে। নতুন স্বাধীনতার পরপরই আনসারদের দিয়ে বিদ্রোহ করার চেষ্টা করেছিল। ছাত্রদের দিয়ে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার নাম করে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ চালিয়ে জনগণের চলার পথে বাধা সৃষ্টি করে চলছে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ করছি।
আমরা এদেশের সাধারণ মানুষ অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি, রক্ত দিয়েছি, শহীদ হয়েছি। পঙ্গু হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছি। ঘরে চলার পথ না পেয়ে খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছি। আমরা এর প্রতিকার চাই। আগস্ট বিপ্লবের দোষীদের বিচারের আওতায় এনে ফাঁসি কার্যকর করা এ সরকারের বড় কাজ।
এ সরকারকে স্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে, কোনো দাবি-দাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ করা যাবে না। সব দাবি-দাওয়া নির্বাচিত সরকার দেখবে। এ সরকার শুধু নির্বাচন কমিশনসহ প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন দিয়ে চলে যাবে। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে স্পষ্ট জানিয়ে দিতে হবে জনগণের চলার পথে কোনো বাধা, বিক্ষোভ, অবরোধ সহ্য করা হবে না। কঠোর হাতে দমন করতে হবে। রেলপথ যারা বন্ধ রেখেছিল, তাদের সঠিক তথ্য জেনে আইনের আওতায় আনতে হবে। জনগণের সম্পদের প্রতি কারো রক্তচক্ষু সহ্য করা হবে না। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী; এমনকি সেনাবাহিনীকেও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে কোনো দাবি-দাওয়া পেশ করা যাবে না। দাবি-দাওয়া ছাড়াই তো আমরা ১৬ বছর হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের কাছে মাথানত করে বাস করেছি। তাই আর কিছুদিন অপেক্ষা করুন। নির্বাচিত সরকার এলেই আমরা দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হব তাদের কাছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হলো যৌক্তিক সংস্কার করে, ভোটার লিস্ট সঠিক করে, ভোটের সাথে জড়িত লোকদের সংস্কার করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমাদের আবেদনÑ স্বৈরশাসকের হাতে দেশ থাকলে আরও আপনাদের জেল খাটতে হতো। গুম হতে হতো, খুন-খারাবির কথা তো আছেই। অতএব একটু ধৈর্য ধরুন। জনগণের হাট-বাজারঘাট থেকে চাঁদাবাজি বন্ধ করার ব্যবস্থা নিন। জনগণ কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিক হাসিনার আমলের চাঁদাবাজি বন্ধ হতে দেখছে না। হাত বদল হয়েছে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ করছি।
এলাকায় দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রশাসনের সহযোগিতায় চাঁদাবাজ, দখলবাজদের তালিকা করে তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করি। আমরা যদি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের লোকদের দলবাজি, চাঁদাবাজি থেকে দূরে রাখতে পারি, জনগণ আপনাদের সাথে থাকবে। চাঁদাবাজদের কোনো দল নেই। তাই সচেতন জনগণের ভোট পেতে হলে চাঁদাবাজ-দখলবাজদের পরিত্যাগ করতে হবে। তাদের না বলতে হবে। ভালো লোকের শাসন কায়েমের জন্য ভালো চরিত্রবান লোককে ভোট দিয়ে চেয়ারম্যান, এমপি, মন্ত্রী বানাতে হবে। এ ব্যাপারে জনগণকে সোচ্চার হতে হবে। ছাত্ররা যেভাবে তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় বিক্ষোভ করছে, সড়ক অবরোধ করছে তা মোটেও কাম্য নয়। বাংলাদেশের মতো ছোট দেশে যত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তা কম নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পড়াশোনার মান বাড়াতে হবে। ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সব বিভাগে যারা ১, ২, ৩ হয়, কেবল তাদেরই প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। দলবাজ লোকদের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যাবে না। আমি যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার অভিজ্ঞতা ভালো নয়। দলবাজির কারণে নিম্নমানের ছাত্রকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অথচ ১ম, ২য়, ৩য়দের দেয়া হয়নি। বর্তমান অবস্থার আলোকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে ভালো শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে। এখানে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। দেশকে ভালো করতে হলে শিক্ষার মান বাড়াতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ভালো মানুষ। তাকেও অনুরোধ করব শুধু সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় নয়। প্রকৃত শিক্ষার মান বজায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে হবে।
দেশের জনগণই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাদের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব আমাদের দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতাদের। দলীয় স্বার্থ কম করে হলেও জনগণের স্বার্থ প্রাধান্য দিতে হবে। কোনোভাবেই এ ১৮ কোটি মানুষের ত্যাগ-কুরবানি অবমূল্যায়ন করা যাবে না। মহান আল্লাহ আমাদের শহীদের রক্ত, ছাত্র-জনতার আহত-নিহতদের ত্যাগ বিবেচনায়ই আগস্ট বিপ্লব ঘটিয়েছেন। আমাদের এর মূল্যায়ন প্রয়োজন। আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের স্বার্থেই ভেদাভেদ ভুলে জনতার সুবিধা বিবেচনা করে আমরা রাস্তাঘাট বন্ধ করে দাবি-দাওয়া আদায়ে পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকব।
পতিত স্বৈরাচারদের কোনো ছাড় নেই। তাদের আইনের আওতায় আনতেই হবে। কাউকেই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। নিরপরাধ লোককে হয়রানি করা যাবে না। আমরা দেশের ভালো চাই, মানুষের ভালো চাই, সব মন্দ থেকে বিরত থেকেই আগস্ট বিপ্লবের ফল জনগণের কাছে পৌঁছাতে চাই। মনে রাখতে হবেÑ আমাদের কাজের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে জবাবদিহি করতে হবে। ভালোর জন্য জান্নাত আর খারাপের জন্য জাহান্নাম আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।