সংস্কার কমিশনের সুপারিশ

নয়া সংবিধান রচনা করতে হবে


৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:৪৩

॥ শহীদুল ইসলাম ॥
সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনায় জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। আর প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ করার প্রস্তাবও করেছে কমিশন।
তবে জুলাই বিপ্লবের মূল নেতৃত্বদানকারীরা মনে করেন, সংবিধানের মূল প্রস্তাবনায় ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীত’। জাতীয় সংসদ এ মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক কোনো আইন পাস করতে পারবে না। অন্যান্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, তা এ মূলনীতির বিরোধী হলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে। এ মূলনীতি ঠিক করা জরুরি। তারা আরো মনে করেন, ’৭২-এর সংবিধান পুরোপুরি বিলুপ্ত করে নতুন করে সংবিধান রচনা করতে হবেÑ যাতে প্রতিফলিত হবে ’২৪-এর জুলাই বিপ্লবের চেতনা। কিন্তু সংস্কার প্রস্তাবে বিদ্যমান সংবিধানের ওপর কিছু সংস্কার করার কথাই বলা হয়েছে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন সংবিধান সংশোধনের জন্য গণভোটের বিধান পুনর্বহালের প্রস্তাবও করেছে। ১৫ জানুয়ারি বুধবার সংবিধান সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেন।
সংবিধান সংস্কার কমিশন দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট চালু করার জন্য সুপারিশ করেছে। এ দ্বি-কক্ষে যাতে করে সবার প্রতিনিধিত্ব থাকে এবং একইসঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নিম্নকক্ষ করতে এবং সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে উচ্চকক্ষ তৈরি করার জন্য সুপারিশ করেছে।
এছাড়া নাগরিকত্ব হিসেবে ‘বাঙালি’ বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশি’ করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। কমিশন ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি…’- এ বিধান বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে। তারা বর্তমান অনুচ্ছেদ ৬(২) “বাংলাদেশের নাগরিকগণ ‘বাংলাদেশি’ বলে পরিচিত হবেন” হিসেবে প্রতিস্থাপন করার সুপারিশ করেছে।
কমিশন মনে করে, গত ১৬ বছর বাংলাদেশ যে একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের মোকাবিলা করেছে, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে ক্ষমতার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য ছিল না। সে কারণে একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে না পারে, সেজন্য রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ ও নির্বাহী বিভাগের দুটি পদÑ প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য কমিশন চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স হিসেবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নামে একটি সাংবিধানিক সংস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে।
সেই কমিশনে থাকবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, সংসদের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা, দুই কক্ষের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, যারা আসবেন বিরোধীদল থেকে এবং একজন থাকবেন, যিনি অন্য দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব করবেন।
কমিশন মনে করে, এ প্রতিষ্ঠান সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহি করতে পারবে।
‘এটা প্রায় স্পষ্ট যে, প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস করা জরুরি এবং যাতে করে তিনি একক ইচ্ছায় নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগ দিতে না পারেন। এজন্য কমিশন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের কাছে এগুলোকে অর্পণ করার সুপারিশ করেছে।’ কমিশন মনে করে, প্রধানমন্ত্রীকে সংসদে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হওয়ার ব্যবস্থা দরকার এবং সেই কারণে ৭০ অনুচ্ছেদ দ্বারা যেন প্রধানমন্ত্রী কেবলমাত্র সুরক্ষিত না হন, সেজন্য কমিশন তার কিছু সংস্কারের প্রস্তাব করেছে।
কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের সুস্পষ্ট কাঠামোর পরামর্শ দিয়েছে এবং সেক্ষেত্রে কমিশন মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা বাছাইয়ের দায়িত্বভার কোনো ব্যক্তি বা একক কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর থাকা ঠিক নয়, সেজন্য এটিকে কমিশন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের ওপর অর্পণের পরামর্শ দিয়েছে।
কমিশন বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ করেছে। কমিশন বলছে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সুগম করতে হলে এবং সবার কাছে পৌঁছে দিতে হলে কমিশন মনে করে, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার। কমিশন সুপ্রিম কোর্টের একক চরিত্র অক্ষুণ্ন রেখেই দেশের সব বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বিভাগের মর্যাদা এবং এখতিয়ারসম্পন্ন একটি একক স্থায়ী আসন প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে। কমিশন মনে করে এবং যাদের সঙ্গে কথা বলেছে, তারা সবাই মনে করে, একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা থাকা জরুরি, সেজন্য কমিশন স্থানীয় সরকার কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে। তারা জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে সমন্বয়ক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাবও করেছে।
এছাড়া কমিশন মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণের কথা বলেছে এবং সেগুলোকে সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষার জন্য একটি সমন্বিত একক সনদের সুপারিশ করেছে। কমিশন মনে করে, রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের যে পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে, তাতে করে ব্যক্তির ইচ্ছা প্রতিফলিত হয় বলে কমিশন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছে এবং এক ধরনের নির্বাচকমণ্ডলীর মাধ্যমে যাতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, সেটার সুপারিশ করেছে। কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ সুপারিশ জমা দেওয়ার সময় বলেন, কমিশন আশা করে, সুপারিশগুলোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো এক ধরনের ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়া এবং প্রস্তাবনা
ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানে যে পরিবর্তনগুলো চেয়েছিল, মোটাদাগে তার অধিকাংশই স্থান পেয়েছে সরকার গঠিত কমিশনের সুপারিশে। তবে সংবিধানের মূলনীতি, সংসদের কাঠামোগত পরিবর্তনসহ সবকিছু যে রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়ামতো হয়েছে, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দলগুলোর মূল প্রস্তাব ঠিক রেখে তার সঙ্গে আরও কিছু যুক্ত করে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার পথকে আরও সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে।
ক্ষমতার ভারসাম্য আনার সুপারিশকে রাজনৈতিক দলগুলো ইতিবাচকভাবে দেখছে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি পরিবর্তনের সুপারিশ নিয়ে কোনো কোনো দলের প্রশ্ন রয়েছে। যদিও বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক দলগুলো এখন পর্যন্ত সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে বিএনপির সংবিধান সংস্কারবিষয়ক কমিটির সদস্য ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ একটি পত্রিকাকে বলেন, ‘যেটুকু দেখছি, তাতে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ, ক্ষমতার ভারসাম্য আনার এ ধরনের কিছু বিষয় আমাদের প্রস্তাব থেকে এসেছে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিষয়ে তো আদালত থেকে আগেই রায় এসেছে। কমিশনও সেটা প্রস্তাব করেছে।’ তিনি বলেন, কমিশন প্রস্তাবের সারসংক্ষেপ প্রকাশ করেছে। বিস্তারিত পেলে প্রস্তাবগুলো নিয়ে দলে আলোচনার পর মতামত জানানো হবে।
এ বিষয়ে এখনই মন্তব্য করা সমীচীন নয় বলে মনে করেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। তিনি বলেন, ‘এটা চূড়ান্ত কিছু নয়, কমিশনের প্রস্তাব। সরকার রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের সঙ্গে যখন সংলাপের আয়োজন করবে, তখন সংবিধানের মৌলিক সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে আমরা আমাদের মতামত দেব। তার আগে মতামত দেওয়া সমীচীন হবে বলে মনে করি না।’
বিএনপি গত নভেম্বরে সংবিধান সংস্কার কমিশনে গিয়ে ৬২টি প্রস্তাব দিয়েছিল। এর মধ্যে সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার বিধান করা, উপরাষ্ট্রপতি ও উপপ্রধানমন্ত্রী পদ তৈরি করা, সংসদে উচ্চকক্ষ সৃষ্টি, অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের অধীন রাখা, গণভোটের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করা, প্রজাতন্ত্র, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব উল্লেখযোগ্য। এর আগে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে বিএনপি সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করে। এ ৩১ দফা রূপরেখাকে দলীয় ‘প্রতিশ্রুতি’ উল্লেখ করে বিএনপি সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেয়, তারা নির্বাচিত হলে ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করবে। রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের এ ৩১ দফার মধ্যে সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত আটটি প্রস্তাব রয়েছে। বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতও গত বছর ৮ অক্টোবর ১০ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিল। তখন জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছিলেন, তাদের সংস্কার প্রস্তাব মূলত ৪১ দফা এবং সেটা বিস্তারিত। এ মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য যেগুলো প্রাধান্য দেওয়া দরকার, কেবল সেগুলোই তারা দিয়েছেন। পরে সংবিধান সংস্কার কমিশনে জামায়াত নিজেদের লিখিত প্রস্তাব দেয়। অন্যদিকে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন সংবিধান সংস্কারে কোনো দফা দেয়নি। তারা একটি আদর্শ রাষ্ট্রের চরিত্র কেমন হওয়া উচিত, তার একটি বর্ণনা দিয়েছে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না মনে করেন, ‘কমিশন বড় আকারে যে প্রস্তাবগুলো করেছে, তার মধ্যে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ একটি। এটি বাস্তবায়ন করতে গেলে যত সময়ের প্রয়োজন, এত সময় অন্তর্বর্তী সরকারের আছে কি না। বিএনপি জুলাই-আগস্টে নির্বাচন চাইছে। সরকার বলছে, এ বছরের মধ্যে নির্বাচন করবে। সংসদের উচ্চকক্ষের ১০০ আসনে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন হবে। এর জন্য সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। হাতে যে সময়, এটাকে উচ্চাভিলাষী মনে হয়।’ ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, তারা কমিশনের প্রস্তাব পর্যালোচনার সুযোগ পাননি। তবে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার প্রস্তাব তারা পছন্দ করছেন না। এছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার পাঁচ মূলনীতি সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘বহুত্ববাদ’ নিয়ে তাদের প্রশ্ন আছে। তিনি মনে করেন, গণতন্ত্র থাকলে বহুত্ববাদের প্রয়োজন নেই।
মূলনীতি পরিবর্তনের সুপারিশ নিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিরও (সিপিবি) প্রশ্ন রয়েছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আলোকে বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি নির্ধারণ করা হয়েছিল। এসব মূলনীতি বাদ দিয়ে সংবিধানের কোনো সংশোধনী আনা হলে তা বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, ‘আমরা সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ চারটি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করছি। পর্যালোচনার পর সংবাদ সম্মেলন করে এসব প্রতিবেদনের বিষয়ে আমরা আমাদের বক্তব্য জানাব।’
প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিএনপি ও জামায়াতÑ উভয় দলই সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে সন্নিবেশের কথা বলেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন, সংবিধানে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের’ বিধান যুক্ত করার সুপারিশ করেছে, যা কার্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতোই। এছাড়া জাতীয় সংসদে ৩০০ আসনের নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা (পিআর) চালুর প্রস্তাব করেছিল জামায়াত। সেটি কমিশন বিবেচনায় নেয়নি।
তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাবে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থাটি রেখেছে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদের উচ্চকক্ষে ১০০ সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে। কমিশন বলেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের সংখ্যানুপাতে ১০০ সদস্য নির্ধারিত হবেন।
বিএনপি বলেছে, রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদে উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন করা হবে। সংবিধান সংস্কার কমিশনও এ প্রস্তাবে একমত হয়েছে। তারা প্রস্তাব করেছে, উচ্চকক্ষ মোট ১০৫ সদস্যের হবে। ১০০ সদস্য জাতীয় নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের সংখ্যানুপাতে নির্ধারিত হবেন। এর মধ্যে পাঁচজন সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করবেন। বাকি পাঁচটি আসন রাষ্ট্রপতি মনোনীত করবেন। যারা কোনো কক্ষেরই সদস্য ও রাজনৈতিক দলের সদস্য নন।
জামায়াত সংসদের প্রধান বিরোধীদল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকারের প্রস্তাব করেছিল। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন এ প্রস্তাব রেখেছে সংসদের উচ্চকক্ষের জন্য। কমিশন বলেছে, ‘উচ্চকক্ষের স্পিকার সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন। আর উচ্চকক্ষের একজন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন, যিনি সরকারদলীয় সদস্য ব্যতীত উচ্চকক্ষের অন্যসব সদস্যের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন।’
সংসদ সদস্য প্রার্থী হওয়ার বয়স ২৫ থেকে কমিয়ে ২১ বছর করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। আবার রাজনৈতিক দলগুলোকে কমপক্ষে ১০ শতাংশ তরুণ প্রার্থী দেওয়ার কথা বলেছে কমিশন। এটি সুচিন্তিত প্রস্তাব নয় বলে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলছেন।
সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদকে বাধা মনে করা হয়। বিএনপি আস্থা ভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িতÑ এমন সব বিষয় ছাড়া অন্যসব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করতে ‘৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার’ কথা বলেছে। কিন্তু সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছে, অর্থবিল ছাড়া নিম্নকক্ষের সদস্যদের মনোনয়নকারী দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। এছাড়া আইনসভার স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি সবসময় বিরোধীদলীয় সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হবেন।
নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে বর্তমান ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ সংশোধন করার কথা বলেছে বিএনপি। আর জামায়াত নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে সার্চ কমিটি গঠন চেয়েছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন নির্বাচন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার, অ্যাটর্নি জেনারেল ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধানসহ কিছু পদে নিয়োগের জন্য ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাব করেছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, বিরোধীদলীয় নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়ে এ কাউন্সিল হবে। বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবও কাছাকাছি। এছাড়া সংবিধানের মূলনীতি, সংসদের কাঠামোয় পরিবর্তনসহ সংবিধানের নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।