ভেঙে পড়া ঐকমত্য ফেরাতে প্রচেষ্টা: নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা আনতে পারে অনিশ্চয়তা

তাড়াহুড়ায় বিলম্বিত হতে পারে নির্বাচন


৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:২৭

॥ ফারাহ মাসুম ॥
বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে অতি তাড়াহুড়া- এটিকে অধিকতর বিলম্বিত করতে পারে। এতে সংস্কার ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করার বিষয়টিও বিলম্বিত হতে পারে। এরই মধ্যে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ হরতালসহ বিভিন্ন সহিংসতা সৃষ্টিকারী কর্মসূচি শুরু করেছে। বিএনপি দ্রুত নির্বাচন প্রদান তথা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য কর্মসূচি ঘোষণা করার কথা জানিয়েছে। এতে করে প্রশাসনের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হতে শুরু করেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অন্তর্বর্তী সরকার তার কার্যকারিতা হারাতে পারে। এ অবস্থায় সেনাসমর্থিত আরেকটি সরকার বর্তমান সরকারের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। সেটি হলে পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে অধিকতর অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। একই সাথে বর্তমান সাংবিধানিক শাসনের ধারাবাহিকতাও ব্যাহত হতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইতোমধ্যে নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। সেই রোডম্যাপ অনুসারে স্বল্প সংস্কার করা হলে ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে আর অধিক সংস্কার হলে জুন ২০২৬-এর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে দৃশ্যত এ সময়সূচির বিষয়ে একমত দেখা যাচ্ছে না। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, ২০২৫ সালের জুলাই-আগস্টের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। আর সংস্কার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, এটি নির্বাচিত সরকারই করবে। দলের অন্যতম নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কর্মসূচি ঘোষণারও ইঙ্গিত দিয়েছেন।
বিএনপির এ কর্মসূচি ঘোষণার পরদিনই আওয়ামী লীগ ফেব্রুয়ারি মাসে হরতালসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়। প্রধান রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি পতিত স্বৈরাচারের এ কর্মসূচির কারণে এমন একটি বার্তা যায়, যেন অন্তর্বর্র্তী সরকারের সময় শেষ হয়ে আসছে। এর ফলে বেসামরিক ও নিরাপত্তা প্রশাসনে সরকারি দায়িত্ব পালনে স্থবিরতা দেখা দেয়। এমনিতেই অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরও প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদল করেনি। আগের প্রশাসনের বড় অংশ এখনো রয়ে গেছে মাঠ প্রশাসনে। আর পরিবর্তনের পর যারা প্রশাসনে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের বড় অংশই বিএনপি মনোভাবের। এ অবস্থায় সরকারের কার্যকারিতা প্রশ্নের মধ্যে পড়ে যায়।
অন্যতম বিরোধীদল জামায়াতে ইসলামী মধ্যবর্তী অবস্থান নিলেও সরকারের কার্যকারিতার প্রশ্নটি রয়ে যায়। আবার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতাদের রাষ্ট্র সংস্কার ও ফ্যাসিবাদের বিচারের দাবির বিষয়টিও উপেক্ষা করার সুযোগ থাকেনি। এর আগে অসত্য বক্তব্য দিয়ে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের পদচ্যুতি এবং জুলাই ঘোষণার ব্যাপারে বিএনপির বিরোধিতার কারণে বিএনপির সাথে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের। তাদের মধ্যে এ ধারণাও সৃষ্টি হয় যে, ভারতীয় আধিপত্যবাদের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের বিষয়ে বিএনপির সাথে কোনো সমঝোতা হয়ে থাকতে পারে। এর মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের বক্তব্যের মধ্যেও এক ধরনের বিভাজনের রেখা ফুটে ওঠে। যদিও জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের দ্রুত সংস্কার শেষে ২০২৫ সালের ভেতরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন একটি জাতীয় দৈনিকের সাথে সাক্ষাৎকারে। এ সাক্ষাৎকারে নির্বাচনে জামায়াত এককভাবে অংশগ্রহণ করবে কিনা, তা চূড়ান্ত হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত হবে। নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কোনো দ্বন্দ্ব নেই বলে দাবি করেন তিনি। ডা. তাহের বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচন কীভাবে হচ্ছে, কত তারিখে হচ্ছে- এ ব্যাপারে একটা অনিশ্চয়তা আছে। কিন্তু নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচিত সরকারের হাতেই ক্ষমতা যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কখন এবং কীভাবে- এ ব্যাপারটা এখনো অস্পষ্ট বলে আমরা এখনো কোনো চিন্তা করছি না। জাতীয় স্বার্থে একটা ব্যাপারে চিন্তা করছি, সেটা হচ্ছে- জাতীয় ঐকমত্য।
জামায়াত জাতীয় ঐকমত্যের যে কথা বলছে, বিএনপিও একপর্যায়ে তার প্রয়োজন অনুভব করছে। জুলাই ঘোষণা এখনকার জন্য অপ্রাসঙ্গিক ইস্যু বলে মন্তব্যের পরও প্রধান উপদেষ্টার এ বিষয়ে আহূত বৈঠকে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছে। জুলাই ঘোষণার একটি খসড়াও তারা উপস্থাপন করেছে। তবে এর মধ্যে ছাত্র সমন্বয়কদের সাথে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়ে যায় বিএনপির। ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়েও প্রাথমিকভাবে বিরোধিতা করে পরে দলের শীর্ষনেতৃত্ব থেকে স্বাগত জানানো হয়। তবে বলা হয়, সরকারে থেকে এ ধরনের দল গঠনের অনুমতি দেয়া হলে সরকার নিরপেক্ষতা হারাবে।
একসময় বিএনপি ও জাতীয় পার্টি সরকারে থেকে দল গঠন করলেও এখন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে আরেকটি দল গঠন হোক, সেটি বিএনপি নেতারা চাইছেন না। প্রধান উপদেষ্টা বিদেশি পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকালে ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার রয়েছে বলে মন্তব্য করায় বিএনপির মধ্যে সন্দেহ আরো বেড়ে যায়। এ অবস্থায় বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের বিরোধিতার স্বর আরো বাড়িয়ে তোলে। এতে সরকারের আরেক দফা রূপান্তরের বিষয়টি আলোচিত হতে থাকে। ছাত্র ও পেশাজীবী গ্রুপগুলোর কারণে-অকারণে আন্দোলন এবং তা সহিংসতায় পৌঁছে যাবার নানা ঘটনায় এর পেছনে কেউ ইন্ধন দিচ্ছে কিনা, সে বিষয়টিও সামনে চলে আসে।
আলোচনায় আইকেবির স্ট্যাটাস
এরই মধ্যে সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূইয়ার (আইকেবি) ধারাবাহিক একটি স্ট্যাটাস আলোচনায় চলে আসে। ১৭ পর্বের এই স্ট্যাটাসে তিনি ৫ আগস্টে স্বৈরাচারের পতন কীভাবে ঘটল তার বিস্তারিত বর্ণনা তার মতো করে দেন। এতে একটি বিষয় উঠে আসে যে, ৩ আগস্ট সেনাবাহিনীর সদস্যদের আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করতে অনীহা প্রকাশ এবং গুরুত্বপূর্ণ সেনা ব্যক্তিত্বদের ফেসবুক প্রোফাইল লাল করে আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ এবং কর্মসূচিতে শীর্ষ সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ গণঅভ্যুত্থানকে পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয়। তিনি উল্লেখ করেন, ‘‘২ বা ৩ আগস্ট নাগাদ সব ডিওএইচএস অঞ্চলেই অভিভাবক আর (সেনা) পরিবারগুলো রাস্তায় নামতে শুরু করে, প্রথমে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে। মোড় ঘুরে যায় ৩ আগস্ট বেলা ১:৩০ ঘটিকায় যখন জেনারেল ওয়াকার সেনাপ্রাঙ্গণে জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। কেননা নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশে তারা বিক্ষুব্ধ ছিলেন। তাদের অসন্তোষ অনুভব করে জেনারেল ওয়াকার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তাদের পক্ষে দাঁড়ান। তারপর যদিও বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গায় গুলির ঘটনা ঘটে, যেমনÑ যাত্রাবাড়ীতে, অন্যত্র গুলির মাত্রা অনেকটাই কমে আসে।’’
জেনারেল ইকবাল করিম তার স্ট্যাটাসের ষষ্ঠদশ অংশে আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরিণতির ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘‘একদিন মহাখালী ডিওএইচএস থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আয়ুব ফোন করে জানালেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাফিজ আমার সাথে দেখা করতে চান। তিনি ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মনজুর কাদের মিলে আমার অফিসে আসেন। আমরা ঠিক করলাম, চলমান বিক্ষোভের পক্ষে একটি মিডিয়া ব্রিফিং করব, যা অনুষ্ঠিত হবে রাওয়ায়। আমরা বিভিন্ন বাসায় যাই, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বাড়িতে, যেমনÑ সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নুরউদ্দিন খানের, যিনি ১৯৯০ সালে এরশাদের স্বৈরতন্ত্র উৎখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ৪ আগস্টের এই ব্রিফিং ক্ষমতাসীন সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেয়। তখনো তারা আশা করছিল, হয়তো দেশব্যাপী অচলাবস্থার মধ্যেও কোনোভাবে টিকে যাবে। শোনা যায়, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকী ও শেখ হেলাল ব্রিফিংয়ের বিষয়বস্তু শোনার পর রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যান, হয়তো বুঝতে পারেন, তাদের সময় ফুরিয়ে এসেছে।’’
আইকেবি আরো লেখেন, ‘‘শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্তে আরেকটি মরিয়া চেষ্টা করেন। ৪ আগস্ট রাতে (প্রায় ২৩:০০টায়) গণভবনে সব নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের ডেকে তিনি নির্দেশ দেন, বিক্ষোভকারীদের শেষ দফা আক্রমণে যেমন করে হোক দমাতে হবে। এজন্য একটি বিশদ পরিকল্পনা করা হয়। বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশকে ঢাকার ১৩টি প্রবেশপথ আটকে দিতে বলা হয় এবং সেনাবাহিনীকে শহরের প্রধান এলাকাগুলো দখলে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। সেনাপ্রধান বুদ্ধিমত্তার সাথে এমনভাবে সেনা মোতায়েন করেন, যাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি কম থাকে। তিনি জানতেন, বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই গুলি চালাতে নারাজ। ৫ আগস্ট অসংখ্য মানুষ ঢাকায় ঢুকতে শুরু করলে বাইরের দিকে অবস্থান নেওয়া বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ বাধা না দিয়ে তাদের পথ ছেড়ে দেয়। শহরের ভেতরে থাকা সেনা ইউনিটগুলোও জনতার সাথে মিশে গিয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করে। গণভবন দখল হয়, আর শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে দেশ ছাড়েন, কয়েক মুহূর্তের জন্য জনতাকে থামিয়ে রাখা হয়, যাতে তিনি হেলিকপ্টারে করে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারেন।’’
সপ্তদশ অংশটিতে জেনারেল ইকবাল করিম শেষ সময়টার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘‘শেষ দৃশ্যটা ঘটে সেনাসদরে যেখানে সেনাপ্রধান এবং নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানরা মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর (বিএনপি) ও ডিজি ডিজিএফআই মেজর জেনারেল হামিদের মাধ্যমে পাঁচটি রাজনৈতিক দল আর ঢাবির আইন বিভাগের শিক্ষক আসিফ নজরুলকে ডেকে পাঠান (এটি ছিল একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ। যেখানে বিজিতদের বিজয়ীদের কাছে যাওয়ার কথা, সেখানে উল্টো বিজয়ীরা বিজিতদের কাছে রিপোর্ট করে)। শোনা যায়, সেখানে রাজনীতিবিদরা ও আসিফ নজরুল সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতি ও সংবিধান বহাল রেখে, আগের তত্ত্বাবধায়কের আদলে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশ চালানোর পরামর্শ মেনে নেন। পরে জনসম্মুখে সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার পদত্যাগ ঘোষণা করেন এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দেন। এরপর বঙ্গভবনে, যেখানে ছাত্রনেতারাও উপস্থিত ছিলেন- ড. ইউনূসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ঠিক করা হয়। যে বিপ্লব জোরালোভাবে শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত একটি “অকাল সিজার”র মতো জটিল কৌশলের মাধ্যমে অনেকটাই মিইয়ে যায়, কিছু ক্ষমতাবান লোক মূল নাটের গুরু হিসেবে থেকে যান।’’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘‘যদি আদর্শভাবে ফরাসি ও রুশ বিপ্লবের ন্যায় এ বিপ্লব সম্পূর্ণ সাফল্য পেতে চাইত, তাহলে হয়তো গণভবন ও বঙ্গভবন একযোগে দখল হতো, বিদ্যমান সংবিধান ছিঁড়ে ফেলা হতো, আর আগের শাসনের সহায়তায় যেসব ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা নিষ্ঠুরতা চালিয়েছেন, তাদের সবাই হয় দেশছাড়া হতেন বা বিচারের মুখোমুখি হতেন। গড়ে উঠত একটি বিপ্লবী পরিষদ, যারা নতুন শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার এবং গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করত। তারপর নির্বাচনী গণতন্ত্রে ফেরা যেত। কিন্তু অনভিজ্ঞ বিপ্লবী নেতৃত্ব পুরনো পদ্ধতিতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে পূর্ববর্তী ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়ে। নতুন কোনো ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুযোগ তারা তাই হারিয়ে ফেলে। এ পরিস্থিতিতে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয়, যার ফাঁক দিয়ে অন্য বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া শূন্য জুতায় পা গলিয়ে দ্রুত আরেকটি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে দ্রুত ধাবমান হয়।’’
জেনারেল ইকবাল করিম ভূইয়ার এই ভাষ্যে অনেক ইঙ্গিত সুপ্ত রয়েছে। বিপ্লবের অপূর্ণাঙ্গ থাকার বিষয়টি এখানে সূক্ষ্মভাবে ব্যক্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া শূন্য জুতায় পা গলিয়ে দ্রুত আরেকটি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে দ্রুত ধাবমান হওয়ার বক্তব্যটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। দ্রুত ক্ষমতায় যেতে পতিত শাসনের সাথে সমঝোতায় যাওয়া অথবা প্রতিবেশী দেশের আধিপত্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার সমঝোতা গ্রহণ না করার একটি বার্তাও এতে পাঠ করা যায়। একই সাথে এতে রয়েছে আরেকটি পরিবর্তনের প্রয়োজনের বার্তাও।
নিয়ন্ত্রণ শিথিল হচ্ছে সরকারের?
আওয়ামী লীগ রাস্তায় যতই সহিংস আন্দোলনের প্রচেষ্টা জোরালো করবে আর সে সাথে দ্রুত নির্বাচনের তাড়া থেকে বিএনপি কর্মসূচি ও বক্তব্য জোরালো করবে, ততই কার্যকারিতা হারাতে থাকবে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে সেনা সমর্থিত আরেকটি সরকার অথবা ভিন্ন কোনোু পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠতে পারে। এই পরিবর্তনের একটি বিকল্প হতে পারে একটি জাতীয় সরকার বা জাতীয় ঐকমত্যের সরকার, যেখানে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সরাসরি অংশগ্রহণ থাকবে। ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর এ ধরনের একটি প্রস্তাবের সাথে একমত হয়নি বিএনপি। কিন্তু আবারও একই অবস্থান গ্রহণ করলে ভিন্ন ফলও আসতে পারে, বিএনপি তার প্রাসঙ্গিকতা হারাতে পারে। ক্ষমতার পথ বা প্রশাসনের ওপর পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ থেকে ছিটকে পড়তে পারে দলটি। অন্যদিকে বিএনপির অংশগ্রহণে ঐকমত্যের সরকার হলে ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা কমে যাবে। তবে জুন ২০২৬ সময়ে নির্বাচন সম্ভব হতে পারে। এতে জরুরি সংস্কার কর্মসূচিসমূহ কার্যকর হবার সম্ভাবনা তৈরি হবে। আর ঐকমত্যের সরকারে বিএনপি অংশ না নিলে ওয়ান ইলেভেনের মতো এমন এক সরকার আসতে পারে যে সরকারে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কারোরই নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।
এদিকে জামায়াত নেতাদের কোনো কোনো বক্তব্যে বিএনপির সাথে দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে মনে হলেও সেটি নিরসনে তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য এখন দেখা যাচ্ছে। জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান দূরত্ব তৈরি হবার মতো বক্তব্য সতর্কতার সাথে এড়িয়ে যাচ্ছেন। দ্রুত নির্বাচন নিয়ে বিএনপি’র সঙ্গে জামায়াতের মতবিরোধ নেই বলে জানিয়েছেন নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি কখনো বলে নাই যে, সংস্কার প্রয়োজন নেই। আমরাও কখনো বলি নাই, সব সংস্কার শেষে নির্বাচন দেন। তারা বলছে, সংস্কার করেন জরুরিগুলো। আমাদের কথা হচ্ছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন দেন। আগে সংস্কার নাকি নির্বাচন আগে প্রয়োজন, এ নিয়ে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। আমরা খুব পরিষ্কার বলেছি, ২০২৫ সালের ভেতরেই নির্বাচন দিতে হবে।’’
সরকারের ছয় মাস ও সংস্কার
ড. ইউনূস এবং তার উপদেষ্টারা বলেছিলেন যে, হাসিনার আওয়ামী লীগ প্রশাসনের ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের রাজনীতিকরণ ও ধ্বংসকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়ন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে। এর জন্য সময় লাগবে এবং প্রয়োজন হবে ধৈর্যের। জয়ের আশায় থাকা দেশের বৃহত্তম দল বিএনপি সম্ভবত ধৈর্য হারাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগস্টের শুরুতে, হাজার হাজার বিক্ষোভকারীর দ্বারা নিজ বাসভবনে অবরুদ্ধ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান। প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল মাত্র এক মাস আগে, যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রীয় চাকরির কোটা পদ্ধতিতে পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। হাসিনার অস্থিরতা দমনের নৃশংস প্রচেষ্টা একটি গণ আন্দোলনে রূপান্তরিত হয় যা তাকে তার প্রধানমন্ত্ররি পদ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য করে। তার পতন বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত, কিন্তু বিতর্কিত এবং প্রায়শই সহিংস রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপের কারণে দেশটি বার বার অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা প্রতিষ্ঠা, উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য সমর্থন জোগাড় করা এবং প্রধান রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের মধ্যে ঐকমত্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে ইউনূস দেশে ও বিদেশে যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ইউনূসের প্রশাসনের শুরুতে হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির সময় যে উচ্ছ্বাস ব্যাপক সমর্থনে রূপান্তরিত হয়েছিল, সেই হানিমুন সময় শেষ হয়ে গেছে। শুধু প্রতিশ্রুত সংস্কার নয়, প্রতিদিনের শাসন ব্যবস্থার উন্নতির জন্যও সরকারের ওপর জনগণের চাপ বেড়েছে।
এছাড়া আরেকটি একটি জ্বলন্ত সমস্যা হলো নতুন জাতীয় নির্বাচনের তফসিল। ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন দেশের প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি থেকে নির্বাচনের একটি তারিখ ঘোষণা করার জন্য ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে ছিল, যা বাংলাদেশকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে দেবে। ১৬ ডিসেম্বর ড. ইউনূস বলেছিলেন, ভোট ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে, যার অর্থ তার প্রশাসন দুই বছরেরও কম সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকবে। ঘোষণাটি বেশিরভাগ সমালোচককে চুপ করে দিয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় অনিশ্চিত রয়ে গেছে। একটি উচ্চাভিলাষী সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে ড. ইউনূস এক ডজনেরও বেশি কমিশন গঠন করেছেন, যার মধ্যে একটি সংবিধান সংশোধনের কাজ এবং অন্যটি নির্বাচনী ব্যবস্থা পুনর্গঠনের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। এ কমিশনগুলোর মধ্যে চারটি জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে রিপোর্ট করে ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কারের প্রস্তাব দেয়। ড. ইউনূস নিজেই আরেকটি কমিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যেটি রাজনৈতিক দলগুলোসহ বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির সাথে আলোচনা করবে প্রস্তাবিত সংস্কারগুলোর মধ্যে কোনটি সামনে এগিয়ে নেয়া হবে এবং কোনটি বাতিল বা ভবিষ্যৎ সরকারের কাছে ছেড়ে দেওয়া হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ঐকমত্য রক্ষা করা এ প্রক্রিয়া সফল করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে।
ক্রাইসিস গ্রুপ মনে করছে, হাসিনার আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে নির্বাসিত হওয়ার সাথে সাথে এর নেতারা নির্বাসিত এবং এর কর্মীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিষ্ক্রিয় হওার প্রেক্ষিতে বিএনপি দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তাই বিএনপিকে সরকার ইন ওয়েটিং হিসেবে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশে অনেকেই অবশ্য এ সম্ভাবনা দেখে হতাশ। অতীতে ক্ষমতায় থাকাকালীন; বিশেষ করে বিশ শতকের শুরুতে বিএনপি প্রায়ই হাসিনার আওয়ামী লীগের অনুরূপ স্বৈরাচারী প্রবণতা প্রদর্শন করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার এবং তার সমর্থকদের জন্য এটি একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়। কারণ তাদের সংস্কারের লক্ষ্য দেশকে স্বৈরাচারী দেশে ফিরে যাওয়া থেকে বিরত রাখা। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য জনসাধারণের সমর্থন ড. ইউনূসকে কিছুটা সুবিধা দেয়।
আইসিজির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, রাজনৈতিক ঝাঁকুনির বাইরে অন্তর্বর্তী সরকার অনেক চাপের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। হাসিনা সরকারের প্রতি অসন্তোষের একটি প্রধান কারণ ছিল অর্থনীতির অব্যবস্থাপনা, যার মধ্যে রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি এবং আর্থিক খাতে তার মিত্রদের লুটপাট, একটি সরকারি তদন্তানুসারে যা অন্তত দশটি ব্যাংককে ‘প্রযুক্তিগতভাবে দেউলিয়া’ করে দিয়েছে। ড. ইউনূস যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছিল এবং খাদ্যমূল্যের মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আশা করে যে, প্রবৃদ্ধি আবারও বাড়বে এবং আগামী অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতি অর্ধেকে নামবে। তবে একটি গতিশীল অর্থনীতির জন্য সংস্কারের প্রয়োজন হবে। সেই সংস্কার কতটা করা যাবে, তা অনেকখানি রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতার ওপর নির্ভর করবে বলে মনে হচ্ছে।