ফ্যাসিস্ট ও তার দোসরদের দ্রুত বিচারের মাধ্যমে শহীদের রক্তঋণ শোধ করতেই হবে
৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ০০:০০
অন্যায়, অপরাধ ও দুর্বৃত্তপনা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতেই মানবসভ্যতার সূচনায় রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন যুগে রাষ্ট্র দুর্বৃত্তদের কবলে পড়েছে। প্রাগৈতিহাসিক গোত্রপতি শাসন, রাজতন্ত্র ও সামন্ত যুগে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ প্রক্রিয়ায় এবং আধুনিক যুগে জোরের সাথে যোগ হয়েছে নানা ছল। অর্থাৎ ছলে-বলে দুর্বৃত্তরা রাজনীতির মাঠ থেকে ন্যায়নিষ্ঠদের সরিয়ে দেশ দখল করে সরকার পরিচালনার নামে জনগণের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালায়। এভাবে দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমেই রাষ্ট্র চলে যায় ফ্যাসিবাদী চরিত্রের শোষক শ্রেণির হাতে। কোনো রাষ্ট্র দুর্বৃত্ত ও ফ্যাসিস্টদের কবলমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণকে চোর, ডাকাত, চাঁদাবাজ, খুনি, অসৎ ব্যবসায়ী, প্রতারকসহ সব অপরাধীর অনিষ্ট থেকে নিরাপদ রাখা। এর বিনিময়ে জনগণ বিভিন্ন কর ও ট্যাক্স দিয়ে রাষ্ট্র এবং সরকারকে সচল রাখে। কিন্তু ফ্যাসিবাদী নৈরাজ্যে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখায় দুর্বৃত্তরা। তারা এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে যে, রাষ্ট্র ও সরকার নয়, তারাই নিরাপত্তা দেয়ার মালিক। তাদের চাঁদা না দিলে, তাদের কথা মতো না চললে যে কাউকে তারা শাস্তি দেয়ার; এমনকি হত্যার ক্ষমতা রাখে, রাষ্ট্র তাদের কেশাগ্র পর্যন্ত স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখে না। কারণ তাদের সাথে রাষ্ট্র ও সরকারের বোঝাপড়া থাকে। অবৈধ দুর্বৃত্তরাও এমন ব্যবস্থায় সরকারেরই বর্ধিত অংশ যেন। এভাবে রাষ্ট্র ও সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তি থেকে নিয়ে পুলিশ, প্রশাসন; এমনকি ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূলের পাতিনেতারা পর্যন্ত ক্ষমতার দাপটে জনগণের জান, মাল, সম্পদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ফ্যাসিস্ট সরকার ও রাষ্ট্র এভাবেই প্রতিটি সেক্টরে তার শিকড় বিস্তার করে জনগণকে শোষণ করে, রাষ্ট্রক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায় ও ইনসাফের কবর রচনা করে। ফ্যাসিবাদ উৎখাত করে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে জনকল্যাণের ধারায় ফিরিয়ে আনতে চরম মূল্য দিতে হয়। প্রাথমিক বিজয়ের পর থেমে গেলে আবার ষড়যন্ত্রের পথ ধরে ফ্যাসিবাদ ফিরে আসে। ন্যায় ও ইনসাফের সৈনিকদের চরম শক্র হিসেবে চিত্রিত করে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের নেশায় মেতে ওঠে।
আমাদের দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, দেশের রাজনীতির মাঠে ফ্যাসিবাদী দুর্বৃত্তদের একটি গোষ্ঠী আদি থেকেই সক্রিয়। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে কম-বেশি হয়তো আছে। তবে রাজনীতি মানেই সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, জনগণের সম্পদ দখল এমন মানসিকতার গোষ্ঠীর সমষ্টি পতিত আওয়ামী লীগ- এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ যেদিন থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে কথিত ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্ম ও নৈতিকতা বাদ দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মোড়কে পৌত্তলিকতাবাদকে নিজের করে নিয়েছে এবং তাদের আদর্শ প্রচারের বদলে অন্যের মিছিল-মিটিংয়ে হামলার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী দর্শনের পূজারি হিসেবে প্রমাণ করেছে। প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থতার দায় মেটায় হত্যা-খুন ও গুমের নির্মমতায়। এমনকি নিজ দলের আদর্শবানরাও তাদের প্রতিহিংসা থেকে রেহাই পায় না। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মিটিংয়ে হামলা, প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হককে গুম এবং পল্টন ময়দানে ১৯৭০ সালে জামায়াতে ইসলামীর মিটিংয়ে হামলা চালিয়ে দুজনকে হত্যার মধ্য দিয়ে হত্যা-সন্ত্রাসের কলঙ্কিত রাজনীতির যে সূচনা এ ফ্যাসিস্ট দলটি করেছে, তার সাথে মিলে যায় নাৎসি হিটলার ও ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির রাজনীতি। জাতীয় সংসদের স্পিকারকে হত্যা করার মতো নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টিকারী দলটি গণতন্ত্রের নামে অনেক ভণ্ডামি করেছে। আর নয়, এবার সব ফ্যাসিস্টের মুখোশ উন্মোচনের মাধ্যমে দ্রুত তাদের বিচার নিশ্চিত করতেই হবে। তবেই বাংলাদেশ সত্যিকারের কল্যাণরাষ্ট্রে পরিণত হবে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলের নামে সংগঠিত কোনো সন্ত্রাসীগোষ্ঠী চ্যালেঞ্জ ঘোষণার সাহস পাবে না। ক্ষমতার পরিবর্তন হবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত স্বচ্ছ ও ভয়ভীতিহীন জনগণের ভোটে। এজন্য অবশ্যই নির্বাচনে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবেÑ যেন কোনো চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, প্রতারক ব্যবসায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ না পায়।
ইতোমধ্যে নোবল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের দাবি পূরণে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। জনগণের প্রত্যাশা তারা এর মাধ্যমে পরীক্ষিত ফ্যাসিস্ট অপশক্তির রাজনীতিতে ফিরে আসার পথ বন্ধ করবে। সত্যিকারের ত্যাগী, জনদরদি ও দেশপ্রেমিকদের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনবেন। যারা রাজনীতিকে বিনা পুঁজির ব্যবসা মনে করে, সেই সব চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্তরা চিরতরে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত হবে। আমরা মনে করি, জনগণের এ প্রত্যাশা পূরণ করতে ফ্যাসিস্ট ও তার দোসরদের দ্রুত বিচারের বিকল্প নেই। রাজনীতির চাদরের আড়ালে চোর-ডাকাতরা সম্মানের উঁচু আসন আঁকড়ে থাকার দিন ২০২৪-এর ৫ আগস্টের পর শেষ হয়ে গেছে। শহীদের ঋণহীন এ প্রত্যাশা বাস্তবায়নের মাধ্যমে পূরণ করতেই হবে।