নিয়োগে অসতর্কতায় বিতর্ক-ক্ষোভ
২৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:৫৩
নেপথ্যে তদবির নাকি বাণিজ্য? নানা প্রশ্ন
॥ সৈয়দ খালিদ হোসেন ॥
দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সবসময় মুক্ত বিদ্যাচর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের দীর্ঘ শাসনামলে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার চেয়ে আধিপত্য বিস্তারে বেশি সময় ব্যয় করেছে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা। ছাত্র রাজনীতির নামে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে অন্য দলের কর্মী-সমর্থক এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের পণবন্দী করে রেখেছিল। কেউ মতের বাইরে গেলে সীমাহীন তাণ্ডব চালানো হতো। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সবসময় আতঙ্কে দিন কাটাতেন। শিক্ষকদের একটি বিরাট অংশ জড়িয়েছে রাজনীতিতে। কেউ সরাসরি, কেউ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আওয়ামী ফ্যাস্টিস সরকারের পক্ষাবলম্বন করেছেন। সরকারি প্রভাব খাটিয়ে লুটপাট করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের অর্থ। আবার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় নানা অজুহাতে দখলে নিয়ে নেয় ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হিসেবে পরিচিত শিক্ষক ও তাদের স্থানীয় দোসররা। আবার কেউ কেউ শিক্ষা খাতের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দলীয় ক্যাডার ও কর্মীর মতো কাজ করে হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ অপচেষ্টা চালান। এসব দোসর এখন আবার সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কাউকে ম্যানেজ করে বা নিয়োগ বদলি ও পদায়ন বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের অর্থের মাধ্যমে ম্যানেজ করে এখনো গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকছেন অনেকে। এখনো বিগত ফ্যাসিবাদের দোসরদের ম্যানেজ করে যারা নানা কায়দায় পদে রয়েছেন বা পদায়ন নিচ্ছেন, তাদের কেউ কেউ পদ ছাড়তে বাধ্যও হয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- একটি বিপ্লবের পর নতুন সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পূর্বের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা না নিয়ে কেন নিয়োগ দিচ্ছে? এখানে দেশের স্বার্থের বাইরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে কিনা তা নিয়েও ভাবনা রয়েছে।
কীভাবে আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্টরা এখনো গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন, তার একাধিক নজির রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ড. খোন্দকার কামাল হাসান। যিনি বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন ওএসডি হন। কেন ওএসডি হন? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছিলেন এ অধ্যক্ষ। আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট এ অধ্যক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন ও দুর্নীতির অভিযোগে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন। এরপর তাকে ওএসডি করা হয়। কিন্তু খোন্দকার কামাল হাসান ওএসডি হওয়ার মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে সেই বিতর্কিত ব্যক্তিকে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে পদায়ন করে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভও দেখা দেয়। প্রশ্ন ওঠে এ বিতর্কিত ব্যক্তির জন্য কে বা কারা তদবির করেছিলেন। এখানেও কী পরিমাণে বাণিজ্য হয়েছিল? অবশ্য যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে বেশি দিন টিকতে পারেননি তিনি। যোগদানের ১০ দিনের মাথায় ওএসডি হন অধ্যাপক ড. খোন্দকার কামাল হাসান। গত ১৯ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব মাহবুব আলমের স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে অধ্যাপক খন্দকার কামাল হাসানকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে।
জানা যায়, ১৪তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ব্যাচের খোন্দকার কামাল হাসান ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে মেহেরপুর সরকারি কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে বদলি হন। ২০১১ সালে বগুড়ার গাবতলী সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। ৫ বছর পর সরকারি আজিজুল হক কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক পদে বদলি হন। ২০১৮ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০২১ সালের এপ্রিলে মেহেরপুরের মুজিবনগর সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন।
অভিযোগ রয়েছে, মেহেরপুরের মুজিবনগর সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকালে আওয়ামী লীগের তৎকালীন এমপি ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী পরবর্তীতে মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিতি পান। তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। তৎকালীন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সুপারিশেই ২০২৩ সালে ১৪ নভেম্বর বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন খোন্দকার কামাল হাসান। যোগদানের পর ১৮ নভেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ঐ সময় শ্রদ্ধা নিবেদন ও কবর জিয়ারতের ছবি কলেজের অফিসিয়াল ফেসবুক আইডি ও স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় বিতর্কিত ভূমিকায় ছিলেন খোন্দকার কামাল হাসান। এছাড়া ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই কলেজ প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীদের ওপর ককটেল হামলা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কামাল হাসান ছাত্রলীগের পক্ষে অবস্থান নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ১১ মাস অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিতর্কিত ভূমিকা ও আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেন শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয় অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল করিম ও দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয় অধ্যাপক স ম আব্দুস সামাদ আজাদকে। গত ১৯ জানুয়ারির এক প্রজ্ঞাপনে এ দুই চেয়ারম্যানকেও ওএসডি করা হয়। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল করিমকে ওএসডি করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকায় সংযুক্ত করা হয়েছে। আর ২০২৩ সালের ৬ জুন দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেছিলেন অধ্যাপক স ম আব্দুস সামাদ আজাদ। তাকেও ওএসডি করে সরকার। এ দুই বোর্ড চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিগত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।
এর আগে গত ২ জানুয়ারি সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে ছয় ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। ১০ দিনের ব্যবধানে পিএসসির সদস্য পদে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ছয় ব্যক্তির নিয়োগের আদেশ বাতিল করা হয়। তারা হলেন- অধ্যাপক শাহনাজ সরকার, মো. মুনির হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ এফ জগলুল আহমেদ, মো. মিজানুর রহমান, শাব্বির আহমদ চৌধুরী ও অধ্যাপক সৈয়দা শাহিনা সোবহান। গত ১৩ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে এ নিয়োগের আদেশ বাতিল করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘এই ছয় ব্যক্তি এখনো শপথ গ্রহণ করেননি। ছয় ব্যক্তির নিয়োগ বাতিলের আদেশ জনস্বার্থে জারি করা হয়েছে’।
কিন্তু কেন পিএসসির এ ৬ সদস্য বাদ পড়লেন? কেন নিয়োগে সরকার আরও সতর্ক থাকল না? এমন প্রশ্ন ওঠেছে সর্বত্র। এ ইস্যুটি সরকারের জন্যও অনেকটা বিব্রতকর। ২ জানুয়ারি নিয়োগ পাওয়া পিএসসির নতুন এ ছয় সদস্যদের শপথ স্থগিত চেয়ে ৮ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল পিএসসি। পিএসসির অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন ছয় সদস্যের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান স্থগিত করেন সুপ্রিম কোর্ট। সূত্র জানিয়েছে, নতুন নিয়োগ পাওয়া সদস্যদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার কারণে তাদের শপথ স্থগিত করা হয়। নতুন নিয়োগ পাওয়া কয়েকজন সদস্য বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় এ সমালোচনা হচ্ছিল। এ ছয়জনকে নিয়োগে সতর্ক ছিল না সরকার। ওই ছয়জনের কেউ কেউ আগের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। কেউ মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বিগত সরকারের যে সিদ্ধান্তগুলো পরে সমালোচনা হয়, সেই পদে ছিলেন ও অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। ফলে পিএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিয়ে আন্দোলনের স্পিরিটকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। এতে সরকারও বিব্রত।