রমজানে ওমরাহ টিকিটের মূল্য আকাশছোঁয়া
১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ১৯:৩২
॥ সাইফ রহমান ॥
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ১৬ বছরের সিন্ডিকেট এখনো অনেক সেক্টরের মতো এয়ারলাইন্স সেক্টরে সক্রিয় রয়েছে। সিন্ডিকেটের যোগসাজশে রমজান মাস সামনে রেখে ওমরাহ টিকিটের মূল্য এখন আকাশছোঁয়া। সৌদি এয়ারলাইন্স এবং বিমান বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশের ভিত্তিতে অন্য এয়ারলাইন্সগুলোও ওমরাহ টিকেটের মূল্য বাড়িয়েই চলছে। অপরিমেয় সাওয়াব ও দোয়া কবুলের আশায় যখন অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসলমান পবিত্র মাহে রমজানে ওমরাহ পালনের জন্য বুকিং দিয়ে বসে আছেন, তখন দফায় দফায় এয়ারলাইন্সের টিকিটের মূল্যবৃদ্ধি রমজানে ওমরাহ পালন অনিশ্চিত করে তুলেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পবিত্র মাহে রমজানের প্রায় দুইমাস আগেই ওমরাহ টিকিট নিয়ে শুরু হয়েছে লঙ্কাকাণ্ড। দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে টিকিট মূল্য কোনো কারণ ছাড়াই। দেশীয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সিস্টেমে টিকিট বিক্রির ঘোষণা দিলেও ওমরাহ এজেন্সিগুলো মাসের পর মাস ঘুরেও সিস্টেমে কোনো ওমরাহ টিকিট পাচ্ছে না। অথচ অতিরিক্ত মূল্য দিলেই মিলছে টিকিট। মধ্যপ্রাচ্যগামী বিমানের টিকিটের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মী ও ওমরাহ যাত্রীদের টিকিট কিনতে নাভিশ্বাস উঠছে। ঢাকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যগামী কর্মীরা ওয়ানওয়ে টিকিট বর্তমানে ৮০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এদিকে বিদেশি সৌদি এয়ারলাইন্স আগামী ১ মার্চ রমজানের ঢাকা-জেদ্দা-ঢাকা রুটের ওমরাহ টিকিটের দাম ৮০০ মার্কিন ডলার থেকে ৮১৫ মার্কিন ডলার ঘোষণা দিয়ে সার্কুলার জারি করেছে। কিন্তু অফিসিয়াল এ সার্কুলারে কোনো টিকিট দেয়া হচ্ছে না। এর মাত্র এক দিন পরই ঢাকাস্থ সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের অফিসের সেলস বিভাগের ম্যানেজার মি. শুভ সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা তোয়াক্কা না করেই দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের যোগসাজশে রমজানের ওমরাহ টিকিটের মূল্য ৮৮০ মার্কিন ডলার থেকে ৯০০ মার্কিন ডলার করে ট্রাভেলস ও ওমরাহ এজেন্সিগুলোর কাছে ই-মেইল করেছে। রমজান আসার আগেই কোনো কারণ ছাড়াই ওমরাহ টিকিটের আকাশচুম্বী মূল্য বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে একাধিক ওমরাহ এজেন্সি মালিক জানান, সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের সেলস বিভাগের কর্মকর্তা মি. শুভ, সেলস প্রতিনিধি মিসেস সিফাত ও নাজমুল রমজানে ওমরাহ টিকিটের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ওমরাহ গমোনিচ্ছুদের জিম্মি করে এ অতিরিক্ত মূল্য নিচ্ছেন। এ ব্যাপারে জানতে সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের সেলস প্রতিনিধি সিফাত ও নাজমুলের মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাদের পাওয়া যায়নি।
ভুক্তভোগীরা জানান, বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর টিকিটের ভাড়া নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা না থাকায় অহরহ ওমরাহ টিকিটের দাম বাড়ছে। ফলে টিকিটের অতিরিক্ত টাকা জোগাতে ওমরাহযাত্রী ও বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। সৌদিকে ওয়ান ওয়ে যে ভাড়া প্রতিবেশী ভারতে মাত্র ৪০ হাজার টাকা সে ভাড়া বাংলাদেশ থেকে সৌদি এয়ারলাইন্স নিচ্ছে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ বিমানের আরেকটি সিন্ডিকেট। বিপুল চাহিদা থাকার পরও বিমান বাংলাদেশ রমজানে ফ্লাইট বাড়াচ্ছে না কিংবা দেশীয় যাত্রীদের কথা বিবেচনায় টিকিটের দাম কমাচ্ছে না। আর এতে সুযোগ নিচ্ছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো। সালাম এয়ার ফ্লাইট দুবাই, এরাবিয়া এসব এয়ারলাইন্সগুলোর টিকিটের দাম কিছুদিন আগেও ছিল ৬০-৬৫ হাজার টাকা। কিন্তু তারাও এখন যাত্রীদের জিম্মি করে টিকিটে দাম হাকাচ্ছে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। যতই রমজান এগিয়ে আসছে, ততই এয়ারলাইন্সগুলো দাম বাড়িয়েই চলছে।
বাংলাদেশ হজযাত্রী ও হাজী কল্যাণ পরিষদের চেয়ারম্যান ড. আব্দুল্লাহ আল নাসের এ প্রসঙ্গে বলেন, পবিত্র রমজানে মহিমান্বিত কদর এবং রমজানটি মক্কা-মদীনায় অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানই পালন করতে চান। তাই এ সময় স্বাভাবিকের চেয়ে এয়ারলাইন্সগুলো একটু বেশি চাপ থাকে। আর এ সুযোগে এয়ারলাইন্সগুলো অস্বাভাবিক চাহিদা দেখিয়ে দফায় দফায় ওমরাহযাত্রীর টিকিটের দাম বাড়াচ্ছে। তিনি বলেন, সাউদিয়া এয়ারলাইন্স ওমরাহযাত্রীদের টিকিটের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়েছে। এটা ওমরাহযাত্রীদের সাথে জুলুম করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের জুলুম থেকে ধর্মপ্রাণ ওমরাহযাত্রীরা বাঁচতে চায়। বিমানসহ বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো যাত্রীদের টিকিটের দাম বৃদ্ধি করে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বাংলাদেশি ওমরাহ গমনেচ্ছু ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ওমরাহ পালনটি নিরবচ্ছিন্ন করতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ধর্ম উপদেষ্টার সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেন এবং বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সিন্ডিকেটগুলো নির্মূলে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।
এ প্রসঙ্গে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ফারাহ ইমতিয়াজ জানান, রমজান মাস এলে ওমরাহযাত্রীদের প্রচণ্ড চাপ থাকে। আর এ সুযোগে অধিকাংশ এয়ারলাইন্স তাদের বেসিক ইকোনমি ক্লাসের টিকিটগুলো বিক্রি বন্ধ করে অতিরিক্ত দাম ধরে ইকোনমি ফ্লেক্সি এবং ইকোনমি প্রিমিয়াম ক্লাসের দাম নিচ্ছে। প্রতি বছরই এমন হয়ে থাকে। তবে সবাই আশা করেছিল এবার অন্তত এই সিন্ডিকেট ভাঙবে। এদিকে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওমরাহযাত্রীদের গন্তব্য সাধারণত সৌদি আরবের জেদ্দা অথবা মদিনা। বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবের এ দুই রুটে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করে কেবল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও সৌদি এয়ারলাইন্স। বিমান ও সৌদি টিকিট সিন্ডিকেট এয়ারলাইন্সগুলো প্রতি টিকিটে ৪০-৪৫ হাজার টাকা বেশি নিচ্ছে। বিমান বাংলাদেশ ও সৌদি ছাড়াও থার্ড ক্যারিয়ার বলে কথিত এয়ার অ্যারাবিয়া, এমিরেটস এয়ারলাইন্স, ফ্লাই দুবাই, গালফ এয়ার, জাজিরা এয়ারওয়েজ, কুয়েত এয়ারওয়েজ, কাতার এয়ারওয়েজ, এয়ার ইন্ডিয়া, ভিস্তারা এয়ারলাইন্স, ওমান এয়ার এবং সালাম এয়ার বাংলাদেশ থেকে যাত্রী নিয়ে নিজ দেশে ট্রানজিট দিয়ে সৌদি আরবে ওমরাহযাত্রী পৌঁছে দেয়। ট্রানজিট ও যাত্রার লম্বা সময়ের কারণে এসব ফ্লাইটের ভাড়া তুলনামূলকভাবে কম ছিল। তবে রমজান মাসকে কেন্দ্র করে তারাও ফ্লাইটের দাম দেড় থেকে দুইগুণ বৃদ্ধি করেছে। থার্ড ক্যারিয়ারগুলোর ৬০ হাজার টাকার ওমরাহ টিকিট এখন ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হজ এজেন্সি নেতৃবৃন্দ। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ ওমরাহযাত্রীর টিকিটের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ওমরাহ এজেন্সি ও যাত্রীদের মাঝে অহরহ বাগবিতণ্ডা হচ্ছে। ওমরাহযাত্রীরা চড়া দামে টিকিট কিনতে গিয়ে অতিরিক্ত টাকা জোগাতে হিমসিম খাচ্ছেন। তারা দ্বারে দ্বারে ঘুরেও সহনীয় পর্যায়ের ওমরাহ টিকিট পাচ্ছেন না। সব মিলিয়ে রমজানে ওমরাহ গমনেচ্ছুকদের মাঝে চরম অনিশ্চয়তা ও চরম ভোগান্তির মধ্যে রয়েছেন।