জনগণের প্রত্যাশা ঐক্য ও সংহতি
১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:১১
॥ জামশেদ মেহ্দী ॥
গত ১১ জানুয়ারি শনিবার সন্ধ্যার পর বিএনপির গুলশান অফিসে (এটি বেগম জিয়ার অফিস, অর্থাৎ বিএনপি চেয়ারপারসনের অফিস) প্রথমে তাদের মিত্র ১২ দলীয় জোট এবং তারপর তাদের অপর মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চের সাথে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনা বেশ লম্বা সময় ধরে চলে। বিএনপির তরফ থেকে বলা হয় যে, এ সরকার সহজে নির্বাচন দেবে না। সংস্কার এবং স্থানীয় সরকারের নাম করে তারা নির্বাচনকে দীর্ঘায়িত করতে চায়। উদ্দেশ্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি মিলে যে রাজনৈতিক দল করবে, সেই রাজনৈতিক দল যেন কিছুটা সময় পায়। ওরা যদি কিছু সময় পায়, তাহলে সারা দেশে ওদের দলের শাখা গঠিত হবে এবং আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য তাদের ঘর গুছিয়ে নেয়ার সময় পাবে। তাদের মিত্র দুই জোটের একটি জোট বিএনপির এ মতের সাথে পুরোপুরি একমত হতে পারেনি। এ জোটের নেতা বলেন, এ সরকার এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জনপ্রিয়তা কমে গেছে বলে বিএনপি যা মনে করছে, সেটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। ৫ আগস্ট এবং পরবর্তী কয়েকদিন ছাত্র নেতাদের যে বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল, সেটা হয়তো কিছুটা কমে গেছে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারা যে একেবারে অজনপ্রিয় হয়ে গেছে, সেটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়।
বিএনপির তরফ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয় যে, কালবিলম্ব না করে অবিলম্বে আমাদের রাজপথে নামতে হবে এবং দ্রুত ও সংক্ষিপ্ততম সময়ে নির্বাচন সমাপ্ত করতে হবে। সরকার সহজে তাড়াতাড়ি নির্বাচন দেবে না। তাই রাজপথে নেমে এটি আদায় করতে হবে। এ পর্যায়ে তাদের মিত্র অপর জোটের নেতা প্রশ্ন করেন- রাজপথে নামলেই যে সেই আন্দোলন পূর্ণ সফলতা লাভ করবে, তার গ্যারান্টি কী? এভাবে এ মুহূর্তে আন্দোলনে নেমে পড়ার প্রশ্নে বিএনপি এবং তার শরিকদের মধ্যে মৃদু মতানৈক্য দেখা দেয়। তবে উভয় জোটেরই শীর্ষনেতারা মনে করেন, তাদের জোটভুক্ত দলগুলোর সব শীর্ষনেতা তেমন পরিচিত নন এবং তাদের কারোরই গণভিত্তি ব্যাপক ও সংগঠিত নয়। দু-একজনের হয়তো ফেসভ্যালু রয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে দলীয় প্রতীক নিয়ে বিএনপির সমর্থন ছাড়া তাদের নির্বাচনে জেতা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। তাই বিএনপির সাথে তারা সম্পূর্ণ একমত না হলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় এ মুহূর্তে বিএনপিকে রুষ্ট করা তাদের জন্য সমীচীন হবে না।
যাই হোক, দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর স্থির হয় যে, জানুয়ারির মধ্যে যদি সরকার দিন-তারিখসহ নির্বাচনের রোডম্যাপ বা পথরেখা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা না করে তাহলে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে অথবা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে তারা রাজপথের আশ্রয় নেবেন। এ পর্যায়ে তাদের অন্যতম মিত্র বলেন যে, ফেব্রুয়ারিতে আন্দোলন কতটা জমে উঠবে, সেটা নিয়ে কিছু সন্দেহ আছে। কারণ তাদের মতে, ফেব্রুয়ারি হলো ভাষার মাস। অপর এক নেতা বলে ওঠেন যে, ফেব্রুয়ারিতে যদি আন্দোলন শুরু করা না যায়, তাহলে মার্চ মাস তো স্বাধীনতার মাস। আওয়ামী লীগ এখন বলতে গেলে দেশে নেই। কিন্তু কিছু বুদ্ধিজীবী এবং তাদের কয়েকটি সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট মার্চ মাসকে স্বাধীনতার মাস বলে সভা-সমাবেশ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালাবে। এসব প্রচারণায় বক্তব্য পরিষ্কার না করলেও যারা বোঝার তারা ঠিকই বুঝে যাবেন, এসব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতার প্রধান টার্গেট হলো এ সরকার এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এসবকিছু বিবেচনা করে ঠিক হয় যে- জানুয়ারির শেষে বা ফেব্রুয়ারির শুরুতে টেস্ট কেস হিসেবে রাজপথে নামা দরকার। রাজপথে নামলেই সরকার এবং ছাত্ররা ও নাগরিক কমিটিসহ সকলেই বুঝে যাবেন, বিপ্লবের সাড়ে ৫ মাস পর কার জনপ্রিয়তা কতটুকু। টেস্ট কেস হিসেবে রাজপথে নেমে জনগণের মধ্য থেকে যদি ভালো সাড়া পাওয়া যায়, তাহলে বিএনপি পূর্ণ শক্তিতে রাজপথে নামবে।
বিএনপির আগামী দিনের পরিকল্পনা সম্পর্কে তার একাধিক মিত্রের সাথে কথা বলে যা জানা যায়, সেখান থেকে এ ধারণা করা যায়, প্রতিটি ইস্যুতে সরকারের সাথে বিএনপির মতদ্বৈধতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিরোধিতা জনগণ তেমন ভালো চোখে দেখছে না বলেই তারা মনে করেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বলেন যে, বিএনপি তো শুরু থেকে দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র তাড়াতাড়ি নির্বাচন নয়, বরং আরো অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যুতেও তারা সরকারের অবস্থানের বিরোধিতা করছে। এ বিরোধিতার সর্বশেষ ইস্যু হলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন। সরকার চেয়েছিল, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েকদিন আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক। এ নির্বাচন আওয়ামী লীগ আমলের মতো দলীয় প্রতীকের অধীনে হবে না। সরকার, ছাত্র নেতা ও নাগরিক কমিটির সূত্র থেকে জানা গেছে যে, অনেক সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদের অনেক নেতা ও সদস্য অফিস করছেন না। হয় তারা বিদেশে পালিয়ে গেছেন অথবা আন্ডারগ্রাউন্ডে আছেন। কারণ যাই হোক, তাদের অনুপস্থিতির কারণে জনগণ নৈমিত্তিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এদের প্রায় সকলেরই আওয়ামী লীগের সাথে সংশ্লেষ ছিল অথবা আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতা ও কর্মী ছিলেন। ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর জনতার রুদ্ররোষে পড়ার ভয়ে হয় এরা বিদেশ পালিয়ে গেছেন অথবা বিপুল সংখ্যায় আত্মগোপনে গেছেন। তাদের অনুপস্থিতিতে জনসেবা বিঘ্নিত হওয়ায় সরকার সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে এসব সংস্থায় প্রশাসক নিয়োগের চিন্তাভাবনা করছে।
বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোরবিরোধিতা করছে। বিএনপির ভয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করে অধিকাংশ কর্পোরেশন ও মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের নির্বাচনে চেয়ারম্যান এবং কাউন্সিলরদের মেজরিটি যদি জামায়াতে ইসলামী এবং শিগগিরই গঠিতব্য দল থেকে আসে, তাহলে তার একটি ইতিবাচক প্রভাব জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর পড়বে। তাই তারা প্রথমে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং তারপর স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়।
কিন্তু সেই একই বিএনপি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজসমূহে ছাত্র সংসদের নির্বাচনে যে অবস্থান নিয়েছে, সেটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গৃহীত তাদের অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে দাবি জানিয়েছিল যে, অনতিবিলম্বে ডাকসু এবং হলসমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হোক। তাদের এ দাবির সাথে সহমত পোষণ করে ইসলামী ছাত্রশিবির। কিন্তু বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল অতি শিগগিরই ডাকসু ও হলসমূহে নির্বাচনের তীব্র বিরোধিতা করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সাথে দেখা করে তাদের অবস্থান জানায়। অনুরূপভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে করার সব প্রস্তুতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও বাধ সেধেছে ছাত্রদল। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসমূহে দ্রুত নির্বাচনের বিরোধিতা করে ছাত্রদল যে যুক্তি দেখাচ্ছে, সেটি স্ববিরোধী। তারা বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহেরও কিছু সংস্কার প্রয়োজন। সে সব সংস্কার কাজ সম্পন্ন করার আগে নির্বাচন দেয়া উচিত হবে না। দেশের নির্বাচন এবং ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বিএনপি এবং ছাত্রদল ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নিয়েছে। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, বিএনপি মনে করে যে, জাতীয় সংসদের আর্লি ইলেকশন বা তাড়াতাড়ি নির্বাচন হলে বিএনপি বড় জয় নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। তাই তারা দেশে তাড়াতাড়ি নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজসমূহে তাড়াতাড়ি নির্বাচন হলে ছাত্রদল হেরে যাবে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ইসলামী ছাত্রশিবির জয়লাভ করবে। তাই তারা নির্বাচন দেরিতে চাচ্ছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, বিএনপি এ মুহূর্তে দৃশ্যমানভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দল। আবার একই সাথে গত জুলাই-আগস্টের বিপ্লব এবং পরবর্তীতে ব্যাপক জনকল্যাণমূলক কাজে নিজেদের নিয়োজিত করার ফলে জামায়াতে ইসলামীর জনপ্রিয়তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে বিপ্লবের কাণ্ডারি হিসেবে জনগণের মাঝে পরিচিতি পাওয়ায় এবং গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হওয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরও উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়তা রয়েছে। যখন নির্বাচন আসবে, তখন জনগণ যাদের পছন্দ করবেন, তাদের ভোট দেবেন এবং অন্যান্য দল মেজরিটি পার্টিকে মেনে নেবে। এটাকেই বলা হয় স্পোর্টসম্যান স্পিরিট।
কিন্তু বিএনপি স্পোর্টসম্যান স্পিরিট নিয়ে যদি এসব ইস্যু বিবেচনা করত, তাহলে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু তারা সরকার, জামায়াত এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের সাথে যে আচরণ করছে এবং তাদের যে ভাষায় বিরোধিতা করছে, তার ফলে সেই স্পোর্টসম্যান স্পিরিট হারিয়ে গেছে এবং আন্দোলন এবং বিপ্লবে তাদের সহযাত্রীদের সাথে তাদের মতানৈক্য প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। এখন প্রায় প্রতিটি গণমাধ্যমে লেখা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে যে, আন্দোলনের মাধ্যমে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, সেই ঐক্য এখন আর নেই। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। বিএনপি যদি দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে নামে এবং ছাত্ররা যদি বিএনপির দাবির বিরোধিতা করে রাজপথে নামে, তাহলে রাজনৈতিক অঙ্গন আবার অস্থির হবে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।
আগামী ১৯ জানুয়ারি কেয়ারটেকার সরকার ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রিভিউ পিটিশনের শুনানি হবে। ঐদিনই রায় ঘোষিত হবে বলে জনগণ মনে করেন। মানুষের ধারণা, ঐ শুনানিতে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকবে। সেক্ষেত্রে কেয়ারটেকার সরকার আবার ফিরে আসবে। কেয়ারটেকার সরকার ফিরে এলে ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের স্ট্যাটাস কী হবে? আগামী নির্বাচন কার অধীনে হবে? কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন? আগের কেয়ারটেকার ব্যবস্থায় বর্তমান প্রধান বিচারপতির আগের বিচারপতি প্রধান উপদেষ্টা হতেন। কোনো কারণে প্রধান বিচারপতি অসমর্থ হলে আপিল বিভাগের সিনিয়র মোস্ট বিচারপতি প্রধান উপদেষ্টা হবেন।
আলোচ্য ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি রেফাত আহমেদের আগের বিচারপতি হলেন ওবায়দুল হাসান। তার আগের বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তার আগের বিচারপতি মাহমুদ হাসান। ওবায়দুল হাসানকে তো ছাত্র-জনতা সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও করে বিতাড়িত করেছেন। তাহলে কে হবেন কেয়ারটেকার সরকার প্রধান?
আরো সমস্যা আছে। সেগুলো পরবর্তীতে আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ। ওপরের আলোচনার পটভূমিতে বলা যায় যে, বিপ্লবের স্বপক্ষের শক্তিদের মাঝে এ মুহূর্তে অনৈক্য এবং আওয়ামী লীগের ভাষার মতো অন্য সহযোগীদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার কোনোভাবেই কাম্য নয়। সরকার বনাম বিএনপি, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বনাম বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী বনাম বিএনপি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এক কথায় দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বিরোধ কাম্য নয়। জনগণের প্রত্যাশা ঐক্য ও সংহতি।