প্রকৃতিবিজ্ঞানে রাসূল মুহাম্মদ সা.-এর অবদান


১০ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:০০

মনসুর আহমদ : মানবসভ্যতা তার বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে বর্তমানে বিজ্ঞানের যুগ অতিক্রম করে চলছে। চারদিকে আজ বিজ্ঞানের জয়জয়কার। এ জয়োল্লাসের মহাসমারোহে আমাদের ভাবিয়ে তুলছে বিজ্ঞানের জয়কেতন ওড়াতে মুসলিম সমাজ কেন এত পেছনে? তবে কি বিশ্বমানবতার জন্য জ্ঞানের আধার মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ আল কুরআন এ ব্যাপারে নিশ্চুপ? না, এ ব্যাপারে কি নীরব রয়েছেন ইসলামের পূর্ণতা প্রদানকারী কালশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ সা.?
রাসূল সা. এলেন বিভ্রান্ত মানবজাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে টেনে আনতে, মানুষের চরিত্রের পূর্ণতাবিধান করে একটি উন্নত ও সুন্দর জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবসভ্যতাকে উন্নতির চরম শীর্ষে পৌঁছাতে। কিন্তু তাঁর এ মিশন চ্যালেঞ্জবিহীন ছিল না। বিভিন্ন বিরোধীশক্তি তাঁকে পদে পদে বাধা দিয়েছে। ফলে রাসূলকে সদা ব্যস্ত থাকতে হয়েছে দীন প্রতিষ্ঠার ও বিজয়ের সার্বিক প্রচেষ্টায়, যেটি ছিল তার প্রধান ও মৌলিক কাজ। দীন প্রতিষ্ঠার মূল দায়িত্ব ব্যতীত মানবজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোনো দিকে নজর দেয়ার সুযোগ তার ঘটেনি, আর এ দায়িত্ব তাঁকে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদানও করা হয়নি। আর এ একই কারণে তার সঙ্গী-সাথী সাহাবাগণও জীবনজগতের বিভিন্ন দিকে বেশি জড়িয়ে পড়েননি। যে কারণে তাঁদের সময় তাঁদের মাধ্যমে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো অবদান লক্ষ করা যায় না।
প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখায় মুসলমানরা চিন্তা ও গবেষণার সুযোগ পেল উমাইয়া যুগে, যার চরম উন্নতি ঘটে আব্বাসীয় খলিফাদের কালে। ইসলামের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুসলিমরা হয়ে উঠেছিলেন এককালে গোটা বিশ্বে বিজ্ঞানের শিক্ষাগুরু (The Master of science)।
অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত মুসলমানরা বিশ্বকে উপহার দিল গণিতবিদ আল-খাওয়ারিজমী, পদার্থবিদ আবু আলী আল হাসান ইবনে হাইসাম, চিকিৎসাবিদ হুনাইন ইবনে ইসহাক, আর-রাজী, ইবনে সীনা প্রভৃতি বিজ্ঞানীদের।
তাঁরা জড়বাদী ছিলেন না। তাদের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির মূল উৎস ছিল আল্লাহর সৃষ্ট বিশ্বজগৎকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার বাসনা, বস্তুজগৎকে আত্মিকজগতের মতো গুরুত্ব প্রদান, আরব মনের বাস্তবতাবাদ এবং সৃষ্টিকে জানার অদম্য কৌতূহল। ইসলাম ধর্ম ও বিজ্ঞান আলাদা পথ ধরে অগ্রসর হয়নি, বরং প্রথমটি দ্বিতীয়টিকে উৎসাহ জুগিয়েছে। মুসলমানরা পাশ্চাত্যের মতো বিজ্ঞানকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেননি। তারা সব কাজে ধর্মীয় চেতনা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন, ফলে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা -নিরীক্ষা কাজে কোনো সময় ক্লান্ত হননি। তাদের সামনে ছিল রাসূলের আদর্শ ও আল্লাহর বিজ্ঞানময় ‘কিতাবুল হাকিম’ পবিত্র আল কুরআন, যা তাঁদেরকে এ পথে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন কালের বিভিন্ন দেশের ধর্মপ্রবর্তক, প্রচারকদের জীবন নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায় যে, রাসূল মুহাম্মাদ সা. ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনায় সকলের শীর্ষে। বিজ্ঞানের গবেষণা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় রাসূল সা.-এর জীবনী ও বাণী অতলান্ত শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করছে। প্রথম যুগের মুসলমানরা যত দিন এ ঐশী উৎস থেকে তৃষ্ণা নিবারণের চেষ্টা চালিয়েছিলেন ততদিন তারা ছিলেন বিশ্বসভ্যতার শিক্ষাগুরু, কিন্তু যখনই এ পবিত্র উৎস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তখন তাঁরা তাদের উজ্জ্বল গৌরব হারালেন, পেছনে পড়ে রইলেন।
কুরআন যেমন কোনো প্রযুক্তিবিজ্ঞানের কিতাব নয়, তেমনি রাসূল সা. ও আধুনিক বিজ্ঞানের পরিভাষায় কোনো বিজ্ঞানী নন। প্রকৃতপক্ষে সাধারণভাবে বিজ্ঞানী হওয়া রিসালতে বৈশিষ্ট্যের খেলাপ। কিন্তু রাসূল হিসেবে তিনি আমাদের যে বাণী শুনিয়েছেন তার মাঝে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কিত যে সব তত্ত্ব পেশ করা হয়েছে তা গ্রহণের মাঝেই রয়েছে মানবতার সভ্যতা-সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির মূল উপাদান। আমরা যদি রাসূলকে বিজ্ঞানী বিবেচনা না করে জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী রূপে মেনে নিয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার কী অবদান রয়েছে, তা খুঁজে আমাদের জ্ঞান ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করি, তা হলে আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের হারান গৌরব ফিরে পেতে পারি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উন্নতি ও অগ্রগতি সাধনে প্রয়োজন মৌলিক গবেষণা অনুবাদের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতির চিন্তা ও গবেষণার সাথে পরিচিতি লাভের মাধ্যমে জ্ঞান ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধশালী করা। রাসূল সা. এ দুটি ধারায় কাজ করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। যেমন হজরত জায়েদ বিন সাবেত (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল সা. আমাকে সিরিয়ান ভাষা শেখার জন্য আদেশ দেন। অন্য এক হাদিসের বর্ণনায়, তিনি আমাকে ইহুদিদের অক্ষর শিখতে আদেশ দেন এবং বলেন, ইহুদিদের লেখার ওপর আমার আস্থা নেই। সুতরাং তাদের ভাষাও শেখ অক্ষরও শেখ।
এ হাদিসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমল করেছিল প্রথম যুগের মুসলমানরা। আল-মামুনের শাসনকালে (৮১০-৮৩৩) এ নতুন জ্ঞানচর্চা শীর্ষে পৌঁছে। আল-মামুন বাগদাদে একটি অনুবাদ কেন্দ্র স্থাপন করেন। সেখানে একটি লাইব্রেরি ছিল। হুনাইন ইবনে ইসহাক (৮০৯-৮৭৭) সেখানকার অন্যতম অনুবাদক ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক ও চিকিৎসাবিদ। গ্রিকদের বহু বই তিনি অনুবাদ করেন। এ গ্রন্থগুলো সেকালের আরবি শিক্ষার অঙ্গ ছিল। এগুলো ছিল ওষুধ, দেহের ওপর ওষুধের প্রভাব ইত্যাদি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত পুনরাবৃত্তি।
মানুষ জ্ঞান লাভ করে বোধি (Intuition), ভুয়োদর্শন (Experience) ও যুক্তির (Reason) মাধ্যমে। রাসূল সা.-কে আল্লাহ জ্ঞান দান করেছেন বোধির বিশেষ প্রক্রিয়া ওহি বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে। এই ওহির জ্ঞান প্রয়োগও যুক্তি বিরোধী নয়। বরং মানব সমাজকে সর্বাবস্থায় সুসামঞ্জস্য, সুন্দর ও সুস্থ রাখার প্রয়োজনে ওহির জ্ঞানের ছিল তীব্র প্রয়োজন। রাসূল সা. ওহির জ্ঞানের আলোকেই মানব জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথ দেখান।
কুরআনের ধারণা অনুযায়ী মানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রই জ্ঞান চর্চার আওতাভুক্ত। পবিত্র কুরআন শুধুমাত্র আদেশ নিষেধের ধারা সম্বলিত কোনো আইন পুস্তক নয়, কুরআন কেবলমাত্র মানুষের কামনা বাসনা ও আধ্যাত্মিক চাহিদার বিষয় নিয়েই নয় বরং তার চার দিকের প্রাণী, উদ্ভিদ, পশু জগৎ, মাথার ওপরের নীলাকাশের শূন্যজগৎ, পায়ের নিচে মাটি ও সীমাহীন সাগর জগৎ সব কিছুর ব্যাপারে মানুষকে ভাবতে শিখায়। আল্লাহ এরশাদ করেন, “নিশ্চয় আসমানসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং দিবারাত্রির পরিবর্তনে জ্ঞানী লোকদের জন্য বহু নিদর্শনাবলী রয়েছে। যারা দাঁড়ানো, বসা অথবা শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে ওঠে, হে আমার প্রতিপালক! এসব তো তুমি বৃথা সৃষ্টি করনি। তুমি অতি মহান; পবিত্র। সুতরাং আমাদের জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা কর। (সূরা আলে ইমরান : ১৯০-১৯১)।
কুরআনের এ আয়াতে রয়েছে বিশ্বপ্রকৃতিকে জানার তাগিদ। এ বিজ্ঞানময় আয়াত মানুষ শুধু তেলাওয়াত করে যাবে, এ নিয়ে কোনো চিন্তা ভাবনা করবে না এটা রাসূল সা. পছন্দ করেননি। তিনি কুরআনের এ ধরনের প্রাকৃতিক বিজ্ঞান সম্পর্কিত আয়াতগুলোকে গবেষণার আওতায় আনার জন্য নির্দেশ দিলেন এই বলে, ‘অয়লুন লেমান কারায়াহা ওয়া লাম ইয়াতা ফাক্কার ফিহা’- ধ্বংস তো তাদের জন্য যারা এ আয়াত। পড়ল., কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো চিন্তা ভাবনা করল না। বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য এমন কড়া তাগিদ ও সাবধান বাণী আর কোনো মহাপুরুষ উচ্চারণ করেছেন বলে জানা নেই।
মহাবিশ্বকে জানার তাগিদ দিয়ে আল্লাহ বলেন, “যিনি সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে সাত আকাশ। দয়াময় আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি কোনো খুঁত দেখতে পাবে না, আবার তাকিয়ে দেখ, কোনো ত্রুটি দেখতে পাও কি? অতঃপর বার বার দৃষ্টি ফিরাও, সেই দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে”। (সূরা মুলক : ৩-৪)।
এমন সুস্পষ্ট আয়াত সামনে থাকার পরেও কেন মুসলমান আলেমগণ নিজেরা গবেষণা কর্মে নিয়োজিত থাকছেন না ও অন্যদের এ কর্মে উৎসাহিত করছেন না তা খুব ভাবিয়ে তোলে।
মহাগ্রন্থ আল কুরআন মানুষকে জানিয়ে দিচ্ছে তার ক্ষমতার সীমা কতটুকু। মানুষ বিশ্বের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ও নিয়ন্তা নয়। তা বোঝাবার জন্য মানুষকে প্রাকৃতিক ঘটনা বৈচিত্র্য, দিবা-রাত্রির আবর্তন, আগুন, পানি, মাটি, বাতাসের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও তাদের কর্মপদ্ধতি, মানুষের জন্ম-মৃত্যু, একটি জাতির বিকাশ ও বিলুপ্তি, প্রকৃতির নীতি ও বিধান পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসব বস্তুকে কীভাবে মানব কল্যাণে নিয়োজিত করা যায় তার জন্য চিন্তাভাবনা করার হুকুম দেয়া হয়েছে কুরআন পাকে। পৃথিবীর এতসব উপায় উপকরণের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিন্তা ও গবেষণা করার আহ্বান জানিয়ে কুরআন ঘোষণা দিয়েছে, “ইহাতে নিদর্শন রয়েছে ঐ সব লোকদের জন্য যারা চিন্তা করে; যারা শ্রবণ করে আর যারা গবেষণা (লি কওমিন ইয়াতাফাক্কারুন) করে। (সূরা নাহল : ১)।
যখন অন্যান্য ধর্মপ্রকৃতির বিরাট শক্তিকে আজগুবি কাহিনীর মাধ্যমে খেল-তামাশার বিষয় বানিয়েছে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুক্ত চিন্তায় বাধা দিয়ে বৈজ্ঞানিক, দার্শনিকদের নানাভাবে হত্যা করা হয়েছে, জেলে আবদ্ধ করেছে, আগুনে পুড়ে মেরেছে, তখন আমরা দেখতে পাই উম্মী রাসূল মুহাম্মদ সা.কে বিজ্ঞানের জ্ঞান সাধনায়রত মানবসন্তাদের মহাকল্যাণের খোশ-খবর দিতে। রাসূল সা. বলেন, ‘আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে এক ঘণ্টা নীরব সাধনা, চিন্তা-গবেষণা এক বছরের উপাসনার চেয়ে উত্তম।’ তিনি আরও বলেন, ‘জ্ঞান সাধকদের কথা কোনো এবং অন্যদের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রেরণা সৃষ্টি ধর্মীয় উপাসনা অনুশীলনের চেয়ে মহত্তর।’
রাসূল সা. আরো এরশাদ করেন, “এক মুহূর্তের চিন্তাভাবনা সত্তর বছরের ইবাদতের চাইতে মঙ্গলকর” (কানযুল হাকায়েক)
রাসূল সা. শুধু বাণীর মাধ্যমেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণায় মুসলমানদের উৎসাহিত করেই ক্ষান্ত হননি। বরং বিভিন্ন সময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবলম্বনে তার অনুসারীদের প্রযুক্তিমুখী করে তুলেছেন। জীবন জিজ্ঞাসার বিভিন্ন জওয়াবে এক জন পাকা বিজ্ঞানীর ন্যায় উত্তর দিয়ে মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পরিপক্ব বিজ্ঞানী হওয়ার পথ বাতলিয়ে দিয়েছেন। ব্যবহারিক জীবনে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে তিনি মোটেই অস্বীকার করেননি। বরং বাস্তব জীবনে তা অবলম্বন করে উৎসাহ জুগিয়েছেন এ পথে অধিকতর অগ্রগামী হওয়ার।
রাসূল সা. যুদ্ধ ক্ষেত্রে পাথর ছোড়ার যন্ত্র ম্যানজানিক, ঢাকনাযুক্ত বিভিন্ন গাড়ি, ঢাল, বর্ম ব্যবহার করেছেন। সেনা শিবিরকে নিরাপদ রাখতে পরিখা খনন রাসূলের প্রযুক্তিজ্ঞানের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত। শুধু তাই নয়, শত্রুকে লক্ষ করে পাথরের কৃত্তিম বস্তু নিক্ষেপ, কাটাযুক্ত গাছের ডালপালা নিক্ষেপ তার উন্নত প্রযুক্তি অবলম্বনের সাক্ষী। বিদেশ থেকে সমরাস্ত্র জোগাড় না করে নিজেরা তৈরি ও উন্নতি বিধানের লক্ষ্যে তিনি উৎসাহ জুগিয়েছেন। এ ব্যাপারে বনু আহকান গোত্রের সুখ্যাতি ছিল সর্বজনবিদিত। অবশ্য প্রয়োজন বোধে উন্নত সমরাস্ত্র সংগ্রহে তিনি অনীহা প্রকাশ করেননি। যেমন সিরিয়ার মাশরাফী ও ভারতের মুহান্না তরবারী সেকালের আরবদের খুবই প্রিয় ছিল। এভাবে তিনি বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মুসলমানদের একটা সৃষ্টিশীল জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
রাসূল সা. মানবের নৈতিক জীবনের উন্নতির সাথে সাথে মানুষকে ভ্রান্তিমুক্ত করে প্রাকৃতিক জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার বহু উদাহরণ রেখে গেছেন। যেমন সেকালের মানুষ চাঁদকে দেবতা হিসেবে মেনে চলতো। কিন্তু রাসূল সা. মানুষের এ ধারণা পাল্টে দিতে ঘোষণা দিলেন যে, ‘চন্দ্র-সূর্য আল্লাহর মাখলুক ব্যতীত কিছু নয়। এদের নেই কোনো ভালো-মন্দ করার ক্ষমতা।’ আল্লাহর রাসূল নতুন চাঁদ দেখে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! এই চাঁদ আমার জন্য আমল, ঈমান এবং নিরাপত্তার শান্তির চাঁদ হোক। হে চাঁদ! তোমার ও আমার রব আল্লাহ।’ এভাবে রাসূল সা.-এর বিভিন্ন দোয়ার মধ্যে রয়েছে অনন্ত জগৎ ঘিরে মানুষের ভাবনার বিষয়। রাসূল সা. তাঁর অনুসারীদের বিশ্বব্যবস্থাপনা নিয়ে চিন্তা গবেষণা করার অনুভূতি জাগ্রত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই তো দেখা যায়, এক বার তাঁকে প্রশ্ন করা হলো সূর্যের গতিবিধি সম্পর্কে, শীত-গ্রীষ্মের আবর্তন নিয়ে, মানব জন্মের রহস্য নিয়ে। রাসূল সা. সেসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন রাসূল হিসেবে, প্রকৃতিবিজ্ঞানী হিসেবে নয়। তবুও তাঁর জবাবের মাঝে প্রকৃতিবিজ্ঞানের গভীর রহস্যের ইঙ্গিত প্রদান করে মানুষের মুক্ত বুদ্ধিকে শাণিত করে বিজ্ঞানের গবেষণায় প্রয়োগের উৎসাহ যুগিয়েছেন।
হজরত আবু জর গিফারী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. এরশাদ করেন, “জানো সূর্য অস্তমিত হয়ে কোথায় যায়? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন। তিনি বললেন, সূর্য গিয়ে আরশের নিচে সিজদা করে এবং অনুমতি চায় আবার পূর্ব দিকে উদিত হবার অনুমতি দান করা হয়। এমন একসময় আসবে যখন সে সিজদা করবে এবং অনুমতি প্রার্থনা করবে; কিন্তু তাকে অনুমতি দেয়া হবে না। তাকে নির্দেশ দেয়া হবে, ফিরে যাও। তখন সে পশ্চিম দিকে উদিত হবে। অতঃপর রাসূল সা. এ আয়াতটি পড়েন : ‘সূর্য তার কক্ষ পথে পরিভ্রমণ করছে, এটি হচ্ছে সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ আল্লাহর নির্দেশ।’ এটি ছিল একটি কালোপযোগী হাদিস। হাদিসে রাসূল হিসেবে তিনি খবর দিলেন মহাবিশ্বের সব কিছু একমাত্র আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলছে। সর্বত্র সার্বভৌমত্ব বিরাজ করছে একমাত্র আল্লাহর। সত্যের এ নিগূঢ় তত্ত্ব প্রকাশের সাথে মহাবিশ্বের সব কিছু যে নিজস্ব কক্ষ পথে পরিভ্রমণশীল, প্রকৃতির এ রহস্যের ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন রাসূল সা. টলেমী, কোপার্নিকাস এবং জে. কেপলারের বহু বছর আগে।
রাসূল সা. শুধু মাত্র ধর্ম সম্পর্কিত উত্তর দিয়েছেন তা নয়, বরং তাঁর কাছে যে প্রকৃতি বিজ্ঞানের জটিল প্রশ্ন আসত, তা থেকে স্পষ্ট অনুমেয় যে, প্রিয় নবী তাঁর কথা ও কাজে বিশ্বমানবতাকে উন্নতির শিখরে তোলার জন্য যে ধরনের জ্ঞান-বিজ্ঞানের খবর রাখা প্রয়োজন তার রহস্য উন্মোচন করে অনুসারীদের সামনে চলার উপাদান ও আদর্শ রেখে গেছেন।
হাদিস শাস্ত্রে প্রকৃতিবিজ্ঞানের বিভিন্ন অধ্যায়ের মাঝে এর অগণিত প্রমাণ বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ মানববংশ রহস্য সম্পর্র্কিত একটি হাদিস তুলে ধরা যেতে পারে। একবার জনৈক ইহুদি আলেম রাসূলকে সন্তান জন্ম সম্পর্র্কিত একটি প্রশ্ন করলে জওয়াবে তিনি বলেন, “পুরুষের বীর্য সাদাটে এবং নারীর বীর্য হলুদ হয় এবং পৃরুষের বীর্য নারীর বীর্যের ওপরে আধিপত্যশালী হলে তখন আল্লাহর হুকুমে পুত্রসন্তান জন্ম লাভ করে। আর যখন নারীর বীর্য পুরুষের বীর্যের ওপরে আধিপাত্যশালী হয়, তখন আল্লাহর হুকুমে কন্যাসন্তান জন্ম গ্রহণ করে। রাসূলের এ জওয়াবের রহস্য আজ বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে নতুন বংশ গতিবিদ্যা ব্যখ্যা করতে সক্ষম হয়েছে।
বর্তমান বংশ গতিবিদ্যা বলে যে, মানুষের দেহে ছেলে মেয়ের উভয়ের জনন কোষে ২৩টি করে অণুবীক্ষণিক ক্রোমোজম তন্তু রয়েছে। আর তাদের মিলনের ফলে তৈরি হয় ৪৬টি ক্রোমোজম যুক্ত নিষিক্ত ভ্রুণ কোষ। যৌন ক্রোমোজমগুলোকে x ক্রোমোজম ও y ত্রোমোজম নামে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। x ক্রেমোজমে স্ত্রী যৌন এবং y ক্রোমোজমে পুরুষ যৌন জীন সমষ্টি অবস্থিত থাকে। মায়ের যৌন কোষের x ক্রোমোজমের সাথে যখন বাবার X ক্রোমোজম যোগ হয়, তখন দুটি ক্রোমোজম যুক্ত সন্তানটি হয় মেয়ে। আবার মায়ের x ক্রোমোজমের সাথে যদি বাবার y ক্রোমোজম যুক্ত হয়, তখন সে সন্তান হয় ছেলে। তাহলে দেখা গেল যে, ছেলের জন্য প্রয়োজনীয় ক্রোমোজম y, যা শুধু মাত্র বাবার জনন কোষে বিদ্যমান থাকে। এ তথ্য থেকে রাসূলের কথা বাবার বীর্য অধিক শক্তিশালী হলে ছেলে সন্তান পয়দা হবে এ কথা প্রমাণিত হয়।
এভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাওয়া যাবে যে, রাসূলের বাণীতে বিদ্যমান ছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত। তাছাড়া রাসূল কোনো বিশেষ শাখার প্রতি জোর না দিয়ে সাধারণভাবে জ্ঞান অর্জনের জোর তাগিদ দিয়েছেন। রাসূল সা. ফরমান, “জ্ঞান অর্জন কর। কেননা, জ্ঞানবান লোক ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে পারে। জ্ঞান বেহেশতের পথ আলোকিত করে। আমরা কখনো বন্ধুহীন হয়ে পড়লে জ্ঞানই থাকে একমাত্র সহায়। তা আমাদের সুখলাভের পথে পরিচালিত করে। দুর্দিনে তা আমাদের সবাইকে দুঃখ কষ্ট সহ্য করার শক্তি দেয়। শত্রুর বিরুদ্ধে তা অস্ত্রের মতো কাজ করে আর বন্ধু মহলে তা শোভা বৃদ্ধি করে। তা দিয়ে আল্লাহ বিভিন্ন জাতির মর্যাদাকে উন্নীত করেন ও তাদের উত্তম কর্মজীবনে পথ প্রদর্শকরূপে গড়ে তোলেন ও নেতৃত্ব দেন। ফলে অন্যরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, তাদের কাজ অনুকরণ করে। তাদের মতামতকে মেনে নেয় ও শ্রদ্ধা করতে থাকে।” (ইবনে আবদ-আল বার : ফাদল আল ইলম)।
এভাবে আল্লাহর রাসূল ধর্মীয় উপাসনা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও জ্ঞানের সাধনাকে চেতনার এক সমতলে নিয়ে এসেছেন। তিনি কোনো অলৌকিকতা আশ্রয়ী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাননি, তিনি চেয়েছেন বাস্তব জীবন ও মানবিক প্রয়োজনকেন্দ্রিক জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে। তাই মানবিক প্রয়োজনে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক উপেক্ষা না করে বরং এদিকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। আমাদেরও তাই উচিত বিজ্ঞানের প্রগতি ও উন্নতির জন্য কুরআন হাদিস বেশি বেশি গবেষণা করা ও আধুনিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অধিকতর জ্ঞান সাধনার প্রচেষ্টা চালান। ওহি জ্ঞান বিবর্জিত নিউটন, আইনস্টাইন, কেপলার প্রমুখ যদি জগৎকে জ্ঞানের আলো দিতে পারেন, তবে ওহির জ্ঞানসমৃদ্ধ মুসলিমগণ কেন এত পেছনে পড়ে থাকবে? মুসলিম পণ্ডিতগণ যদি প্রথম যুগের মুসলিম বিজ্ঞানীদের অনুসরণ করেন, তাহলে প্রকৃতি জগতের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়ে আমাদের আল্লাহর মহিমা, বিধিবিধান ও তাঁর সার্বভৌমত্বের কাছে আত্মসমর্পণের অধিকতর শক্তি জোগাবে।
আল্লাহ তাঁর বান্দার জন্য জিকর ও বিশ্ব ব্যবস্থাপনার ফিকর তথা গবেষণাকে সমান গুরুত্ব প্রদান করে পাঠিয়েছেন। আমাদের উচিত এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিস্থাপন করে উভয়ের সাধনায় নিজদের নিয়োজিত করা। তাহলে সম্ভব ইসলামের মানবিক প্রগতিমুখী বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। তাই রাসূলের পথ ধরে এগোলেই বলতে পারব, “রব্বানা মা খালাক্তা হাজা বাতেলাÑ প্রভু হে! তুমি এসব বৃথা সৃষ্টি করনি। তুমি পবিত্র, আর তুমি আমাদের ধ্বংসের অনল কুণ্ড থেকে রক্ষা কর।”