জামায়াতে ইসলামী ও ক্ষমতার রাজনীতি


১০ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:০০

॥ শামসুন্নাহার নিজামী ॥
‘যার বিয়ে তার মনে নেই, পাড়া-পড়শির ঘুম নেই’ প্রবাদটা বেশ প্রচলিত। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে রাজনীতি করে। দলটি ক্ষমতায় যেতে পারবে কি না- এটা নিয়ে অনেকেরই মাথাব্যথা। জামায়াত ক্ষমতায় না যাক- এটা তারা চায়। কিন্তু তারা ক্ষমতায় গেলে তাদের মাথাব্যথার কারণ তো অনেক। জনগণের ঘাড়ের ওপর বসে অন্যায়ভাবে নিজেদের কর্তৃত্ব-নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী বড় বাধা। কারণ জামায়াত আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারা আল্লাহর আইন ও সৎলোকের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। কাজেই যারা নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ক্ষমতার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাদের জন্য জামায়াতে ইসলামী বড় বাধা।
অনেকে থকর করেন, জামায়াত কখনো ক্ষমতায় যেতে পারবে না। জামায়াত কি সত্যিই ক্ষমতায় যেতে চায়। যদি চাইতই, তাহলে এ দলের নেতৃত্ব পাওয়ার পর আমীরে জামায়াতসহ সর্বস্তরের নেতারা শপথের সময় কেন কান্নায় ভেঙে পড়েন? আসলে এটা নেতৃত্ব নয়, বরং দায়িত্বের বড় বোঝা কাঁধের ওপর এসে পড়ে। যে দায়িত্বের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত ওমর ফারুক (রা.)। তিনি বলেছেন, ফোরাতের কূলে একটা কুকুরও যদি না খেয়ে মারা যায়, তার জন্য ওমরকে জবাবদিহি করতে হবে। এটা একটা আমানত। ঈমানের ঘোষণা দেওয়ার পর যেমন এ আমানত থেকে সরে থাকার সুযোগ নেই, তেমনি সঠিকভাবে পালন করা ছাড়াও কোনো পথ নেই। বোখারী শরীফের হাদীসে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সবাই আমানতদার আর এ আমানতের ব্যাপারে সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে।’ একটা দলের দায়িত্বের বোঝা যারা বহন করতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন, তাদের পক্ষে গোটা দেশের দায়িত্বের বোঝা বহন করার খায়েশ কেমন করে হবে? কিন্তু এ কাজটা তাদের করতে হয় ঈমানের দাবি পূরণের জন্য।
ইসলামী আন্দোলন তথা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ আল্লাহ ফরজ করেছেন। আর ইসলামী আন্দোলনের সর্বশেষ ও চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে নেতৃত্বের আমূল পরিবর্তন করে মানুষের সমাজে সব দিক এবং বিভাগে অসৎ, পাপিষ্ঠ লোকদের নেতৃত্ব নির্মূল করে সেই জায়গায় সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। কুরআন ও হাদীসে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের এটাই একমাত্র উপায়। কাজেই এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতার রাজনীতি করে না, বরং সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, আমাদের একমাত্র অনুকরণীয় আদর্শ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে। যিনি ছিলেন মানুষের প্রতি কল্যাণকামী, রহমদিল। আল্লাহর ভাষায়, ‘তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল এসেছেন। তোমাদের যা কিছু বিপর্যস্ত করে, তা তার জন্য কষ্টকর। সে তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি অতীব দয়ালু, পরম করুণাময়।’ (সূরা আত তাওবা : ১২৮)।
কুরআনের ঘোষণা মতে, রাসূল (সা.)-এর পর উম্মতে মুহাম্মদী হিসেবে এটা আমাদের দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন, ‘এভাবে আমি তোমাদের একটি মধ্যমপন্থি জাতি হিসেবে গড়ে তুলেছিÑ যাতে করে তোমরা গোটা মানবজাতির জন্য সত্যের সাক্ষ্যদাতা (বাস্তব নমুনা) হতে পার এবং রাসূল (সা.) যেন তোমাদের জন্য সাক্ষ্য বা নমুনা হন।’ (সূরা আল বাকারা)।
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য সত্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়াও।’ (সূরা আল মায়েদা : ৮)।
এর থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় জামায়াত শুধুমাত্র ক্ষমতার রাজনীতি করে না। বরং আল্লাহর হুকুম পালন করে।
সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ.) এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এরপর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম হয়। এ দলের সূচনালগ্নে তিনি বলেছিলেন, আমরা এমন এক ভূখণ্ড চাই, যেখানে আল্লাহর সার্বভোমত্ব থাকবে। পাকিস্তান ইসলামের নামে অর্জিত হলেও সেখানে ইসলাম কায়েম হয়নি। এজন্য তখনো জামায়াতে ইসলামীকে আন্দোলন-সংগ্রামে থাকতে হয়েছে। জেল-জুলুমের শিকার হয়েছে। এরপর ১৯৭১-এ ভারতের অভিভাবকত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হোক- এটা জামায়াত চায়নি। কী কারণে, সেটা ২০২৪-এ মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে জামায়াত বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিয়ে এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্রপ্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। ইতিহাস সাক্ষী কোনো স্বার্থের জন্য নয়- ঈমানী দায়িত্ব হিসেবে তারা তাদের এ দায়িত্ব পালন করেছে।
জামায়াতের অসংখ্য বই-পুস্তক, নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে এসব বিষয় সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। শত জুলুম-নির্যাতনের মুখেও তারা পিছু হটেনি। এ দেশপ্রেম ঈমানের দাবি। লোকদেখানোর জন্য বা দুনিয়ার কোনো স্বার্থ উদ্ধারের জন্য নয়, বরং আদালতে-আখিরাতে আল্লাহর কাছে জবাবদিহির জন্য। আমরা নিজেরা প্ল্যান করে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করিনি। বরং আল্লাহ আমাদের এদেশে পাঠিয়েছেন। তাই এদেশের মানুষ, সৎ, যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করার কাজ আমাদেরই করতে হবে। আর এভাবেই এদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে হবে।
কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে যেহেতু আমরা পরিচালিত, কাজেই সেটা নির্ভুল। মানুষ হিসেবে আমাদের কর্মকাণ্ডে যদি ভুল থাকে, তাহলে আল্লাহ তাওবার রাস্তা খোলা রেখেছেন। সংগঠনের কাজ পরিচালিত হয় পরামর্শের ভিত্তিতে। বলা হয়ে থাকে- যারা এস্তেখারা এবং পরামর্শের ভিত্তিতে চলে, তাদের লজ্জিত হতে হয় না।
ইসলাম কারো ব্যক্তিগত বা দলগত বিষয় নয়। এটা বিশ্বমানবতার মুক্তি সনদ। আর এটা এসেছে সেই মহান আল্লাহর কাছ থেকে, যিনি মনের গোপন বিষয়টিও জানেন। অনেক ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা এমন এক বাংলাদেশে অবস্থান করছি, যেখানে আমরা স্বাধীনভাবে নিজের কথা বলতে পারছি। কিন্তু স্বাধীনতার শত্রুরা ওত পেতে আছে এটা নস্যাৎ করার জন্য। ঐক্যবদ্ধভাবে এর মোকাবিলা করে গড়ে তুলতে হবে কাক্সিক্ষত সোনার বাংলা। যেখানে মানুষকে আর অধিকার বঞ্চিত হতে হবে না।