সম্পাদকীয়

ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়, জাতীয় স্বার্থ সবার আগে


২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:৫২

শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন না করে শুধু ব্যক্তি ও দলের ক্ষমতার পালাবদলে আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না- এটা আজ প্রমাণিত। দীর্ঘ দেড় দশকের হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে শেষ হয়েছে। হাসিনা পালিয়েছেন, তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের অধিকাংশ গণহত্যার অপরাধে কারাগারে, নয়তো আত্মগোপনে। অনেকে দেশ ছেড়েছে। কিন্তু জনগণের সম্পদ লুটের মাধ্যমে বিত্তবৈভব গড়ার যে নিকৃষ্ট নজির ফ্যাসিবাদের দোসররা রেখে গেছে, সেই রোডম্যাপ অনুসরণ করে একটি বড় রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে সংগঠিত দুর্বৃত্তরা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাই এমনভাবে নষ্ট হয়ে গেছে যে, রাজনীতি এখন আর শুধু বিনা পুঁজির ব্যবসা নয়, জনগণের ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভোগদখলের জমিদারির সনদ লাভের মতো হয়ে গেছে দুর্বৃত্তদের কাছে। তাই ব্যক্তি বদল হলেও সনদ হস্তান্তর ছাড়া জনগণের আর কোনো লাভ হয় না। পৃথিবীর টেকসই গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো এদেশের মানুষ কবে রাজনীতির নামে জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া দুর্বৃত্তদের হাত থেকে মুক্তি পাবে? সেই প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলেও সমাধানে রাজি নয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী।
রাজনীতিতে কবে আবার আসবেন নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক গোলাম আযম, শামসুল হকের মতো ত্যাগী ব্যক্তিরা, যারা জমিদারি, পৈতৃক ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিক্রি করে দেশ ও জনগণের সেবার মানসে রাজনীতি করেছেন। রাজনীতি তাদের কাছে ছিল জনগণের কল্যাণে দাতব্য বিষয়, ব্যবসা নয়। আমরা মনে করি, দেশের রাজনীতি সেই ধারায় ফিরিয়ে আনলেই হানাহানি, চাঁদাবাজি, খুন, গুম, প্রতিপক্ষ নির্র্মূলের প্রতিহিংসা বন্ধ হবে। এজন্য রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ ফিরে আসার পথ বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক ব্যবস্থা তথা রাষ্ট্রসংস্কার ছাড়া তা সম্ভব নয়। এজন্য যথেষ্ট সময় অন্তর্বর্তী সরকারকে দিতে হবে। আমাদের পরে সিরিয়ার স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের পতন ঘটিয়েছে সেদেশের বিরোধীপক্ষ। অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা করেছে তিন বছরের মধ্যে সংস্কার শেষ করে চার বছর পর নির্বাচন দিতে। ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থ নয়, দেশ ও জনগণের স্বার্থ সবার আগে- এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। কিন্তু প্রচলিত ধারায় রাজনৈতিক দলগুলোর বড় বড় পদে যারা বসে আছেন, তারা তাদের আচরণ ও কাজেকর্মে তার প্রমাণ দিতে পারছেন না।
রাজনৈতিক দলের কর্মীরা হবেন সমাজের স্বেচ্ছাসেবক, মানবাধিকার কর্মী। কিন্তু কথায় আছে, পিতা গুণে ব্যাটা, গাছ গুণে গুটা (ফল)। এ সম্পাদকীয় নিবন্ধে মাত্র একটি উদাহরণ উল্লেখ করা হলো, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়েছেন, সপ্তাহ না ঘুরতেই বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার শিরোনাম হয়, যুবদলের সদস্য নয়ন। এ কথা কারো অজানা নয়, ফ্যাসিস্ট হাসিনা কীভাবে রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক তার তহবিলরক্ষক এস আলমকে দিয়ে দখল করেছিলেন। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর যুবদলের সদস্য নয়ন ব্যাংকটি দখলের সশস্ত্র হামলা চালায়। এতে ব্যাংকের ৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আহত হন। দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মাগুরার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও মাত্র কয়েকদিনে দখল আর চাঁদাবাজি করে কয়েক কোটি টাকা কামিয়েছেন নয়ন। এর ফলে দলের মধ্যে নানা বিতর্ক চলছে তাকে ঘিরে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুবদলের এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, ‘বিএনপির প্রভাবশালী দুই নেতা এবং যুবদলের এক কেন্দ্রীয় নেতার সমর্থনে রবিউল ইসলাম নয়ন পুরো দলকে ডোবাবে।’ কিন্তু এ দল ডোবানো ঘটনার পক্ষে যখন দলটির মুখপত্র সাফাই সাক্ষী দেন, তখন কী আর জাতির সংস্কারের আগে নির্বাচন দাবির উপায় থাকে। কারণ নির্বাচন কেমন হবে, কারা কীভাবে ক্ষমতায় আসবে এবং আসার পর কী করবে, তা বুঝতে কারো বাকি থাকে না।
আমরা মনে করি, এ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের নষ্ট রাজনীতির বেড়াজাল ছিন্ন করতে না পারলে জাতির মুক্তি আসবে না। বার বার নতুন রূপে নতুন নামে ফ্যাসিবাদ ফিরে আসবে, যা কারো কাম্য নয়।