সম্পাদকীয়

গুমের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে


১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৫:০৪

গুম শুধু মানবতাবিরোধী অপরাধই নয়, নির্মমতার দিক দিয়েও সবচেয়ে পৈশাচিক- এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু সেই নির্মমতা কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তার নিকৃষ্টতম উদাহরণ পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে করা গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গুম কমিশন ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ (সত্য উন্মোচন) শীর্ষক প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দিয়েছে। গত ১৪ ডিসেম্বর শনিবার তদন্ত কমিশন এ প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর কিছু ঘটনায় দেশবাসীর সামনে যে সত্য প্রকাশিত হয়েছে, তা হরর ফিল্মকে হার মানিয়েছে। প্রত্যেকটি গুমের ঘটনার সাথে কমিশন সরাসরি শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততা পেয়েছে।

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত এ কমিশন ১ হাজার ৬৭৬টি গুমের অভিযোগ পেয়েছে। এর মধ্যে ৭৫৮টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেছে। কমিশনের তদন্ত, ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তা, নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যে উঠে এসেছে নির্যাতন ও হত্যার ভয়াবহ বর্ণনা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের পর নির্যাতনের যেসব ঘটনার বিষয়ে তদন্ত কমিশন জানতে পেরেছে, তা নৃশংস এবং যে পদ্ধতিতে নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা ভয়াবহ। তবে সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে পুলিশের মতো অন্য বাহিনীর নির্যাতনের ঘটনায় বেশ পার্থক্য দেখা গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের মতো বেসামরিক বাহিনীগুলোর বন্দিশালায় নির্যাতন চালানো হতো নিয়মিত ভিত্তিতে। গুম কমিশনের তদন্তে উঠে এসেছে, নির্যাতনের ক্ষেত্রে এমন কিছু যন্ত্র-সরঞ্জাম ব্যবহার করা হতো, যেগুলো শুধু নির্যাতন চালানোর জন্য তৈরি। একই জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা নিয়মিত নির্যাতন চালাতেন। গুমের শিকার ব্যক্তিদের কথা থেকে জানা গেছে, বন্দিশালার কাছাকাছি অবস্থানে বসে কর্মকর্তারা অফিস করতেন। আশপাশে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা যন্ত্রণায় কাতরালেও তারা শান্তভাবে কাজ করে যেতেন। এতে বোঝা যায়, এসব বিষয় ওই কর্মকর্তাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। তবে সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রিত বাহিনীগুলো; যেমন র‌্যাব ও ডিজিএফআইয়ের গোপন বন্দিশালায় নির্যাতনের জন্য ছিল বিশেষ বন্দোবস্ত। এসব গোপন বন্দিশালা এমনভাবে তৈরি করা হতো, যেখানকার শব্দ বাইরে থেকে শোনা যেত না। নির্যাতনের জন্য বিশেষ যন্ত্র-সরঞ্জাম থাকত। শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন চালানোর জন্য বিশেষভাবে যন্ত্র-সরঞ্জাম তৈরি করা হতো। কমিশন জানিয়েছে, তদন্তের স্বার্থে এসব গোপন বন্দিশালা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বন্দিশালা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হবে। নির্যাতনের ধরন ও মাত্রা নিয়ে ধারণা দিতে দুটি ঘটনা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে অন্তর্বর্তী এ প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে আরো উল্লখ করা হয়েছে, গুমের শিকার ব্যক্তিদের বেশিরভাগ সময় হত্যা, নয়তো ফৌজদারি অপরাধে বিচারের জন্য আদালতে সোপর্দ করা হতো। অল্প কিছুসংখ্যক ব্যক্তিকে মামলা না দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কেউ কেউ ছাড়া পান। গুমের পর যারা হত্যার শিকার হয়েছেন, তাদের কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল, সে বিষয়ে প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। গুমের শিকার কিছু কিছু ব্যক্তির লাশ উদ্ধার হওয়ার পর ময়নাতদন্তে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। র‌্যাবে কাজ করেছেন, সামরিক বাহিনীর এমন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিমেন্টের বস্তায় বেঁধে লাশ ফেলে দেওয়া হতো নদীতে। যেসব নদীতে লাশ ডুবিয়ে দেওয়া হতো, তার মধ্যে রয়েছে ঢাকার অদূরের বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা। নদীতে লাশ ফেলার জন্য ঢাকার পোস্তগোলা ও কাঞ্চন ব্রিজ ব্যবহার করা হতো। পোস্তগোলা সেতু এলাকায় একটি নৌকা রাখা ছিল। হত্যার পর লাশ গুমের কাজে এ নৌকা ব্যবহার করা হতো। হত্যায় প্রায়ই সরাসরি অংশ নিতেন কর্মকর্তারা। র‌্যাবের একটি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার ছিলেনÑ এমন এক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেছে কমিশন। তিনি জানান, র‌্যাবে যোগদানের পর ‘ওরিয়েন্টেশনের’ কথা বলে সংস্থাটির তৎকালীন গোয়েন্দাপ্রধানের নেতৃত্বে তাকে কোনো একটি সেতুতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তার সামনেই দুজন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত ছিলেনÑ এমন এক সেনাসদস্য কমিশনকে জানান, গুমের শিকার এক ব্যক্তি সেতু থেকে নদীতে লাফ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। নদীতে লাফ দেওয়ার পর ওই ব্যক্তিকে তুলে আনেন তিনি। উদ্ধারের পর সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়। গুমের পর হত্যা ও লাশ নিশ্চিহ্ন করার আরও বিকল্প পদ্ধতির বিষয়ে জানতে পেরেছে কমিশন। এক সেনাসদস্য জানান, একবার তাকে একটি লাশ নিয়ে ঢাকার একটি রেললাইনে যেতে বলা হয়। তাকে নির্দেশ দেওয়া হয় লাশটি রেললাইনে রাখতে, যাতে ট্রেন গেলে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

এমন অনেক নির্মম ঘটনা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। যার অংশবিশেষ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা জানতে পারছি। উল্লেখিত ঘটনাগুলো যারা ঘটিয়েছেন, তারা আইন, সংবিধান ও বিচারের তোয়াক্কা করেনি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার অনুসরণ দূরের কথা, তাদের হৃদয়ে কোনো মানবিকবোধ আছে কিনা, সেই প্রশ্নই আজ জাগছে আমাদের মনে। রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব জনগণের জান-মাল রক্ষা করা। কিন্তু হাসিনা সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে জনগণের সাথে ফ্যাসিস্ট হিটলার, মুসোলিনির মতো আচরণ করেছে। তাই তাদের শাস্তিও হতে হবে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির মতো। যে রাজনৈতিক শক্তি ফ্যাসিজম লালন করে, তাদের পুনর্বাসনের সুযোগ জার্মানি, ইতালিসহ কোনো ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে নেই। এ কথাও আমাদের দেশের নীতিনির্ধারক গোষ্ঠী অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনীতিবিদ, নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার সাথে সংশ্লিষ্টদের মনে রাখতে হবে। তবেই ভবিষ্যতে কেউ ক্ষমতার লোভে এমন ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার সাহস দেখাবে না।