আইন পরিবর্তন করে কাদের মোল্লার ফাঁসি পৃথিবীতে নজিরবিহীন
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৫৯
॥ শহীদুল ইসলাম ॥
বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করে কোনো ব্যক্তিকে ফাঁসি দেয়ার ঘটনা পৃথিবীতে না ঘটলেও বাংলাদেশে ঘটেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে। ২০১৩ সালের ১২ মার্চ রাতে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার সরকার উচ্চ আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে ইতিহাসের এ জঘন্যতম কাজটি সম্পন্ন করেছে। পরবর্তীতে সেই ধারাবাহিকতায় জামায়াতের সাবেক আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও সাবেক নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীকে ফাঁসি দেয়া হয়।
কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিগত ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ছয়টি অভিযোগের মধ্যে দুটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ, তিনটিতে ১৫ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেন। অন্য একটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়। কিন্তু কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আকস্মিকভাবে শাহবাগে তরুণদের নেতৃত্বে প্রতিবাদ শুরু হয়। গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। ভারতীয় দূতাবাস এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকাতায় মাসের পর মাস রাজধানী কেন্দ্রস্থলে চলতে থাকে এ গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রম। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত তারা এ কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে বলে তখন অঙ্গীকার করে। বাস্তবে হয়েছেও তাই। যা ছিল উচ্চ আদালতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে জবরদস্তিমূলক রায় বা দাবি আদায় করে নেয়ার শামিল।
অপর্যাপ্ত দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ রেখে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে আনা সংশোধনী আবদুল কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য বলে মত দিয়েছিলেন দুই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। তারা যুক্তি দেখান যে, এই সংশোধনী বৈধ। অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের আইনি সহায়তাকারী) হিসেবে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রফিক-উল হক ও এম আমীর-উল ইসলামের আদালতে দাখিল করা লিখিত বক্তব্যে এ মত উঠে আসে। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন-১৯৭৩-এর অধীনে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ প্রশ্নে ভিন্নমত দিয়েছিলেন এ দুই অ্যামিকাস কিউরি।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ শুনানি গ্রহণ করেন। আবদুল কাদের মোল্লার দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে করা আপিল শুনানিকালে দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইনগত প্রশ্ন ওঠায় ২০ জুন আপিল বিভাগ এ বিষয়ে মতামত দিতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে জ্যেষ্ঠ সাত আইনজীবীর নাম ঘোষণা করে ৮ জুলাই শুনানির দিন ধার্য করেন। প্রশ্ন দুটি হলো, দণ্ড ঘোষণার পর আইনে আনা সংশোধনী কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না। অপরটি হলো, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন-১৯৭৩-এর অধীনে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে কি না।
আদালতে রফিক-উল হকের ২৫ পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য আদালতে দাখিল করেন অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড মো. ওয়াহিদুল্লাহ। পরে তিনি তা পড়ে শোনান। এরপর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম লিখিত বক্তব্য দাখিল করে বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
রফিক-উল হকের বক্তব্যে বলা হয়, ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ২১ ধারায় সংশোধনী আনা হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট এ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তা বৈধ ও সংবিধানসম্মত। ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে তা কার্যকর বলে গণ্য হবে। সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদে আইনটিকে সুরক্ষা দেওয়া আছে। নতুন ধারা অনুসারে, কাদের মোল্লার দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে অধিকার হিসেবে সরকার আপিল করতে পারে। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা এবং ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ক্ষেত্রে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন (কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল) প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই।
শুনানির পর আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এ সংশোধনী কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এর আগে তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালের আইনটি যখন করা হয়, সে সময় বিদ্যমান প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সমন্বয় করে করা হয়। পরে আন্তর্জাতিক আইনের অনেক উন্নয়ন (ডেভেলপমেন্ট) হয়েছে। জেনেভা কনভেনশনের পার্টি (পক্ষভুক্ত) ছিল পাকিস্তান, ১৯৫১ সালে। ১৯৭২ সালে আমরা জেনেভা কনভেনশনে পার্টি (পক্ষভুক্ত) হয়েছি। ওই কনভেনশনে আন্তর্জাতিক আইনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেই উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে জেনোসাইড (গণহত্যা) হয়েছে। এ ঘোষণাপত্রে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের ঘোষণার প্রতি অনুগত থাকার কথাও বলা হয়।
পবিত্র কুরআনে যুদ্ধের ব্যাপারে নির্দেশনা, হজরত আবু বকর (রা.)-এর সময়ের নীতি, ঈশা খাঁর যুদ্ধকালীন আচরণের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে আমীর-উল ইসলাম বলেন, এ সবকিছু মানবসভ্যতার একেকটি বড় মাইলফলক। এর ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে আইন, যাকে ইন্টারন্যাশনাল কাস্টমারি ল (প্রথাগত আইন) বলা হয়। এ আইন আমাদের ওপরও প্রযোজ্য। সংবিধান অনুসারে প্রথাও আইনের অংশ।
আইনের সংশোধনী প্রসঙ্গে আমীর-উল ইসলাম বলেন, সর্বশেষ সংশোধনীর মাধ্যমে আপিল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ সংশোধনী বৈধ। এতে দণ্ড বাড়ানোর জন্য কোনো নতুন বিধান করা হয়নি। আপিলের সমানাধিকার নিশ্চিতের জন্য সংশোধন করা হয়েছে। সংবিধান অনুসারে, বিচারে সমঅধিকার থাকতে হবে। ভূতাপেক্ষ হিসেবে এটা সংবিধানবিরোধী নয়।
অন্য অ্যামিকাস কিউরিদের ভিন্নমত থাকলেও মূলত এ দুই সিনিয়র আইনজীবীর মতামতের ওপর ভিত্তি করেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে জঘন্য কালাকানুনের আদেশ দেন উচ্চ আদালত।
এরপর দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সমান সুযোগ রেখে ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) (সংশোধন) বিল, ২০১৩ জাতীয় সংসদে পাস হয়। আগে কোনো অভিযোগে আসামির সাজা হলে তার বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ ছিল না সরকারপক্ষের।