একজন শহীদের কথা
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৫৭
শামসুন্নাহার নিজামী : শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা। একটি নাম, একটি ইতিহাস। প্রচলিত আইন পাল্টিয়ে নতুন আইন তৈরি করে যাকে মিথ্যা-বানোয়াট অভিযোগে কসাই কাদের বানিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়, যা দুনিয়ার ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি।
শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা আমাদের ছোট ভাই। আমি পড়ালেখা শেষে যখন ১৯৭৬ সালে ঢাকায় আসি, তখন সে ছাত্র। ঐ সময় যাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পেয়েছি, সে তাদের অন্যতম। খুব কাছ থেকে তাকে দেখেছি। সহজ-সরল। অত্যন্ত সাদাসিধা, নিরীহ-নিরহঙ্কার মেধাবী যুবক। কাদের মোল্লার স্ত্রী আমার ছাত্রজীবন থেকেই পরিচিত ছিল। আমাকে সে খালা বলে ডাকে। বিয়ের পর সম্পর্কের জটিলতা দেখা দেয়। আমার সন্তানরা কাদের মোল্লাকে বলে মোল্লা চাচা। আর তার স্ত্রী পিয়ারীকে ডাকে আপা। তাদের বিয়েশাদী-সংসার সবই মনে হয় আমার কাছে জীবন্ত হয়ে আছে।
শহীদ সাবেক আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী জেলে থাকাকালীন তার একটা স্বপ্নের কথা আমাদের বলেছিলেন। তিনি বললেন, মনে হলো একটা প্রোগ্রামে আমরা সবাই বসে আছি। এর মধ্যে কাদের মোল্লা উঠে সবার আগে এগিয়ে গেল। বুঝতে পারলাম না, মুরুব্বিদের রেখে সে কেন আগে এগিয়ে গেল। পরবর্তীতে আমাদের মনে হয়েছে, এটা তার আগে শহীদ হওয়ার একটা ইশারা ছিল।
স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকার একের পর এক সামনের সারির নেতাদের ফাঁসি দেয়। জামায়াতের অসংখ্য নেতাকর্মীকে গুম-খুন, জেল-জুলুমের মাধ্যমে যে অবর্ণনীয় অত্যচার করেছে, গোটা বিশ্ব তা দেখেছে। জামায়াতের মতো এত অত্যাচার আর কোনো রাজনৈতিক দলের ওপর করা হয়নি। যদিও আলেম-ওলামাসহ যাদের তারা তাদের স্বৈরতন্ত্রের জন্য হুমকি মনে করেছে, কাউকেই তারা রেহাই দেয়নি।
জামায়াতের নেতৃবৃন্দের ওপর এ জুলুমের একমাত্র কারণ ছিল, যা কুরআনের ভাষায়, “তারা তাদের (মুমিনদের) থেকে প্রতিশোধ নিয়েছিল শুধুমাত্র এ অপরাধে যে, তারা অসীম ক্ষমতাবান সপ্রশংসিত আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল।” (সূরা বুরূজ : ৮)।
শুধু আজকের সমাজেই নয়, অতীতে সব নবী-রাসূলগণকেই বিভিন্নভাবে ঘাত-প্রতিঘাত, জুলুম-নির্যাতন, হত্যা ইত্যাদি মোকাবিলা করে সমাজকে পুনর্গঠন ও সংস্কারের কাজ করতে হয়েছে। গোটা বিশ্বের মানবতা-মনুষ্যত্বের মডেল হযরত মুহাম্মদ সা. আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে বর্বর-অশিক্ষিত এক জনপদে জন্ম নিয়েছিলেন। দীর্ঘ ৪০ বছর পর্যন্ত (নবুয়্যতের পূর্ব পর্যন্ত) তিনি তার দরাদ মন নিয়ে বিভিন্নভাবে সেই সমাজের মানবতা-মনুষ্যত্বের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। অবশেষে ৪০ বছর বয়সে নবুয়্যত পেয়ে আল্লাহর নির্দেশে তাঁরই দেখানো পথে সেই অশিক্ষিত-বর্বর মানবগোষ্ঠীকে মানবতা-মনুষ্যত্বের সর্বোত্তম মডেলে পরিণত করেছিলেন। মক্কায় নবুয়্যতের ১৩ বছরে তিনি এৎড়ঁহফ ড়িৎশ করেছেন। মানুষ তৈরির কাজ করেছেন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, মক্কী যুগের সূরাগুলোয় তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাতের বর্ণনা বেশি বেশি এসেছে। বিশেষভাবে আখিরাতের বর্ণনা এসেছে। এ বর্ণনাগুলো এতটাই হৃদয়গ্রাহী যে, যারা ঈমান এনেছিল, তারা আখিরাতে জাহান্নামের আজাব থেকে বাঁচার জন্য, জান্নাতের নেয়ামত পাওয়ার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি।
এভাবে মক্কায় ঘাত-প্রতিঘাত, বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সাহাবায়ে কেরাম মদীনায় গিয়ে মদীনাবাসীর সার্বিক সহযোগিতায় (যারা আনসার নামে পরিচিত) বিশ্বের বিস্ময় এক কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেন। যে রাষ্ট্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবাই সমান অধিকার পেয়েছে। পেয়েছে সুবিচার এবং সামাজিক সুরক্ষা। বিশেষভাবে নারীরা, যারা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ছিল, যাদের জন্মের পরপরই জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, তারাও পেল সম্মান এবং মর্যাদা। ইতিহাস সাক্ষী। রাসূল সা.-এর নেতৃত্বে গোটা বিশ্বের মানুষ একটি সফল রাষ্ট্রের নমুনা দেখতে পেল।
এ সবই সম্ভব হয়েছিল রাসূল সা.-এর হাতে গড়া মানুষের (যারা সাহাবায়ে কেরাম নামে পরিচিত) ঈমানী দৃঢ়তার কারণে। এ ঈমান কেমন ছিল? যা পবিত্র কুরআনের বর্ণনা মতে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের জান ও মাল বেহেশতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন।” (সূরা তাওবা : ১১১)।
ঈমানের দাবিই হচ্ছে আল্লাহর কাছে নিজের জান ও মাল বিক্রি করে দেওয়া। এ বিক্রির মূল্য দুনিয়ায় পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কিন্তু আখিরাতে আল্লাহ নিশ্চিতভাবেই দেবেন। এ বিশ্বাসের ভিত্তিতেই দুনিয়ার কোনো লাভ-লোকসান, চাওয়া-পাওয়ার পরোয়া না করে প্রকৃত ঈমানদাররা আল্লাহর নির্দেশিত পথে মানবতা-মনুষ্যত্বের কল্যাণের জন্য দুনিয়ার জীবনে লড়াই-সংগ্রাম করে। যারা আল্লাহর পথে এ সংগ্রামে শহীদ হন, তারা চরম সৌভাগ্যবান। আল্লাহ তাদের প্রশংসায় বলেন, “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তোমরা তাদের মৃত বলো না, প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত। কিন্তু তোমরা তা বুঝতে পার না।” (সূরা আল বাকারা : ১৫৪)।
আমাদের শহীদরা (শহীদ আবদুল কাদের মোল্লাসহ) বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল, স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ইসলামকে বোঝার পর থেকে তিলে তিলে জীবনের সবকিছু দিয়ে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দীন কায়েমের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের সত্যিকার সাফল্য চেয়েছিলেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি।
এ ঈমানী দৃঢ়তা তারাই দেখাতে পারে, যারা নিজের জান-মাল আল্লাহর কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এবারও জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে আমরা সাধারণ গণমানুষের মধ্যে এ স্পিরিটই দেখতে পেয়েছি। পুলিশের ভাষায়, “স্যার গুলি করলে একটা মরে, কিন্তু পাশের একটাও লড়ে না।”
আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে, যারা ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া আর কিছু বুঝে না। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “মানুষের মধ্যে কিছু লোক আছে, যারা বলে, ‘আল্লাহ! আমাদের এ দুনিয়াতেই (আমাদের যা প্রাপ্য) দিয়ে দাও।’ এ ধরনের লোকদের জন্য আখিরাতে কোনো অংশ নেই।” (সূরা আল বাকারা : ২০০)।
কিন্তু সত্যিকার ঈমানদারগণ ভিন্ন প্রকৃতির। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “তাদের মধ্যে আবার এমন লোকেরাও আছে, যারা বলে, আল্লাহ! আমাদেরকে এ দুনিয়াতেও কল্যাণ দান কর এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান কর। আর আমাদেরকে জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করো।”
এরাই হলো সেই সব (উত্তম) মানুষ, যাদের জন্য তাদের কর্মের ভিত্তিতে (উভয় স্থানেই) যথাযথ অংশ রয়েছে। আর আল্লাহ তো দ্রুত হিসাব সম্পন্নকারী।” (সূরা বাকারা : ২০১-২০২)।
শহীদ কাদের মোল্লা একদিনে তৈরি হয়নি। তারা দেশের সম্পদ। আল্লাহ ভালোবেসে তাদের শহীদি মর্যাদা দিয়েছেন। দুনিয়ায়ও সম্মানিত করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগা জাতি তার সূর্য সন্তানদের হারালো।