বেগম রোকেয়ার ধার্মিকতা


১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৪০

॥ মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম ॥
কোনো স্কুল-কলেজে বিদ্যা শিক্ষা না নিয়েও কঠোর ধর্মীয় পর্দাপ্রথার মধ্যে উর্দু ভাষী পরিবার-সমাজে বেড়ে উঠেছিলেন বাংলা ভাষা-সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল ক্ষণজন্মা প্রতিভার অধিকারিণী, নারী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। কঠিন অবরোধ প্রথা ও সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশে পরিচালিত হয়েছিল তার জীবন সংগ্রাম। যখন প্রতিটি নারী অধিকার বঞ্চিত হয়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত, তখন সমগ্র নারী জাতিকে রক্ষায় এগিয়ে এসেছিলেন বেগম রোকেয়া। সম্পূর্ণ স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কঠোর পরিশ্রম, স্বীয় প্রচেষ্টা-মেধা ও যোগ্যতা বলে তিনি একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। একদিকে সৃজনশীল চিন্তার বাস্তবায়ন (বালিকা বিদ্যালয় এবং নারী কল্যাণ সমিতি প্রতিষ্ঠা); অন্যদিকে ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সমাজে প্রচলিত কঠিন অবরোধ প্রথা ও ধর্মের নামে মিথ্যা-কুসংস্কারের ভিত্তিমূলে কঠোরভাবে আঘাত হেনেছিলেন বেগম রোকেয়া। তাই বলে কখনোই পর্দা-বোরকা, ইসলামের বিধিবিধানের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ছিল না। তার চিন্তা, সৃজনশীলতা, কর্ম-বিশ্বাস গভীর থেকে উপলব্ধি করতে না পেরে তাকে থামানোর জন্য সমাজে একশ্রেণির কাঠমোল্লা তার বিপক্ষে উঠেপড়ে লেগে গিয়েছিলেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগের পরে হিন্দুরা যখন বহু দূর এগিয়ে আর মুসলমানরা বহুদূর পিছিয়ে, তখন কতিপয় সাহসী মুসলমানরা মুসলিম জাগরণের উদ্দেশে কলকাতা থেকে পত্রপত্রিকা প্রকাশে এগিয়ে আসেন। সেসব পত্রপত্রিকায় তার বহু সৃজনশীল চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়। তার ভাষায়-আমি কারসিয়ং ও মধূপুর বেড়াতে গিয়ে সুন্দর-সুদর্শন পাথর কুড়িয়েছি, উড়িষ্যা ও মাদ্রাজে সাগরতীরে বেড়াতে গিয়ে বিচিত্র বর্ণের বিবিধ আকারের ঝিনুক কুড়িয়ে এনেছি। আর জীবনের ২৫ বছর ধরে সমাজসেবা করে কাঠমোল্লাদের অভিসম্পাত কুড়াচ্ছি। (রোকেয়া রচনাবলি, মোরশেদ শফিউল হাসান সম্পাদিত, উত্তরণ, ঢাকা- ২০০৬, পৃ-৩০৩)। ফলে তাকে নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে এবং সমাজে এখনো তার প্রভাব বিদ্যমান। এ সময় কাজী নজরুল ইসলামও তাদের দ্বারা কাফের ফতোয়া পেয়েছিলেন। তার রচিত ‘সাম্যবাদী’ কবিতার গূঢ় রহস্য উপলব্ধি করতে না পেরে বামপন্থী বলে তাকে যেভাবে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা লক্ষ করা যায়, ঠিক তদ্রƒপ বেগম রোকেয়াকেও ধর্মবিদ্বেষী, ইসলামবিদ্বেষী আধুনিক নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত বলে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টাও থেমে থাকে না। তাকে নিয়ে, তার সৃষ্টিশীল চিন্তা-কর্ম নিয়ে যেভাবে গবেষণা হওয়ার কথা ছিল, সমাজে সেভাবে তার প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ পায়নি। প্রকৃতপক্ষে উদার নৈতিক মতবাদ ইসলাম ধর্মকে অবলম্বন করেই তার সমগ্র চিন্তা এবং কর্মের বিকাশ ঘটেছিল। তিনি প্রতিদিন কুরআন পাঠ এবং উপলব্ধির মধ্য দিয়ে সমাজে নারী শিক্ষার ভিত্তি গড়ে তুলেছিলেন। তার বিভিন্ন পত্রাবলি ও লেখনিতে তার প্রগাঢ় প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। কিন্তু ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অভাবেই তার বিরুদ্ধে এ বিদ্বেষী মনোভাব সৃষ্টির অন্যতম কারণ বলে অনুমান করা যায়। তার নিজস্ব বিশ্বাস ও চিন্তায় ধার্মিকতার যে পরিষ্কার ছাপ পাওয়া যায়, আলোচ্য প্রবন্ধে তা নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তাদের অন্তর আছে, কিন্তু তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না; চোখ আছে, তা দ্বারা দেখে না এবং তাদের কর্ণ আছে তা দ্বারা তারা শ্রবণ করে না। এরা পশুর ন্যায় বরং তারা অধিক পথভ্রষ্ট। (সূরা আরাফ : ১৭৯)। ‘কূপমণ্ডুকের হিমালয় দর্শন’ প্রবন্ধে বেগম রোকেয়া প্রভুর দেওয়া চক্ষু, কর্ণ ও হৃদয় নিয়ে এক অসাধারণ আবেগঘন লেখা প্রকাশ করেছেন। এখানে তার কিঞ্চিত উপস্থাপিত হলো। তার ভাষায়-আমাদের এমন সুন্দর চক্ষু, কর্ণ, মন নিয়ে যদি আমরা স্রষ্টার গুণকীর্তন না করি, তবে কি কৃতজ্ঞতা হয় না? মন, মস্তিষ্ক, প্রাণ সব নিয়ে উপাসনা করলে তবে তৃপ্ত হয়। কেবল টিয়া পাখির মতো কণ্ঠস্থ কতকগুলো শব্দ (কুরআন তেলাওয়াত) উচ্চারণ করলে (অন্তত আমার মতো) উপাসনা হয় না। তদ্রƒপ উপাসনায় প্রাণের আবেগ থাকে কই? প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শনকালে মন-প্রাণ স্বতই সমস্বরে বলে ওঠে, ঈশ্বরই (আল্লাহই) প্রশংসাযোগ্য। (আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন)। তিনিই ধন্য। (রোকেয়া রচনাবলি, পৃ-৩৪২)। বেগম রোকেয়ার হৃদয়, চক্ষু এবং কর্ণ সর্বদা জাগ্রত ছিল বলেই তিনি স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির তথা সমাজের বিশেষ করে অধঃপতিত নারী জাতির উন্নতি এবং উন্নয়নের সাথে কুরআন-হাদীসের সাদৃশ্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করে সফল হয়েছেন। আর এটাকে সমাজে তার অপরাধ বলে প্রচারের চেষ্টা করা হয়েছে। মিরাজে গিয়ে রাসূল সা. দেখেছিলেন, জাহান্নামে নারীরাই বেশি শাস্তি ভোগ করছেন। এ হাদীসটির ব্যাখ্য স্বরূপ রোকেয়া বলেন, আমরা কিন্তু এ পৃথিবীতেই দেখছি-কুলকামিনীরা অসহ্য নরকযন্ত্রণা ভোগ করছেন। পৈতৃক সম্পত্তির অংশ থেকে কন্যাকে বঞ্চিত করবার নিমিত্ত কী কী জঘন্য উপায় অবলম্বন করা হয়ে থাকে, তা কে না জানে। কোনো ভ্রাতা তা মুখফুটে বলেন না। বললে অবলাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে যে। সুতরাং সে শোচনীয় কথা আমাদেরকে বলতে হচ্ছে। কোন স্থলে আফিংখোর, গাঁজাখোর, নিরক্ষর, চিররোগী বৃদ্ধ- যে মোকদ্দমা করে জমিদারির অংশ বের করতে অক্ষম, এইরূপ লোককে কন্যা দান করা হয়। অথবা ভগ্নির দ্বারা বিবাহের পূর্বেই না- দাবি লিখিয়ে নেওয়া হয়। কিংবা ভগ্নিদের চিরকুমারী রাখা হয় এবং ভ্রাতৃবধূ ননদদের দাসীর মতো ভাবেন।…এটাই সমাজের নালী ঘা! হায় পিতা মুহাম্মদ (সা.)! তুমি আমাদের উপকারের নিমিত্ত পিতৃ-সম্পত্তিতে অধিকারিণী করেছো, কিন্তু তোমার সুচতুর শিষ্যগণ নানা উপায়ে কুলবালাদের সর্বনাশ করছে। আহা! ‘মুহাম্মাদীয় আইন’’- পুস্তকের মসি-লেখারূপে পুস্তকেই আবদ্ধ থাকে। টাকা যার, ক্ষমতা যার, আইন তার। (রোকেয়া রচনাবলি, পৃ-৬৯)। ইসলামে সম্পত্তিতে নারী অধিকারের যে নিখুঁত বর্ণনা পাওয়া যায়; বিশেষ করে মিরাছি সম্পত্তি বণ্টন সম্পর্কিত (আল-কুরআন-৪ : ১১-১২), তা থেকে এখনো মুসলিম সমাজে নারীরা যে মুক্তি পেয়েছে, তা কল্পনাও করা যায় না। কুরআনে বর্ণিত জান্নাতে প্রবেশের প্রধান দুটি শর্ত করা হয়েছে ঈমান ও আমলে সালিহ বা সৎকর্মকে। কুরআনে এদুটি শব্দ মোট ৯৩ বার একত্রে পাশাপাশি উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু সিয়াম ১৪ বার, যাকাত ৩২ বার, হজ ১২ বার, সালাত ৯১ বার (শব্দ) উচ্চারিত হলেও এই সৎকর্মসমূহের জন্য কুরআনের কোথাও জান্নাত লাভের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। তাই জান্নাতের প্রত্যাশায় নারী-পুরুষ উভয়ের মুক্তির জন্য নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরীক হওয়ার মতো শ্রেষ্ঠ সৎকর্ম আর কী হতে পারে? কিন্তু ইসলাম অনুসরণ করা ও প্রচারের তালিকায় তার বিন্দুমাত্র নাম-গন্ধও পাওয়া যায় না। এ অন্ধ-কুসংস্কারের বিরুদ্ধেই সারা জীবন লড়াই করেছিলেন বেগম রোকেয়া।
বেগম রোকেয়া তার লেখনী দিয়ে শুধু তৎকালীন অন্ধকার মুসলিম সমাজকে আঘাতই করেননি, বরং মহামুক্তির পথ কোথায়? তার সঠিক ও নিখুঁত সমাধানও পেশ করেছেন হাতে-কলমের মাধ্যমে। তার ভাষায়-(সমাজে) কন্যাকে পাত্রস্থ করার সময় বহু অর্থ ব্যয়ে কন্যাকে জড় স্বর্ণ মুক্তার অলঙ্কারে সজ্জিত করা হয় অথচ ঐ টাকায় তাদেরকে জ্ঞান-ভূষণে অলঙ্কৃতা করার চেষ্টা করা উচিত। একখানা জ্ঞানগর্ব পুস্তক পাঠে যে অনির্বাচনীয় সুখ লাভ করা যায়, দশখানা অলঙ্কার পরিধান করলে, তার শতাংশের একাংশ সুখও পাওয়া যায় না। অতএব শরীর শোভন অলঙ্কার ছেড়ে জ্ঞান-ভূষণ লাভের জন্য ললনাদের আগ্রহ বৃদ্ধি হওয়া বাঞ্চনীয়। এ অমূল্য অলঙ্কার। (রোকেয়া রচনাবলি, মতিচূর, ১ম খণ্ড, পৃ-৬২)। কুরআনে বলা হয়েছে-সৎকর্ম (আমলে সালিহ) মানুষকে উন্নতি দান করে। (৩৫ : ১০)। ‘যাকে জ্ঞান দান করা হয়, তাকে প্রভুত কল্যাণ দান করা হয়। (বাকারা : ২৬৯)। এখানে উন্নতি-উন্নয়নের মূল নারীকে পৃথক ভাবার প্রশ্নই আসে না। এই চিন্তায় বিশ্বাসী ছিলেন বেগম রোকেয়া।
পর্দাপ্রথা ও নারীমুক্তি সম্পর্কে বেগম রোকেয়ার বক্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার এবং তা অবশ্যই কুরআন-হাদীসে বর্ণিত পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে নয়। কুরআনে ‘ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আমানু এবং ইয়া আইয়ুহান্নাসু’ অর্থাৎ ‘হে ঈমানদারগণ এবং হে মানবমণ্ডলী’ বলে যে সম্বোধন করা হয়েছে, সেখানে নারী-পুরুষ উভয় সম্বোধিত। পৃথকরূপে ভাবার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ কুরআনের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা এবং পালনের ব্যাপারে উভয়ের সমান দায়িত্ববোধ জাগ্রত হওয়ার কথাই এখানে প্রকাশ পায়। এটা পালিত না হলে দুনিয়ায় যেমন শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, তদ্রƒপ আখেরাতেও মুক্তি অসম্ভব। কিয়ামতের দিন তারা উভয় আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (১০২ : ৩)। এখানেও নারীকে পৃথকরূপে ভাবার সুযোগ রাখা হয়নি। এক কথায় আল্লাহকে ভয় করে যাবতীয় কর্মযজ্ঞে নারী অংশগ্রহণ করতে পারে-এটাই পর্দাপ্রথার মূল বিধান। পরিবেশ সৃষ্টি হলে পৃথকভাবে সমস্ত কর্মে নারীদের অংশ গ্রহণের ব্যাপারেও রোকেয়ার চিন্তা অত্যন্ত পরিষ্কার।
কুরআনের ৪টি আয়াত বিশ্লেষণ করলে পর্দা সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক. নবী পত্নীদের বলা হয়েছে, তারা যেন আল্লাহকে ভয় করে এবং পরপুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা না বলে, যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে, সে প্রলুব্ধ হয়। (৩৩ : ৩২)। তারা (মুমিন নারীগণ) যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না। (৩৩ : ৫৯)। তারা যেন তাদের (নারী-পুরুষ উভয়) দৃষ্টিকে সংযত করে ও লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। তারা (মুমিন নারীগণ) যেন সাধারণত যা প্রকাশ থাকে তা ব্যতীত তাদের আবরণ প্রদর্শন না করে। তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে। (২৪ : ৩১)। নবী পত্নীদের নিকট থেকে কিছু চাইলে তারা যেন পর্দার (হিজাব) অন্তরাল থেকে চাই। (৩৩ : ৫৩)। কুরআনে বর্ণিত পর্দাপ্রথা অনুসরণের মধ্য দিয়ে শিক্ষা গ্রহণই (ইকরা) নারী মুক্তি সম্ভব বলে বেগম রোকেয়া মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তার ভাষায়-মনে রাখা প্রয়োজন, পর্দা কিন্তু শিক্ষার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়নি। বর্তমান শিক্ষয়িত্রীর অভাব আছে। এ অভাবটি পূরণ হলে এবং স্বতন্ত্র স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা হলে যথাবিধি পর্দা রক্ষা করেও উচ্চশিক্ষা লাভ হতে পারে। (রোকেয়া রচনাবলি, পৃ-৬৩)। মুসলমান ধর্মে শাস্ত্রানুমোদিত পর্দা রক্ষা করে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করা যায়। এ কথা অনেকেই বুঝে না। তাই তারা বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে হলে মহাবিপদ ভাবে। শাস্ত্রে পর্দা সম্বন্ধে যতটুকু কঠোর ব্যবস্থা আছে, প্রচলিত পর্দাপ্রথা তদপেক্ষাও কঠোর, যা হোক কেবল শাস্ত্র মেনে চললে অধিক অসুবিধা ভোগ করতে হয় না। আমার বিবেচনায় প্রকৃত পর্দা সেই-ই রক্ষা করে, যেসব মানবজাতিকে সহোদর ও সহোদরার ন্যায় জ্ঞান করে। (রচনাবলি, পৃ-৩৪১)। পর্দা-বোরকা সম্পর্কে রোকেয়ার চিন্তা অত্যন্ত ইতিবাচক। তার ‘বোরকা’ প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে-কেউ কেউ বোরকা ভারী বলে আপত্তি করেন। কিন্তু তুলনায় দেখা যায় ইংরেজ মহিলাদের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হ্যাট অপেক্ষা আমাদের বোরকা অধিক ভারী নয়। পর্দা অর্থে তো আমরা বুঝি গোপন করা বা হওয়া, শরীর ঢাকা ইত্যাদি-কেবল অন্তঃপুরের চারি প্রাচীরের ভিতর থাকা নয় এবং ভালোমতো শরীর আবৃত না করাকেই ‘বেপর্দা’ বলি। যারা ঘরের ভিতর চাকরদের সম্মুখে অর্ধনগ্ন অবস্থায় থাকেন, তাদের অপেক্ষা যারা ভালোমতো পোশাক পরে মাঠে-বাজারে বের হন, তাদের পর্দা বেশি রক্ষা পায়। এই যে ‘গায়রে মাজহাব’ বিশিষ্ট স্ত্রীলোকের সাথে পর্দা করা হয়- এটা ছাড়তে হবে। আমাদের ধর্ম তো ভঙ্গ প্রবণ নয়। তবে অন্য ধর্মাবলম্বিনী স্ত্রীলোকের সাথে দেখা হলে ধর্ম নষ্ট হবে, এরূপ আশঙ্কার কারণ কি? আমরা অন্যায় পর্দা ছেড়ে আবশ্যকীয় পর্দা রাখব। প্রয়োজন হলে অবগুণ্ঠন (ওরফে বোরকা)সহ মাঠে বেড়াতে আমাদের আপত্তি নেই। স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য শৈলবিহারে বের হলেও বোরকা সাথে থাকতে পারে। বোরকা পরে চলাফেরায় কোন অসুবিধা হয় না। তবে সেজন্য সামান্য রকমের একটু অভ্যাস চাই, বিনা অভ্যাসে কোন কাজটা হয়? সম্প্রতি আমরা যে এমন নিস্তেজ সঙ্কীর্ণমনা ও ভীরু হয়ে পড়েছি, তা অবরোধে থাকার জন্য হয়নি, হয়েছে শিক্ষার অভাবে। সুশিক্ষার অভাবেই আমাদের হৃদয়বৃত্তিগুলো এমন সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। (রচনাবলি, পৃ-৬২)।
‘বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সমিতি’র এক সভায় সভানেত্রীর ভাষণে পর্দা সম্পর্কে তার সুচিন্তিত মতামত আরও দৃঢ়ভাবে প্রকাশ পায়। তার সেই অভিভাষণটি চৈত্র ১৩৩৩ মাসিক সওগাত পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়- ‘ভারতবর্ষের অবরোধ প্রথা স্ত্রীলোকদের পক্ষে অত্যন্ত মারাত্মক। অবরোধ-প্রথা আমাদের সমাজের সর্বাপেক্ষা যন্ত্রণাদায়ক ক্ষত। ভ্রাতৃগণ! পর্দার নাম শুনিবা মাত্র আপনারা হয়তো একযোগে বলে উঠবেন, তবে কি আমরা ইংরেজদের অনুকরণে বিবিদের রাজপথে বেড়াতে দিব। তদুত্তরে বলি, আমি মুসলমান শাস্ত্রের সীমার মধ্যে থেকে আপনার সাথে কথা বলতে চাই। ভারতীয় পর্দার সাথে শাস্ত্রীয় পর্দার কোন সম্বন্ধ নেই বললে অত্যুক্তি হবে না।’ পর্দা সম্বন্ধে আমি নিজের কোন মতপ্রকাশ করতে ইচ্ছুক নয়। কেবল এ টুকু বলি যে, শেখ সাহেব পর্দাকে ‘সর্বাপেক্ষা যন্ত্রণাদায়ক ক্ষত’ বলেছেন, আমি তা মনে করি না। ‘‘যন্ত্রণাদায়ক’’ হলে অবলাগণ ‘বাবারে! মারে! মলুম রে!’’ বলে আর্তনাদে গগন বিদীর্ণ করতেন। অবরোধ-প্রথাকে প্রাণঘাতক কার্বনিক এসিড গ্যাসের সাথে তুলনা করা যায়। যেহেতু তাতে বিনা যন্ত্রণায় মৃত্যু হয় বলে লোকে কার্বনিক গ্যাসের বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বন করবার অবসর পায় না।! অন্তঃপুরবাসিনী নারী এ অবরোধ গ্যাসে বিনা ক্লেশে তিল তিল করে নীরবে মরছে। (রাকেয়া রচনাবলি, পৃ-৩৮৫)।
কুরআনের প্রতি বেগম রোকেয়ার গভীর ভালোবাসার কথা বেশি-বেশি প্রচারের পরিবর্তে তাকে কুরআনবিদ্বেষী বলে বেশি-বেশি প্রচারের নমুনা রয়েছে সমাজে। শিক্ষার সকল স্তরে তিনি কুরআনের প্রচার-প্রসার কামনা করেছেন। তার প্রতিষ্ঠানেও তিনি সেটা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছেন। তার ভাষায়,‘মুসলমান বালিকাদের প্রাথমিক শিক্ষার সাথে কুরআন শিক্ষাদান করা সর্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজন। কুরআন শিক্ষা অর্থে শুধু টিয়া পাখির মত আরবি শব্দ আবৃত্তি করা আমার উদ্দেশ্য নয়। বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় কুরআনের অনুবাদ শিক্ষা দিতে হবে। সম্ভবত এজন্য গভর্ণমেন্ট বাধ্যতামূলক আইন পাশ না করলে আমাদের সমাজ মেয়েদের কুরআন শিক্ষাও দেবে না। যদি কেউ ডাক্তার ডেকে ব্যবস্থাপত্র লয়, কিন্তু তাতে লিখিত ওষুধ পথ্য ব্যবহার না করে সে ব্যবস্থাপত্রখানাকে মাদুলী রূপে গলায় পরে থাকে আর দৈনিক তিনবার করে পাঠ করে তাতে কি সে উপকার পাবে? আমরা কুরআন শরীফের পাঠ লিখিত ব্যবস্থা অনুযায়ী কোন কাজ করি না, শুধু তা পাখির মতো পাঠ করি আর কাপড়ের থলিতে (জুযদানে) পুরে যত্ন করে উচ্চ স্থানে রাখি। কিছুদিন হলো, মিশর থেকে আগত বিদূষী মহিলা মিস যাকিয়া সুলেমান এলহাবাদে এক বিরাট মুসলিম সভায় বক্তৃতাদানকালে বলেছিলেন, ‘উপস্থিত যে যে ভদ্রলোক কুরআনের অর্থ বোঝেন, তারা হাত তুলুন।’ তাতে মাত্র তিনজন ভদ্রলোক হাত তুলেছিলেন। কুরআন জ্ঞানে যখন পুরুষদের এরূপ দৈন্য, তখন আমাদের দৈন্য যে কত ভীষণ, তা বলাই ভালো। সুতরাং কুরআনের বিধি-ব্যবস্থা কিছুই আমরা অবগত নয়।…..আমার অমুসলমান ভগিনীগণ! আপনারা কেউ মনে করবেন না যে, প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সাথে কুরআন শিক্ষা দিতে বলে আমি গোঁড়ামির পরিচয় দিলাম। তা নয়, আমি গোঁড়াাম থেকে বহুু দূরে। প্রকৃত কথা এই যে, প্রাথমিক শিক্ষা বলতে যা কিছু শিক্ষা দেওয়া হয়, সে সমস্ত ব্যবস্থাই কুরআনে পাওয়া যায়। আমাদের ধর্ম ও সমাজ অক্ষুণ্ন রাখবার জন্য কুরআন শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন।” কুরআনের প্রতি কি অসাধারণ গভীর ভালোবাসার নমুনা রয়েছে এ আলোচনায়! বেগম রোকেয়ার ধার্মিকতানিয়ে মুসলিম সমাজে যেভাবে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হয়নি। ফলে দেশ-বিদেশে তাঁর কর্ম-চিন্তা ও ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
মিসেস এ্যানি বেশান্তের ‘ইসলাম’ শীর্ষক একটি বিখ্যাত ইংরেজি প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছিল। তার গভীর তাৎপর্য উপলব্ধি করে ‘নূর ইসলাম’ নামে বেগম রোকেয়ার মতিচূর ২য় খণ্ডে তা প্রকাশ করা হয়। ইসলামের আলো শিরোনামে ঐ প্রবন্ধে কী অসাধারণরূপে ইসলাম জ্যোতির স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে, তা না পড়লে অনুধাবন করা যাবে না, ইসলামের সৌন্দর্য বর্ণনায় বেগম রোকেয়ারও কী আকূল মনোভাব বিরাজ করত। খ্রিস্টান জগতের পোপ (দ্বিতীয় মিসলউটিয়র) যিনি খ্রিস্টান ধর্মে অতি উকৃষ্ট পণ্ডিত গুরু ছিলেন, তিনি মুসলমানদেরই কর্ডোভা মাদরাসায় অঙ্ক শাস্ত্র শিক্ষা করেছিলেন। এ কারণে লোকে তাকে বিধর্ম্মী বলে জনসমাজে অপদস্থ করেছিল এবং তাঁকে ‘শয়তানের বাচ্চা’ বলা হয়েছিল। এতে স্পষ্টই জানা যায় সে সময় ইউরোপের খ্রিস্টান বিভাগ কেমন ঘোর মূর্খতায় তমসাচ্চন্ন ছিল। আর কেবল ইসলামের অনুবর্ত্তিগণই তাদের (ইউরোপীয়দের) জ্ঞানের আলোকরশ্মি দেখায়েছিলেন। (রচনাবলি, পৃ,-৯৫)। জাগো মাতা, ভগিনী, কন্যা-উঠ, শয্যা ত্যাগ করে আস, অগ্রসর হও। ঐ শুন. মোয়াজ্জিন’ আজান দিচ্ছে। তোমরা কি ঐ আজানধ্বনি, আল্লাহর ধ্বনি শুনিতে পাও না? উঠ, এখন আর রাত নেই। এখন সুবহে সাদিক। মোয়াজ্জিন আজান দিচ্ছেন। যৎকালে সমগ্র জগতের নারী জাতি জেগে উঠিয়াছে, তারা নানাবিধ সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তারা শিক্ষামন্ত্রী হয়েছে, তারা ডাক্তার, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, যুদ্ধমন্ত্রী, প্রধান সেনাধ্যক্ষ, লেখিকা, কবি ইত্যাদি হচ্ছে, আমরা বঙ্গ নারী গৃহ কারাগারে অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে পড়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছি আর যক্ষèা রোগে ভুগে হাজারে হাজারে মরছি। (রোকেয়া রচনাবলি, পৃ-৩৯৯)।
বেগম রোকেয়ার ধার্মিকতা উপলব্ধি করতে হলে বিভিন্ন সময়ে তার অতি পরিচিতজনদের নিকটে লিখিত পত্রাবলিতে তার বহু স্মৃতি লুকিয়ে আছে। প্রায় সবপত্রই কোলকাতা বা কোলকাতার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল থেকে লিখিত ছিল। এখানেই তার জীবন বাতি আলোকিত হয়ে উঠেছিল। তিনি জীবনের সবটুকুই এখানেই বিসর্জন দিয়েছিলেন। এখান থেকেই তার সকল পত্র লিখিত হয়েছে। ২৫/৪/১৯৩২ সালে লিখিত তার একটি পত্রে তিনি তার অতিঘনিষ্ঠ এক ভাইয়ের নিকটে পত্রে উল্লেখ করেন-‘‘চিরকাল আমি স্ত্রী স্বাধীনতার জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছি। আর আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ আমাকে এতে সাহায্য করবেন এবং একমাত্র আল্লাহই আমার ভরসা। আমাকে অনেক দুঃখ দিয়ে তিনি পরীক্ষা করছেন, কিন্তু আমার আশা যে, শিগগিরই তিনি আমাকে দয়া করবেন। প্রতিদিন ভোরে আমি পাক কুরআনের ২/১ পৃষ্ঠা পড়লে বড় শান্তি পাই। কত সান্ত্বনা রয়েছে এই কথা ক’টিতে ‘‘আমি এ দুনিয়ায় কিছু চাই না, আমার পুরস্কার জমা রয়েছে সারা দীন দুনিয়ার মালিকের কাছে। (আল কুরআন-২৬ : ১০৯, ২৬ : ১২৭, ২৬ : ১৪৫, ২৬ : ১৬৪, ২৬ : ১৮০, ১১ : ২৯, ১১ : ৫১)। বেগম রোকেয়া যে কুরআনের অর্থ ভালভাবে বুঝতেন এখানে তার প্রমাণ রয়েছে।
১৬/৮/১৯৩১ সালে খানবাহাদুর তসদ্দক আহমদকে লিখিত এক পত্রে উল্লেখ করা হয়Ñ ভাই সাহেব, আপনার চিটি পেয়ে খুশি হয়েছি। এখানে কোলকাতায় ভালোভাবে নিশ্বাস নেবারও যেন অবসর পাওয়া যয় না। আপনার চিঠির উত্তর সঙ্গে সঙ্গেই দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পর মুহূর্তেই সাংঘাতিক কাজের চাপে তলিয়ে গেলাম। ১৪ তারিখেই আমাদের মিলাদ শরীফ হলো। সেজন্য ১১ তারিখে আমাকে সব দাওয়াতের চিঠির বিলি-বন্দোবস্ত করতে হলো। … ভাই সাহেব, আমাদের সমাজের কাছ থেকে আমি সম্মান বা খ্যাতি কিছুই চাই না। আমি শুধু চাইযে, তারা সত্যিকার মুসলমান হবার জন্য চেষ্টা করুন। আপনি শুনে খুশি হবেন যে, মি. ইসলামও বলেন যে, তিনি ভুয়ো পর্দা প্রথার পক্ষপাতী নন। কিন্তু অনেকেই কথায় ওরকম বলে, কিন্তু কাজে দেখায় না। আমার শুভেচ্ছা নেবেন। খোদা আপনার মঙ্গল করুন।’’ প্রাপক অজ্ঞাত এক পত্রে (৬/৯/১৯৩১) উল্লেখ করা হয়- বাইবেল বলে, ‘শরীরে জোর না থাকলে মনের জোরও থাকে না। কিন্তু আমার শরীরের জোর না থাকলেও মনে জোর আজও আছে। কিন্তু সময় নাই। কি করে আমি বিশ্রাম নেব? কেমন করে আমার ভাবনা কমবে? আল্লাহ পাক কুরআনে বলে দিয়েছেন, ‘কেউ অন্য কারো ভার বহন করবে না। (আল-কুরআন, বনী ইসরাইল : ১৫, ৩৫ : ১৮)। ৩০/৪/১৯৩১ সালে লিখিত স্নেহস্পদ মোহসেনা রহমানকে এক পত্রে উল্লেখ করা হয়-আর যদি পারি প্রাণভরে একটু আল্লাহকে ডাকি। তা ছাই ডাকতেও পারি না। আমার মত দুর্ভাগিনী, অপদার্থ বোধ হয়, এ দুনিয়ায়, আর একটা জন্মায়নি।… আল্লাহর নিকট তোমাদের কুশল কামনা করি।’ (রোকেয়া রচনাবলি, পৃ-৫১৩)।
১৩৩৮ জ্যৈষ্ঠ মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় তার লিখিত ‘ধ্বংসের পথে বঙ্গীয় মুসলিম’ প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়-আদর্শ মোসলেম বালিকা বিদ্যালয়ে আদর্শ মোসলেম নারী গঠিত হবে। যাদের সন্তান-সন্ততি হবে হজরত ওমর ফারুক, হজরত ফাতেমা, জোহরার মত। এর জন্য কুরআন শরীফ শিক্ষার বহুল বিস্তার দরকার। কুরআন শরীফ, অর্থাৎ তার উর্দ্দু এবং বাংলা অনুবাদের বহুল প্রচার একান্ত আবশ্যক। ছেলেবেলায় আমি মা’র মুখে শুনতুম-‘কুরআন শরীফ ঢাল হয়ে আমাদের রক্ষা করবে।’ সে কথা অতি সত্য। অবশ্য তার মানে এ নয় যে, খুব বড় আকারের সুন্দর জেলদ বাঁধা কুরআন খানা আমার পিঠে ঢালের মতো করে বেঁধে নিতে হবে। বরং আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আমি এ বুঝি যে, কুরআন শরীফের সর্বজনীন শিক্ষা আমাদের নানাপ্রকার কুসংস্কারের বিপদ থেকে রক্ষা করবে। কুরআন শরীফের বিধান অনুযায়ী ধর্ম-কর্ম আমাদের নৈতিক ও সামাজিক অধঃপতন থেকে রক্ষা করবে।”(রচনাবলি, পৃ-৪০৮)।
কুরআনের জ্ঞান সম্পর্কে বেগম রোকেয়ার গভীরতা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। তার অগ্রন্থিত প্রবন্ধ ‘গুলিস্তাঁ’য় উল্লেখ করা হয়-ফাদখুলি ফি ইবাদি ওয়াদকুলি ফি জান্নাতি। (আল-কুরআন-৮৯:২৯)। অর্থাৎ ‘আমার বাগানের মধ্যে আইস এবং আমার বাগানের মধ্যে প্রবেশ কর। মানবের চরম লক্ষ্য সেই গুলিস্তাঁ। যা আল্লাহ পূণ্যাত্মাদের দান করবেন। যেই গুলিস্তাঁয় প্রবেশ করতে আল্লাহ নিমন্ত্রণ করেছেন। সৃষ্টিকর্তার কি অপার মহিমা! তিনি মাটি ও ধুলা থেকে ফুল উৎপন্ন করেছেন। তা থেকে এই শিক্ষা পাই যে, আমরা যতই পাপিষ্ঠ হই না কেন অনুতপ্ত চিত্তে তওবা করলে আমাদের সব কলুষ ধুয়েমুছে যাবে, আমাদের মন ফুলের মত পবিত্র হবে। পাপপঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হতে পারলেই আমরা ফুল হতে পারব। ফুল থেকে শ্রেষ্ঠ আর কোন বস্তু পৃথিবীতে আছে কি? ফুল অমূল্য ধন। (রচনাবলি, পৃ-৪১৪)। রোজাব্রত আমাদের সংযম শিক্ষা দিয়ে থাকে। এই রোজা যথানিয়মে পালন করলে সামাজিক, শারীরিক, মানিসিক বা আধ্যাত্মিক কল্যাণ হয়। মানুষ মাত্রই সংযম শিক্ষা আবশ্যক। এজন্য দেখা যায়, পৃথিবীর প্রায় সমুদয় ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে কোন না কোন প্রকারের উপবাসব্রত বর্তমান আছে। (রোকেয়া রচনাবলি, পৃ-৩৪৫)।
ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বেগম রোকেয়ার যে গভীর পাণ্ডিত্য ছিল, এখানে তার প্রমাণ রয়েছে। সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীকে অশিক্ষা-কুসংস্কারে রেখে জাতীয় মুক্তির চিন্তাই করা যায় না। তিনি কুরআনের অর্থ গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারতেন বলেই তার হৃদয়ে কোন সঙ্কীর্ণতার ছাপ ছিল না। এ জ্ঞান তাকে উদার হতে শিক্ষা দিয়েছিল। সৎকর্ম বা আমলে সালিহ ছাড়া শুধু, সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত আদায়ের মাধ্যমে দুনিয়া বা আখিরাতে মানুষের মহামুক্তি বা কোন সম্মান-মর্যাদা নেই-কুরআনের এই গভীর অনুশীলন বেগম রোকেয়ার মনে দানা বেঁধেছিল। কুরআনের ৯৩টি স্থানে ঈমান এবং সৎকর্মের মাধ্যমে মানুষের ভাগ্য এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়- এখানে নারী-পুরুষকে পৃথকভাবে ভাবার কোন সুযোগ নেই। প্রত্যেকের মেধা-মননশীলতা থেকেই জাতীয় মুক্তির সূত্র সৃষ্টি হয়। কুরআনেও তার বহু সমর্থন রয়েছে। একে অপরের সহযোগিতা ছাড়া মহামুক্তির এই পথ আবিষ্কার হয় না। বেগম রোকেয়া এ বিশ্বাস সৃষ্টির জন্যই সারা জীবন লড়াই করেছেন হাতে-কলমে এবং তিনি তার কর্মে সফলও হয়েছিলেন। জাতি তাকে কখনোই ভুলে যেতে পারে না।
লেখক : বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা), অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (ইসলামের ইতিহাস), বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মাউশি, ঢাকা।