বেগম রোকেয়ার অবরোধ বাসিনী ও একটি মীমাংসাদর্শন
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৩৯
॥ নূরুন্নাহার নীরু ॥
‘অবরোধ বাসিনী’ বেগম রোকেয়ার সাহিত্য কর্মের একটি অন্যতম গ্রন্থ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বেগম রোকেয়া তাঁর সময়কে ধারণ করেই উক্ত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তার এ রচনা তাঁর দূরদর্শী চিন্তা ও কর্মের এক যুগান্তকারী স্বাক্ষর। তাঁর রচনাবলি কখনো সংস্কারমূলক, কখনো রম্যরসনা বা ব্যঙ্গ বিদ্রƒপাত্মক, যা সমাজকে ঘা মেরে সচেতন করে তোলার প্রয়াস সংশ্লিষ্ট ছিল।
কবি, সাহিত্যিক আব্দুল কাদির, বেগম রোকেয়ার সাহিত্য কীর্তি শিরোনামে ‘অবরোধ বাসিনী’ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তাঁর অবরোধ বাসিনী গ্রন্থে ৪৭টি অবরোধ সম্পর্কিত দুর্ঘটনার উপাদেয় কাহিনী আছে। অতুলনীয় শ্লেষ ও লিপিকুশলতার সঙ্গে তিনি সেগুলো বর্ণনা করিয়াছেন।’
সত্যিকার অর্থেই এ গ্রন্থের প্রতিটি কাহিনীই তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে, আবার কারো বর্ণনা শুনে বা লেখা থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে বর্ণিত। যা তৎকালীন সমাজে পর্দা প্রথার নামে নারীদের এক বীভৎস (!) রূপকে তুলে ধরেছিলেন তিনি। কী হিন্দু! কী মুসলিম সমাজ! কোনো সম্প্রদায়েই নারীর স্বাধীনতা প্রকাশ, শিক্ষা গ্রহণ, ক্ষমতায়ন কোনোটিরই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ছিল না, যা এ সমাজে বসে আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। বর্তমান সময়ে বেগম রোকেয়ার অবরোধবাসিনী যারা পড়েছেন বা পড়ে থাকবেন সকলেই এক বাক্যে বিস্ময় প্রকাশ করে বলবেন, ‘এমনও কি হতে পারে? আদতেই নারীদের অবস্থা এমনি ছিল? সেও কি ভাবা যায়? হ্যাঁ বিষয়টা ‘একবাক্যেই অনস্বীকার্য।’ যেহেতু তিনি তার চারপাশের অবস্থা দর্শনেই লিখে গেছেন সে সব কাহিনী।
কিন্তু যখন ঐ বিষয়গুলোর সাথে ধর্মকে জড়িয়ে বিশেষ করে ইসলামকে কটাক্ষ করতে কোনো নিন্দুকের ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন হয়; তখন তার প্রতিবাদ না করে উপায় নেই। আমি অন্তত জোর গলায় বলতে চাই তৎকালীন সে সমাজ ব্যবস্থা কখনোই ইসলামের অনুসারে নয়, বরং নিজেদের মনগড়া বিধিবিধানে নিবদ্ধ ছিল এবং এর পেছনে কারণও ছিল কিছু। যেমন- সমাজে (ক) নারী নামক একটা অংশকে দাবিয়ে রাখা, (খ) কৌলিন্যপ্রথার জয়জয়কার জিইয়ে রাখা, গ) নারীনির্যাতন, নিষ্পেষণের দ্বার প্রশস্ত রাখা, ঘ) কায়েমী স্বার্থবাদিতাকে পুষে রাখা, ঙ) সর্বোপরি অজ্ঞতা, যা পুরুষদের মধ্যেই ছিল প্রবল। পুরুষ যদি সুশিক্ষিত হতো, তাহলে সে সমাজে নারীরাও তার আলো লাভ করতে পারত।
প্রকৃতার্থেই ইসলামে নারীদের উপরোক্তভাবে কোণঠাসা করে রাখার কোনোই বিধান নেই। যেমনটা বেগম রোকেয়ার যুগে ছিল; কোনো অভ্যাগতা বা নারী মেহমান বা বাইরের মহিলা দেশি কি ভিনদেশি কারো সাথেই বাড়ির শিশু থেকে সমুত্থ কন্যারা দেখা দিতে পারতো না- রীতিমতো লুকিয়ে থাকতে হতো! এমন কথাতো আল-কুরআনের কোথাও নেই! আল-কুরআন ও হাদীসের জ্ঞানানুযায়ী বিবৃত আছে : ১৪ জন পুরুষের সাথে দেখা দেয়া ছাড়া বাকি সবার সাথেই পর্দার হুকুম পালিত এবং সে পর্দার ব্যাপারেও বলা হয়েছে- বুক, মাথা, গ্রিবা ঢেকে রাখা ফরজ। মূলত ইসলামে সতর ঢাকার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। সৌন্দর্য দেখিয়ে না বেড়ানোর কথা বলা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে পুরুষের সাথে ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে।
অথচ বেগম রোকেয়ার সে যুগে নারীরা মহাবিপদে পড়লেও উহু শব্দটি পর্যন্ত করতেন না কণ্ঠের পর্দার স্খলন হবে বলে, আবার এমন ধরনের আলখেল্লা জাতীয় বোরকা পরতেন যাতে দেখে চলার ব্যবস্থা থাকতো না কিংবা থাকলেও তা সরাসরি চক্ষুষ্মান যথাস্থানে থাকতো না, তার ওপর আবার মশারি টানিয়ে চলাচলের বিধিও বিদ্যমান ছিল! পাল্কিতে চড়লেও পাল্কিটিকে ও চারদিক ঘিরে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হতো চাদর বা বস্তার পরতে! এসবই ছিল পর্দার নামে মনগড়া-বাড়াবাড়ির শামিল। বলা যায় ধর্মীয় শিক্ষার অভাবই বরং এক্ষেত্রে অধিক অকার্যকর অবস্থা বয়ে এনেছিল। যেমন- বেগম রোকেয়া অবরোধ ‘বাসিনীর’ ভূমিকাতে বলেছেন, ‘এ স্থলে বলিয়া রাখা আবশ্যক যে, গোটা ভারতবর্ষে কুলবালাদের অবরোধ কেবল পুরুষদের বিরুদ্ধে নহে, মেয়ে-মানুষদের বিরুদ্ধেও। অবিবাহিতা বালিকাদিগকে অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া এবং বাড়ির চাকরানি ব্যতীত অপর কোনো স্ত্রীলোকে দেখিতে পায় না। বিবাহিতা নারীগণও বাজীকর-ভানুমতী ইত্যাদি তামাশাওয়ালী স্ত্রীলোকদের বিরুদ্ধে পর্দা করিয়া থাকেন। যিনি যত বেশি পর্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশি পেঁচকের মতো লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনিই তত বেশি শরীফ। শহরবাসিনী বিবিরাও মিশনারী মেমদের দেখিলে ছোটাছুটি করিয়া পলায়ন করেন। মেমতো মেম- শাড়ি পরিহিতা খ্রিস্টান বা বাঙালি স্ত্রীলোক দেখিলেও তাঁহারা কামরায় গিয়া অর্গল বন্ধ করেন।’ বলা যায় এ উক্তিগুলো থেকেও তৎকালীন সমাজের চিত্র প্রচ্ছন্ন। কিন্তু যারাই এ সবকে ধর্মীয় বিধান মনে করেন, আরো মনে করেন যে, ধর্মই তৎকালীন নারীদেরে অর্গলবন্দী করেছিল তাদের সুবাদেই আমার এ লেখা। আল-কুরআন বলছে- ‘হে নবী! মুমিন পুরুষদের বলে দিন, তারা যেন নিজেদের চোখকে বাঁচিয়ে চলে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফাজত করে। এটা তাদের জন্য উত্তম। যা তারা করে আল্লাহ সে বিষয়ে পুরোপুরি অবহিত। আর হে নবী! মুমিন স্ত্রীলোকদের বলে দিন, তারা যেন নিজেদের চোখকে বাঁচিয়ে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফাজত করে ও নিজেদের সাজসজ্জা না দেখায়। কেবল সেই সব স্থান ছাড়া যা আপনা থেকেই প্রকাশিত হয়ে পড়ে, তাছাড়া নিজেদের সাজসজ্জা প্রকাশ না করে। তারা তাদের চাদর/ওড়না দিয়ে যেন গলা ও বক্ষ ঢেকে রাখে।’ (সূরা নূর : ৩০-৩১)। আল-কুরআন আবার বলছে, “যে সকল অতিবৃদ্ধা স্ত্রী লোক পুনরায় কোনো বিবাহের আশা পোষণ করে না, তারা যদি তাদের বহিরাবরণ খুলে রাখে, তা হলে তাতে কোনো দোষ নেই। তবে শর্ত এই যে, বেশভূষা প্রদর্শন করা যেন তাদের উদ্দেশ্য না হয়। এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা তাদের জন্যে মঙ্গলময়। আর আল্লাহ সবকিছু জানেন ও শুনেন।” (নূর : ৬০)। আরো আছে- ‘হে নবী! তোমার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ ও মুমিন মহিলাদের বলে দাও, তারা যেন নিজেদের ওপর নিজেদের চাদরের আঁচল টেনে দেয়। এতে তাদের আভিজাত্য চিনতে পারা যাবে ও ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (আহযাব : ৫৯)। এ আয়াতটা ইভটিজিং থেকে বেঁচে থাকার একটি মোক্ষম ইঙ্গিত। প্রসঙ্গক্রমে আরো একটি আয়াত দ্রষ্টব্য, “হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা সাধারণ স্ত্রীলোকদের মতো নও। তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় কর তবে বিনিয়ে বিনিয়ে কথা বলো না। যাতে দুষ্টু মনের কোনো ব্যক্তি খারাপ আশা পোষণ করতে পারে বরং সোজা সাপ্টা স্পষ্ট কথা বল।” (সূরা আহযাব : ৩২)। আল হাদীস থেকে জানা যায় : নবী করিম সা. একবার তাঁর শ্যালিকা হযরত আসমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বলেছিলেন, ‘হে আসমা! সাবালিকা হওয়ার পর ইহা ও ইহা ছাড়া (মুখমণ্ডল ও হাতের কব্জি দেখিয়ে) শরীরের কোনো অংশ দেখানো স্ত্রীলোকের পক্ষে জায়েজ নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহর অভিশাপ ওই সকল নারীর ওপর যারা কাপড় পরেও উলঙ্গ থাকে।’ আরো জানা যায়, হাফসা বিনতে আব্দুর রহমান একবার সূক্ষ্ম দোপাট্টা পরে হযরত আয়েশার সম্মুখে এলে তিনি তা ছিড়ে ফেলে দিয়ে মোটা চাদরে তাকে ঢেকে দেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)।
মূলত পোশাকে আচ্ছাদিত শরীর যেমনই সৌন্দর্যকে ঢেকে রাখে, তেমনি শোভাও বর্ধন করে। আল-কুরআন নিজেই একথার ঘোষণা দিচ্ছে, “হে আদম সন্তান! আমি তোমাদের জন্য পোশাক নাজিল করেছি যেন তোমাদের দেহের লজ্জাস্থানকে ঢাকতে পারো। এটা তোমাদের জন্য দেহের আচ্ছাদন ও শোভাবর্ধনের উপায়, তবে সর্বোত্তম পোশাক হলো ‘তাকওয়ার পোশাক’। উহা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি উজ্জ্বল নিদর্শন, সম্ভবত লোকেরা উহা হতে শিক্ষা গ্রহণ করবে।” (আ’রাফ : ২৬)।
লেখক আবুল কাসেম হায়দার তাঁর মনীষী ভাবনা গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, চরিত্রবান, ইসলাম ধর্মের মৌলিক আদর্শে বিশ্বাসী সমাজ সংস্কারক। তিনি তাঁর বোরকা প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘কেহ কেহ বোরকা ভারী বলিয়া আপত্তি করেন। কিন্তু তুলনায় দেখা গেছে ইংরেজ মহিলাদের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হ্যাট অপেক্ষা আমাদের বোরকা অতি ভারী নহে।’ সত্যিকার অর্থেই যে বোরকা মূলতই পর্দার জন্য তিনি তারই উদাহারণ এখানে তুলে ধরেছেন। ওই প্রবন্ধে তিনি আরো বলেছেন, ‘আমরা উপকারী পর্দা করব।’
তথাপি তিনি অবরোধবাসিনী গ্রন্থ রচনা করে সমাজকে সচেতন করতে চেয়েছেন যাতে ওই সব কৃত্রিম পর্দা থেকে নারীজাতি রেহাই পায়। সে গ্রন্থ থেকে বোঝা যায় তৎকালীন সমাজ পর্দার নামে নারীদের কেমন নিগ্রহের মধ্যে রেখেছিল। তাঁর বর্ণিত ১নং গল্পটি থেকে জানা যায়, আঙিনায় অজুরত ‘আ’ শাহজাদীর সম্মুখে হঠাৎ ঢুকে পড়া লম্বা চওড়া কাবুলী মহিলাকে দেখে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তা তাঁরই বর্ণনা মতে, ‘আলতার মার হাত হইতে বদনা পড়িয়া গেল, সে চেঁচাইতে লাগিল- ‘আঁউ! আঁউ! মরদটা কেন আইল!’ সে স্ত্রীলোকটি হাসিয়া বলিল, ‘হে মরদানা! হাম মরদানা হ্যাঁয়!’ সেই টুকু শুনিয়াই ‘আ’ সাহেবজাদী প্রাণপণে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া তাহার চাচী আম্মার নিকটে গিয়া হাঁফাইতে হাঁফাইতে ও কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন, ‘চাচিআম্মা পায়জামা পরা একটা মেয়ে মানুষ আসিয়াছে!’ হায়রে জ্ঞান! কতটা কম শিক্ষা থাকলে একেতো পায়জামা পরা তার ওপর বাইরের মহিলা বলে পর্দা লঙ্ঘনের ভয় ঢুকে গেছিলো আলতার মা ও ‘আ’ সাহেবজাদীর। এরকম গল্প আরো আছে। ২নং গল্পটি থেকে জানা যায় পাল্কি চড়ে বিয়ে বাড়িতে যাওয়া জনৈকা হাশমত বেগম ভুলক্রমে পাল্কি থেকে নামতে না পারায় প্রচণ্ড শীতে সারারাত পাল্কিতেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন কোলের শিশুকে নিয়ে তবু কণ্ঠ খুলে বলতে বা জানাতে পারেননি তার অবরুদ্ধ হয়ে থাকার কথা। হায়রে পর্দা!
আর বাক্সপেট্টা, বোচকা, বস্তার মতো স্টেশনে ফেলে রাখার মতো করে নারীদের বসিয়ে রাখা বা মালগাড়ির বগিতে চড়া, এমনকি একের সাথে অপরকে বেঁধে দিয়ে পথ চলানোর কাহিনীও তিনি বিবৃত করেছেন বেশ কয়েকবার, যা ছিল নিতান্তই অমর্যাদাকর ও অমানবিক বিষয়। এসব কখনোই ইসলামের অনুসরণ নয় বরং বাড়াবাড়ি করে ইসলামী বিধানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলা। রোকেয়ার দেখানো তৎকালীন সমাজের উক্তরূপ পর্দা শুধু বঙ্গীয় মুসলিম সমাজেই নয় সনাতনী হিন্দুদের মধ্যেও যে বিদ্যমান ছিল না, তা নয়। যেমন তাঁর ১২নং গল্পে বলেছেন, স্বামীর চেহারা দেখতে না পাওয়া জনৈকা হিন্দু বধুর করুণ কাহিনী। বধূটি স্বামী শাশুড়ির সাথেই গঙ্গাস্নানে গিয়েছিল বটে কিন্তু স্নান শেষে ভিড়ের মাঝে তাদের হারিয়ে বধূটি জনৈক ভদ্রলোকের কাছার খুঁটি ধরে হাঁটতে লাগলো। রোকেয়ার নিজ বর্ণনা : কতক্ষণ পরে পুলিশের হল্লা। সেই ভদ্রলোককে ধরিয়া কনস্টেবল বলিল, ‘তুমি অমুকের বৌ ভাগাইয়া লইয়া যাইতেছ।’ তিনি আচম্বিতে ফিরিয়া দেখেন, আরে! এ কাহার বৌ পিছন হইতে তাহার কাছার খুঁটি ধরিয়া আসিতেছে। প্রশ্ন করায় বধূ বলিল, সে সর্বক্ষণ মাথায় ঘোমটা দিয়ে থাকে- নিজের স্বামীকে সে কখনো ভাল করিয়া দেখে নাই। স্বামীর পরিধানে হলদে পারের ধূতি ছিল, তাহাই সে দেখিয়াছে। এ ভদ্রলোকের ধূতির পাড় হলদে দেখিয়া সে তাহার সঙ্গ লইয়াছে! ‘কল্পনা করা যায়! সেদিন পুলিশের হস্তক্ষেপ না পড়িলে সে মহিলার কি দুর্গতি হতো! ৪১ নং গল্পে তিনি বলেছেন গঙ্গাস্নানের দৃশ্য দেখার কথা। যেখানে বেহারারা পাল্কিসমেত ভেতরে আবদ্ধ রমণীকে গঙ্গায় নামিয়ে কয়েক চুবানি দিয়ে তুলেছিল। এ বর্ণনাটি ছিল ‘রায় শ্রীযুক্ত জলধর সেন বাহাদূররের ১৩৩৫ সনে লেখা, ‘সেকালের পর্দ্দা’ নামক গল্পের বিবৃতিতে। রায় সাহেবের নিজ বর্ণনা : ‘আমার হাসি এলো পাল্কির গঙ্গাস্নান দেখে; আর মনে কষ্ট হতে লাগল পাল্কির মধ্যে যাঁরা ছিলেন, তাদের অবস্থা স্মরণ করে। এই শীতের সন্ধ্যায় পাল্কির মধ্যে মা-লক্ষ্মীরা ভিজে কাপড়ে হি হি করে কাঁপছেন। এদিকে তাদের স্নান যা হলো, তাতো দেখতেই পেলাম। এরই নাম পর্দ্দা।’ এরকম আরো কাহিনী বর্ণিত আছে অবরোধবাসিনীতে যেখানে মেয়েদের নামটা পর্যন্ত গোপন রাখা, স্বামীর নাম না বলা, চিকিৎসার ক্ষেত্রে অভিনব বিষয়াদি মেনে চলা এমন কী বিবাহের ক্ষেত্রেও নারীর মতামতের মোটেও তোয়াক্কা না করা। এমনকী বিবাহের পূর্বে অন্তত ছ’মাস আগে থেকে ‘মাইয়াখানা’ নামক বন্দীঘরে আবদ্ধ রাখার প্রথা ছিল যা বিশেষ করে ইসলাম ধর্মীয় বিধানের সাথে দূরতম সম্পর্কযুক্ত নয়। আরো অনেক উদ্ভট উদ্ভট কাহিনী আছে যা পড়ে শুধু হাসিই নয় কষ্টেও পড়তে হবে এ প্রজন্মকে। মূলত বেগম রোকেয়া ছিলেন শতাব্দীর সংস্কারক।
যখনি কোনো সমাজ অজ্ঞতা আর গোঁড়ামিতায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে তখনি সে সমাজের মুক্তি আল্লাহ রাব্বুলের পক্ষ থেকেই ঘটবে। আর তা তিনি মানুষকে দিয়েই তার সমাধান করে থাকেন।
বেগম রোকেয়ার সেই যুগ ভবিষ্যতেও যে আবার ফিরে আসবে না, তাও বলা যায় না। হয়তো রূপ বদলাবেÑ এর কারণ হচ্ছে মানুষ যদি প্রকৃত জ্ঞানের উৎস আল কুরআনের শিক্ষা থেকে দূরে সরে যায় বা ধর্মের নামে নিজেদের মনগড়া বিধানের দোহাই দিয়ে যায়, তবে তা ঘটা খুবই স্বাভাবিক। আমাদের আজকের সমাজের দিকে একটু চোখ খুলে তাকালেই আমরাও দেখবো এখনি শুরু হয়ে গেছে একটি শিক্ষিত মহল থেকেইÑ যারা কন্যা সন্তানদেরে আরবি হরফ ছাড়া বাংলা, ইংরেজি কিছুই শেখাচ্ছেন না, শেখালেও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক নয় বরং ঘরে রেখেই শেখাচ্ছেন। খুব দ্রুতই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন মেয়ের মতামতের তোয়াক্কা না করেই। চিকিৎসার জন্য লেডি ডা. ছাড়া চলবে না যেমন, ঠিক তেমনি লেডি ডা. তৈরি হবার জন্য পথ উন্মুক্ত রাখছেন না নিজ পরিবারের জন্য। এভাবে যদি চলতে থাকে তবে মহিলা শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারে আস্তে আস্তে ভাটা পড়বে এবং একসময়ে বেগম রোকেয়ার যুগ চলে আসবে। সেদিন আবার প্রয়োজন হবে ২য় কোনো রোকেয়ার। উচ্ছেদ হবে প্রাকৃতিক নিয়মেই অবরোধবাসিনীর অজ্ঞতাপ্রসূত বিধিবিধান।
তাই চলুক জ্ঞানার্জন, চলুক নারী জাগরণ! পর্দা প্রথা পালন করে এখন থেকেই যারা সমাজের সর্বত্র করছে বিচরণ- প্রশস্ত হোক তাদের আগমন। তবেই স্বার্থক হবে বেগম রোকেয়ার স্বপ্নপূরণ। সুতরাং তাঁর সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলে যাই- তার বোরকা প্রবন্ধে উদ্বৃত সেই কথাই; ‘আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠনসহ মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নাই।’
লেখিকা : নারী অধিকার আন্দোলন, সাহিত্য সংস্কৃতি গবেষণা বিভাগ প্রধান।