সম্পাদকীয় : ফ্যাসিজম ও রেসিজমের বিপদজালে ভারত
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:২২
দাদাগিরির দিন শেষ, এবার সমতা আর সম্মানজনক সম্পর্কের কথা ভাবতে হবে। অবশেষে ভারত এ সত্য উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। কিন্তু কথায় আছে¬- বিপদ কেটে গেলে উপলব্ধির পারদ নিম্নগামী হয়। তাই আমাদের আশঙ্কামুক্ত থাকার উপায় নেই। বরং সতর্র্কতা আরো বাড়াতে হবে। দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। বাণিজ্য; বিশেষ করে নিত্যপণ্য আমদানি, চিকিৎসা এবং ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশিদের বিকল্প অবশ্যই হাতে রাখতে হবে। সার্কভুক্ত সব দেশ এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশ; যেমন- চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ মুসলিমবিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্য সম্পর্কোন্নয়ন বাড়িয়ে ভারতনির্ভরতা কমালে অবশ্যই বাংলাদেশ লাভবান হবে। ভারতের দাদাগিরি এবং কথায় কথায় খোঁটা- ‘চাল, পেঁয়াজ, আলু… না দিলে বাংলাদেশের মানুষ শুকিয়ে মরবে’ বন্ধ হবে।
বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। বর্তমানে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী জনতার যে শক্তি ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে দেশছাড়া করে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের পক্ষে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে, তারা সবাই ভারতের সাথে সমর্মাদার ভিত্তিতে সুসম্পর্কের পক্ষে। তাহলে আর সমস্যা কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ভারতের অনেক সাংবাদিক ও বিশ্লেষক কঠিন মন্তব্য করেছেন। তাদের অনেকে বলেছেন, ‘ভারতে এখন চলছে মূর্খ ধর্মান্ধ উগ্রহিন্দুত্ববাদীদের শাসন। যারা হিন্দু ধর্ম অনুসরণ নয়, রাজনীতির স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে। তারা বাংলাদেশকে কাশ্মীর, পশ্চিমবঙ্গ, তালিমনাড়ু, ঝাড়খণ্ডের মতো করে শাসন করতে চায়। তারা চায়, তাদের ইচ্ছায় বাংলাদেশে সরকার বদল হবে এবং চলবে…। তারা আসলে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব মেনে নিতে পারছে না।’ তারা আরো মনে করেছেন, বাররি মসজিদের মতো ঐতিহাসিক মসজিদ ভেঙে যাদের রাজনীতির উত্থান, যারা গুজরাটকে কসাইখানায় পরিণত করেছিল, সংখ্যালঘুদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলেছে, তারাই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ করছে- এ যেন মাছের মায়ের পুত্রশোক। তাদের এ মন্তব্য এ কথাই প্রমাণ করেÑ ভারত ও বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। দুই দেশের জনগণই সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক চায়। কিন্তু সমস্যার মূল ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী। যারা রেসিজম (বর্ণবাদ) ও ফ্যাসিজম (জুলুমতন্ত্র) কায়েম করে ভারত শাসন করছে।
ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) টানা ক্ষমতায় থাকার নেপথ্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে ভোট জালিয়াতির কথা বের হয়ে আসছে। এশিয়া টাইমসের দিল্লিভিত্তিক কলাম লেখক রবি কান্ত সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর বোঝা যাচ্ছিল মোদির বিজেপি তাদের শক্তি ও জনসমর্থন হারিয়েছে।.. কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফল সবাইকে হতবাক করে দেয়। ভোটের প্রাথমিক প্রবণতা কংগ্রেসের পক্ষে থাকলেও চমক লাগানো মোড় নিয়ে শেষ পর্যন্ত বিজেপি জয়লাভ করে। ভোট গণনার পর দেখা যায়, বিজেপি ৯০টির মধ্যে ৪৮টি আসনে জিতে হ্যাটট্রিক করেছে এবং ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। ২০০০ সালের পর থেকে এটি ছিল তাদের সেরা ফল। অথচ ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি ১০টির মধ্যে ৫টি সংসদীয় আসনে পরাজিত হয়েছিল। এ রাজ্যে বিজেপি ১৯টি আসনে ৫০ শতাংশের বেশি এবং ৩৯টি আসনে ৪০-৫০ শতাংশ ভোট পেয়েছে; যেখানে কংগ্রেস যথাক্রমে ১২ ও ৩২ আসনে এ পরিমাণ ভোট পেয়েছে। এ রাজ্যে বিজেপি ৪৬ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতার লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে। এটি কেমন করে সম্ভব হলো, তা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে একটি বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারবিরোধী মনোভাবের তীব্রতা, মোদির জনপ্রিয়তায় ধস, নেতৃত্বের সংকট, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পরও বিজেপি যে অসাধারণ সাফল্য পেয়েছে, তা যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্য প্রায় অসম্ভব একটি অর্জন।… কারণ এখানে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য স্বচ্ছতার অভাব স্পষ্ট। বর্তমানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোদি সরকারের অধীন অর্থ সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। এটি স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করে। এটি এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যেন একজন অভিযুক্ত তার নিজের পছন্দমতো বিচারক বেছে নিচ্ছেন। নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধারের জন্য নির্বাচন কমিশনের উচিত ইভিএমে এমএফএ যুক্ত করা অথবা পুরোনো কাগজের ব্যালট পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া। অন্যথায় ভারতের নির্বাচন পদ্ধতি রাশিয়া বা উত্তর কোরিয়ার মতো নির্বাচন হবে, যেখানে ভোটের ফলাফল আগেই অনুমান করা যায়।’ তার মানে চরমপন্থী উগ্র ভারতীয় জনতা পার্টির শাসনে ভারত শুধু আঞ্চলিক মিত্র শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, বাংলাদেশের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে না, তাদের দেশেও ফ্যাসিজম ও রেসিজমের বিপদের অশনিসংকেত দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে। ফ্যাসিজম ও রেসিজমের বিপদের জাল ভারত ছিন্ন করতে ব্যর্থ হলে ভারত গভীর সঙ্কটে পড়বে।
তাই আমাদের পরামর্শ, ভারতের সরকার ও জনগণের এখন উচিত প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে দাদাগিরি বন্ধ করে সুসম্পর্ক করা এবং নিজ ঘর সামলানোকে বেশি গুরুত্ব দেয়া।