স্বৈরাচার পতনের পরও বন্ধ হয়নি চাঁদাবাজি


১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:০৬

স্টাফ রিপোর্টার : ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরাচারী হাসিনা দেশ ছেড়ে পালালেও পালায়নি তার অনুগত চাঁদাবাজরা। এ চাঁদাবাজরা নানা অপকৌশলের অবলম্বন করছে। একটি অংশ রাতারাতি খোলস বদলে বিএনপি বনে গেছে, একটি অংশ বিএনপির স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ভাগাভাগির ভিত্তিতে চাঁদাবাজি করছে, আরেকটি অংশ স্পট ছেড়ে দেওয়ার ওই স্থান দখল করে নিয়েছে হালে ফুরফুরা মেজাজে থাকা রাজনৈতিক দলের কিছু চিহ্নিত ব্যক্তি। অর্থাৎ জীবন উৎসর্গ করে ছাত্র-জনতা স্বৈরাচার হটালেও বহাল রয়েছে চাঁদাবাজি। বাসাবাড়িতে ময়লা নেওয়ার ক্ষেত্রে, নতুন ভবন নির্মাণ, মাটি ভরাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবহন সেক্টরে ভয়াবহ চাঁদাবাজি হচ্ছে। চাঁদাবাজির অভিযোগের প্রমাণ মেলায় বিএনপি বিভিন্ন শাখা সংগঠনের একাধিক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে এবং ঢাকা মহানগর কমিটি ভেঙে দিতে হয়েছে।
নানা কৌশলে নীরব চাঁদাবাজির বিষয়টি ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অফিস-আদালত; এমনকি ড্রয়িংরুম পর্যন্ত সর্বত্র মানুষের মুখে মুখে চাউর। ছোট-খাটো ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিগত ক্ষমতাসীন দলের নেতা-পাতিনেতা কারও যেন নিস্তার নেই চাঁদাবাজদের হাত থেকে ফসকে যাওয়ার। বড়-ছোট ব্যবসায়ীদের একটি অংশ মোটামুটি টেনশনে রয়েছেন।
খবর নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এখনো নীরবে চাঁদাবাজি হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে উপদেষ্টাদের হস্তক্ষেপ চেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। একই সঙ্গে বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যবসায়ীদের সোচ্চার হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সম্প্রতি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বাজারে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। শুধু চাঁদাবাজদের মুখ বদল হয়েছে। প্রকাশ্যে না হলেও তারা নীরবে চাঁদা তুলছে। দিনরাত বাজারের বিভিন্ন স্থানে এসব চাঁদাবাজি হয়। তবে তারা কোনো দল বা কর্মীর নাম উল্লেখ করেননি। চাঁদা বন্ধ হলে এবং নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পারলে পণ্যের দাম কম থাকবে বলে জানান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তারা বাজারে চাঁদাবাজি বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নজরদারি বাড়ানোর অনুরোধ করেন।
অভিযোগ শোনার পর অনিয়ম ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান। তিনি বলেন, চাঁদাবাজি যেটা ছিল বাজারে, সেটা এখনো নীরবে আছে কমবেশি। আমাদের কাছে তথ্য আসছে, নতুন করে চাঁদাবাজি হচ্ছে।
গত ১৪ অক্টোবর দেশের একটি প্রভাবশালী জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিল, ‘হাতবদল হয়ে পরিবহনে এখন বিএনপির দুই সাইফুলের চাঁদাবাজি’। পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে বলা হয়, বিএনপির দুই সাইফুলের চাঁদাবাজি চলছে রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনালে। এ টার্মিনাল থেকেই দিনে সাড়ে ১০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এ সাইফুলদের একজন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক সাইফুল আলম নিরব। আরেকজন হলেন কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল আলম। রাজনৈতিক ও পরিবহন খাতের সূত্রগুলো বলছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি দখলে নেন কুমিল্লা বিএনপির সাইফুল। তিনি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেশের পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করছেন। আর ঢাকা উত্তর বিএনপির সাবেক নেতা সাইফুল আলম নিরব মহাখালী বাস টার্মিনালের বাইরে তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনাল, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, কারওয়ান বাজার ও শেরেবাংলা নগর এলাকায় একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তেজগাঁও, শেরেবাংলা নগর, মহাখালী টার্মিনালসহ আশপাশের এলাকা দীর্ঘদিন ধরে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের লোকজন নিয়ন্ত্রণ করতেন। ৫ আগস্টের পর আসাদুজ্জামান খান আত্মগোপনে চলে যান। তাকে ভারতে দেখা গেছে এমন খবর বের হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আসাদুজ্জামান খান কামাল যেসব এলাকায় নিয়ন্ত্রণ করতেন, এর সবই সাইফুল আলম নিরবের অধীন চলে এসেছে। কোথাও কোথাও বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাদের দিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। মহাখালী ও তেজগাঁও টার্মিনালে আসাদুজ্জামান খানের লোকজনকে সামনে রেখে চাঁদাবাজি করছেন তিনি। ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল ও তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনাল থেকে শুরু করে পরিবহন সমিতি এখন বিএনপিপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে। অবশ্য চাঁদাবাজিসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে মাত্র আড়াই মাসের ব্যবধানে। এ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন সাইফুল আলম নিরব। এর আগে তিনি যুবদলের সভাপতি ছিলেন। তার লোকজনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও এলাকায় থাকা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের আলোচনাও আছে। অবশ্য সাইফুল আলম নিরব ওই দৈনিকের কাছে দাবি করেন, তিনি পরিবহন খাতে চাঁদার নিয়ন্ত্রণ করছেন এ কথা কোনো মালিক-শ্রমিক বলতে পারবেন না। পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণে বিএনপির তার চেয়ে অনেক বড় নেতা জড়িত। তিনি বলেন, তিনি ২০০১ সালে মহাখালী থেকে একটি বাস চালাতেন। পরে সেটি বিক্রি করে দিয়েছেন। তেজগাঁওসহ অন্যান্য এলাকায় দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগকে তিনি অপপ্রচার বলে দাবি করেন।