আজীবন সংগ্রামী শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা


১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৭:৫০

সামছুল আরেফীন : আবদুল কাদের মোল্লা একটি নাম, একটি ইতিহাস, একটি অনন্য প্রতিভা। যিনি একজন রাজনীতিবিদ, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, লেখক, ইসলামীব্যক্তিত্ব ও সদালাপী মানুষ হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর শাহাদাতবরণ করেন ইসলামী আন্দোলনের এ অগ্রসেনানী। আজীবন লালিত শাহাদাতের স্বপ্ন পূরণ করে আবদুল কাদের মোল্লা চলে গেছেন তার প্রিয় প্রভুর দরবারে। কিন্তু তাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছে। শুধুমাত্র আবদুল কাদের মোল্লাকে হত্যা করার জন্য তারা দফায় দফায় আইন পরিবর্তন, মিথ্যা অভিযোগ, সাক্ষী জালিয়াতি করে স্তম্ভিত করে দিয়েছে বিশ্ববিবেককে।
জন্ম: শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৪৮ সালের ২ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলাস্থ সদরপুর উপজেলার চরবিষ্ণুপুর ইউনিয়নের জরিপের ডাংগি গ্রামে নিজ মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সানাউল্লাহ মোল্লা ও মাতার নাম বাহেরুন্নেসা বেগম। শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা ছিলেন ৯ ভাই-বোনের মাঝে ৪র্থ।
শিক্ষাজীবন : আবদুল কাদের মোল্লা একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি ১৯৫৯ ও ১৯৬১ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনস্টিটিউট থেকে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ফরিদপুরের বিখ্যাত রাজেন্দ্র কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে ১৯৬৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাস করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি একই কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন। কিন্তু দারুণ আর্থিক সংকটের কারণে এরপর তাকে শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করতে হয়। পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া হয়নি তখন আর। ফরিদপুরের এস এস একাডেমি নামক একটি স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেন কিছুদিন।
১৯৬৯ সালের পদার্থ বিজ্ঞানে এমএসসি করার জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। মিষ্টভাষী ও আকর্ষণীয় চারিত্রিক মাধুর্যের অধিকারী হওয়ায় আব্দুল কাদের মোল্লা হয়ে উঠেছিলেন তার সহপাঠী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সবার প্রিয়পাত্র।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। ক্লাশ পরীক্ষা না হওয়ায় তিনি গ্রামের বাড়িতে চলে যান। ২৩ মার্চ ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জেসিও মফিজুর রহমানের ডাকে এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করেন শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা। ১ মে পাকিস্তানি বাহিনী ফরিদপুরে পৌঁছার দিন পর্যন্ত তার এ ট্রেনিং অব্যাহত থাকে।
পরবর্তীতে তিনি ১৯৭২-এর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। যুদ্ধের সময় প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আরো অনেকের মতো আবদুল কাদের মোল্লার লেখাপড়ায়ও ছন্দপতন ঘটে। ১৯৭৪ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে তিনি শিক্ষা প্রশাসনের ডিপ্লোমায় অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরে আবার ১৯৭৭ সালে শিক্ষা প্রশাসন থেকে মাস্টার্স ডিগ্রিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন।
বিয়ে ও কর্ম জীবন : শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দান করেন। এমএড পরীক্ষার রেজাল্টের পর তিনি বাংলাদেশ রাইফেলস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে তিনি একই প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে রিসার্চ স্কলার হিসেবে বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
আবদুল কাদের মোল্লা বেগম সানোয়ার জাহানের সাথে ১৯৭৭ সালের ৮ অক্টোবর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার দুই পুত্র ও চার কন্যা। সব সন্তানই দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন।
সাংবাদিকতা : আবদুল কাদের মোল্লা একজন নির্ভীক সাংবাদিক ছিলেন। বর্ণাঢ্য জীবনের শেষ দৃশ্যে তিনি আমাদের কাছে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত হলেও জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময়টা অতিবাহিত করেছেন একজন নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে। গৌরব-সাফল্যের ধারাবাহিকতায় উদয়ন উচ্চবিদ্যালয়, রাইফেলস পাবলিক স্কুল এবং মানারাত স্কুলের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮১ সালে ‘দৈনিক সংগ্রাম’ পত্রিকায় সাব-এডিটর পদে যোগদান করেন তিনি। শিক্ষকতা পেশায় যে সত্যের পরশ পেয়েছিলেন, তা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে তিনি সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অত্যন্ত অল্প সময়ের ব্যবধানে তার ওপর পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পিত হয়। এ সময়ে তার ক্ষুরধার ও বস্তুনিষ্ঠ লেখা প্রকাশ হতে থাকে দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাময়িকীতে।
আবদুল কাদের মোল্লা ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য ছিলেন। সাংবাদিকতা ও লেখালেখীর পাশাপাশি জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিকদের দাবি আদায়ের সংগ্রামে। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ ও ১৯৮৪ সালে পরপর দুবার তিনি ঐক্যবদ্ধ ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। অন্তরে দ্রোহ আর বিপ্লবের চেতনা লালন করেও সদা হাস্যোজ্জ্বল এ মানুষটি ছিলেন সাংবাদিক আড্ডার প্রাণকেন্দ্র।
লেখক আবদুল কাদের মোল্লা : শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা সমসাময়িক বিষয়ের ওপর শতাধিক কলাম ও প্রবন্ধ লিখেছেন, যা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সাময়িকী এবং আর্ন্তজাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। এছাড়া বস্তুবাদ এবং কমিউনিজমের ওপরে তাঁর বৈজ্ঞানিক সমালোচনা শিক্ষিত মহলের কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়। পরবর্তীতে তিনি বীক্ষণ ছদ্মনামে লেখা শুরু করেন। তার লেখাগুলো খুবই পাঠক প্রিয়তা অর্জন করে।
ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহণ : অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালেই তিনি কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকার পরও তাফহীমুল কুরআনের হৃদয়স্পর্শী ছোঁয়ায় তিনি ইসলামের প্রতি প্রবল আকৃষ্ট হন এবং আলোকিত জীবনের সন্ধান পেয়ে ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে তিনি তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে তিনি এ সংগঠনের সদস্য হন। তিনি ছাত্রসংঘের শহিদুল্লাহ হল শাখার সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি, ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারি ও একই সাথে কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান : শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতের রুকন (সদস্য) হন। তিনি অধ্যাপক গোলাম আযমের রাজনৈতিক সেক্রেটারি এবং ঢাকা মহানগরীর শূরা সদস্য ও কর্মপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে অল্প দিনের ব্যবধানেই জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য হন। ১৯৮২ সালে তিনি ঢাকা মহানগরী জামায়াতের সেক্রেটারি ও পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালের প্রথম দিকে ঢাকা মহানগরীর নায়েবে আমীর, অতঃপর ১৯৮৭ সালে ভারপ্রাপ্ত আমীর এবং ১৯৮৮ সালের শেষ ভাগে তিনি ঢাকা মহানগরীর আমীর ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে তিনি জামায়াতের প্রধান নির্বাচনী মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯১ সালে কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও ২০০০ সালে জামায়াতে ইসলামীর এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল ও নির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দেশে-বিদেশে দীনের প্রচার প্রসার: শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার কূটনীতিকদের সাথে ছিল গভীর সম্পর্ক। সদা হাস্যোজ্জ্বল কাদের মোল্লার কথা ছাড়া যেন কোনো প্রোগ্রাম জমজমাট হতো না। জামায়াতের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি নানা কূটনীতিক কর্মসূচিতে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। দীনের প্রচার প্রসারে শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। তিনি আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, ভারত, কানাডাসহ নানা দেশ সফর করেন।
আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম : স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা। বিশেষ করে ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জামায়াতের প্রতিনিধি হিসেবে লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। তখন কমিটিতে গৃহীত আন্দোলনের কর্মসূচি সম্পর্কে ব্রিফিং করতেন আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম ও আবদুল কাদের মোল্লা। সকল দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাথে তার সম্পর্ক ছিল এবং দেশের সকল রাজনৈতিক সংকট নিয়ে আলোচনা করতেন।
২০১১ সালের ১৫ জুন কথিত সেইফ হোমে জিজ্ঞাসাবাদের সময় শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা নিজেই বলেছিলেন, “১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচনে জামায়াত এবং বিএনপি আলাদাভাবে নির্বাচন করে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একপর্যায়ে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং আমাকে বললেন, আমরা তো সরকার গঠন করলাম, আমাদের কিছু পরামর্শ দেন। মহিউদ্দিন খান আলমগীর তখন মুখ্য সচিব ছিলেন এবং তিনি আমাকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে রিসিভ করেন। আমি তখন প্রধানমন্ত্রীকে কিছু গঠনমূলক পরামর্শ দিই, যা শুনে তিনি আমাকে সাধুবাদ দেন। একইভাবে তিনি পরে আমাকে আরো দুবার ডেকেছিলেন। এখন আমি মনে করছি, দীর্ঘদিন যাদের সঙ্গে রাজনৈতিক আন্দোলন করলাম, মিটিং মিছিল করলাম, সুসম্পর্ক রাখলাম, সখ্য রেখে চলেছি, তারা এখন শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য দীর্ঘ ৪০ বছর পর আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করল।”
কারাবরণ ও জুলুম-নির্যাতন : আবদুল কাদের মোল্লাকে বিভিন্ন সময়ে জেলে যেতে হয়। আইয়ুব সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনের দায়ে ১৯৬৪ সালে প্রথমবারের মতো তিনি বাম রাজনীতিক হিসেবে গ্রেফতার হন। জেনারেল এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কারণে আবদুল কাদের মোল্লাকে আবারও আটক করে রাখা হয় ১৯৮৫ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ১৪ অগাস্ট। প্রায় চার মাস আটক থাকার পরে উচ্চ আদালত তার এ আটকাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করলে তিনি মুক্ত হন। এরপর ১৯৯৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের সাথে একই দিনে গ্রেফতার হন। সাত দিন পর তিনি মুক্ত হন। সর্বশেষ ২০১০ সালের ১৩ জুলাই হাইকোর্টের প্রধান গেট থেকে গ্রেফতার হন আবদুল কাদের মোল্লা। তবে তিনি আর আমাদের মাঝে ফিরে আসেননি। জালিম সরকার অন্যায়ভাবে তাকে হত্যা করে দুনিয়া থেকেই বিদায় দেয়।
ট্রাইব্যুনালে আবদুল কাদের মোল্লা: অভিযোগ গঠনের সময় ট্রাইব্যুনালে কথা বলতে চেয়েছিলেন শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা। তিনি একটি বক্তব্যও লিখে এনেছিলেন। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে তাকে সেই বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে পরিবারের মাধ্যমে তার লিখিত বক্তব্যের কপি পাওয়া যায়। এতে তিনি বলেন, আমার ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষ এ আদালতে যে সব অসত্য ও বানোয়াট অভিযোগ উথাপন করেছেÑ সে ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং অনবহিত। কারণ ঐ সময়ে আমি ঢাকাতেই ছিলাম না। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষিত হওয়ার পর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। আমি তখন শহীদুল্লাহ হলের ছাত্র। আমাদের গ্রুপে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা চলছিল। কিন্তু পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তৎকালীন পদার্থ বিজ্ঞানে বিভাগের শ্রদ্ধেয় চেয়ারম্যান আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইন্নাস আলীর পরামর্শে আমি আমার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে চলে যাই।
আমি যেখানে আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সময় ঢাকায় ছিলাম না। সুতরাং ঐসব অভিযোগের সাথে জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। আমার বিরুদ্ধে আন্দাজ-অনুমানে শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে মিথ্যা অভিযোগ এনে রাষ্ট্রপক্ষ সচেতনভাবেই একটি বুদ্ধিবৃত্তিক অসৎ এবং অন্যায় কাজ করেছেন, যা রাজনৈতিক হিংসা চরিতার্থ করার একটি জঘন্য অপকৌশল।
রায় শোনার পর ট্রাইব্যুনালে শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে দাঁড়িয়ে পড়েন ও বলেন, “আমি এই রায় মানি না। এ রায় অন্যায় হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সে সময় আমি ঢাকায় ছিলাম না। আমি মহান আল্লাহ তায়ালা ও বিশ্বমানবতার কাছে বিচার দিচ্ছি।” তিনি আরো বলেন, ‘আমি পবিত্র কুরআন হাতে নিয়ে বলছি, এ ঘটনার সাথে আমি যুক্ত নই। যেসব অভিযোগে আমাকে সাজা ও খালাস দেয়া হয়েছে, তার কোনটার সাথে আমার দূরতম সম্পর্কও নেই। আমি কেয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে এ বিচারকদের বিরুদ্ধে মামলা করবো। তখন তাদের মুখে কথা বলার কোনো শক্তি থাকবে না। সেদিন এদের হাত-পা কথা বলবে।”
নেই উদ্বেগ দুঃখ আর হতাশার ছাপ: আবদুল কাদের মোল্লার মেয়ে আমাতুল্লাহ পারভীন ও আমাতুল্লাহ শারমিন কারাগারে শেষ সাক্ষাৎ নিয়ে স্মৃতিচারণ করে এক লেখায় বলেন, কনডেম সেলে কোনো উদ্বেগ নেই, নেই প্রাণনাশের চিন্তা, চোখে-মুখে নেই কোনো দুঃখ হতাশার ছাপ। কী প্রশান্তি মহান রবের সান্নিধ্যের প্রত্যাশায়! তার পরিবার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাক্সক্ষীরা যখন ফাঁসির আদেশে অস্থির হয়ে পড়লো, তখন তিনি সকলকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “মৃত্যুর ফয়সালা আসমানে হয়, জমিনে নয়।” কী দৃঢ়প্রত্যয়, কী অটুট মনোবল।
মৃত্যুর পথে যাত্রা: ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্র্রীয় কারাগারে আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের সব অনুরোধ এবং আপত্তি উপেক্ষা করে পতিত ফ্যাসিস্ট আ’লীগ সরকার আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে আল্লাহর দীনের মর্দে মুজাহিদ পাড়ি জমান তার প্রিয় মাবুদের দরবারে।
আবদুল কাদের মোল্লাকে আমরা আর কেনোদিন দেখতে পাব না। কিন্তু শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার সংগ্রামী জীবন ও নেক আমল আমাদের অব্যাহতভাবে অনুপ্রাণিত করবে। তার প্রতি ফোঁটা রক্ত ইসলামী আন্দোলকে আরো বেগবান করবে। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ বির্নিমাণের মধ্য দিয়েই তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে।