রাখাল দলের পড়ালেখা
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:১৪
॥ শরীফ সাথী ॥
নাতি দাদুকে বলল, দাদু ভাই সানকে ঘাট কাকে বলে? দাদু মুচকি হেসে বলল, দুষ্টু নাতি সানকে ঘাটও চেন না। এই আমরা আজ নদীর তীরে সান বাঁধানো ঘাটের ওপর বাঁশের মাচায় বসে রয়েছি। ঐ যে নিচের সান বাঁধানো ঘাটটিই সানকে ঘাট। এ ঘাটের পানিতে যতদূর নামবে বালি আর শুধু বালি, একটুও কাদা নেই। বড্ড আরামে গোসল হয় মানুষজন গরু মহিষের এখানে। টলোমলো ছলোছলো ঝলমলে ঝর্ণা মাখা জল কোমরপুর গ্রামের এ ঘাটটি প্রাচীন আমল থেকে সানকে ঘাট হিসেবে পরিচিত। নাতি বলল, দাদু তাহলে আজকে বৈকালী হাওয়ায় এমন একটি গল্প শোনাও, যেখানে নদীতীরে মায়াবী পরিবেশে রাখাল বাঁশি সুর তোলে? দাদু বলল, শোন নাতি ভাই আমার চোখে দেখা একটি বাস্তবতার গল্প তোকে বলে শুনাই।
প্রকৃতির নান্দনিক ছন্দনিক গাঁথুনীতে গাঁথা পাটাচোরার তীরধরা দ্বীপ। মাথাভাঙ্গা ও ভৈরব নদীর জলে ঘেরা দ্বীপটি সবুজ অরণ্যের শ্যামল হাসিমুখে, সুখে মুখরিত করে তার বুকে। নিদারুণ অনুভূতিময় বৈচিত্র্যময় দ্বীপটির মায়াময় ছায়া। পাখিদের কুঞ্জনে গুঞ্জনে বিভোর। ঘাসফড়িং এর লাফালাফির দৃশ্য নদীর তীরের অপরূপ চাওয়া হিমেল হাওয়ায় একাকার। মাঝি দলের নৌকা বেয়ে অবিরত চলা। রাখাল দলের মিলন মেলা নিত্যব্যাপার। পাটাচোরা সুবুলপুর রঘুনাথপুর কাঞ্চনতলাসহ বেশকিছু গ্রামের রাখাল বালকের গরু-ছাগলের চরানোর দৃশ্য নদীর তীরঘেঁষা এই তীরধরা দ্বীপে। প্রতিদিনের প্রতিনিয়ত বাঁশির সুর তোলা, হরেক রকম খেলায় সাজানো প্রকৃতির ভালোলাগার অনুভব। কয়েক গ্রামের কচি কচি কোমলমতি শিশুদের পড়ালেখা করতে যেতে হয় এ তীরধরার তীর বেয়ে নদীর তীরবর্তী স্কুল পাটাচোরায়। যাওয়া আসার ফাঁকে ফাঁকে সময় করে রাখাল বালকদের সঙ্গে বিভিন্ন খেলায় মেতে ওঠে। লাটিম ঘুরানো, গুটি খেলা, বল খেলা, গাদি খেলা, ডাংগুলি, নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি। হরেক খেলনার পরশার মাঝে একটি খেলা নয়ন কাড়ে। চিতে গাছ কেটে তা হাত এবং পায়ের সাহায্যে টেনে পাইপের মতো করে নল বানিয়ে, ৪-৫টা নল এক সাথে জোড়া দিয়ে এ প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে পানি ওই পাইপ দিয়ে যাতায়াতের দৃশ্যগুলো মনে করে দিলো স্মৃতির মেমোরি। পাটাচোরা গ্রামের ছোট্ট ছেলে শীর্ষ। তার খুব ইচ্ছে করে রাখাল বালকদের সাথে খেলতে। প্রকৃতির এই বৈচিত্র্যতায় চায় তার সোনালি স্বপ্ন মাতামাতি করতে। ৩-৪ জন সঙ্গী নিয়ে স্কুল ফাঁকি দিয়ে রাখাল বালকদের সাথে ঘুরেঘুরে খেলা করে স্কুল সময় অতিবাহিত করে। এভাবে মাস পেরোতেই স্কুলের শিক্ষকরা শীর্ষ’র বাবা মায়ের কাছে অভিযোগ করে বলল, ছেলে ঠিকমতো স্কুলে আসছে না কেন? শিক্ষকের এমন কথায় বাবা মা তো হতবাক। কেন ছেলেতো নিয়মিতই স্কুলে যায়? সন্ধ্যার পর, পড়ার টেবিলে বাবা মা হাজির হয়ে ছেলেকে বলল, তুমি স্কুলে না গিয়ে কোথায় যাও? শীর্ষ স্তম্ভিত হয়ে গেল। নির্বাক চাহনি। প্রশ্নের উত্তর নেই তার মুখে। মা আচ্ছা মতো বকাঝকা করে চলে গেল। বাবা ছেলেকে অভয় দিয়ে বলল, কি হলো বলো, কোথায় যাও স্কুলের সময়? শীর্ষ অভয় আশ্বাস পাওয়ায় লুকানো মুখ সহল করে বলল, তীরধরা দ্বীপে রাখাল দলের সাথে খেলতে যায়। তার কল্পনাময় স্বপ্নলোকের অনুরাগের কথাগুলো বাবাকে খুলে বলল। বাবা রাগান্বিত হলেও হাসতে হাসতে বলল, খেলাধুলা খেলবে তাতে তো আপত্তি নেই। কিন্তু স্কুল ফাঁকি দিয়ে খেললে হবে? আমাদের অনেক স্বপ্ন তুমি পড়ালেখা করবে। অনেক বড় হবে। মানুষের মতো মানুষ হবে। মুখ উজ্জ্বল করবে। গরিব-অনাথ রাখাল ছেলেগুলো কারও বাবা নেই আবার হয়তো কারও মা নেই। গৃহস্থালির বাড়ির গরু চরানো দুঃখ কষ্ট গাঁথা কোমলমতি রাখাল ছেলেগুলোর প্রতি আমারও খুব মায়া হয়, দরদ হয়। কিন্তু কি করার আছে বলো বাবা? তুমি যদি আমার উপদেশ মতো চলতে পারো, তাহলে আমার তোমার এবং রাখাল ছেলেগুলোর বড্ড উপকার হবে। কেউ তোমার জন্য আর কমপ্লেন (অভিযোগ) দেবে না? সবাই ভালো ছেলে বলবে। শীর্ষ তাঁর বাবার মুখের দিকে চেয়ে বলল, কি উপদেশ বলো না খুব শুনতে ইচ্ছে করছে? বাবা বলল, তুমি সময়মতো স্কুলে যাবে। স্কুলের লেখাপড়া মনোযোগ সহকারে করবে। ছুটি শেষে বাড়ি এসে বিকালবেলা ওদের সাথে খেলতে যাবে। সাথে করে নিয়ে যাবে মুড়ি আর খেজুর গুড়ের ছিন্নি (পাটালি)। আরেকটা জিনিসও নেবে সাথে? শীর্ষ বলল, কী জিনিস? বাবা বলল, ওদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য বই-খাতা। আচ্ছা মতন গ্রামীণ খেলাধুলা শেষে দল বেঁধে পাটালি দিয়ে মুড়ি খেয়ে একেক দিন বইয়ের অক্ষর শেখাবে, যা পরদিন খেলতে খেলতেই ওরা (রাখালদ্বয়) বলবে দেখবে? কারণ মনে রাখার জন্য ওরা রাতে ওই পড়াগুলো চর্চা করবেই। শীর্ষ হাসতে হাসতে বলল, লক্ষী বাবা আমার তাই হবে। সুন্দর মায়া-ছায়ার পরিবেশবান্ধব তীরধরা দ্বীপে চলতে লাগলো শীর্ষ ও রাখাল ছেলেগুলোর অন্যরকম জীবন। যেখানে সুর ছন্দ আনন্দ অফুরান। এমন সময় নাতি বলল, খুব ভালো লাগলো দাদু ভাই? দাদু বলল, চল নাতি ভাই, সন্ধ্যা হলো পড়তে বসবে?