ফ্যাসিস্ট সরকারের ঠিকাদারের হাতে অধিকাংশ প্রকল্প : থমকে আছে উন্নয়ন কাজ


২৯ নভেম্বর ২০২৪ ০০:০০

এডিপি বাস্তবায়ন ৮ শতাংশের কম
॥ উসমান ফারুক॥
দেশের কর্মসংস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও নাগরিক সুবিধা বাড়াতে অবকাঠামো নির্মাণ-সংস্কার তথা সার্বিকভাবে সরকারি অর্থে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম উদ্যোগ হলো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি বাস্তবায়ন। প্রতি বছর এ পরিকল্পনা দেখে বোঝা যায়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কতটা গতি আসবে। পরিকল্পনা নেয়ার পর অর্থ বরাদ্দ থাকলেও এবার সর্বশেষ চার মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ৭ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ মোট পরিকল্পনার মধ্যে মাত্র প্রায় ৮ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়। এটি গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন বাস্তবায়নের হার। তবে শেষ মাস অক্টোবরে কাজের গতি বৃদ্ধি পাওয়ায় এডিপি বাস্তবায়নের হার গত অর্থবছরের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। অর্থবছরের শুরুতেই আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পরে এডিপির এসব কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নতুন সত্য উন্মোচন হয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এডিপির প্রকল্পের সবগুলো কাজই ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা ঠিকাদার হয়ে বাগিয়ে নিয়েছে। লাখকোটি টাকার এসব কাজ বাগিয়ে নিতে জন্ম হয়েছে হাজার হাজার আওয়ামীপন্থী ঠিকাদার। সরকার পতন হলে গা-ঢাকা দেয়ার পাশাপাশি দেশ ছেড়েছেন তারা। এতে কাজের বাস্তবায়ন নিয়ে এক ধরনের সংকটে পড়েছে পুরো দেশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্রুতগতিতে প্রকল্প শেষ করতে জরুরি ভিত্তিতে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দিতে হবে। পালিয়ে যাওয়া ঠিকাদারদের জামানত ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে।
ঠিকাদার পলাতক : গাজীপুর চৌরাস্তা মোড় পার হয়ে উত্তরের ১৬ জেলার সঙ্গে ঢাকার সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। এছাড়া টাঙ্গাইলসহ ঢাকা বিভাগের কয়েকটি জেলার সঙ্গে যাতায়াতের একমাত্র পথ হচ্ছে গাজীপুর চৌরাস্তা। চর্তুমুখী গাড়ির চাপে কয়েক কিলোমিটার এ পথটুকু পাড়ি দিতে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যায়। ঈদ ও উৎসবের ছুটির সময়ে তা ১০-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত লাগে। দীর্ঘদিনের যানজটের সমাধান করতে পাঁচ বছর আগে নেয়া হয় গাজীপুর চৌরাস্তার ওপর উড়ালসড়ক বা ফ্লাইওভার নির্মাণ।
বিআরটি ও বেসরকারি যৌথভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত ঠিকাদার গত ৫ আগস্টের পর গা-ঢাকা দিয়েছে। কর্মচারীরা বেতন না পেয়ে অন্য কাজে যোগ দিয়েছেন। ফলে প্রকল্প পড়ে আছে বেহাল অবস্থায়। সরকারের পক্ষ থেকে ঠিকাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও কোনো সন্ধান পায়নি বিআরটি কর্তৃপক্ষ। একইভাবে বিমানবন্দর-মালিবাগ উড়ালসড়ক বা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজও বন্ধ রয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পালিয়ে যাওয়ায়। দেশি-বিদেশি অর্থায়নে নির্মাণাধীন এ প্রকল্পের কাজ এখনো শুরু হয়নি।
সরকার পতনের পড়ে এরকম শত শত প্রকল্পের কাজ থমকে আছে। এ কারণে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর চার মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে আন্দোলন ও পরে আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলে সৃষ্টি হওয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পাশাপাশি প্রশাসনে রদবদলের ধাক্কায় সরকারি উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে এ ধীরগতি চলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে পতন ঘটে ক্ষমতা দখল করে থাকা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশ ছেড়ে গোপনে ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেয় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বিশেষ হেলিকপ্টারে ভারতের আগরতলা গিয়ে নামেন শেখ হাসিনা। সেখান থেকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ একটি বিমানে করে প্রথমে যান ভারতের গাজিয়াবাদের হিন্দন বিমানঘাঁটিতে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ভারতের এ স্থানে থাকেন দুই দিন।
তার পর ভারত সরকার বিশেষ নিরাপত্তা দিয়ে তাকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়। ভারতের গণমাধ্যম দ্য প্রিন্টের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, শেখ হাসিনা বর্তমানে দিল্লিতে আছেন। নয়াদিল্লির লোধি গার্ডেনের লুটেনস বাংলো জোনে একটি সুরক্ষিত বাড়িতে রয়েছেন তিনি। ভারত সরকারই তার থাকার জন্য বাড়িটির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। শেখ হাসিনার জন্য কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সাদা পোশাকে ২৪ ঘণ্টা তার চারপাশে নিরাপত্তারক্ষীরা থাকেন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সবকিছু ভারতই বহন করছে। এখন সেখানে বসেও ষড়যন্ত্র করছে, নানা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত সবই ব্যর্থ হয়েছে জনগণের প্রতিরোধে।
কেন দেরি হচ্ছে নতুন ঠিকাদার নিয়োগে
সরকারি কাজের টেন্ডার পাওয়া ঠিকাদারের কাছ থেকে প্রকল্প অন্য কোনো ঠিকাদারকে দিতে আইনি বিষয় জড়িত। কোনো ঠিকাদার প্রকল্পের কাজ না করলে নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরই তা কেবল সম্ভব। এর সঙ্গে আছে আদালতের সম্পর্কও। পরবর্তীতে ঠিকাদার আদালতে গিয়ে ক্ষতিপূরণও চাইতে পারে। সরকার তখন নতুন করে আর্থিক দণ্ডের মুখে পড়তে পারে। এসব বিষয় পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, আইনি জটিলতায় এখন প্রকল্পের কাজ থমকে আছে শেষ পর্যায়ে আসা অনেক প্রকল্পের কাজ।
গতি পাচ্ছে এডিপি
পতিত আওয়ামী লীগ সরকার চলতি অর্থবছরে এডিপিতে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ রেখে বাজেট পাস করেছিল। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে এডিপির অর্থ ব্যয় হয়েছে ২১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩১ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরের চেয়ে কম ব্যয় হয় ৯ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। অর্থবছরের মোট বরাদ্দের হিসাবে প্রথম চার মাসে বাস্তবায়নের এ হার হয়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ হার ছিল ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
সাধারণত অর্থবছরের শুরুতে টাকা ছাড় দেরিতে হওয়া ও প্রকল্পের কাজ শুরুর প্রথম পর্যায়ে থাকায় এডিপির বাস্তবায়ন সবসময়ই কম হয়। তা ১১ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যেই থাকে। কিন্তু এবারই প্রথম এত কম বাস্তবায়নের তথ্য মেলেনি গত ১৫ অর্থবছরেও। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে তথ্য পাওয়া যায়। এতে দেখা যায় ওই অর্থবছর থেকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এর থেকে কম এডিবি বাস্তবায়ন হয়নি। এর আগে ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ০৬ শতাংশ, ৮ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রকল্প ব্যয় সাশ্রয় করা, কাজে গতি ফেরানোর মতো উদ্যোগ নেয়ায় ছোট ছোট প্রকল্পের কাজগুলোয় কিছুটা গতি ফিরেছে। এ কারণে সর্বশেষ অক্টোবর মাসে কাজে গতি বাড়তে শুরু করায় এডিপি প্রায় আট শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে, যা গত অর্থবছরের কাছাকাছি।
সমাধান কী এসব প্রকল্পের
শুধু গাজীপুর চৌরাস্তার প্রকল্প নয়, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে নামানোর পর দলটির প্রভাবশালী ঠিকাদাররা যেমন আত্মগোপনে রয়েছে, তেমনি সরকারের সমর্থনপুষ্ট ঠিকাদাররাও কাজে নেই। এতে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ থমকে আছে। যার মধ্যে অনেক প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে আসল খরচের চেয়ে অনেক বেশি। দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ঠিকাদারদেরও বিচারের আওতায় আনতে পারে ছাত্র-জনতার সরকার সেই শঙ্কাও রয়েছে তাদের মধ্যে। এ কারণে স্কুল, কলেজ, রাস্তা, অবকাঠামো নির্মাণসহ সেবা খাতের সব প্রকল্পে এক ধরনের অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে সারা দেশে। ছোট ছোট প্রকল্পও আটকে গেছে। এলাকায় এলে ঝামেলায় পড়বেন কিনা, প্রকল্পের অনিয়ম হওয়ায় কারা কারা দায়ি হবেন, দুর্নীতির টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা কোন কোন মন্ত্রী ও নেতার নামে হয়েছে, অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে কারা জড়িত, এসব বিষয়ে নতুন সত্য বেরিয়ে আসবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে থাকার কথা বলছেন ঠিকাদাররা।
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ও বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঠিকাদার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া প্রকল্পের কাজ বন্ধ করলে বা অসমাপ্ত রাখলে তার সমুদয় বিল বা পাওনা আটকে যাবে। ঠিকাদারের জামানত হিসেবে রাখা অর্থ বাজেয়াপ্ত করবে সরকার। চাইলে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলাও করতে পারে।
এসব পদক্ষেপ দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ জানিয়ে তারা পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, আইনি পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি প্রকল্পের কাজ চলমান রাখতে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের সরেজমিন পরিদর্শন প্রতিবেদন তৈরি করতে পারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এ প্রতিবেদনের ওপর ভর করে প্রকল্পের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে নতুন ঠিকাদার জরুরি ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। আগের ঠিকাদার কাজ সম্পন্ন না করায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে তাদের চিঠি দিতে হবে। আদালতে মামলা করতে হবে ক্ষতিপূরণ আদায়ে।
এসব ঠিকারদারি প্রতিষ্ঠানকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো সরকারি প্রকল্পে অংশ নিতে না পারে। ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায় নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক হিসাব জব্দে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাকে চিঠি দিয়ে সংশ্লিষ্টদের বিদেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। তাদের সব ধরনের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে রাষ্ট্রের অনূকূলে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ভবিষ্যতে সরকারি প্রকল্পের কাজ এমনভাবে দেয়া হয়- যাতে করে কোনো ঠিকাদার গোষ্ঠীর কব্জায় না যায়। সব প্রকল্প উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে র্নিধারণ করতে হবে। যোগ্য ও অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকেই কাজ দেয়ার স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নির্ধারণ করতে হবে।