ফ্যাসিস্ট আমলে বিদ্যুৎ খাতে হাজার হাজর কোটি টাকা লুটপাট : ঘানি টানতে হচ্ছে বর্তমান সরকার ও জনগণকে
২৯ নভেম্বর ২০২৪ ০০:০০
॥ সাইদুর রহমান রুমী ॥
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ শুধু বিদ্যুৎ খাতেই বিগত ১৬ বছরে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা লোপাট করেছে। লুটপাটের টাকা তুলতে তারা ১৫ বছরে ১৪ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ায়। হাসিনার এসব লুটপাটের সহযোগী সামিট পাওয়ার, ওরিয়ন, দেশ এনার্জি, ডরিন পাওয়ার, ইউনাইটেডসহ নাটের গুরু নসরুল হামিদ বিপুসহ সবাই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। অপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন সরকারের গলার কাঁটা। যার মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিপূরণ গুনতে হচ্ছে এখনো বর্তমান সরকার ও সাধারণ মানুষকে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও আজব কায়দায় এসব লুটেরা মাসের পর মাস অলস বসে থেকে পেয়েছে শত শত কোটি টাকার ভাড়া তথা ক্যাপাসিটি চার্জ। এসব কেন্দ্রের বেশিরভাগেরই মালিক ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ঘরানার ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা।
কুইক রেন্টালের নামে শত শত কোটি টাকা লোপাট : ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ সংকটকে পুঁজি করে গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় করেছে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। এ সময়ে শুধু রেন্টাল-কুইক রেন্টালের আড়ালে অস্বাভাবিক দরে বিদ্যুৎ কেনার নামেই লুটপাট আর পাচার করা হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি পেমেন্টই (কেন্দ্র ভাড়া) দেওয়া হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এসব কেন্দ্রের বেশিরভাগই উৎপাদন না করেই এসব টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা পেয়েছে। আর এসবের বেশিরভাগেরই মালিক ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও কথিত প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। ২০০৮ সালে বিদ্যুৎ খাতে ৯০০ কোটি টাকা ভর্তুকি থাকলেও তা পরে কেন্দ্র ভাড়ার নামে তথা ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ হাজার কোটি টাকায়। কারণ ভর্তুকির ৮৫ শতাংশই গেছে কেন্দ্র ভাড়ায়। ভর্তুকি কমাতে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম, যা যাচ্ছে গ্রাহকের পকেট থেকে। যার ঘানি মানুষ এখনো টানছে প্রিপ্রেইড মিটারসহ নানা যন্ত্রণার মাধ্যমে। গত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সম্পূর্ণ বিনা দরপত্রে ৩২টি কুইক রেন্টাল কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়। আর দরপত্র এড়াতে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে দুই বছরের জন্য পাস করা হয় জরুরি বিশেষ আইন। এ আইনের অধীনেই পর্যায়ক্রমে মোট ৮২টি রেন্টাল ও ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) কেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া হয়। এ আইনের কারণে কোনো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না, যাওয়া যাবে না দেশের কোনো আদালতে তাদের লুটপাটের বিচার চাইতে। পরে আইনটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়েছিল। এ আইনটির বলেই আওয়ামী লীগ লুটপাটের এ মহাযজ্ঞ শুরু করে।
পিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে আইপিপি ও রেন্টাল কেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয় প্রায় সাড়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এর পরের পাঁচ বছরে, অর্থাৎ ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয় প্রায় ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর গত ১৩ বছরে বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্র পাওয়ার শীর্ষে ছিল সামিট গ্রুপ। এই গ্রুপ গোপালগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগের টানা ছয়বারের এমপি ও সাবেক বিমানমন্ত্রী ফারুক খানের। সামিটের সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়া পেয়েছে ১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপের পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, এগুলো পেয়েছে ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। আর কনফিডেন্স গ্রুপ বিনা দরপত্রে ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র পেয়েছে। কেন্দ্র ভাড়া পাওয়ার দিক থেকে এই গ্রুপটি তৃতীয় স্থানে রয়েছে, তাদের ছয়টি কেন্দ্র ভাড়া পেয়েছে ৯৬২ কোটি টাকা। কেন্দ্র ভাড়া পাওয়ায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে বাংলাক্যাটের চার বিদ্যুৎকেন্দ্র, ৮৮৩ কোটি টাকা। আরেক আওয়ামী লীগ নেতা নুরে আলম সিদ্দিকীর ডরিন গ্রুপ ছয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে পায় ৬৫১ কোটি টাকা।
সূত্র মতে, প্রয়োজন ছাড়াই বার বার বেড়েছে এসব কেন্দ্রের মেয়াদ। দেশে প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। গ্রীষ্মে মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ পাঁচ মাস পিক আওয়ারে (সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত) সর্বোচ্চ বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় ১৬ হাজার থেকে ১৬ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ পিক আওয়ারেই সক্ষমতার অন্তত ৪০ শতাংশ কেন্দ্র বসে থাকে। এরপরও গত বছর পাঁচটি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়, যেগুলোর সম্মিলিত ক্ষমতা ৬০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি। এ কেন্দ্রগুলো তিন বছরের মেয়াদে এসেছিল। ওই সময়ের মধ্যে কেন্দ্রগুলোর মালিকরা লাভসহ বিনিয়োগও তুলে নিয়েছেন। এরপরও লুটপারেটর ভাগবাঁটোয়ারার অংশ হিসেবে দফায় দফায় এসব কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ মেয়াদ বাড়ানোর কারণে এসব কেন্দ্রের জন্য বছরে গুনতে হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা।
দেনার দায়ে নিমজ্জিত পিডিবি: সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিডিবি গত ১৫ বছরে বিদ্যুতের ভুল নীতির কারণে লোকসান গুনেছে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে লোকসান প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ ১৫ বছর আগে বছরে লোকসান ছিল মাত্র ৮২৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে লোকসান দেয় ৫১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ বিপুল অর্থ সরকারের অর্থ বিভাগ ধার হিসেবে দেয় পিডিবিকে। তবে অর্থ বিভাগের কাছে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় এখন পিডিবিকে টাকা দিতে পারছে না। কারণ পিডিবি দেনা শোধ করে মার্কিন ডলারে। রিজার্ভের ওপর টান পড়ায় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরাও পিডিবির কাছে বিদ্যুতের বিল পাবেন। বিগত সরকার বন্ড ইস্যু করেও পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারেনি। সব মিলিয়ে পুরো টাকাই লুটপাটের মাধ্যমে বাঁটোয়ারা করা হয়েছে, কিন্তু দেখানো হয়েছে সরকারি দেনা। অথচ গ্রাহকরা এক টাকাও তাদের বকেয়া রাখেনি। লুটপাটের এ পুরো কাজটি করেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা তৎকালীন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা, বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব, পিডিবি চেয়ারম্যানসহ বিদ্যুৎ বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট। এর মধ্যে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ছিলেন মূল গুরু। আর সিন্ডিকেটের গডফাদার হিসেবে কাজ করেছেন পতিত সরকারের সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ ও আহমেদ কায়কাউস। সরাসরি এ সিন্ডিকেটকে সহায়তা করেছেন পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান এবং চিহ্নিত আওয়ামী দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলীরা।
ভারতের এক আদানি এক বছরে নিয়ে গেছে ১০ হাজার কোটি টাকা : শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ হতে বিদ্যুৎ বেচার নামে করে অসম চুক্তির মাধ্যমে ভারতের আদানি গ্রুপ নিয়ে যায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে ভারতের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আদানি পাওয়ারের আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৫০ হাজার ৯৬০ কোটি রুপি বা ৬৭ হাজার ২৩ কোটি টাকা। আদানির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রির জন্য গত বছর ৫ এপ্রিল গড্ডা কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট ও ২৬ জুন দ্বিতীয় ইউনিটটি উৎপাদন শুরু করে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চুক্তির আওতায় কেন্দ্রটি থেকে লম্বা সময় ধরে (২৫ বছর) বিদ্যুৎ বিক্রি করা হবে। অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের নিজস্ব কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রেখে আদানি থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছিল। কারণ আদানির সঙ্গে চুক্তির শর্তে বলা হয়েছে, গড্ডা কেন্দ্রটির সক্ষমতার একটি নির্দিষ্ট অংশের কম বিদ্যুৎ কেনা হলে বাংলাদেশকে উল্টো জরিমানা দিতে হবে। এছাড়া কেন্দ্রটির জন্য উচ্চহারে ক্যাপাসিটি চার্জও দিতে হচ্ছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত এক বছরে আদানি বাংলাদেশ হতে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জই পেয়েছে প্রায় ৩৭ দশমিক ৭৫ কোটি ডলার বা চার হাজার ১৫০ কোটি টাকার বেশি।
১৫ বছরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ১৪ বার : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যখন দেশের মানুষ দিশেহারা ছিল, তখনো দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। ২০২৩ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসেও তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। যার প্রভাব এখনো রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে সবকিছুর ওপর। সর্বশেষ এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ২৭ তারিখে ফের ইউনিটপ্রতি সর্বোচ্চ ৭০ পয়সা বাড়ানো হয়। এ নিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ১৫ বছরের মেয়াদে গ্রাহক পর্যায়ে ১৪ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ায়। এছাড়া পাইকারি পর্যায়ে বাড়ানো হয় ১২ বার। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় গ্রাহকদের চরম ভোগান্তির পাশাপাশি শিল্পকারখানাগুলোও বিক্রয় সক্ষমতা হারায়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায় হুহু করে, যার প্রভাব এখনো অব্যাহত আছে। সাধারণ গ্রাহকদের পাশাপাশি; এমনকি সেচ, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, রাস্তার বাতিসহ অন্যান্য বিদ্যুতের দামও বাড়ায় হাসিনা সরকার।
বায়ু বিদ্যুতের নামেও লুটপাট : শুধু কুইক রেন্টালই নয়। বায়ু বিদ্যুতের নামেও লুট করা হয়েছে কোটি টাকা। বাস্তবিক কোনো কাজে না আসায় ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে কুতুবদিয়ায় স্থাপিত বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এখন শুধুই দেখার জিনিস। অত্যন্ত সম্ভাবনাময় দেশের সর্ববৃহৎ বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অযত্ন-অবহেলায় শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। এর জন্য অনিয়ম, দুর্নীতি-তদারকির অভাবকে দায়ী করেন সংশ্লিষ্টরা। কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়ার মানুষকে বিদ্যুৎ-সুবিধা দিতে দুটি প্রকল্পের অধীন ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছিল বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। একটি প্রকল্প ২০০৭ সালে ও অপরটি ২০১৬ সালে চালু হয়। দুই প্রকল্পের অধীন বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য স্থাপন করা হয় ৭০টি হাওয়াকল। বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম প্রকল্পের অধীন স্থাপন করা হাওয়াকল থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা গেছে মাত্র কয়েক দিন। দ্বিতীয় দফায় চালু করা হওয়াকল সক্রিয় ছিল কয়েক মাস। এরপর থেকেই বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রের হাওয়াকলগুলো কেবল দেখার জিনিসে পরিণত হয়েছে। সরকারি কোনো তদারকির ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এমনকি হয়নি কোনো পূর্ব সমীক্ষা। সংশ্লিষ্টরা জানান, বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের পুরো টাকাই প্রকৃতপক্ষে অপচয় হয়েছে। এটি এখন তাদের বোঝা। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের তাবলেরচর এলাকার পশ্চিম সৈকতে ২০০৭ সালে ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ১ হাজার কিলোওয়াট (১ মেগাওয়াট) উৎপাদন ক্ষমতার বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কেন্দ্রের দুই পাশে খোলা জায়গায় স্থাপন করা হয় ৫০ ফুট উঁচু ৫০টি বায়ুকল। মাথায় লাগানো হয় ইস্পাতের উইন্ড টারবাইন বা বায়ুচালিত পাখা। বাতাসে পাখা ঘুরলে উৎপাদিত হয় বিদ্যুৎ। সেই বিদ্যুৎ ব্যাটারিতে জমা করে গ্রাহকের কাছে সরবরাহের কথা। ২০০৮ সালের ১৫ মার্চ কেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়। এরপর ১৪ এপ্রিল ৬০০ গ্রাহকের মধ্যে সান্ধ্যকালীন কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। কিন্তু কয়েক দিনের মাথায় কেন্দ্রের একটি যন্ত্র অচল হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০১০ সালের ১৪ জুলাই ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে থাকা বেড়িবাঁধ ভেঙে গেলে কেন্দ্রটি ঝুঁকির মুখে পড়ে। গত ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বছরে কেন্দ্রটি আর আলোর মুখ দেখেনি। এদিকে ২০১৬ সালে অচল হয়ে পড়া বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে ১ মেগাওয়াটের আরেকটি নতুন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। তাতে খরচ হয় ২৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের ১৫ মার্চ কেন্দ্রটি চালু হয়। ৩৫০ জন গ্রাহকের কাছে সান্ধ্যকালীন কয়েক ঘণ্টার বিদ্যুৎ সরবরাহও শুরু হয়। কিন্তু এক মাস যেতে না যেতেই এটিও অচল হয়ে পড়ে। ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত ৬ বছরে এ কেন্দ্রও আর আলোর মুখ দেখেনি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বাসিন্দারা বলেন, দুর্নীতি-লুটপাটের জন্যই দুর্গম উপকূলে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এজন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। কেন্দ্র দুটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ প্রকল্পটি মূলত ফ্যাসিস্ট হাসিনার লুটপাটের আরেকটি বড় উদাহরণ।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা : সার্বিক বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, বিদ্যুতের কল্পিত উচ্চ চাহিদা দেখিয়ে অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে। আর ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে গিয়েই বিগত সরকার বার বার দাম বাড়িয়েছে বিদ্যুতের আর এর দায় চাপিয়েছে মানুষের ওপর। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবি ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া পরিশোধে। তিনি বলেন, অথচ গত বছরও বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৪১ শতাংশ সক্ষমতা অলস বসে ছিল। মানুষ লোডশেডিংয়ে ভুগেছে। ব্যাহত হয়েছে শিল্পকারখানার উৎপাদনও। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম. তামিম বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানোর ভালো বিকল্প হচ্ছে দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচ কমিয়ে ভর্তুকি কমানো। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সামাজিক প্রভাব বিচার করে দাম নির্ধারণ করতে হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়লে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। তাই এটি বছরে কয়েকবার বাড়ানোয় বাজারে জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে চলে গেছে। এত চাপ ভোক্তা আর বর্তমানে নিতে পারছে না। বিদ্যুৎ খাতে মূল্যবৃদ্ধি করে পুরো ভর্তুকি সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে আত্মঘাতী। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানান, সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর তিন মাসে জ্বালানি খাতে ৩৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ পরিবেশ ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে আমাদের সেদিকেই এগিয়ে যেতে হবে। চলতি সপ্তাহে ৪০টি নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পের দরপত্র দেওয়া হবে। তিনি বলেন, পাবলিক সেক্টরে প্রতিযোগিতার অভাব রয়েছে। টিকে থাকতে হলে ঘুষ-বাণিজ্য থেকে বের হতে হবে। সরকারি ক্রয়কে প্রতিযোগিতার মধ্যে আনতে হবে। ফাওজুল কবির বলেন, গত ১৫ বছরে বিগত সরকারের মন্ত্রী এবং সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা নির্দিষ্ট ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের চুক্তিগুলো হয়েছে। খাতে সুস্থ ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতাকে ব্যাহত করেছে। এটা দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে সখ্য করে আর ব্যবসা হবে না। যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে এ খাতে কাজ করার সুযোগ পাবেন ভালো ব্যবসায়ীরা। এতে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা হবে এবং দেশের অর্থনীতিরও প্রবৃদ্ধি হবে। এখন থেকে রাজনৈতিক বিবেচনায় কিংবা দলীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতে কোনো চুক্তি করা হবে না।