চট্টগ্রামে ইসকন সন্ত্রাসীদের হামলায় আইনজীবী নিহত


২৯ নভেম্বর ২০২৪ ০০:০০

দুষ্কৃতকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে উত্তাল সারা দেশ
স্টাফ রিপোর্টার : চট্টগ্রামে ইসকন অনুসারীরা সহকারী সরকারি কৌঁসুলিকে (এপিপি) গত ২৬ নভেম্বর মঙ্গলবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করেছে। নিহত আইনজীবীর নাম সাইফুল ইসলাম ওরফে আলিফ (৩৫)। চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার চুনতি এলাকার জামাল উদ্দিনের ছেলে। চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ইসকনের সন্ত্রাসীরা বিক্ষোভের একপর্যায়ে এ আইনজীবীকে চেম্বারের নিচ থেকে ধরে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। চট্টগ্রাম জজ আদালতের এপিপি তরুণ আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় দেশব্যাপী তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এ দেশের সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী, একজন রাষ্ট্রপতি, জামায়াতের আমীরসহ শীর্ষনেতাদের গ্রেফতার, বিচার এমনকি হাসিনা আমলে সাজানো মামলায় ফাঁসিতে হত্যার পর আইনজীবী হত্যার মতো ঘটনা ঘটেনি। ইসকন যা করেছে, তা রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল বলে মন্তব্য করেছেন পর্যবেক্ষকরা।
চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে গত সোমবার (২৫ নভেম্বর) বিকেল রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। গত মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন-৬ এর কাজী শরিফুল ইসলামের আদালতে তোলা হলে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক। চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ইসকনের (আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ) বাংলাদেশ শাখায়ও ছিলেন। তবে সম্প্রতি ইসকন তাকে বহিষ্কার করে। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে চট্টগ্রাম আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর করা হয়। পরে তাকে কারাগারে পাঠানোর জন্য প্রিজনভ্যানে তোলা হয়। তখন চিন্ময়ের অনুসারীরা প্রিজনভ্যান আটকে দেয়। তারা এ সময় বিক্ষোভ শুরু করে। তখন পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী চেষ্টা করেও প্রিজনভ্যান আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বের করে কারাগারে নিতে পারেনি। পরে বিকাল ৩টার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের (টিয়ার) শেল নিক্ষেপ এবং লাঠিচার্জ শুরু করলে বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এরপর ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলতে থাকে। পরে চিন্ময় কৃষ্ণকে বহনকারী প্রিজনভ্যান কারাগারের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ ও সাধারণ আইনজীবীদের ওপর ইসকনের চিন্ময় অনুসারীরা হামলা শুরু করে।
প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবীরা জানান, পুলিশ ও আইনজীবীদের সঙ্গে ইসকন সন্ত্রাসীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের মধ্যে আইনজীবী আলিফকে ইসকন সন্ত্রাসীরা বেধড়ক কোপায়। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক নিবেদিতা ঘোষ জানান, আহত অবস্থায় সাত-আটজনকে নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের মাঝে আইনজীবী আলিফ মারা গেছেন। জানতে চাইলে নগর পুলিশের উপকমিশনার লিয়াকত আলী বলেন, আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এদিকে আইনজীবী হত্যার ঘটনায় গত ২৭ নভেম্বর বুধবার চট্টগ্রামসহ সারা দেশে আদালতে কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন আইনজীবীরা। অন্যদিকে চিন্ময়কে গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে ভারতের অযাচিত বিবৃতির জবাবে গত মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অত্যন্ত হতাশার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার উল্লেখ করেছে যে, শ্রী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে নির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেফতার করার পর থেকে তার গ্রেফতারকে কিছু মহল ভুলভাবে ব্যাখ্যা করছে। বাংলাদেশ সরকার বলতে চায়, এ ধরনের ভিত্তিহীন বিবৃতি শুধু সত্যকে বিকৃত করে না, বরং দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও বোঝা-পড়ার চেতনার পরিপন্থি। এর আগে সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে আটকের বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ চেয়ে বিবৃতি দেয় ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন)। বিবৃতিতে তারা চিন্ময় দাসের মুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে ভারতের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে। গত সোমবার (২৫ নভেম্বর) গভীর রাতে নিজেদের অফিসিয়াল এক্স হ্যান্ডলে টুইট করে এ কথা জানিয়েছে তারা। মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) পৃথক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া ও ইকোনমিক টাইমস। টুইটে ইসকন দাবি করেছে, সন্ত্রাসবাদের সাথে ইসকন যুক্ত নয়।
চট্টগ্রাম জজ আদালতের এপিপি তরুণ আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতি প্রদান করেছেন। বিবৃতিতে তিনি যেকোনো উসকানিতে সর্বোচ্চ ধৈর্য ধরার জন্য আন্তরিকভাবে আহ্বান জানান। বিবৃতিতে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ২৬ নভেম্বর দুপুরে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, তা অত্যন্ত জঘন্য এবং নিন্দনীয় অপরাধ। একটি গোষ্ঠী পতিত স্বৈরাচারের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশকে অস্থির করার জন্য ক্রমাগতভাবে দুরভিসন্ধি ও অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশকে অস্থির করে তুলতে চায়। দেশপ্রেমিক জনগণ তাদের দুরভিসন্ধির ব্যাপারে পরিপূর্ণ সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ। তাদের অপচেষ্টা অতীতে যেমন ব্যর্থ হয়েছে, আগামীতেও ব্যর্থ হবে, ইনশাআল্লাহ। তিনি বলেন, দেশের জন্য তার (হত্যার শিকার আইনজীবী) আত্মত্যাগ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমার দলীয় সহকর্মী, ছাত্র-জনতা এবং দেশপ্রেমিক জনগণের প্রতি যেকোনো উসকানিতে সর্বোচ্চ ধৈর্য ধরার জন্য আন্তরিকভাবে আহ্বান জানাচ্ছি। কোনো অবস্থাতেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। তিনি আরও বলেন, এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
জানা গেছে, গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামে সমাবেশ করে বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ। চিন্ময় কৃষ্ণ দাস এ মঞ্চের মুখপাত্র। সমাবেশের পর গত ৩১ অক্টোবর চিন্ময়ের বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগ এনে চট্টগ্রামে একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেন বিএনপি নেতা ফিরোজ খান। মামলাকারীকে বিএনপি পরে বহিষ্কার করে। কোতোয়ালি থানায় করা মামলায় চিন্ময় দাসসহ ১৯ জনকে আসামি করা হয়। মামলার আসামিরা হলেনÑ ইসকনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও পুণ্ডরীক ধাম মন্দিরের অধ্যক্ষ চন্দন কুমার ধর প্রকাশ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী (৩৮), চট্টগ্রামের হিন্দু জাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক অজয় দত্ত (৩৪), নগরীর প্রবর্তক ইসকন মন্দিরের অধ্যক্ষ লীলা রাজ দাশ ব্রহ্মচারী (৪৮), গোপাল দাশ টিপু (৩৮), ডা. কথক দাশ (৪০), প্রকৌশলী অমিত ধর (৩৮), রনি দাশ (৩৮), রাজীব দাশ (৩২), কৃষ্ণ কুমার দত্ত (৫২), জিকু চৌধুরী (৪০), নিউটন দে ববি (৩৮), তুষার চক্রবর্তী রাজীব (২৮), মিথুন দে (৩৫), রুপন ধর (৩৫), রিমন দত্ত (২৮), সুকান্ত দাশ (২৮), বিশ্বজিৎ গুপ্ত (৪২), রাজেশ চৌধুরী (২৮) এবং হৃদয় দাস (২৫)।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার পর নগরের নিউমার্কেট মোড়ের জিরো পয়েন্টে স্তম্ভের ওপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা একটি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে, যা এখনো সেখানে রয়েছে। ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের উদ্যোগে লালদীঘির মাঠে একটি মহাসমাবেশ হয়। ওই দিন চন্দন কুমার ধরসহ ৯ জন আসামির ইন্ধনে বাকি আসামিরা নিউমার্কেট মোড়ের জিরো পয়েন্ট স্তম্ভ ও আশপাশে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ওপর ধর্মীয় গোষ্ঠী ইসকনের গেরুয়া রঙের ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করে সেখানে স্থাপন করে দেয়। এ নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ মামলার পর ইসকন প্রবর্তক ধাম অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে একটি ভিডিওবার্তায় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা প্রসঙ্গে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। এতে তিনি মামলাটিকে সনাতনীদের আট দফা ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা হিসেবে দাবি করলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এটি ছিল মূলত পতিত আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের অপচেষ্টা। সমাবেশে হিন্দুদের চেয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থকরাই বেশি যোগ দিয়েছিলেন।