দূরত্ব নয়, প্রয়োজন ঐক্য
২৯ নভেম্বর ২০২৪ ০০:০০
॥ জামশেদ মেহ্দী॥
জনগণ গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণের মাত্র ৩ মাস ২০ দিনের মধ্যে দেশের রাজনীতি ত্রিমুখী জটিল আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে দেশে কোনো রাজনীতি না থাকলেও বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে রাজনীতিতে যারা স্টেকহোল্ডার, তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে- যেটি সচেতন রাজনৈতিক মহলের কাছে স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে বিএনপির দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সাথেও বিএনপির দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এর মাঝে সরকারের কয়েকটি কাজের মৃদু সমালোচনা করেছে সেসব বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতা, যারা সরাসরি সরকারে অন্তর্ভুক্ত নন। এর ফলে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করার জন্য বার বার পতিত আওয়ামী ফ্যাসিবাদ চেষ্টা করছে। তাদের এ চেষ্টায় পূর্ণ মদদ জোগাচ্ছে ভারত। ভারতের উসকানিতে গত ২৩ নভেম্বর শনিবার শেখ হাসিনা শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাত সম্পর্কে চরম মিথ্যাচার করেছেন। উদ্দেশ্য, দেশে একটি অরাজকতা সৃষ্টি করা। সবকিছু মিলিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, সেটি আগামী ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে একটি ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
যেসব ইসু্যুতে সরকার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং বিএনপির মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- (১) অবিলম্বে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা, (২) প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর অপসারণ, (৩) আওয়ামী লীগ তথা আওয়ামী ঘরানাকে নিষিদ্ধ করা, (৪) সংবিধান রচনা অথবা সংশোধন ইত্যাদি। এর মধ্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় মতানৈক্য দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ইস্যুতে এবং আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং তাদের প্যারেন্ট সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটি কিছু দিন আগে সরকারের কাছে ৫ দফা দাবি পেশ করেছিল। এগুলো হলো, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা, প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর অপসারণ এবং বর্তমান সংবিধান প্রত্যাখ্যান করে নতুন সংবিধান রচনা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হলো বাংলাদেশকে দ্বিতীয় প্রোক্লামেশনের মাধ্যমে নতুনভাবে বিনির্মাণ করা। ছাত্রদের এসব দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, প্রবাসী ব্লগার ও ইউটিউবার পিনাকী ভট্টাচার্য, ড. কনক সরোয়ার, ইলিয়াস হোসেন প্রমুখ। এ দাবি খুব জোরের সাথে উত্থাপন করেছেন বিশিষ্ট গবেষক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। একটি দাবির সাথে আরেকটি দাবি ওতপ্রেতভাবে জড়িত। যেমন যখন প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর অপসারণ দাবি করা হয়, তখন বিএনপি তার বিরোধিতা করে। তারা যুক্তি দেখায় যে, প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করলে সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বলে, তারা নীতিগতভাবে প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিনের অপসারণ দাবির সাথে একমত। কিন্তু তারা চায় যে বিএনপিও এ দাবি সমর্থন করুক। বিএনপিকে ছাড়া এ দাবির সমর্থনে জোর আওয়াজ তুললে ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির মধ্যে অনৈক্য দেখা দেবে।
পক্ষান্তরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি বলে যে, তারা এ সংবিধান মানে না। তারা আরো বলেন, সংবিধান মেনে তো জুলাই-আগস্টের বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়নি। আসলে গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব হয় জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে। সেখানে দেশের সংবিধান গৌণ হয়ে পড়ে। ছাত্র নেতৃবৃন্দ বলেন, সংবিধানের দোহাই দিয়ে প্রেসিডেন্টকে অপসারণের বিরোধিতা করার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। তারা বলেন, এ সরকারের; বিশেষ করে এ সরকার প্রধানের ক্ষমতার উৎস হলো জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান বা বিপ্লব। অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের মাধ্যমে কোনো সরকারকে অপসারণ করলে সেই বিপ্লবী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেই সংবিধান বাতিল করে অথবা স্থগিত রাখে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংবিধানের অংশবিশেষ স্থগিত করা হয়। এ পটভূমিতে সাংবাদিকরা ছাত্র নেতৃবৃন্দকে প্রশ্ন করেছেন, ড. ইউনূস এ সংবিধানের অধীনে কেন শপথ নিলেন? বিভিন্ন দেশের অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের মাধ্যমে যেসব সরকার গঠিত হয়েছে, তারা তো সংবিধানের অধীনে শপথ নেননি।
যতই দিন যাচ্ছে, ততই নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। এগুলো এতদিন অজানা ছিল। ছাত্র নেতৃবৃন্দকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, তারা শুরুতেই অভ্যুত্থানের সরকার বা বিপ্লবী সরকার গঠন করলেন না কেন? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৩ শীর্ষ নেতা এখন মন্ত্রীর মর্যাদায় সরকারের উপদেষ্টা। তারা বোধগম্য কারণেই প্রকাশ্যে কথা বলতে পারেন না। কিন্তু অপর সমন্বয়কগণ; বিশেষ করে হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, আব্দুল কাদের, আরিফ সোহেল প্রমুখ বলছেন যে, অভ্যুত্থানের পর আমাদের মধ্য থেকে বিপ্লবী সরকারের কথা উঠে এসেছিল। কিন্তু দেশের স্থিতিশীলতার কথা বলে আমাদের সংবিধানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বলা হয়েছিল। গত ২০ নভেম্বর দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক সংবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেবে কিনা, সেটা কোনো প্রাসঙ্গিক বিষয় নয়। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, বর্তমান সরকার একটি বিপ্লবী সরকার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে এটিকে কনস্টিটিউশনাল (সাংবিধানিক) করে ফেলা হয়েছে। এতে আমরা মনে করি, আমাদের সিনিয়ররা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এখন পর্যন্ত জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহীদ ও আহতদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি। (দৈনিক ইনকিলাব, ২০ নভেম্বর, পৃষ্ঠা ৮)।
অপর একটি টেলিভিশন টকশোতে সারজিস আলম ছিলেন একক আলোচক। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল আগস্ট মাসে, ‘মার্চ টু ঢাকা’ অভিযানের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬ আগস্ট। সেটিকে হঠাৎ করে এক দিন আগে এনে ৫ আগস্ট করা হলো কেন? উত্তরে সারজিস আলম বলেন, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমরা ১০ থেকে ১৬ জন সমন্বয়ক সম্মিলিতভাবে নিতাম। ৩ আগস্টের অভূতপূর্ব সমাবেশের পর আমাদের ভেতরে আলোচনা হলো যে, ৪ আগস্টেও বিপুল জনসমাগম হবে। তারপর ১ দিন বিরতি দিয়ে যদি ৬ আগস্ট করা হয়, তাহলে অংশগ্রহণকারী জনতার স্পিরিট শিথিল হতে পারে এবং তাদের মধ্যে লেথার্জিও আসতে পারে। আরেকটি চিন্তা ছিল এই যে, যদি ৪ আগস্ট রাতে বা ৫ আগস্ট ভোরে আমাদের ১০ জন সমন্বয়ককে গ্রেফতার করা হয়, তাহলে নেতৃত্বে ভয়াবহ শূন্যতা দেখা দেবে। তাই আমরা বিরাট রিস্ক নিয়েছিলাম। আমরা ১ দিনের বিরতি না দিয়ে ঢাকা অভিযান পরদিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট করলাম।
তাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, আপনারা বিপ্লবী সরকার করলেন না কেন? ভবিষ্যতে কোন ধরনের সরকার হবে এ সম্পর্কে আপনাদের কি কোনো অগ্রিম চিন্তাধারা ছিল না? উত্তরে তিনি বলেন, সত্যি কথা বলতে কী! আমরা নিজেরাও ভাবিনি যে ৫ আগস্ট ঢাকার প্রায় ১ কোটি লোক রাস্তায় নেমে আসবেন, মফস্বলে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসবেন এবং শেখ হাসিনা জনরোষে এভাবে পালিয়ে যাবেন। কিন্তু যখন শেখ হাসিনা সত্যি সত্যি পালিয়ে গেলেন এবং ১৫ বছরের স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ ভেঙে পড়ল, তখন আমরাও বিস্মিত হয়েছিলাম। এখানে সারজিস আলম একটি নতুন তথ্য প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, সেনাপ্রধান প্রথম ঘোষণা করেন যে, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। এরপর আমাদেরকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ডাকা হয়। আমরা প্রথমে ভয়ে ছিলাম। সেনা ছাউনিতে আমাদের কেন ডাকা হচ্ছে? তবুও আমরা সাহস করে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, অন্যান্য বড় রাজনৈতিক দলের বড় বড় নেতা বসে আছেন। তারা নিজেদের মধ্যে এবং সেনাপ্রধানের সাথে সরকারের রূপরেখা নিয়ে কথা বলছেন। আমাদের কথা বলার সুযোগ খুব কম ছিল। তারপরও আমরা বললাম, বিপ্লবী সরকার গঠন করুন। যখন বলা হলো যে, এর ফলে স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে, তখন আমরা বললাম যে, আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সকলকে নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা হোক। কিন্তু আমাদের বক্তব্য বড় বড় নেতাদের কথার মাঝে হারিয়ে গেল। সবকিছু এমন অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ঘটে গেল যে, আমরা ভালো করে বসতে পারিনি এবং ভাববার সময়ও পাইনি।
সরকার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং বিএনপির মধ্যে যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় তিনটি কারণ হলো আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন করা এবং নতুন সংবিধান রচনা করা।
সচেতন দেশবাসী এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের বিস্ময় উৎপাদন করে বিএনপি সরাসরি বলে বসে যে, তারা রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধে বিশ্বাস করে না। তারা আরো বলে যে, নতুন সংবিধান প্রণয়ন জটিলতা সৃষ্টি করবে এবং নির্বাচনকে বিলম্বিত করবে। তারা আরো বলে যে, যেটুকু সংস্কার না করলেই নয়, সেটুকু করে অতি দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে। বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির মেম্বার মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আগামী ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করেছেন। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের প্রশ্নে ড. ইউনূস সরাসরি কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দলের ব্যাপারে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত দিইনি। বিএনপি এটা করেছে। বলেছে, সব রাজনৈতিক দল অবশ্যই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। সুতরাং তারা ইতোমধ্যেই রায় দিয়ে দিয়েছে। আমরা দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের মতামতকে উপেক্ষা করবো না। (দৈনিক সমকাল, ২০ নভেম্বর, পৃষ্ঠা ১৩)।
বিএনপি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিরোধিতা করে এবং তাদেরকে নির্বাচনে আনার ইচ্ছা প্রকাশ করে যে বক্তব্য দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যখন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের কথা বলি, তখন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বক্তৃতায় সেটিতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি আরো বলেন, ১৯৪৫ সালে জার্মানির ফ্যাসিস্ট নাৎসি পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং আজও তারা নিষিদ্ধ রয়েছে। সেখান থেকেই বোঝা উচিত, আওয়ামী লীগের কী পরিণতি হওয়া উচিত। (দৈনিক সমকাল, ২০ নভেম্বর, পৃষ্ঠা ১৩)। দৈনিক সমকাল ঐ একই খবরে বলেছে, এর আগে এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি আওয়ামী লীগ বা কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নন।
ছাত্র নেতৃবৃন্দের সন্দেহ, আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন করতে চাইছে ভারত। আর দ্রুত নির্বাচনের জন্য চাপ দিচ্ছে বিএনপি। ভারত এবং বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ছেলেদের রক্তের ওপর পা রেখে দিল্লিকে কিবলা বানিয়ে ক্ষমতার মসনদে যাওয়ার আকাক্সক্ষা জনগণের মুক্তির নিয়তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। আওয়ামী পুনর্বাসনে যারা উদ্যোগ নেবে ইতিহাস তাদের গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করবে।’ এ ব্যাপারে সারজিস আলম বলেছেন, ‘গণহত্যার বিচারের আগে আওয়ামী লীগকে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেবো না। প্রয়োজনে দ্বিতীয় অভ্যুত্থান হবে।’
আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের কথা যখন উঠছে, তখন শেখ মুজিবকে নিয়েও বিএনপির সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃবৃন্দের মতানৈক্য স্পষ্ট হয়েছে। অন্যতম উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নিজে বঙ্গভবনসহ আরো কয়েকটি সরকারি অফিস থেকে শেখ মুজিবের ছবি নামিয়েছেন। দেশের লাখ লাখ মানুষের মধ্যে শেখ মুজিবের ছবি নামানো বিপুলভাবে সমর্থিত হলেও বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রিজভী বলেন, সংবিধানে শেখ মুজিবকে জাতির পিতা ঘোষণা করা হয়েছে এবং অফিস-আদালতে তার ছবি টাঙানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রিজভীর এ বক্তব্যের পর মুহূর্তের মধ্যেই সারা দেশে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অনেক লোককে বলতে শোনা যায় যে, বিএনপি আসলে চাচ্ছে কী? তারা সংবিধানের দোহাই দিয়ে প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিনের অপসারণের বিরোধিতা করে। তারা সংবিধানের দোহাই দিয়ে শেখ মুজিবের ছবি নামানোর বিরোধিতা করে। তারা অতি উদারতা দেখাতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধকরণের বিরোধিতা করে। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পর তারা উষ্মা প্রকাশ করে বলে যে, এ নিষিদ্ধকরণ পদ্ধতি অনুযায়ী হয়নি। পরে অবশ্য রুহুল কবির রিজভী দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, তিনি মনে করেছেন দরবারের যে কক্ষে সব রাষ্ট্রপতির ছবি সেখান থেকে নামানো হয়েছে, তাই ইতিহাস রক্ষায় এ বক্তব্য দিয়েছিলেন। পরে তিনি জেনেছেন অন্য একটি কক্ষ থেকে তা সরানো হয়েছে। যেটি ফ্যাসিবাদী সংবিধানের কারণে টানানো হয়েছিল। এখন যে আইনের কোনো কার্যকারিতা নেই।
সাধারণ পথচারীরাও বলছেন, বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের জন্য এত অস্থির হয়ে পড়েছে কেনÑ সেটি তাদের বোধগম্য নয়। যদি ৫ আগস্ট ছাত্র নেতৃবৃন্দ অসীম সাহসে বুক বেঁধে শেখ হাসিনার বুলেট-বোমাকে উপেক্ষা না করতেন, তাহলে বিএনপিকে তো আরো সাড়ে ৪ বছর অপেক্ষা করতে হতো। তারপরও কি শেখ হাসিনা বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে দিতেন? তাদের কি সাধ্য ছিল শেখ হাসিনার দানবীয় শক্তিকে পরাভূত করার? বৈষম্যবিরোধী নেতারা এতদূরও বলেছেন, গত ২৮ অক্টোবর ১০ লাখ লোকের বিশাল জনসভায় পুলিশের কয়েকটি সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপেই ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।
তারা এ ব্যাপারে স্পষ্ট বলেন, দেড় হাজার ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছেন, ২৬ হাজার ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন, অনেকের হাত ও পা কেটে ফেলতে হয়েছে, অনেকে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। এ বিপুল কুরবানি কি আওয়ামী লীগকে সরিয়ে দ্রুত নির্বাচন দিতে এবং আরেকটি দলকে ক্ষমতায় আনতে?
তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বিএনপি যতই চাপ দিক। সংস্কারের ওপর ভিত্তি করে হবে নির্বাচন। (দৈনিক সমকাল, ২৪ নভেম্বর, পৃষ্ঠা ৩)। নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দীন বলেছেন, Polls only after vital electoral reforms/New CEC says after taking oath. অনুবাদ: গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক সংস্কারের পরেই নির্বাচন/শপথ গ্রহণের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার। (দ্য ডেইলি স্টার, প্রথম পৃষ্ঠা, প্রধান সংবাদ, ২৫ নভেম্বর)।
ওপরের এ সুদীর্ঘ আলোচনার পর ধারণা করা হচ্ছে যে, বিএনপি যত সহজে পার পেতে চাচ্ছে, তত সহজে তারা পার পাবে না। আগামী দিনে ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং একশ্রেণির সিনিয়র পলিটিশিয়ানের রাজনৈতিক অবস্থান হবে, (১) প্রচণ্ড ভারতবিরোধিতা, (২) প্রচণ্ড আওয়ামী লীগবিরোধিতা, (৩) শেখ মুজিবকে দেবতার আসনে স্থান দেওয়ার বিরোধিতা এবং (৪) জনআকাক্সক্ষাধারী একটি সংবিধান। সেখানে বিএনপির পলিটিক্যাল মূল ইস্যু কী হবে?
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন ২৪ বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করে বিএনপিকে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হতে হবে। কারণ এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য, সংহতি। দূরত্ব করলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। অতএব সাবধান।
Email: [email protected]