আ’লীগকে সমর্থনে ইমেজ সংকটে ভারত
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০০
বাংলাদেশ নিয়ে দিল্লীর মনোভাব বদলের পরামর্শ আন্তর্জাতিক সংগঠনের
॥ উসমান ফারুক॥
ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠা ও দুর্নীতির নজির সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গালগল্প তৈরিকারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন এক বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো। ছাত্র-জনতার এ বিপ্লবে স্বৈরশাসকের পতনের পর নতুন যুগের যে পথ চলা শুরু হয়েছে, তা বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর জন্যও একটি বার্তা। বাংলাদেশের উত্থান সাহস জুগিয়েছে ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোয়ও। মনিপুরে বিপ্লবের সুর এখনো জানান দিচ্ছে। আওয়ামী সরকারের পুরোমাত্রায় সমর্থনকারী ও সহায়তাকারী ভারতের প্রতি পরামর্শ দিয়ে আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) বলেছে, আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে কাজ করে বাংলাদেশের গণ মানুষ ও বিশ্বের কাছে ভারত নিজেদের ‘ইমেজ’ হারিয়েছে। ভারতের উচিত হবে হারানো ‘ইমেজ রিপেয়ার (পুনরুদ্ধার করা)’ করা। এজন্য ভারতকে পরামর্শ দিয়ে বেলজিয়ামভিত্তিক সংগঠনটি সুপারিশ করেছে, বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা, দর্শন, ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনৈতিক পরিবেশ ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতি ভারতের শ্রদ্ধা পোষণ করতে হবে। সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইলে ভারতের পুরনো দৃষ্টিভঙ্গি বদলিয়ে বাংলাদেশের জনবান্ধব করতে না পারলে সমস্যায় পড়বে তারা। এজন্য বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পরামর্শ দিয়ে আইসিজি বলেছে, কোনো একক দলের পরিবর্তে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের গণমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হলে ভারতকে তার পররাষ্ট্র নীতিতে আমূল সংস্কার করতে হবে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি একটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে ঘিরেই চলছে ১৯৭১ সাল থেকে। গত তিনটি নির্বাচন ও ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে প্রকাশ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছে ভারত। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অফিসে দেশটির ঢাকা দূতাবাসের কর্মকর্তা ও গোয়েন্দাদের অবাধ যাতায়ত ছিল। বাংলাদেশের মানুষ এখন বিশ্বাস করে, ভারত একমাত্র আওয়ামী লীগের বন্ধু। নিজে সেক্যুলার দাবি করলেও বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধ্বংসে আওয়ামী লীগকে বার বার সহযোগিতা করে আসছে ভারত।
গত দেড় দশকে ভারতের এমন আচরণ পুরো বিশ্বের কাছেও ধরা পড়েছে। গত ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যে জুলাই বিপ্লব হয়েছে, তার বিরুদ্ধে এখনো ভারতের মিডিয়া গুজব ও প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। অবৈধভাবে হাজার হাজার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ভারতে আশ্রয় দিয়েছে। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাংলাদেশে ফেরত, বহুদলীয় গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করা, মুসলিম নির্যাতন ও হত্যা বন্ধ, পানির ন্যয্য হিস্যা দেয়া, সীমান্তে গুলি করে মানুষ হত্যা, মাদকের চোরাচালান বন্ধ করার মতো দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নেওয়া পর্যন্ত ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে না বাংলাদেশের মানুষ।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশ, মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, পাকিস্তান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ সকল রাষ্ট্রপ্রধান ও আন্তর্জাতিক সংস্থা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করছে। দাতা সংস্থাগুলোকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশের পাশে থাকার আহ্বান জানিয়ে আইসিজি বলেছে, বানোয়াট এ প্রতিবেদন তৈরি করে ফ্যাসিস্ট পতিত সাবেক সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠরা বাংলদেশ থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার পাচার করে নিয়ে গেছে। স্থানীয় মুদ্রায় তা ১২ লাখ কোটি টাকা।
বিশাল এ অংক পাচার করে নিয়ে গেছে ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দুবাই, সাইপ্রাস, বেলজিয়ামসহ দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোয়। এসব ফিরিয়ে আনতে সংস্কার কার্যক্রম ও আইনি পদক্ষেপ নেয়ার কথাও বলেছে সংগঠনটি। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পড় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গত ১০০ দিনের কর্মকাণ্ড ও সংস্কারে বিভিন্ন দিক নিয়ে আইসিজি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ নিয়ে। সেখানে সুশাসন, অর্থনৈতিক বাস্তবতা, প্রবৃদ্ধির হিসাব পদ্ধতি ও সরকারের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
হাসিনা ও তার সহযোগীদের পাচার ১২ লাখ কোটি টাকা
অপ্রয়োজনীয় ও বেশি অর্থে প্রকল্প বানিয়ে কাগুজে উন্নয়ন দেখিয়ে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ১২ লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার করে নিয়ে গেছে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীরা। অর্থ সরিয়ে নিতে তৈরি করা হয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বানোয়াট তথ্য। অনুসন্ধানীমূলক অপরাধ কর্মকাণ্ড নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) শেখ হাসিনার অর্থ পাচারের এ ছলচাতুরীর নাম দিয়েছে ‘রাবার পেন্সিল’ মেকানিজম। সংস্থাটি বলেছে, শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীরা নিজেদের মতো করে অর্থনৈতিক তথ্য পেন্সিল দিয়ে লিখেছে, আবার বার বার তা রাবার দিয়ে মুছে ফেলেছে যতক্ষণ না উদ্দেশ্য হাসিল হয়। বার বার ঘষা-মাজা করে অর্থনৈতিক প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বলে এ নাম দিয়েছে সংগঠনটি।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শেখ হাসিনার ‘রাবার পেন্সিল’ মেকানিজম এখন আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পরে গত ১৫ বছরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে গবেষণা করেছে সংগঠনটি। সেখানে উঠে এসেছে, নিজেদের মতো করে হিসাব তৈরি, ঘষা-মাজা করে প্রতিবেদন বানিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। এ পদ্ধতিকে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, শেখ হাসিনার আমলে অর্থনীতির হিসাবগুলো নিজের মতো করে কুকড (রান্না) অর্থাৎ প্রস্তুত করা হয়েছে।
বানোয়াট এ প্রতিবেদন তৈরি করে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠরা বাংলাদেশ থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার পাচার করে নিয়ে গেছে। স্থানীয় মুদ্রায় তা ১২ লাখ কোটি টাকা। বিশাল এ অংক পাচার করে নিয়ে গেছে ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দুবাই, সাইপ্রাস, বেলজিয়ামসহ দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোয়।
ইতোমধ্যে আওয়ামী সরকারের ২৪ এমপি, মন্ত্রী ও দুই উপদেষ্টার পাচারের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (এফআইইউ) ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আরো শতাধিক এমপি, মন্ত্রীর তথ্য নিয়ে কাজ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান দুটি। প্রাথমিকভাবে অর্থ পাচারের তথ্যের সঙ্গে আরো জানা গেছে, এই ২৪ এমপি, মন্ত্রীর বিদেশি নাগরিকত্বও নিয়ে রেখেছেন অনেক আগ থেকেই। নাগরিকত্ব নিয়ে দেশগুলোয় অর্থ পাচার করেছেন।
সংবিধান অনুযায়ী, এমপি, মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব নিতে পারবেন না। অন্য দেশের নাগরিকত্ব থাকলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। কিন্তু অন্য দেশের নাগরিকত্ব থাকার পরও তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রাতের ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠন করে মন্ত্রিত্ব নিয়েছেন। সংবিধান লঙ্ঘন করে তারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এখন তাদের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘন ও অর্থ পাচার দুটি অভিযোগ নিয়ে কাজ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো।
গত ৫ আগস্ট দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি ও ক্ষমতা দখল করে থাকা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাকে উৎখাত করে ছাত্র-জনতা। জুলাই বিপ্লবের এ দিনে গণঅভ্যুত্থান দেখে দেশ থেকে গোপনে পালিয়ে গিয়ে ভারতে ওঠেন শেখ হাসিনা। পড়ে তার পথ ধরে হাজার হাজার নেতা কর্মী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালসহ অসংখ্য মন্ত্রী ভারতে গিয়ে উঠেছেন রাতের বেলা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে। পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়াই তারা ভারতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আগ থেকে পাচার করা অর্থ এখন তারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে খরচ করছেন। ভারত সরকারও তাদের অভয়ারণ্য দিয়ে রেখেছেন।
অর্থ পাচারের ক্ষত রিজার্ভ ও অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে
করোনা মহামারির সময়ে বাংলাদেশের রিজার্ভ ২০২০ সালের আগস্ট মাসে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল প্রবাসীদের কারণে। বিশাল এ রিজার্ভ থাকায় বাংলাদেশের টাকার মানও স্থিতিশীল হয়। বৈদেশিক লেনদেনে সুবিধাজনক অবস্থানে চলে যায় দেশ। অর্থ পাচার করতে এখানেই শকুনি দৃষ্টি দেয় জনবিচ্ছিন্ন ও পতিত আওয়ামী সরকার।
আমদানি-রফতানির আড়ালে মূল্য তথ্য কমিয়ে-বাড়িয়ে অর্থ পাচার শুরু করে। পণ্যর দাম ২০০ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে আমদানি করা হয়। অন্যদিকে জ্বালানি তেল আমদানিতেও বাড়তি মূল্য দেখানো হয়। এভাবে অর্থ পাচার করায় রাষ্ট্রীয় কোষাগার রিজার্ভ কমতে কমতে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে চলে গেছে। সংকট এতটাই করে ফেলেছিল যে, নিট রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলার করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় শেখ হাসিনা। বৈদেশিক বাণিজ্য করতে গিয়ে বাংলাদেশের চলতি হিসাব ঘাটতিতে পড়ে যায়।
দুই বছর ঘাটতিতে থাকার পরে গত মাসে ইতিবাচক হয় চলতি হিসাবটি। চলতি হিসাবে ঘাটতি হলে কোনো দেশকে ঋণ করতে হয় বিদেশ থেকে। এটি করতে গিয়ে মুদ্রা বা টাকার মান কমে যায়। গত দুই বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের টাকা ৮৪ টাকা থেকে নেমে গিয়ে ১২০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। মাঝে তা ১২৩ টাকা উঠেছিল ব্যাংকিং চ্যানেলে। খোলাবাজারে ডলার এখনো ১২৩ টাকা।
সেই রিজার্ভ আবার অল্প অল্প করে বাড়াচ্ছেন প্রবাসীরা। অর্থ পাচারকারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গোপনে সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব নিয়ে রেখেছেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের ‘রেসিডেন্স কার্ড’ (স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি) নিয়েছে বেলজিয়ামের। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যুক্তরাজ্যের নাগরিক। দেশটির লন্ডনে তার মেয়ে অনেক আগে থেকেই লন্ডনে থাকেন। এছাড়া সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, তাজুল ইসলাম ও জুনাইদ আহমেদের যুক্তরাষ্ট্রে থাকার বৈধ অনুমতি বা ‘গ্রিন কার্ড’ রয়েছে। আর সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জমান একাই সাড়ে তিন হাজার কোটি টাক পাচার করে যুক্তরাষ্ট্রে বিশাল সাম্রাজ্য গড়েছেন।
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করলে বা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলে তিনি সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হতে পারেন না। কিন্তু তা লঙ্ঘন করে সাবেক প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও মো. মাহবুব আলী বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়েছেন। এর মধ্যে সালমান এফ রহমান, জুনাইদ আহমেদ পলক ও মাহবুব আলী দেশের কারাগারে আছেন ছাত্রদের হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকায়।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসে গ্রিন কার্ড আছে সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আব্দুস শহীদ, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ), মাহফুজুর রহমান ও সালাউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ, আবদুর রহমান, মাহবুব উল আলম হানিফ, আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (নাসিম), শামীম ওসমান, শফিকুল ইসলাম (শিমুল) ও হাবিব হাসান।
শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আবদুস সোবহানের পরিবারের যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক ফ্ল্যাট বা বাড়ি থাকার বিষয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি) তাদের ওয়েবসাইটে গত বছরের জানুয়ারি মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৪ সালে প্রথম নিউইয়র্কে অ্যাপার্টমেন্ট কেনা শুরু করেন গোলাপ। পরের পাঁচ বছরে তিনি নিউইয়র্কে একে একে ৯টি প্রপার্টি বা সম্পত্তির (ফ্ল্যাট বা বাড়ি) মালিক হন। এসব সম্পত্তির মূল্য ৪০ লাখ ডলারের বেশি (ডলারের বর্তমান বিনিময় মূল্য অনুযায়ী প্রায় ৪২ কোটি টাকা)।
দুদকের তথ্যানুযায়ী, সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব রয়েছে সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের এবং জাপানে থাকার অনুমতি (রেসিডেন্স কার্ড) রয়েছে সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমের। সাবেক সংসদ সদস্য (টাঙ্গাইল-২ আসন) তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনির জার্মানির নাগরিক এবং সাবেক সংসদ সদস্য (ময়মনসিংহ-১১) এম এ ওয়াহেদ পাপুয়া নিউগিনির নাগরিকত্ব নিয়েছেন।
সালমান এফ রহমানের সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব থাকলেও ‘বাগানবাড়ি’ করেছেন যুক্তরাজ্যে। সেখানে তার চারটি বাড়ি রয়েছে। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শামীম ওসমান কানাডার নাগরিক। আছে দুবাইয়ের আজমান শহরে তার আরো বাড়ি। কানাডায় বাড়ি, ব্যবসাসহ বিপুল সম্পদ রয়েছে ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর (নাসিম)। তার এক মেয়েও কানাডায় থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি রয়েছে মানিকগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন মাহমুদ জাহিদের। নাটোরের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুলের বাড়ি রয়েছে কানাডার টরন্টোর নিকটবর্তী স্কারবরো শহরে। গত বছরের শুরুতে ১৭ লাখের বেশি কানাডিয়ান ডলার খরচ করে বাড়িটি কেনেন তিনি। স্থানীয় মুদ্রায় তা প্রায় ১২ কোটি টাকা।
অর্থনীতি মূল সড়কে আনা সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ
অর্থনীতি লুটপাটের কারণে দেশ এখন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও অন্যান্য সংস্থার কছে। সেই ঋণের বোঝা এখন টানতে হবে দেশের জনগণকে। দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগকে সরানোর পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ আছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৫ বছরে ক্ষমতা ধরে রাখতে শেখ হাসিনার সরকার পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে; বিশেষ করে পুলিশ, বিচারব্যবস্থা এবং আমলাতন্ত্রের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করেছে। ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সরকারবিরোধীদের ওপর নিয়মিত দমন-পীড়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, চরম সামাজিক বৈষম্য ও ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি ও ব্যাংকিং খাত লুটপাট করায় তারল্য সংকটের মধ্যে রয়েছে।
এসব সংস্কার ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে নিজের কাজে ফেরানোর মতো চ্যালেঞ্জ যেমন রয়েছে, তেমনি প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া দোসরা এখনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। সুশাসন ফিরিয়ে আনা ও প্রশাসনকে জবাবদিহির আওতায় আনা সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ফ্যাসিস্টের পতনের পর নতুন বাংলাদেশ গড়তে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ, মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, পাকিস্তান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ সকল রাষ্ট্রপ্রধান ও আন্তর্জাতিক সংস্থা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করছে। সুশাসন ফিরিয়ে আনা ও সংস্কার ইস্যুতে তারা আর্থিক সহযোগিতা নিয়েও পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু একমাত্র দেশ ভারত এখনো পতিত আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করছে। ভারতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের হাজার হাজার কর্মীও নেতাদের আশ্রয় দিয়েছে। তারা সেখানে বসে অনলাইনে গুজব ছড়াচ্ছে। কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, হত্যা ও অর্থ পাচারের সকল তথ্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তুলে ধরতে হবে সরকারকে। শক্ত হাতে দমন করতে হবে বাজার সিন্ডকেট ও ফ্যাসিস্টদের দোসরদের।