রহমানের বান্দার পরিচয় : পর্ব-২০ : অপরাধ ও দুর্নীতিমুক্ত জীবন গঠন : সফল মুমিনের পরিচয়


১ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:৫৩

॥ ড. মুহাম্মদ খলিলুর রহমান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা প্রকৃত সফল মুমিনের যেসব গুণাবলি উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘লাগব’ তথা বাজে কাজ, বাজে কথা, বাতিল কাজ, অনুচিত কর্মসমূহ, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, অপরাধপ্রবণতা, বেহুদা ইত্যাদি। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, “সত্যিকার সফল মুমিন তারাই… যারা ‘লাগব’ তথা বাজে কাজ, বাজে কথা, বাতিল কাজ, অনুচিত কর্মসমূহ, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, অপরাধপ্রবণতা, বেহুদা ইত্যাদি থেকে নিজকে বিরত রাখে।” (সূরা আল-মুমিনুন : ৩)। উল্লেখ্য যে, সফল মুমিনের ধারাবাহিক পরিচয় পর্বের এ অংশে আমরা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ‘লাগব’ সম্পর্কে আলোচনা করব।
‘লাগব’ শব্দের শাব্দিক বিশ্লেষণ: বিভিন্ন অভিধানে ‘লাগব’ এর অর্থ বলা হয়েছে বেহুদা, অপ্রয়োজনীয়, যাতে কোনো উপকার নেই, The vain talk, গালিগালাজ, ভর্ৎসনা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহার হয় (লিসানুল আরব, আল-মুনজিদ ইত্যাদি)।
পারিভাষিক বিশ্লেষণ: সাহাবীদের (রা.) যুগ থেকে শুরু করে অদ্যবধি বিভিন্ন মুফাসসির, ইসলামী মনীষী ‘লাগবে’ বিভিন্ন তাফসির করেছেন। ১. সর্বশ্রেষ্ঠ মুফাসসির আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে ইমামা ইবনে কাসির উল্লেখ করেন যে, ‘লাগবের অর্থ হলো বাতিল, মিথ্যা, শিরক এবং সকল ধরনের পাপাচার।” (ইবনে কাসির ৩/১৮৫)। ২. ইমাম রাগেব ইস্পাহানী বলেন, “যেসব কথার কোনো উপকারিতা ও প্রয়োজন নেই তাকেই ‘লাগব’ বলা হয়।” ৩. ইমামা শাওকানিসহ বিশিষ্ট মুফাসসিরগণ এর তাফসিরে বলেন, “মিথ্যা, বানোয়াট, কল্পনাপ্রসূত, বেহুদা বাজে কথাবার্তা, বাজে কাজ, মিথ্যা সাক্ষ্য ইত্যাদি কে ‘লাগব’ বলা হয়। তাই তো আল্লাহ তায়ালা রহমানের বান্দার গুণাবলিতে উল্লেখ করেছেন, “সত্যিকার রহমানের বান্দা তারা যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না, আর যখন ‘লাগব’ তথা বেহুদা-অন্যায় কার্যক্রমের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, তখন অত্যন্ত ভদ্রচিতভাবে আত্মমর্যাদা নিয়ে সন্তর্পণে কেটে পরেন।” (সূরা ফুরকান : ৭২)। এ ব্যাপারে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, “যদি কেউ এমন কোন মজলিসে থাকেন যেখানে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয় না, তাহলে তিনি যেন মৃত গাধার পাশে অবস্থান করলেন, আর এটা মজলিসের সবার জন্যই মহা ভর্ৎসনা ও ক্ষতির কারণ। (আবু দাউদ- ৪/১৪২) (ইবনে তাইমিয়াহ: মাজমাউল ফাতওয়া-৬৬৪৪)। ৪. ‘লাগব’ এর তাফসিরে আরো কতিপয় হাদিস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, বিশিষ্ট সাহাবী মুয়াবিয়া, আলী, ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘সফলকাম মুমিন সকলধরনের মায়াছি তথা গুনাহের কাজ ও বেহুদা কাজ থেকে নিজকে বাঁচিয়ে রাখে।” ৫. তাফসিরে ফাতহুল কাদিরে উল্লেখ করা হয়েছে, “সকল ধরনের বাতিল মিথ্যা কথা ও কাজকে ‘লাগব’ বলা হয়।” (ফাতহুল কাদির)। ৬. “যে সকল চিন্তায়, কাজে ও কথায় আল্লাহর সন্তুষ্টি নেই সে সবকিছুকেই ‘লাগব’ বলা হয়”। (আইসারুত তাফাসির ১৪২)। ৭. ইমাম যামাকশারি (র.) বলেন, “যে কথা বা কাজ আপনার কোন কাজে আসবে না, উপকারে আসবে না যেমন বেহুদা হাসি-ঠাট্টা, বাজে গল্প-গুজব, লৌকিকতার খেলাপ, যেসব কাজ মানুষকে বেহুদা কাজের দিকে ধাবিত করে এ সবকিছুকেই ‘লাগব’ বলা হয়।” (কাসসাফ)। ৮. তাফসিরে দুররে মানসুরে বলা হয়েছে, ‘সফল ঈমানদারগণ বাতিল ও অনর্থক কর্মকাণ্ডে নিমজ্জিত হওয়া থেকে আল্লাহ তায়ালা রক্ষা করেন।’ ৯. তাফসিরে যাদুল মাসির এ বলা হয়েছে, “‘লাগবের’ মৌলিক পাঁচটি অর্থ ক. ইবনে আব্বাস (রা.- এর মতে ‘শিরক’, খ. আবু তালহা (রা.) এর মতে ‘বাতিল মতাদর্শ’, গ. হাসান বসরি (রা.)-এর মতে ‘সকল ধরনের পাপাচার’, ঘ. ইমাম সুদ্দি (র.)-এর মতে ‘মিথ্যা কথা ও কাজ’, ঙ. ইমাম মুকাতিল (র.) বলেন, ‘গালিগালাজ ও কষ্ট,’ যা কাফির ও ইসলামের দুশমনদের পক্ষ থেকে ঈমানদারদের ওপরে আপতিত হয়। চ. ইমাম জুজায (র.) বলেন, ঈমানদারগণ সকল ধরনের অপরাধ, গুনাহ, মিথ্যা, বেহুদা খেল-তামাসা সবকিছুই থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক থেকে আত্মরক্ষা করে থাকেন। আল্লাহ তায়ালা যথার্থই বলেছেন, ‘আর যখন তারা কোন অযথা-বাজে কথা শোনে সেখান থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে চলে আসে।’ (সূরা আল-কাসাস: ৫৫)। অতএব, ওপরে বর্ণিত রহমানের বান্দার পরিচয় পর্বে যে গুরুত্বপূর্ণ গুণের কথা বলা হয়েছে তা হলো ‘লাগব’ তথা বাজে কাজ, বাজে কথা, বাতিল কাজ, অনুচিত কর্মসমূহ, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, অপরাধ প্রবণতা, বেহুদা ইত্যাদি থেকে নিজকে ফিরিয়ে রাখা। সকল ধরনের অন্যায়, অপকর্ম, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, বেহুদা-বাজে কথা ও কাজ থেকে সাচ্চা ঈমানদার নিজেদের ফিরিয়ে রাখেন।
মুমিনের জীবন হবে শিরক-বিদ’আত, মিথ্যাচারমুক্ত নৈতিক মানসম্পন্ন। ইসলামী মূল্যবোধ নৈতিকতার ওপরেই নির্ভরশীল। অশ্লীলতা মুক্ত জীবনযাপন করা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সাধারণভাবে অশ্লীলতা আইনগতভাবে এমন কোনো বিষয়বস্তু বা আচরণকে বোঝায়, যা সমাজে অশালীন, হিসেবে বিবেচিত হয়। ‘লাগব’ তথা বাজে কাজ, বাজে কথা, বাতিল কাজ, অনুচিত কর্মসমূহ, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, অপরাধ প্রবণতা, বেহুদা ইত্যাদি থেকে নিজকে ফিরিয়ে রাখার জন্য কতিপয় করণীয় উল্লেখ করা হলো- ১. নৈতিক শিক্ষা : ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে ‘লাগব’ তথা বেহুদা কর্মকাণ্ড থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। তাই তো আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন নৈতিকতার শিক্ষার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জনের বিধান দিয়ে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনি সেই সত্তা, যিনি সাধারণ মানুষের মাঝে রাসূল পাঠিয়েছেন, তাদের আল্লাহর আয়াত-বিধান শিখিয়েছেন, তাদের আত্মশুদ্ধি ও পবিত্র করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দিয়েছেন।’ (সূরা জুমুআ : ২)। এভাবে পবিত্র কুরআন এবং সহিহ হাদিসে অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২. পরিবার এবং সমাজের ভূমিকা : আমাদের আকিদা-বিশ্বাস থেকে শুরু করে ব্যাক্তিগত জীবনে ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সৎ আচরণের প্রচলন এবং সমাজে ভালো পরিবেশ গড়ে তোলা অশ্লীলতা মুক্ত জীবনের জন্য খুব বেশি কার্যকর। এজন্যই মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন ‘তোমরা নিজে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো এবং পরিবার পরিজনদেরও উক্ত আগুন থেকে বাঁচাও।’ আল-কুরআন।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো নিশ্চিত জেনে রাখ যে তোমাদের কতিপয় স্বামীর জন্য তার স্ত্রী এবং স্ত্রীর জন্য স্বামী এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য তাদের সন্তান-সন্ততি একে অপরের জন্য শত্রু হয়ে যাবে যদি পরস্পর পরস্পরের প্রতি সচেতন, সতর্ক, সজাগ ও আন্তরিক না হওয়া যায়। অতএব এ ঝুঁকি থেকে মুক্তির জন্য সতর্ক হোন, (পরস্পর পরস্পরের প্রতি সজাগ সচেতন আন্তরিক ও দায়িত্ববান হোন)।’ সূরা তাগাবুন : ১৪। ৩. আত্মসংযম : আত্মসংযম; বিশেষ করে দৃষ্টির হেফাজত করা এবং অশ্লীল বিষয়বস্তু থেকে দূরে থাকা; ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বেহুদা-বাজে কথা ও কাজ থেকে দূরে থাকার জন্য আত্মসংযম, দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন মানবিক অভ্যাস নিয়ন্ত্রণের বিশেষ পরিকল্পনা নেয়া দরকার। আল্লাহ তায়ালা বলেন , ‘প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল ধরনের অশ্লীলতা বেহায়াপনা থেকে দূরে থাকো।’ সূরা আনআম।
হাদীস শরীফে বিশ্বনবী সা. বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ তায়ালা সকল ধরনের অশ্লীলতা বেহায়াপনা নিষেধ করেছেন।’ (আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ)। ৪. ভালো বন্ধু, সৎসঙ্গ নির্বাচন করা: বেহুদা কাজ থেকে মুক্ত হয়ে নির্ভেজাল নিষ্কলুষ পাপ-পঙ্কিলমুক্ত জীবন গঠনের জন্য দীনদার মুত্তাকি বন্ধু-সঙ্গী বাছাই করা খুবই জরুরি। সৎ ও নৈতিক মানুষদের সঙ্গী হলে অশ্লীলতার প্রভাব কমে আসে। মহানবী সা. বলেছেন, নেক্কার সৎ মুত্তাকি বন্ধু এবং বদ দুষ্ট এবং খারাপ বন্ধুর তুলনা হলো আতরওয়ালা সুগন্ধি যুক্ত ব্যক্তি এবং কর্মকারের মতো। সুগন্ধিওয়ালা তার বন্ধুকে হয় সুগন্ধি দেবে অথবা সুগন্ধি বিক্রি করবে, তা না হলে আতরের সুঘ্রাণ সে পাবেই। অপরদিকে কর্মকার সে তার আগুন দিয়ে হয় বন্ধুর জামা কাপড় জ্বালিয়ে ফেলবে অথবা দূষিত ধোঁয়া তার নাকে মুখে অটোমেটিক ঢুকে কষ্ট দিবে। (বুখারী ও মুসলিম)। ৫. ইসলামের মৌলিক ইবাদতসমূহ পালন করা: নামায, রোজা, হজ, যাকাতসহ মৌলিক ইবাদতসমূহ পালন করলে বেহুদা কাছ থেকে দূরে থাকা সহজ হয় এবং অশ্লীলতামুক্ত জীবন গঠনে সহায়ক হবে। এমনকি বিধর্মীরাও যদি তাদের ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী জীবনযাপন করেন তাহলে তারাও তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবে। ৬. ইসলামের সঠিক শিক্ষার প্রতি বিষয়ের গুরুত্ব দেওয়া: ইসলামের মৌলিক শিক্ষাদানের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা এবং বিশেষ বিশেষ কাউন্সেলিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে অশ্লীলতার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা। (চলবে)।
লেখক : প্রবন্ধকার: কলামিস্ট, লেখক, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। ওয়ার্ল্ড মুসলিম স্কলার্স ফোরাম কাতারের নির্বাহী সদস্য।
[email protected]