রেমিট্যান্সপ্রবাহে রেকর্ড, বাড়ছে রিজার্ভ, কমছে নিত্যপণ্যের দাম : ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি


১ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:১৬

॥ উসমান সরকার ॥
সংস্কারের উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। দিশেহারা অর্থনীতি তার পথ পুনরুদ্ধার করায় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক একাধিক সূচকে নাটকীয় উন্নতি হচ্ছে গত দুই মাসে। বিশ্বের মধ্যে ৩৫তম দেশের এ অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ক্ষত অর্থ পাচার হওয়ার পথটি বন্ধ করতে পারায় রেমিট্যান্সপ্রবাহে রেকর্ড তৈরি হয়েছে গত দুই মাসে। এর প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে শুরু করেছে। ডলারের সংকট কাটতে শুরু করায় গত দুই মাসে সোয়া তিন বিলিয়ন ডলারে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার খরচ করতে হয়নি বাংলাদেশকে। এতে টাকার মান শক্তিশালী হওয়ায় ডলারের বিপরীতে স্থিতিশীল হচ্ছে। অন্যদিকে গণতন্ত্রকামী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আর্থিক দিক দিয়ে সহযোগিতা করতে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ব সম্প্রদায়। বিশ্বব্যাংক, এডিবি (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক), জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে বাজেট সহায়তা দিতে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সোয়া ৫ বিলিয়ন ডলার দিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে আরো সোয়া ৫ বিলিয়ন ডলার যুক্ত হবে এক মাস পরই। অন্যদিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) প্রকল্পগুলোয় অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও অপচয় নিয়ন্ত্রণ করা এবং দুর্নীতির সুযোগ বন্ধ হওয়ায় সাধারণ মানুষের কাছেও সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিশ্বাসের বার্তা গেছে।
এছাড়া নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পরিচালিত অভিযান সফল হওয়ার সুফল পেতে শুরু করেছে। দুই সপ্তাহের মধ্যে সব ধরনের সবজি ও মাছ-মুরগির দর নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। সবচেয়ে আলোচিত খাদ্যপণ্য ডিমের দামও ১২ টাকার নিচে নেমেছে। সব মিলিয়ে অর্থনীতির প্রধান প্রধান সূচকগুলো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করায় বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনীতিতে যে মাফিয়াতন্ত্র তৈরি করেছিল পতন হওয়া ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার, তার অবসান হয়েছে। সবখানে একটি বার্তা গেছে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে সিন্ডিকেট তৈরি মানবে না সাধারণ জনগণ। প্রয়োজনে সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে এসব মাফিয়া ও সিন্ডিকেটের সদস্যদের জনসম্মুখে বিচার করবে। এসব কারণে অর্থনীতি এখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। খুব শিগগির তাতে গতি আরো বাড়বে বলে মনেই করছেন সবাই।
এজন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়ে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু নীতি সংস্কারই নয়, ফ্যাসিস্ট সরকারের সঙ্গে যেসব আমলা, নীতিনির্ধারক কাজ করেছে, সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে সুবিধা পেয়ে আসছে, তাদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। নইলে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করা অর্থনীতি মাঝপথেই দিক হারাতে পারে।
উল্লম্ফন রেমিট্যান্সপ্রবাহে
গত বছরেও দেশের প্রবাসী আয় রেমিট্যান্সপ্রবাহ ছিল ১০ শতাংশের নিচে। অনেক মাসেই তা নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে ছিল। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন। জনতার সমুদ্র দেখে বাংলাদেশ ছেড়ে গোপনে ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেয় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তার দেখানো পথ ধরে আগে ও পরে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা এখন ঘুরছে কলকাতা শহরে। দেশ থেকে টাকা পাচার করে ভারতে খরচ করছে। ভারত সরকারও শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের নিরাপদ আশ্রয়ের অভয়ারণ্য করে দিয়েছে। জগদ্দল পাথরের মতো বাংলাদেশের জনগণের ওপর চেপে বসা সকরারের পতন হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। সরকারে আসেন দেশের গ্রহণযোগ্য ও সততার নজির রাখা অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা।
দায়িত্ব নিয়েই নুইয়ে পড়া অর্থনীতি সংস্কার ও মাফিয়াতন্ত্র উৎখাতের ঘোষণা দেয় সরকার। বন্ধ করতে সক্ষম হয় অর্থ পাচারের সম্ভ্যাব্য সকল পন্থা, বড় বড় কয়েকটি শিল্প গ্রুপকে কঠোর নজরদারির আওতায় আনা হয়। তাদের ব্যাংক হিসাব তলব ও ফ্রিজ করা হয়। ব্যক্তি পর্যায়ের দুর্নীতিগ্রস্তদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার মতো উদ্যোগ চলমান থাকায় দেশ থেকে অর্থ পাচারের সম্ভাব্য সকল পথ বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে দেশপ্রেমিক প্রবাসীরা আগের চেয়ে বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠানো শুরু করেছেন। এতে গত আগস্ট মাসে সরকারের পতনের পর থেকেই রেমিট্যান্সপ্রবাহে উল্লম্ফন দেখা গেছে।
সরকার পতনের পর প্রথম মাস সেপ্টেম্বরে গত বছরের চেয়ে ৮০ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। এক মাসে রেমিট্যান্সপ্রবাহের এমন প্রবৃদ্ধি দেশের ইতিহাসে প্রথম। মাসটিতে প্রবাসীরা দেশে প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ দুই দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন। করোনা মহামারির সময়ে ২০২১ সালেও দেশে ফেরত আসার প্রবণতা বৃদ্ধির সময়েও এত পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে আসেনি। সর্বশেষ গত অক্টোবর মাসেও রেমিট্যান্সপ্রবাহে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মাসের ২৬ দিনেই পৌনে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ এসেছে দেশে।
নতুন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ ও বাংলাদেশের বড় শ্রম বাজার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বৈঠক করেছেন ঢাকায় এসে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এটি বাংলাদেশে কোনো সরকারপ্রধানের প্রথম সফর ছিল। সেই সফরে বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ফের খুলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি আসে। এতে করে দেশটিতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ফের বাড়তে শুরু করবে। প্রথম ধাপেই ১৮ হাজার শ্রমিক নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। ফলে প্রবাসী আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানও বাড়বে, যা অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করবে।
সহযোগিতা করতে চায় বিশ্ব
ফ্যাসিস্ট ও ভারতের পদলেহী আওয়ামী সরকারের শোচনীয় উৎখাতের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে ঘোষণা দিয়েছে পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশ। বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণে কাজ করতে সহযোগী হিসেবে থাকতে চায় বলে ঘোষণা দিয়েছে। এজন্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোও আর্থিক সহযোগিতা করতে চয়। জাপান, বিশ্বব্যাংক ও এডিবি ইতোমধ্যে সোয়া ৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তা করতে ঘোষণা দিয়েছে। আগামী ডিসেম্বর মাসেই এ অর্থ বাংলাদেশের রিজার্ভে যোগ হবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও বিভিন্ন পরিষেবা উন্নয়নে বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। যুক্তরাষ্ট্রও আর্থিক উন্নয়ন ও সংস্কারে সহযোগিতা করতে চেয়েছে। বাংলাদেশের প্রয়োজনে আরো তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ। ইতোমধ্যে সংস্থাটির প্রধান এক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বাংলাদেশিদের জন্য সৌদি আরবের শ্রমবাজার আরো সহজ প্রবেশ নিয়ে আলোচনা করেছে দেশটি। এবার হজ খরচও কমে আসবে বাংলাদেশিদের জন্য। উড়োজাহাজের পাশাপাশি সমুদ্রপথে হাজযাত্রী পরিবহনের সুবিধা চালু হওয়ায় হজ করতে যাওয়াদের খরচ কমবে অন্তত ৩০ শতাংশের মতো। এছাড়া সিন্ডিকেটমুক্ত করায় প্রতি জনের হজ খরচ ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা কম লাগবে বলে ধর্মমন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বাংলাদেশের মানুষের পাশে থাকার এমন অভাবনীয় ঘোষণা অতীতে কখনো আসেনি। সর্বশেষ জাতিসংঘের সম্মেলনেও তার প্রমাণ মেলে। পুরো বিশ্বের নেতৃত্ব তাকিয়ে ছিল বাংলাদেশের সরকার প্রধানের বক্তব্য শুনতে। গত আসরে পুরো বিশ্বের মধ্যমণি হয়েছিল বাংলাদেশ। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হয়েও বাংলাদেশের নেতৃত্বের কথা শুনেছে বিশ্বের পরাশক্তিধর দেশগুলো।
রিজার্ভে হাত না দিয়েই বিদেশি ঋণ পরিশোধ
করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ উঠেছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। সেই রিজার্ভ থেকে নানা নামে খরচ ও অর্থ পাচার করায় ডলার সংকটে পড়ে বাংলাদেশ। শুধু শেখ হাসিনা তার ঘনিষ্ঠরাই ১৭ বিলিয়ন ডলার দেশ থেকে পাচার করে নিয়ে গেছেন বিদেশে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তা বলেছেন। অর্থের হিসাবে এ অঙ্ক দুই লাখ কোটি টাকার বেশি। এত পরিমাণ অর্থ কয়েকটি গোষ্ঠী পাচার করায় শুধু বাংলাদেশের রিজার্ভই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। গত কয়েক বছর ধরে মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে গেছে দেশের মানুষ। আমদানি-রফতানিতে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
বাধ্য হয়ে চার বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহযোগিতা নিতে হয়েছে আইএমএফের কাছ থেকে। সেই পরিস্থিতিতে নাটকীয় পরিবর্তন আসে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দুই মাসেরও কম সময়ে বাংলাদেশের রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পৌনে দুই বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ পরিশোধ করেছে রিজার্ভে হাত না দিয়ে। শুধু বিদেশি ঋণ নয়, এর বাইরে আরো সোয়া এক বিলিয়ন ডলারের অর্থ পরিশোধ করেছে বিভিন্ন প্রল্পেরও ঋণ ও সুদ বাবদ।
এত সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশ রিজার্ভে হাত না দিয়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে। ফলে অনিশ্চয়তা কাটতে শুরু করেছে তেল, গ্যাস, সারসহ দরকারি পণ্য আমদানিতে। ডিসেম্বরের মধ্যে সব দায় মেটানোর পর আরো ইতিবাচক ধারায় ফিরবে অর্থনীতি। ফ্যাসিস্ট সরকার আড়াই বিলিয়ন বা আড়াই হাজার কোটি ডলার বকেয়া রেখে গিয়েছিল বিদ্যুৎসহ কয়েকটি পণ্য আমদানিতে। সেই দায় পরিশোধ করে ৭০০ মিলিয়ন বা ৭০ কোটি ডলারে নামিয়ে এনেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এভাবে রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায়ও বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে শুরু করেছে।
রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় নাটকীয় মোড় ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের চলতি হিসাব দুই বছর পর ইতিবাচক হয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পাদনে চলতি হিসাব একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে দেখা হয়। এ হিসাবে অর্থ থাকা মানে কোনো দেশ বিদেশি দায় পরিশোধে সক্ষম। দেশটির আমদানি প্রক্রিয়া সহজ হয়। বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা করতে নিরাপদ মনে করে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান সহনশীল থাকে। কিন্তু গত দুই বছর ধরে ঘাটতিতে থাকায় ডলারের বিপরীতে ক্রমাগত মান হারিয়েছিল টাকা।
সেই হিসাবে গত মাসে ইতিবাচক হয়েছে বাংলাদেশ। এর ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান আর কমেনি। এতে দীর্ঘদিন ধরে অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ীরাও এখন বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে সাহস ফিরে পেয়েছেন। লুটপাট করে যাওয়া বিদ্যুৎ খাত সামাল দিতে যে অনিশ্চতা দেখা গিয়েছিল, তা কেটে গেছে। এখন বিদ্যুতের জন্য তেল ও গ্যাস আমদানিতে আর কোনো সমস্যা থাকবে না বলে জানিয়েছেন গভর্নর। সবশেষ বাংলাদেশের রিজার্ভ আইএমএফের হিসাবে ২০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস হিসাবে তা ২৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। এ পরিমাণ রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করতে পারবে বাংলাদেশ।
আওয়ামী লীগ নামের স্বৈরশাসকের পতনের পর বিদ্যুৎ খাতের বকেয়া পাওনা নিয়ে চিন্তার ভাজ পড়েছিল সরকারের কপালে। একদিকে লুটপাট সামাল দেওয়া ও অন্যদিকে বকেয়া পরিশোধ করে নিয়মিত তেল আমদানি করা। আগের সরকারের কমিশন বাণিজ্যর সুবিধাভোগীরাও হঠাৎ করে পণ্য সরবরাহ বন্ধ করার হুমকি ছিল। কিন্তু দক্ষতার সঙ্গে ব্যবস্থাপনা করায় জ্বালানি উপদেষ্টা সেই সমস্যা সামাল দিতে পেরেছেন। ফলে বিদ্যুৎ নিয়ে সমস্যাও কেটে গেছে।
নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে ফ্যাসিস্ট মিডিয়ার মিথ্যা তথ্য
সরকার পতনের পড়ে চাঁদাবাজি বন্ধ হলেও আগের সিন্ডিকেট ভাঙতে সময় লেগেছে অন্তবর্তীকালীন সরকারের। সিন্ডিকেট ভাঙতে সাধারণ ছাত্ররা বিভিন্ন আড়তে আড়তে গিয়ে তা তদারকিও করেছে। এতে নিত্যপণ্যের দাম হাতের নাগালে চলে এসেছে। সবজি ও মৌসুমি শাকের দাম আগের বছরের তুলনায় গত দুই মাসে কমেছে কেজি প্রতি অন্তত ২০ টাকা করে।
নোয়াখালী, ফেনিসহ ১১ জেলা ও উত্তরের তিন জেলায় বন্যা আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ নিয়ে ডিমের দাম বাড়িয়েছে আওয়ামী সরকারের সময়ে তৈরি হওয়া ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। ডিমের জোগান বাড়ানো ও অভিযান পরিচালনা করায় ডিমের দাম এখন নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। কিন্তু মুরগি, মাছ, সবজির বিভিন্ন দাম নিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হিসেবে পরিচিত কিছু ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও পত্রিকা মিথ্যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। যেকোনো সবজি বাজারে ওঠার প্রথম দিকে একটু বাড়তি দাম থাকে। সরবরাহ বাড়লে অর্থাৎ মৌসুম শুরু হলে তার দাম স্বাভাবিক হয়।
গত কয়েক বছর ধরেই পেঁপে ৬০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে তা প্রতি কেজি ২৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পটোল ৭০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা ও আলু ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে এ দরেই সবজিগুলো বিক্রি হয়েছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ৮০ টাকার নিচে এক কেজি সবজি কেনার সুযোগ ছিল না।
সেখানে এখন ২৫ থেকে ৩০ টাকা দরে সবজি মিলছে অনেক। এক পিস লাউ যেখানে ৮০ থেকে ১০০ টাকায় কিনতে হতো, এখন তা ৪০-৬০ টাকায় মিলছে। বেগুন পাওয়া যাচ্ছে ৪০ টাকা কেজিতে, ঢ্যাঁড়শ ৪০ টাকা কেজি, এক ডজন লেবু পাওয়া যাচ্ছে ৩০ টাকায়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন বাজারে পণ্যের দর দৈনিক ভিত্তিতে প্রকাশ করে।
টিসিবির দেয়া তথ্যানুযায়ী, গত অক্টোবর মাসে এক লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১৬৫ টাকা, গত ২০২৩ সালের এ সময়ে যা ছিল ১৬৮ টাকা প্রতি লিটার। খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি, গত বছরের এ সময়ে ছিল ৪৫ টাকা কেজি। মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১০৫ টাকায়, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ছিল কেজি প্রতি ১১০ টাকা। আর ৯০ টাকা দরের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে এ বছরে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজিতে। রসুন আগের দর ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, আর ২০২৩ সালের অক্টেবরে ৪২০ টাকা প্রতি কেজি শুকনা মরিচ এবছর বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২৫০ টাকা কেজিতে, ২৮০ টাকা কেজির আদা এখন বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা কেজি, ২০০ টাকা কেজি তেজপাতা বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়, লবঙ্গের দাম ২০ টাকা কমে কেজিতে বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ টাকা।
মাছের মধ্যে সাড়ে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হওয়া রুই মাছের কেজি এখন ২৫০ টাকা, গরুর গোশত যেখানে ৭৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা কেজিতে। আর ১৯০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগি ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝখানে তা আরো কমে গেছিল। কিন্তু ডিমের দাম বৃদ্ধির প্রভাব মুরগির দরেও পড়েছিল। কিন্তু এসব না লিখে, বাজারে না গিয়ে কয়েকটি পত্রিকা বানোয়াট খবর দিয়েছে সাধারণ মানুষকে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কাঁচামরিচ দেড় হাজার টাকা কেজি হয়েছিল, এখন তা সর্বোচ্চ ৪০০ টাকায় উঠেছিল বন্যার কারণে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় তা এখন পুনরায় ১৬০ টাকা কেজিতে নেমেছে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রায় তিন মাস বয়সী সরকার দক্ষ পরিচালনার মাধ্যমে অর্থনীতিকে টেনে তুলতে পারছে। গত দেড় যুগ ধরে অ্যবস্থাপনা, লুটপাটে ক্ষত হওয়া অর্থনীতিকে সামাল দেয়া সহজ কাজ নয়। এর সঙ্গে আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা এখনো অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আছেন। তারাও চাইবে না সরকার সফল হোক। এজন্য সরকারকে নীতিনির্ধারণের পাশাপাশি গণমাধ্যম তার ভূমিকা পালন করছে কিনা, তাও নজরদারিতে আনতে হবে। এডিপির তিন প্রকল্প থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পেরেছে সরকার। মেট্রোরেল মাত্র ২১ কোটি টাকায় মেরামত করেছে। যেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের শেখ হাসিনা বলেছিল, ৪০০ কোটি টাকা লাগবে। সবখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনায় খরচও কমে যাচ্ছে। এসবের প্রচারও করা প্রয়োজন, সর্বোপরি গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার এ উদ্যোগে দেশপ্রেমিকদের নিয়ে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করতে পারে। এ কমিটি মন্ত্রণালয়ের কাজ তদারকি ও বাস্তবায়নের বাধাসমূহ দূর করতে সরকারকে সহযোগিতা করবে।