ফ্যাসিস্ট হাসিনার দুঃশাসনে ফোকলা অর্থনীতি

আসছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট

হারুন ইবনে শাহাদাত
২৯ মে ২০২৫ ১০:২৭

॥ হারুন ইবনে শাহাদাত ॥
দীর্ঘ দেড় দশকের ফ্যাসিস্ট হাসিনার দুঃশাসনে ফোকলা অর্থনীতি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট প্রস্তাব আগামী ২ জুন পেশ করা হবে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। সূত্রটি আরও জানিয়েছে, নতুন অর্থবছরের জন্য অর্থ উপদেষ্টা ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিতে পারেন। মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, মানুষের জীবনমান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় বাড়তি নজর দিয়ে এবারের বাজেটের অর্থ ব্যয়ের ছক করা হচ্ছে। এ বাজেটে নির্বাচনের জন্য ২ হাজার ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব আগামী ২ জুন বিকেল ৩টায় জাতির সামনে উপস্থাপন করবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এবারের এ বাজেট শুধু চ্যালেঞ্জিং নয়, অনেক দিক থেকে অভিনব বৈশিষ্ট্যের। এ প্রতিবেদনে সংক্ষেপে বাজেট প্রস্তাবে কী কী বিষয় থাকবে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, তা তুলে ধরা হলো-
১. বাজেট স্পিচ হবে সংক্ষিপ্ত
রাজনৈতিক সরকার না হওয়া এবং জাতীয় সংসদ না থাকায় অর্থ উপদেষ্টা এবার টেলিভিশনের মাধ্যমে নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন। অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইটেও বাজেট ঘোষণা সরাসরি সম্প্রচার করার ব্যবস্থা থাকবে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশ টেলিভিশনে অর্থ উপদেষ্টার বাজেট ঘোষণা সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। অর্থ উপদেষ্টা জানিয়েছেন, ‘এবার বাজেট স্পিচ ৫০ থেকে ৬০ পাতার মধ্যেই হবে। এবারের বাজেটটা একটু বাস্তবমুখী করব।’
২. নির্বাচনী বাজেট, তবে ভিন্ন অর্থে
নির্বাচনী বাজেট বলতে সাধারণত রাজনৈতিক দলগুলোর ভোট টানার জন্য বাহুল্য ব্যয়কে বোঝায়। কিন্তু এবারের ঘোষিত বাজেটের অর্থবর্ষেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। নির্বাচন উপলক্ষে নতুন অর্থবছরের বাজেটে ২ হাজার ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। তবে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য আগামী অর্থবছরে ৫ হাজার ৯২২ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছিল নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের চাহিদার অর্ধেকের কম বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অনুকূলে মোট ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এর মধ্যে বিভিন্ন নির্বাচনের জন্য বরাদ্দ প্রায় ২০০ কোটি টাকা। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মূল বাজেটে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। তবে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের কারণে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে ৪ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা করা হয়।
এর আগে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। আর সর্বশেষ গত বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকার ব্যয় ধরা হয়। মাঝে ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় নির্বাচন না থাকায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয় খাতে ব্যয় হয় ৮৭৮ কোটি টাকা।
৩. স্বচ্ছতা বাড়াতে প্রকৃত করের ওপর সারচার্জ
কর ন্যায্যতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার সারচার্জের বিধান সংশোধনের পরিকল্পনা করছে, যেখানে বর্ধিত করের বদলে প্রকৃত করের ওপর সারচার্জ আরোপ করা হবে। এ পদক্ষেপের লক্ষ্য কর রিটার্নে আরও স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকৃত সম্পদ প্রদর্শনে করদাতাদের উৎসাহিত করা। বর্তমানে ৪ কোটি টাকার ওপর যেকোনো সম্পদ থাকলে তার ওপর বিভিন্ন স্তরে প্রদেয় করের ওপর ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত সারচার্জ (করের ওপর কর) দিতে হয়। এ পদক্ষেপ মূলত উচ্চ-আয়ের করদাতাদের লক্ষ করে নেওয়া হয়েছে। ব্যক্তি খাতের আমদানিকারকদের এখন আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) দিতে হয়। বছর শেষে যদি কেটে নেওয়া এআইটির পরিমাণ করদাতার প্রকৃত প্রদেয় করের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে এআইটি বা বেশি করের ওপর সারচার্জ আদায় করা হয়। ফলে একদিকে করদাতাকে প্রকৃত করের চেয়ে বেশি কর দিতে হচ্ছে; অন্যদিকে ওই বর্ধিত করের ওপরই সারচার্জ হিসাব করায় বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে।
ধরা যাক, আমদানি পর্যায়ে একজন আমদানিকারকের কাছ থেকে এআইটি হিসেবে ১০০ টাকা কেটে নেওয়া হলো এবং বছর শেষে তার প্রকৃত কর হলো ৫০ টাকা। ওই ব্যক্তির যদি ৪ কোটি টাকার ওপর সম্পদ থাকে (যেকোনো রূপে), তাহলে তিনি প্রদেয় করের ওপর সারচার্জ দেবেন সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত। বর্তমান ব্যবস্থায় ১০০ টাকার ওপর হিসাব করায় এ করহার ১০০ টাকার ৩৫ শতাংশ বা ৩৫ টাকা হয়ে যায়।
কিন্তু যদি প্রকৃত কর হিসাব করা হতো, তাহলে ওই আমদানিকারক সারচার্জ দিতেন ৫০ টাকা করের ওপর। যেমন ৩৫ শতাংশ সারচার্জ হলে প্রকৃত করের ওপর সারচার্জ প্রদেয় হতো ১৭.৫ টাকাÑ অর্থাৎ কার্যত করের বোঝা অর্ধেক কমে যাবে। প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় এনবিআর সেই পথেই হাঁটতে যাচ্ছে। এ বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের অভিযোগ ছিল। কারণ এ ব্যবস্থা কার্যত তাদের করের বোঝা বাড়িয়ে দেয়।
অনেকেই বলেছেন, এ ব্যবস্থার কারণে তারা প্রকৃত সম্পদের হিসাব দেখাতে নিরুৎসাহিত হন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ‘বর্তমানে অগ্রিম করসহ মোট কেটে নেওয়া কর প্রকৃত করের চেয়ে বেশি হলেও ওই টাকার ওপরই সারচার্জ দিতে হয়।’
‘কর ন্যায্যতার বিবেচনায় এবং করদাতাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিগগিরই শুধু প্রকৃত করের ওপরই সারচার্জ আরোপ করা হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, এ নীতিগত পরিবর্তনের ফলে করদাতাদের সম্পদ লুকানোর প্রবণতা কমবে এবং প্রকৃত আয় ও সম্পদ দেখাতে উৎসাহিত হবেন বলে আশা করা হচ্ছে। করদাতা ও বিশেষজ্ঞরা এ উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে একইসঙ্গে তারা অগ্রিম কর্তিত করবছর শেষে প্রকৃত করের সঙ্গে সমন্বয় করার বা রিফান্ড দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করাও যৌক্তিক বলে মত দেন।
৪. কালো টাকা সাদা করার সুযোগ
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অন্তর্বর্তী সরকার বন্ধ করলেও আগামী বাজেটে এর কোনো সুযোগ থাকবে কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আগামী জুনে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে আর কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে আমরা এ বিষয়টি নিয়ে একটু চিন্তা করছি। অনেকের কাছে অপ্রদর্শিত আয়ের টাকা-পয়সা রয়েছে, যা প্রদর্শন করার সুযোগ পাচ্ছে না। মানুষের হাতে থাকা অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থ যদি একদম প্রদর্শন না করে, সেটি অর্থনীতিতে যুক্ত হবে না। এজন্য সরকারিভাবে জমি ও ফ্ল্যাটের মূল্য বাড়িয়ে সেক্ষেত্রে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হলে সরকারের রাজস্ব কিছুটা বাড়বে। রিয়েল এস্টেট (আবাসন) খাতে রাজমিস্ত্রি থেকে শুরু করে অনেক শ্রমিক জড়িত। এ খাতে বড় ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যও হচ্ছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থ দিয়ে জমি বা ফ্ল্যাট কিনতে পারবেন। আমরা যদি অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার এ সুযোগটাও বন্ধ করে দিই, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আর কোথাও যেতে পারবে না। এতে অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়তে পারে। তবে আগামী বাজেটে ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হবে না। চেষ্টা করব যতটুকু সম্ভব দেওয়া যায়। অনেকে তার আর্থিক স্টেটমেন্টে তথ্য দেয়নি যে, তার কত টাকা আছে। তাদের বলে দেওয়া হবে তোমার কত টাকা আছে, সেটির ওপর নির্ধারিত কর এবং সারচার্জ দিয়ে বৈধ করতে পারবে। তবে এটি যে তার বৈধ আয় কিন্তু প্রদর্শন করা হয়নি, এ বৈধ আয়ের প্রমাণ দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ এক কোটি টাকা লুকিয়ে রেখেছে, কখনো দেখায়নি। এই এক কোটি টাকার প্রমাণ দেখাবে যে এটি তার বৈধ আয়। এরপর ওই টাকার ওপর কর ও সারচার্জ দিয়ে বৈধ করতে পারবে। তবে অন্যান্য খাতে ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার মতো ঢালাওভাবে সুযোগ আমরা দেব না।
৫. মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানা ও বাণিজ্যের প্রসার
২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকারের আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা কেমন হবে তার পূর্বাভাস দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। বাজেট এবার ‘খুবই বাস্তবমুখী’ হবে দাবি করে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, তার লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি কমানো, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো। বাজেট নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘বাজেটে আমাদের উদ্দেশ্য থাকবে একটি সমতাভিত্তিক এবং কল্যাণমুখী বাজেট যেন আমরা দিতে পারি। বাজেট হবে মধ্যমেয়াদি, কারণ দীর্ঘমেয়াদি বাজেট আমাদের ম্যান্ডেট না। আমি কথাবার্তা কমই বলি, লম্বা বক্তৃতা আমি পছন্দ করি না। এবার বাজেট স্পিচ ৫০ থেকে ৬০ পাতার মধ্যেই হবে। এবারের বাজেটটা একটু বাস্তবমুখী করব।’
৬. করমুক্ত আয়সীমা বাড়াবে
আগামী অর্থবছরে বাড়তে পারে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা। বর্তমানে বার্ষিক আয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত আয়সীমা রয়েছে। এ সীমা আরও ২৫ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে। আসন্ন বাজেটে একজন করদাতার বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রস্তাব করা হতে পারে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ করদাতাদের স্বস্তি দিতে এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, কর কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এমনটা জানা গেছে। এছাড়া করহার পুনর্বিন্যাস করা হতে পারে বলে জানা গেছে। করমুক্ত আয়সীমার পরের এক লাখ টাকার ওপর বর্তমানে প্রচলিত ৫ শতাংশ কর আরোপ হয়। এ স্তরের পরিধি বাড়ানো হতে পারে। তবে করের হার অপরিবর্তিত রাখা হতে পারে। বর্তমানে করহার হতে পারে ৫, ১০, ১৫, ২০ ও ২৫ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, এক বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে নিম্নআয়ের করদাতারা চাপে আছেন। তাঁদের কিছুটা স্বস্তি দিতে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর আলোচনা চলছে। গত দুই অর্থবছরে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করা হয়। কিন্তু পরের দুই বছরেই মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। কিন্তু করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। এক বছর ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি ছিল। টানা ১০ মাস (২০২৪ সালে মার্চ থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত) খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের বেশি। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে ওঠে, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসের পর থেকে এ বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ গত এক বছরে গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এবারের বাজেট করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো, সারা দেশে করজালের বিস্তৃতির ব্যাপারে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘‘ক্যাশলেস সোসাইটি (কাগুজে নোটবিহীন লেনদেন) এবং ফেসলেস ট্যাক্স সিস্টেম প্রয়োজন। আমি মনে করি ট্যাক্স অফিসারদের মুখোমুখি হওয়া কারও জন্য মোটেও বাঞ্ছনীয় না। সামনাসামনি হলে টেবিলের নিচ দিয়ে লেনদেন হয়। অটোমেশন নিশ্চিত করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তির ওপরে আরও গুরুত্ব দিতে হবে।’’
৭. এডিপিতে বরাদ্দ
এবার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ব্যাপক পরিমাণে কমানো হচ্ছে। এবার কমছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এডিপির আকার হচ্ছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। নতুন খসড়া এডিপিতে বরাদ্দের দিক থেকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতকে। এ খাতে মোট ৫৮ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে শিক্ষা খাতে। এ খাতে আগামী অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দের পরিমাণ ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা।
অন্য খাতগুলোর মধ্যে গৃহায়ন খাতে ২২ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা; স্বাস্থ্যে ১৮ হাজার ১৪৮ কোটি: স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ১৬ হাজার ৪৭২ কোটি; কৃষিতে ১০ হাজার ৭৯৫ কোটি; পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ খাতে ১০ হাজার ৬৪১ কোটি; শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবায় ৫ হাজার ৩৮ কোটি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে ৩ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ যাচ্ছে। প্রায় সব খাতেই চলতি এডিপিতে বরাদ্দ কমেছে।
৮. শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বাড়বে না
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ বাড়ল না। আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রকল্পে টাকা বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের মূল এডিপি থেকে আগামী এডিপিতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। আর স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমছে আড়াই হাজার কোটি টাকা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের খসড়া এডিপি অনুসারে, শিক্ষা খাতে ৯১টি প্রকল্পে আগামী অর্থবছরের বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা, যা চলতি এডিপির বরাদ্দ থেকে ২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা কম। চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ৩১ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে শিক্ষা খাতের ৩৫টি প্রকল্পে আগামী অর্থবছরের বরাদ্দ থাকছে ১৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। চলতি এডিপিতে বরাদ্দ ২০ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। উন্নয়ন বাজেটে এ দুই খাত প্রত্যাশিত মনোযোগ পাচ্ছে না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত অনেকটা অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। আগামী বাজেটেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার ইঙ্গিত নেই।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, পৃথিবীর যে ১০টি দেশ অর্থনীতির আকারের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়, বাংলাদেশ তার একটি। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে একজন বাংলাদেশির বছরে ৮৮ ডলার খরচ করা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে মাথাপিছু খরচ হয় ৫৮ ডলার, যার বড় অংশই নাগরিকেরা নিজেরা সংস্থান করেন।
৯. ভূমি নিবন্ধনে কর কমছে
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ভূমি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে আসন্ন বাজেটে কিছুটা ছাড় দেওয়া হচ্ছে। কাঠার পরিবর্তে শতাংশে নিবন্ধন ফি ও কর নির্ধারণ করা হবে। ভূমি নিবন্ধনে অগ্রিম কর কিছুটা কমানো হতে পারে। এর ফলে ভূমি বা সম্পত্তি নিবন্ধনে কর কমবে না বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। গত অর্থবছর ভূমি নিবন্ধন থেকে এনবিআর প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার কর পেয়েছে।
১০. পুঁজিবাজারে বিশেষ সুবিধা
পুঁজিবাজারের ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেনের ওপর উৎসে কর কমানো হতে পারে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। বাজেট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ব্রোকারেজ হাউসের মালিকরা দীর্ঘদিন ধরে এ কর কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা খুব বেশি না হলেও কিছুটা লাভবান হবেন। এছাড়া নতুন নতুন কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে শর্ত যেমন সহজ করা হবে, তেমনি কর ছাড়ও দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।
১১. এসি-ফ্রিজ-মোবাইল ফোনে ভ্যাট বাড়ছে
মাত্র ছয় মাস আগে ফ্রিজ ও এয়ার কন্ডিশনার প্রস্তুতকারকদের ওপর কর্পোরেট কর দ্বিগুণ করার পর, এবার তাদের পণ্যে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে সরকার। ফলে দেশীয় উৎপাদনকারীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিতে পারে। বর্তমানে ফ্রিজ ও এয়ার কন্ডিশনারের উৎপাদন পর্যায়ে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপিত রয়েছে। তবে এনবিআর আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছর তা ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা করছে। একইভাবে, মোবাইল ফোন তৈরিতে স্থানীয় মূল্য সংযোজনের ওপর নির্ভর করে ৫ ও সাড়ে ৭ শতাংশ হারে যে ভ্যাট আরোপিত রয়েছে, তা বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ ও ১০ শতাংশ করারও প্রস্তাব করা হচ্ছে। এছাড়া ব্যাটারি তৈরির ওপরও কর্পোরেট কর বিদ্যমান সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হতে পারে। তবে টক টাইমে বাড়ছে না ভ্যাট ও কর।
১২. কৃষিভিত্তিক খাতে কর অব্যাহতি প্রত্যাহার
কর অব্যাহতি প্রথা তুলে নেওয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসন্ন বাজেটে বহুল আলোচিত মৎস্য ও পোলট্রি খাতের বিদ্যমান আয়কর সুবিধা বাতিল করার ঘোষণা আসতে পারে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে এসব খাত থেকে আয় করলে তার ওপর ৩ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয়। তবে আগামী বাজেটে এসব খাতের আয়ের ওপর নিয়মিত হারে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হতে পারে। যার আওতায় আসবে হাঁস-মুরগি ও চিংড়ি হ্যাচারির আয়, পোলট্রির পেলেটেড ফিড উৎপাদন, গবাদিপশু, চিংড়ি ও মাছের পেলেটেড ফিড উৎপাদন, বীজ উৎপাদন ও বিপণন, গবাদিপশুর খামার, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের খামার, ব্যাঙ উৎপাদন খামার, হর্টিকালচার, তুঁত চাষ, মৌমাছি চাষ প্রকল্প, রেশম গুটিপোকার খামার, মাশরুম খামার এবং ফ্লোরিকালচারের আয়। বর্তমানে এসব খাত থেকে বার্ষিক আয় হলে প্রথম ১০ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী ১০ লাখ টাকার ওপর ১০ শতাংশ এবং অবশিষ্ট আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। অথচ এর বিপরীতে ব্যক্তি করদাতাদের সর্বোচ্চ করহার বর্তমানে ৩০ শতাংশ এবং অধিকাংশ কোম্পানিকে ২৭.৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। মূলত দেশের মৎস্য, পোলট্রি ও গবাদিপশু খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে এসব খাতে বাড়তি সুবিধা ছিল।
রাজস্ব বাড়ানো ও ব্যয় কমানোর চ্যালেঞ্জ
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আগামী অর্থবছরে পাঁচ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হতে পারে, যা চলতি বাজেটে ছিল চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী কর আদায় না হওয়ায় চলতি অর্থবছরে রাজস্বের লক্ষ্য কমিয়ে চার লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রাজস্ব আদায় হয়েছে দুই লাখ ২১ হাজার ৮১৭ টাকা, কিন্তু আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৮ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ ২১ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এবার বাজেটের আকার ছোট হোক, সেটা আমরা বলেছি। কারণ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়ে বাজেট বড় করা রাজনৈতিক সরকারের কাজ। এ সরকারের তো সেই ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে সরকার চাইলেই ঘাটতি কমিয়ে মূল্যস্ফীতির দিকে নজর দিতে পারে। পাশাপাশি যেদিকে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন সেটা হলো, সম্প্রতি সিপিডি তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে, ২০২৩ সালে দুই লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে। অর্থাৎ এ রাজস্ব সরকারের পাওয়ার কথা ছিল। সেটা কীভাবে পাওয়া যাবে সেই পথ দেখতে হবে। সব পাওয়া না গেলেও যদি অর্ধেকও পাওয়া যায় অর্থাৎ এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা সেটাও তো বাজেটের বড় একটা অংশ। এদিকে অবশ্যই অর্থ উপদেষ্টাকে নজর দিতে হবে।’ চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২০২৫) মূল বাজেট বরাদ্দ ছিল সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা, যা সংশোধন করে সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকায় সীমিত রাখা হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল বাজেট বরাদ্দ ছিল সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা পরবর্তীকালে সাত লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছিল।