জরুরি সংস্কার শেষে এপ্রিলে নির্বাচন
৮ মে ২০২৫ ১৩:৪১
॥ ফারাহ মাসুম ॥
জরুরি সংস্কার শেষে মার্চ বা এপ্রিলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি এক প্রকার নিশ্চিত হয়ে গেছে। দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কিছু মৌলিক সংস্কারে সাড়া দিতে পারে বিএনপি। আগামী রোজার আগে নির্বাচনের দাবি জানালেও ফ্যাসিবাদের গণহত্যার বিচার ও মৌলিক সংস্কারে গুরুত্ব দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। অন্যদিকে ছাত্রদের দল এনসিপির ফোকাস রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারে। তারা মনে করে, ফ্যাসিবাদের পুনরাবির্ভাব ঠেকানোর কাঠামোগত ব্যবস্থা, গণহত্যার বিচার ও সংস্কার ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্র অনুসারে, এটা প্রায় নিশ্চিত যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী তার মেয়াদ শেষ করবে। প্রধান উপদেষ্টা আগামী বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সে প্রতিশ্রুতি অনুসারে মার্চ-এপ্রিল নাগাদ পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। নির্বাচন কমিশন আগামী জুলাই বা আগস্টে নির্বাচনের সূচি ঘোষণা করতে পারে। তবে তার আগে প্রধান উপদেষ্টা কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করতে চান। এ সংস্কার ও গণহত্যার বিচারের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ উন্নয়ন সহযোগী দেশসমূহের সম্মতি রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার নিজেরা যেসব সংস্কার বাস্তবায়ন করবে, তার বাইরে নির্বাচিত সরকারের বাস্তবায়নের জন্য কিছু সংস্কারের রূপরেখা দিয়ে যেতে পারে। এটির কেবল ব্যতিক্রম হতে পারে, যদি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার জন্য ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী যেভাবে সহিংস হয়ে উঠছে, সেটি অব্যাহত থেকে অচলাবস্থা তৈরি হয় আর এর সাথে দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে যদি বিএনপি বা ফ্যাসিবাদবিরোধী কোনো দল অস্থিরতা তৈরির প্রকল্পে যোগ দেয়।
জানা গেছে, সংস্কারের বিষয়ে সবচেয়ে অনমনীয় বিএনপি মনে করছে দ্রুত নির্বাচন নিশ্চিত করতে চাইলে কিছু সংস্কারে সম্মত হতে হবে। এক্ষেত্রে দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা এবং উচ্চকক্ষের নির্বাচন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে সম্পন্ন করার বিষয়ে ছাড় দেয়ার আভাস দিয়েছে বিএনপি। মূল বক্তব্যে এ বিষয়ে নীতিগত একমত হলেও সংসদে আলোচনা করে সেটি ঠিক করার কথা বলা হয়েছিল। দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনে বিধিনিষেধ একই ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান পদে না থাকা এবং ৭০নং অনুচ্ছেদের বিষয়ে ছাড় দিতে রাজি নয় বিএনপি। সংসদ বা রাষ্ট্রপতির মেয়াদ ৪ বছর করার বিষয়েও বিএনপি একমত নয়। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার পক্ষে বিএনপি। বিএনপি নাগরিকতন্ত্র বাংলাদেশি পরিচয় ৭খ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করার বিষয়ে একমত। নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যা ৪০০ করার বিষয়টিও বিএনপি অনুমোদন করে, তবে নারী আসন ১০০-তে উন্নীত করে বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচন চায়।
জামায়াত আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছে। মূল সংস্কার প্রস্তাবে শুধু উচ্চকক্ষে আনুপাতিক নির্বাচনের কথা বলা আছে। জামায়াত স্থানীয় সরকার নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করতে চায়। বর্তমান স্থানীয় সরকার নির্বাচনও অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে চায় জামায়াত। রাষ্ট্রীয় মূলনীতির প্রশ্নে জামায়াত পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায়। সংসদ ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ ৫ বছর রাখতে চায় জামায়াত। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের বিষয়ে জামায়াত সংস্কার প্রস্তাবের সাথে একমত নয়।
জামায়াত মৌলিক সংস্কার শেষ করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মতামত তুলে ধরে। তবে লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাথে শীর্ষনেতৃবৃন্দের সাক্ষাতের পর দলের অবস্থান বেশ কিছুটা নমনীয়। জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান রমজানের আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মত দিয়েছেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিলে নির্বাচন প্রশ্নে দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কিছুটা মতভিন্নতা দেখা দেয়। বিএনপি প্রথম থেকেই যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে সংস্কার কাজ এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে বলে আসছে। সেখানে জামায়াত গুরুত্ব দিয়ে আসছিল সংস্কার ও ফ্যাসিবাদের বিচারে।
জামায়াতপ্রধান ডা. শফিকুর রহমান বলেন, তারা চান আগামী নির্বাচন হোক সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে, সেটা তারা মার্কিন প্রতিনিধিদলকেও বলেছেন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের বিচার দেখতে চাওয়ার প্রত্যাশার কথাও বলেন জামায়াতের আমীর।
এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে ‘মৌলিক সংস্কারের’ রূপরেখা তুলে ধরেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি বলেছে, মৌলিক সংস্কারের মূল লক্ষ্য তিনটিÑ ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহি ও বিকেন্দ্রীকরণ। এনসিপি মনে করে, নির্বাচন যেকোনো সময় অনুষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু তার আগে অবশ্যই মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হবে। এর পাশাপাশি ফ্যাসিবাদী, গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচার দৃশ্যমান পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে।
মৌলিক সংস্কার বলতে এনসিপি বুঝিয়েছে, স্বৈরতান্ত্রিক ঝুঁকি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য শাসনব্যবস্থার গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন। তারা রূপরেখায় বলেছে, গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য শুধু একটি নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়া নয়, অবশ্যই নির্বাচন ক্ষমতার রূপান্তর নিশ্চিত করার মূল উপাদান। কিন্তু ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক অনুশীলন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে কি না, তা কখনোই শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায় না।
এনসিপি নির্বাহী বিভাগকে জবাবদিহির মধ্যে রাখতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন করার পক্ষে। সাংবিধানিক পদগুলোয় নিয়োগ দেবে এ কাউন্সিল। আইনসভা হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। নিম্নকক্ষ বিদ্যমান পদ্ধতিতে এবং উচ্চকক্ষ গঠিত হবে ভোটের আনুপাতিক হারে। সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারবেন। তবে সরকারের স্থিতিশীলতাও যেন ঠিক থাকে, সে ধরনের সাংবিধানিক ব্যবস্থা থাকতে হবে।
নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে রূপরেখায় কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে, কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। একই ব্যক্তি একসঙ্গে দলনেতা, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না। বিরোধীদল ছায়া মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারবে। জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব কমিটি; পরিকল্পনা, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধীদল থেকে দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট দেওয়া যাবে (তবে সরকারের প্রতি অনাস্থা ভোট দেওয়া যাবে না)।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে নিজস্ব প্রশাসনিক সচিবালয় গঠন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন, জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, বিচারপতি নিয়োগে জুডিশিয়াল কমিশন ও মেধাভিত্তিক পরীক্ষা, আপিল বিভাগে বিচারপতি পদোন্নতিতে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং বিভাগীয় শহরগুলোয় হাইকোর্টের স্থায়ী আসন স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এনসিপির রূপরেখায় বলা হয়েছে, ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়স হবে ১৬ বছর এবং সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ন্যূনতম বয়স হবে ২৩।
এছাড়া প্রাদেশিক সরকার গঠন বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও ফরিদপুর ও কুমিল্লাকে নতুন বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে একমত হয়েছে দলটি। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে সরাসরি ভোটে নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে এনসিপি। এছাড়া স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বৈঠকে এনসিপি আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন ও দুদকের ৩২-এর ক ধারা বাতিল এবং সংবিধানের ৩৩-এর ৩ অনুচ্ছেদ ধারা সংস্কার, ছায়া মন্ত্রিসভা ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন, নাগরিক সেবা নিশ্চিতে আইন প্রণয়ন, নাগরিক সেবা ও অভিযোগ কমিশন গঠন করা।
এনসিপি বলেছে, একটি গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়ন জরুরি হয়ে উঠেছে। সংবিধান পুনর্লিখন এবং বিচার বিভাগের কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয় বলেও দলটির নেতারা মন্তব্য করেন। মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়ন এবং আওয়ামী লীগের দৃশ্যমান বিচার প্রক্রিয়া হলে ডিসেম্বর থেকে জুনের আগেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব বলে উল্লেখ করা হয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সার্বিক মূল্যায়ন অনুসারে, কিছু দুর্বলতা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থবহ সংস্কার সম্পন্ন করতে এবং ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য পর্যাপ্ত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমর্থন ধরে রেখেছে। ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে যারা দ্বিতীয় স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন, তাদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে এবং বাংলাদেশ ২.০ গঠনে সহায়তা করার জন্য একসাথে কাজ করার তাগিদ রয়েছে উন্নয়ন সহযোগীদের।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও পলায়ন এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ পরিবর্তন আওয়ামী লীগের দীর্ঘস্থায়ী আধিপত্য থেকে সরে আসার, একক দলের আধিপত্য থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং একটি নতুন যুব-নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হচ্ছে। দেশটি রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস, সম্ভাব্য অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার বিষয়ে উদ্বেগের একটি জটিল দৃশ্যপট অতিক্রম করছে বলে বিভিন্ন উন্নয়ন অংশীদাররা তাদের পর্যবেক্ষণে মত ব্যক্ত করছে।
জাতিসংঘের একটি সাম্প্রতিক তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে ‘যুক্তিসঙ্গত কারণ’ পাওয়া গেছে যে, শেখ হাসিনার সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনী জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালের বিক্ষোভের সময় সহিংস দমন-পীড়নের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, যার ফলে ১,৪০০ জন নিহত হয়েছিল। হাসিনাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং তাকে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। তার পদত্যাগের ফলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়ার পরবর্তী নির্বাচনে প্রত্যাবর্তনের পথ পরিষ্কার হয়ে যায়, যা আপাতত ২০২৫ সালের শেষের দিকে বা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে নির্ধারিত ছিল। বেগম জিয়া আগস্টে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পান এবং দুর্নীতির অভিযোগ থেকে খালাস পান। তিনি লন্ডনে ৪ মাস চিকিৎসার জন্য অবস্থান শেষে লাখো জনতার সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে দেশে ফিরেছেন। বেগম জিয়া এখনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে আস্থা ও ঐক্যের প্রতীক।
অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার আমলের অর্থনৈতিক পরিণতির সাথে লড়াই করছে। হাসিনার শাসনামলে (২০০৯-২০২৩) অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর একটি শ্বেতপত্র তৈরির জন্য গঠিত ১২ সদস্যের একটি কমিটি পদ্ধতিগত দুর্নীতি, নিয়ন্ত্রক ব্যর্থতা এবং ২৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধ আর্থিক বহির্গমনের বিষয়টি উন্মোচন করেছে।
হাসিনার ভারতে উপস্থিতি কূটনৈতিক উত্তেজনাও বাড়িয়ে তুলেছে, যেখানে বাংলাদেশ ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের ওপর দমন-পীড়নের জন্য বিচারিক প্রক্রিয়ার জন্য তাকে প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়েছে। ভারত এ বিষয়ে নীরব।
এর ফলে একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারত এবং বাংলাদেশ এখন অবিশ্বাসের এক ঘূর্ণায়মান চক্রে আটকা পড়েছে, যা মূলত হাসিনাকে প্রত্যর্পণে ভারতের অনীহার কারণে সৃষ্ট। এছাড়া নির্বাসন থেকে হাসিনার মন্তব্যও বাংলাদেশে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে, যেমন ৫ ফেব্রুয়ারি সমর্থকদের উদ্দেশে তার ভাষণ, যা বাংলাদেশে ব্যাপক বিক্ষোভের সূত্রপাত করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারত বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে বলেছে যে, হাসিনার মন্তব্য তার ব্যক্তিগত এবং এটি ভারতের সরকারি অবস্থান প্রতিফলিত করে না।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ার পর্যবেক্ষণ অনুসারে, হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে উল্টে দিয়েছে। একসময়ে তার শক্তিশালী আওয়ামী লীগ এখন বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ থেকে খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক খালাস এবং গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পুনর্জাগরণ দিয়েছে বিএনপিকে। ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনী সংস্কার চূড়ান্ত করার জন্য চাপের মধ্যে রয়েছে, যার মধ্যে একটি বিশ্বাসযোগ্য ভোটার নিবন্ধন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
২০২৪ সালের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া অন্য রাজনৈতিক শক্তির উত্থান, আওয়ামী লীগ-বিএনপির আধিপত্য থেকে সম্ভাব্য বিচ্ছিন্নতার ইঙ্গিত দেয়। বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতার নেতৃত্বে নতুন ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি দেশব্যাপী জনসাধারণের জরিপের ওপর ভিত্তি করে তার এজেন্ডা তৈরি করছে, যা দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের মতো অগ্রাধিকারগুলোকে তুলে ধরে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক ভোটার অংশগ্রহণ করেছেন, যাদের বেশিরভাগই তরুণ, যারা জনসংখ্যার প্রায় ২৮ শতাংশ। এ নতুন দলটি আরও প্রতিযোগিতামূলক এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে চাইলেও রাজনৈতিক রাষ্ট্রযন্ত্র এবং প্রতিষ্ঠিত অভিজাত প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে যাওয়ার ফলে এর স্থিতিস্থাপকতা পরীক্ষার মুখে পড়বে।
আগস্ট বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের ইসলামিক রাজনৈতিক শক্তির প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে। একসময় জামায়াতের ১২ শতাংশ সমর্থন এখন ২০ শতাংশ ছাড়িয়েছে বলে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন। এর সাথে হেফাজতসহ অন্য ইসলামিক শক্তির ঐক্য হলে এটি ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর বাংলাদেশ তার বৈদেশিক নীতি পুনর্বিন্যাস করছে। ভারতের বৈরিতার মুখে ঢাকা পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক জোরদার করছে এবং চীনের সাথে সহযোগিতা সম্প্রসারণ করছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের সাথেও কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখছে। স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের সাথে সরাসরি জাহাজ চলাচল রুট এবং বিমান পরিষেবা ঘোষণা করা হয়েছে এবং দুই দেশের সামরিক নেতারা বৈঠক করেছেন। ইতোমধ্যে চীন বিরোধীদল এবং ছাত্র আন্দোলনের নেতাসহ বাংলাদেশি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের আতিথ্য দিয়েছে।
রাখাইনে মানবিক চ্যানেল প্রতিষ্ঠাসহ কিছু সংবেদনশীল বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর দৃশ্যমান দূরত্ব দেখা গেলেও এ গ্যাপ পূরণ করা কঠিন নয়। এর মধ্যে দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় জাতীয় ঐক্যের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান প্রফেসর ড. ইউনূসের বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনা এবং ভবিষ্যৎ অর্থনীতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাকে প্রেসিডেন্ট বা অন্য কোনো অভিভাবকত্বের ভূমিকা দেয়ার প্রস্তাব এসেছে। বৈষম্যবিরোধী দলগুলোর মধ্যে বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতার কথাও বলা হয়েছে। এ ধরনের সমঝোতা হলে এমন একটি দৃশ্যপট দেখা যেতে পারে, যেখানে প্রফেসর ইউনূস নির্বাচিত সরকারের প্রেসিডেন্ট, বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকার আর জামায়াত ও ইসলামিস্টরা থাকবে প্রধান বিরোধীদল। এ ধরনের সমঝোতা হলো ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শক্তি লম্বা সময়ের জন্য বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়বে। বাংলাদেশ আধিপত্যবাদের আগ্রাসী পদক্ষেপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবে।
সেটি না হলে প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থা যেভাবে ফ্যাসিবাদী শক্তিকে সহিংসভাবে সক্রিয় করে তুলতে চাইছে, তাতে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বড়ভাবে ক্ষুণ্ন হতে পারে। সেটি হলে জরুরি অবস্থা জারি ছাড়া কোনো পথ থাকবে না। এতে নির্বাচন যে সময়ে সম্পন্ন করার চিন্তা হচ্ছে, সেটি অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার নিজেরা না চাইলেও সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত হতে পারে।