রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে মানবিক করিডোর
১ মে ২০২৫ ১৭:৫৪
॥ ফারাহ মাসুম॥
মিয়ানমারের নন-স্টেট অ্যাক্টর আরাকান আর্মির সাথে এনগেজমেন্টে জাতিসংঘের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান এ কথা বলেন। এতে স্পষ্ট হয়েছে, জাতিসংঘের প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে ঢাকা। তবে এটি বাস্তবায়নে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেইজিং সহজে স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র মেনে নিতে চাইবে না, যেখানে পশ্চিমাদের প্রভাব থাকবে। অন্যদিকে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের সম্মতি ছাড়া এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের বিরোধিতা করছে। এতে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, প্রতিবেশী ভারত এর বিপক্ষে দাঁড়াতে পারে।
ড. খলিলুর রহমান ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে গত ২৯ এপ্রিল মঙ্গলবার বলেন, ‘রাখাইনে জাতিসংঘের নেতৃত্বে মানবিক সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হলে বাংলাদেশ তাতে কারিগরি সহায়তা দিতে আগ্রহী আছে। আমরা বিশ্বাস করি, জাতিসংঘের সহায়তায় মানবিক সহায়তার মাধ্যমে রাখাইনে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে, যা শরণার্থীদের ফেরার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে।’ ড. খলিল বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘ এবং সংশ্লিষ্ট অন্য পক্ষগুলোর সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। তবে মানবিক সহায়তার রুটের বিষয়টি এখনো আলোচনার পর্যায়ে আছে, যা নিয়ে নানা পক্ষের মধ্যে ঐকমত্য হওয়া প্রয়োজন।’
এদিকে বার্তা সংস্থা ইউএনবির এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, সরকার মানবিক করিডোর নিয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে এখনো কোনো আলোচনা করেনি। যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ লজিস্টিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত থাকবে।
শফিকুল আলম বলেন, তারা আশঙ্কা করছেন যে, রাখাইনে এ ভোগান্তি দীর্ঘসময় ধরে চলতে থাকলে আরও মানুষের বাংলাদেশে আসার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এ অবস্থা বাংলাদেশ সামাল দিতে পারবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাখাইনে সাহায্য পাঠানোর একমাত্র কার্যকর পথ হলো বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে। এ পথ ব্যবহার করে সাহায্য পরিবহনে কারিগরি সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করছি। যথাসময়ে বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শ করব।
রাখাইনে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মানবিক করিডোর চালুর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের বিষয়টি জনসমক্ষে আনেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘এতটুকু আপনাদের বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ) হবে; কিন্তু আমাদের কিছু শর্ত রয়েছে, সেই বিস্তারিত বিষয়ে যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’
সংকট সমাধানের সন্ধানে
নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, জাতিসংঘ, বাংলাদেশ, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির এ বিষয়ে একমত হতে হবে। এ চার পক্ষের মধ্যে কোনো একটি পক্ষের ভিন্নমত থাকলে এটি আদৌ বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি না, সেটি বড় প্রশ্ন।
একাধিক কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে যোগাযোগের বিষয়ে গত ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশকে কূটনৈতিক পত্র দিয়ে আপত্তি জানিয়েছে মিয়ানমার। আরাকান আর্মিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ অভিহিত করে বাংলাদেশ কেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এ নিয়ে মিয়ানমার প্রশ্ন তুলেছে। দেশটির সামরিক জান্তা করিডোরের বিরোধিতা করলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বিডিনিউজকে বলেন, ‘আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছি যে, বাংলাদেশের সীমান্তে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, আমরা এটা অস্বীকার করতে পারি না। মিয়ানমারের সাথে আমাদের সীমান্তের পুরো অংশটি এখন নন-স্টেট অ্যাক্টরদের নিয়ন্ত্রণে। সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো কর্তৃত্ব নেই।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘অতএব আমাদের নিজেদের স্বার্থে, আমাদের অবশ্যই যোগাযোগের কিছু ধরন বজায় রাখতে হবে। যদিও আমরা একটি অ-রাষ্ট্রীয় অভিনেতার সাথে অফিসিয়াল যোগাযোগে নিযুক্ত হতে পারি না, তবে এটি সম্পূর্ণভাবে সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকাও সম্ভব নয়। আমরা যে স্তরের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন তা বজায় রাখব।’
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জড়িয়ে পড়ি কি-না, সেটা অন্য বিষয়। তবে মিয়ানমারের সংঘাত সরাসরি আমাদের জাতীয় স্বার্থের সাথে জড়িত। কারণ তাদের বিপুলসংখ্যক নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং আমরা তাদের প্রত্যাবর্তনের সুবিধা দিতে চাই। তাদের প্রত্যাবর্তনকে সমর্থন করার জন্য যা যা প্রয়োজন, তা করতে হবে কারণ আমাদের জাতীয় স্বার্থ এটি দাবি করে।
আরাকান আর্মির ৭ শর্ত
আরাকান আর্মি ২০২৩ সালের নভেম্বরে রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে এবং তখন থেকে রাজ্যের ১৭টি টাউনশিপের মধ্যে ১৪টি দখল করেছে এবং সেইসাথে প্রতিবেশী চিন রাজ্যের পালেতওয়া টাউনশিপও দখল করেছে। গত বছর এটি রাখাইন শাসকের পশ্চিমী কমান্ডের সদর দপ্তর দখল করে, জান্তার সামরিক কমান্ডের ১৪টির মধ্যে দ্বিতীয়টি। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে ২৭০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে এবং গত ডিসেম্বরে মংডু টাউনশিপ দখলের সাথে সাথে আরাকান আর্মি মিয়ানমারের পক্ষের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়।
একই মাসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমবারের মতো ঘোষণা করে যে, তারা আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগের দ্বার খুলেছে। ২০১৭ সালে রাখাইনের সীমান্ত অঞ্চল থেকে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম তাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলার মধ্যে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে।
বিমসটেক সম্মেলনের সাইডলাইনে বাংলাদেশের রোহিঙ্গাবিষয়ক হাইরিপ্রেজেনটিটিভ ড. খলিলুর রহমানের সাথে মিয়ানমার সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে আলোচনার পর প্রথম পর্যায়ে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্তের পর আরাকান আর্মি ও এর রাজনৈতিক সংগঠন ইউএলএ ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি চিঠি দেয়। বাংলাদেশের কাছে দেয়া এ চিঠিতে ৭টি শর্তের উল্লেখের কথা জানা যায়। এতে বিমসটেক বৈঠকের সাইডলাইনের সভায় মিয়ানমারের সরকারের সাথে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের আলোচনা প্রসঙ্গে বলা হয়, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জান্তা সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, ফলে মিয়ানমারের জান্তা সরকার যা কিছুই বলুক না কেন বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না।
এ চিঠিতে আরাকান আর্মির উল্লেখ করা ৭টি শর্তের মধ্যে রয়েছে, প্রথমতÑ আরসা ও এর সাথে যুক্ত সব গোষ্ঠীর সশস্ত্র কার্যক্রম আরাকানে বন্ধ করতে হবে। সেখানে শান্তি-শৃঙ্খলা পুরোপুরি ফিরে না আসা পর্যন্ত প্রত্যাবর্তনের কাজ হবে না। দ্বিতীয়ত, প্রত্যাবর্তিতদের জন্য প্রয়োজনীয় আবাসন, স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্র, শিক্ষা অবকাঠামো সংবলিত নিরাপদ জোন তৈরি করতে হবে। এর নিরপেক্ষতা ও মান বজায় রাখার জন্য তাতে আন্তর্জাতিক তদারকির ব্যবস্থা থাকতে হবে। তৃতীয়ত, প্রত্যাবর্তিতদের জীবন জীবিকার জন্য যথোপযুক্ত ভকেশনাল ট্রেনিং ও চাকরি সৃষ্টির ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তারা অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভর ও সমন্বিত হতে পারে। চতুর্থত, অতীতে সৃষ্ট সংঘাত সংঘর্ষ ও ঘৃণামূলক কার্যক্রমে সৃষ্ট দূরত্ব দূর করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পঞ্চমত, সশস্ত্র সংগঠনের সাথে সম্পর্কহীনদের চিহ্নিত করে বেসামরিক নাগরিকদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে হবে। ষষ্টত, প্রত্যাবর্তন কাঠামো সৃষ্টির সাথে সাথে সামঞ্জস্য রেখে পর্যায়ক্রমিকভাবে ছোট ছোট গ্রুপে আন্তর্জাতিক তদারকির মাধ্যমে পুনর্বাসন কাজ এগিয়ে নিতে হবে। সপ্তমত, স্থানীয় (রাখাইন) ও মুসলিম (রোহিঙ্গা) উভয় সম্প্রদায়কেই পরিকল্পিত পুনর্বাসন কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে।
জাতিসংঘের মহাসচিবের বাংলাদেশ সফরের পর এবং দুই মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের আগে দেয়া আরাকান আর্মির এ চিঠিতে তাদের অবস্থান বেশ নমনীয় বলে মনে হয়। এ চিঠিতে রোহিঙ্গাদের সামরিক সরকার যেভাবে রোহিঙ্গা হিসেবে উল্লেখ করেছে সেভাবে না করে মুসলিম সম্প্রদায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা না হলেও তাদের স্থায়ী পুনর্বাসনের অঙ্গীকারই চিঠিতে ব্যক্ত হয়েছে বলে মনে হয়।
সম্ভবত বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ মহাসচিবের আরাকান আর্মির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার পরামর্শ গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য রাখাইনের ভেতরে নিরাপদ জোন গঠনের জন্য হয় আরাকান আর্মির সাথে সমঝোতায় উপনীত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, নয়তো সামরিক জান্তা সরকারের সাথে যোগ দিয়ে আরাকান আর্মিকে পরাজিত করে এ অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শেষোক্ত বিষয়টি বাংলাদেশের বাস্তবতার জন্য খুব বেশি ভায়াবল হবে বলে নানা কারণে মনে হয় না। প্রথমত, রাখাইন থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, ভরণপোষণ ও তাদের ইস্যু নিয়ে বৈশি^ক ফোরামে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে ইউরোপ আমেরিকার পশ্চিমা দেশ এবং ওআইসিভুক্ত মুসলিম দেশগুলো। তাদের কেউই জান্তার সাথে মিলে আরাকান আর্মিকে পরাজিত করার প্রকল্পে সায় দেবে বলে মনে হয় না। আর সেটি না হলে বাংলাদেশের পক্ষে এ ধরনের কাজে যুক্ত হওয়া কঠিন হবে।
রোহিঙ্গাদের স্বাধীন রাষ্ট্র নয়
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদলের সদস্যদের সাথে গত ২৭ এপ্রিল রোববার ঢাকায় জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের মিয়ানমারের রাখাইনে স্বাধীন রোহিঙ্গা রাষ্ট্রের প্রস্তাব করেছে মর্মে খবর বের হয় গণমাধ্যমে। খবরে বলা হয়, জামায়াতে ইসলামী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি স্বাধীন রোহিঙ্গা রাষ্ট্র গঠনের জন্য চীনকে প্রস্তাব দিয়েছে। তিন সদস্যের চীনা প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির (আইডিসিপিসি) আন্তর্জাতিক বিভাগের দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক পেং জিউবিন। চীনা প্রতিনিধি দলটি আরও কয়েকটি প্রধান রাজনৈতিক দল এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছে।
বৈঠকের পর জামায়াতের প্রতিনিধিদলের নেতা নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন যে, বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় ১১ থেকে ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী ‘অমানবিক পরিস্থিতি’ সহ্য করছে এবং শুধুমাত্র মানবিক সহায়তা প্রদান করা একটি টেকসই সমাধান নয়। আমরা রোহিঙ্গা সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় তাদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে একটি ‘স্বতন্ত্র আরাকান রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছি। জামায়াতের ‘স্বতন্ত্র আরাকান রাজ্য’কে কিছু গণমাধ্যমে ‘স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং বলা হয় মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে জামায়াত চীনের সমর্থন চায়।
পরে এ বিভ্রান্তি দূর করার জন্য ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রদান করে এক বিবৃতি প্রদান করেন। এতে তিনি বলেন, ‘গত ২৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সফররত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে বৈঠকের পর প্রেস ব্রিফিংয়ে আমি যে বক্তব্য দিয়েছি তাতে মূলত বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক ও নিরাপদভাবে তাদের দেশে প্রত্যাবর্তন করার ব্যবস্থা ও তাদের জন্য একটি নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলার বিষয়টি বুঝাতে চেয়েছি। এটিই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দৃষ্টিভঙ্গি।’
আলোচনার মাধ্যমে পদক্ষেপ কামনা
অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা ব্যতিরেকে মিয়ানমারের রাখাইনে মানবিক করিডোর দেয়ার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের দিকে অগ্রসর হওয়ার পক্ষে নয় বিএনপি। দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত বিষয়ে একটি অনির্বাচিত সরকারের এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার নেই বলে উল্লেখ করে দলটি। তাদের শঙ্কা, সরকার ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা ছাড়া এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলে ভবিষ্যতে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে বাংলাদেশ। গত ২৮ এপ্রিল সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন আলোচনা হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপি মানবিক করিডোর প্রশ্নে তার দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে অন্য দলগুলোকে আনতে চাইছে বলে মনে হয়। এ নিয়ে তারা আলোচনা শুরু করার কথাও জানিয়েছে। ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতের নেতারা অনুরূপ বক্তব্য দিয়েছেন।
মানবিক করিডোর নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যের পরদিন (গত ২৮ এপ্রিল সোমবার) ঠাকুরগাঁওয়ে এক গণসংযোগ অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যোগাযোগের জন্য ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কথা বলে নেওয়া উচিত ছিল। কারণ এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের শান্তি-শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা জড়িত রয়েছে।
মিয়ানমারের জান্তা সরকার রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে কোণঠাসা করার জন্য সব সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে, যা মানবিক সংকটকে আরও খারাপ করেছে। পরিস্থিতির সাথে জাতিসংঘ রাখাইনে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছে এবং বাংলাদেশকে মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য একটি করিডোর সরবরাহ করতে বলেছে।
বাংলাদেশের তিনটি জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান এবং কক্সবাজার রাখাইন রাজ্যের সাথে সীমান্ত ভাগ করে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ রাখাইনের সাথে শক্তিশালী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জনসংখ্যাগত, সাংস্কৃতিক এবং মানবিক সম্পর্ক ভাগ করেছে। এছাড়া বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে আনুমানিক ২০ হাজারের বেশি জাতিগত রাখাইন নাগরিক রয়েছে।
বাংলাদেশ এবং রাখাইনের মধ্যে ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে পরবর্তীতে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে। ১৯৭৮ সাল থেকে মিয়ানমার উত্তর রাখাইন রাজ্যে কেন্দ্রীভূত রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বার বার জাতিগত নির্মূল অভিযান শুরু করেছে এবং কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ নিজের জন্য উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক, আর্থিক, নিরাপত্তা এবং পরিবেশগত খরচে ১৩ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিচ্ছে।
রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক সহিংসতার প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশের জন্য আরও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মানবিক এবং নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করেছে। প্রথমত, রাখাইনে চলমান সংঘাত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতার জন্য বেশ কিছু হুমকি সৃষ্টি করেছে। এটি অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম (সিএইচটি) অঞ্চল এবং দক্ষিণ চট্টগ্রাম বিভাগে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনে বছরের পর বছর ধরে পা টেনে আনার পর মিয়ানমার জান্তা সরকার প্রত্যাবর্তনে উদ্যোগ নিতে রাজি হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য পরিচালিত হয় প্রাথমিকভাবে রাখাইন রাজ্যের ভূখ-ের মাধ্যমে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ও রাখাইনের মধ্যে মাসিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৪ মিলিয়ন ডলার। রাখাইন রাজ্যে সংঘাতের ক্রমবর্ধমান কারণে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বাণিজ্য হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে।
তৃতীয়, অপারেশন ১০২৭-এর সময় অরাকান আর্মির সাফল্যের প্রতিক্রিয়ায় জান্তা বাহিনী দৃশ্যত রাখাইন রাজ্যে ‘ফোর কাট’ কৌশল বাস্তবায়ন করছে। ‘চার কাট’ কৌশলটি খাদ্য, তহবিল, তথ্য এবং বিদ্রোহীদের জন্য নিয়োগের উৎস বন্ধ করতে চায়। আরাকান আর্মির আক্রমণাত্মক অভিযান শুরু হওয়ার পরপরই তাতমাডু উপকূলীয় রাখাইন রাজ্যে রাস্তা ও জলপথ অবরোধ করে প্রতিক্রিয়া জানায়। তারা শহর ও গ্রামের মধ্যে রাস্তা অবরুদ্ধ করেছে এবং রাখাইন রাজ্যকে ইয়াঙ্গুন এবং মিয়ানমারের অন্যান্য অংশের সাথে সংযুক্তকারী তিনটি প্রধান সড়ক অবরোধ করে এবং শেষ পর্যন্ত ১৪টি টাউনশিপে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
সব শষে রাখাইন রাজ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাত বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে বিভিন্নভাবে ক্ষুণœ করার সম্ভাবনা রয়েছে। যুদ্ধের সম্ভাব্য স্পিলওভার ভোগা ছাড়াও এর প্রতিবেশী এলাকায় দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষ তার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে পারে।
আরাকান আর্মি (এএ) এ যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে জয়ী হলে বাংলাদেশ একটি অস্বীকৃত স্টেটলেটের সাথে সীমান্ত ভাগ করবে। যদি আরাকান আর্মি এ যুদ্ধে কোনো কারণে হেরে যায়, বাংলাদেশ তার ভূখ-ে ছদ্মবেশী এএ যোদ্ধাদের আগমন প্রত্যক্ষ করতে পারে। অধিকন্তু, সংঘাত বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে অবৈধ মাদক ও অস্ত্রের প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এভাবে রাখাইন রাজ্যে সংঘাতের ক্রমবর্ধমানতা বাংলাদেশকে একটি গুরুতর সমস্যায় ফেলেছে।
ঢাকার জন্য এগিয়ে যাওয়ার পথ
বাংলাদেশের জন্য রাখাইন ইস্যুটির সংবেদনশীলতা বিবেচনায় রেখে দেশটির উচিত তার জাতীয় স্বার্থকে আরও এগিয়ে নিতে মিয়ানমারের বিষয়ে সতর্কতার সাথে নীতি প্রণয়ন করা।
প্রথমত, প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উচিত রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুত মানুষের দুর্ভোগ কমানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত, তাদের কাছে খাদ্য ও ওষুধসহ মানবিক সাহায্য পাঠানো।
দ্বিতীয়ত, সিটওয়েতে বাংলাদেশি কনস্যুলেট এবং অন্যান্য উৎস ব্যবহার করে দেশটির উচিত রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধের গতিশীলতা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা। এছাড়া ঢাকাকে অস্থিতিশীল বাংলাদেশ-রাখাইন রাজ্য সীমান্তে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত এবং রাজ্যের পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার জন্য তার সামর্থ্যানুযায়ী সব কিছু করা উচিত।
তৃতীয়ত, যেহেতু রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধের ফলাফল সুনিশ্চিত নয়, সেহেতু ঢাকার উচিত পরিস্থিতিটি সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করা এবং উপযুক্ত আকস্মিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।
অবশেষে রাখাইন রাজ্যে উর্বর কৃষিজমি এবং প্রচুর হাইড্রোকার্বন মজুদ রয়েছে। অধিকন্তু, এর ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য এ অঞ্চলে চীনা এবং ভারতীয় স্বার্থ দ্বারা শক্তিশালী হয়েছে, যথাক্রমে চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর এবং কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প দ্বারা চিত্রিত হয়েছে। রাখাইনের সাথে বাণিজ্য ও অন্যান্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ যথেষ্ট অর্থনৈতিক সুবিধা পেতে পারে।
এছাড়া চীন, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বৃহৎ এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক টানাপড়েন বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই মিয়ানমার সরকারের সাথে সম্পর্ক ছাড়াও ঢাকার উচিত রাখাইন রাজ্য সরকারের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে তোলা।
রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার উত্থান বাংলাদেশের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ। এমন পরিস্থিতির মধ্যে রাখাইনে সহিংসতার শিকারদের সহায়তা করার পাশাপাশি তার মূল জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা বাংলাদেশের নৈতিক দায়িত্ব। তাই সীমান্তে সংঘাত মোকাবিলায় ঢাকার উচিত একটি সুস্পষ্ট, সুষম, মানবিক ও পারস্পরিক কল্যাণকর নীতি প্রণয়ন করা।
রোহিঙ্গা এবং রাখাইন উভয় সম্প্রদায়ই প্রায়শই জটিল এবং আন্তঃসম্পর্কিত উপায়ে আরাকানে [রাখাইনে] কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসছে। যেকোনো টেকসই এবং ন্যায্য রেজোলিউশনকে অবশ্যই এ অঞ্চলের সব সম্প্রদায়ের অধিকার, পরিচয় এবং আকাক্সক্ষাকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
চীনসহ আন্তর্জাতিক অভিনেতাদের ভূমিকা শান্তি ও রাজনৈতিক সমাধানের সুবিধার্থে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তবে টেকসই ফলাফল অবশ্যই স্থানীয় বাস্তবতায় মূল হতে হবে, স্থল থেকে বিচ্ছিন্ন বাহ্যিক প্রেসক্রিপশন নয়।
মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতিসংঘ রাখাইনে সহায়তার একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারলে সেখানে একটি নিরাপদ জোন তৈরি করা বিশ^ সম্প্রদায়ের জন্য সহজ হবে। আর আরাকান আর্মি যে ৭টি শর্তের কথা উল্লেখ করেছে, তাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি বাস্তবায়নের বিষয় রয়েছে। তাদের নাগরিক অধিকারের বিষয়টি শর্তে উল্লেখ না করা হলেও অর্থনৈতিক অধিকার এবং সেখানে সামাজিক সমন্বয় গড়ার যে কথা তারা উল্লেখ করেছে, তাতে দুই সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে রাখাইন রাজ্য গঠনের বিষয় রয়েছে। মানবিক করিডোর রাখাইন রাজ্যকে টিকে থাকার জন্য বিশ^ সংস্থা ও বাংলাদেশের ওপর তাদের নির্ভরশীল করার কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে এর চেয়ে উত্তম কোনো সমাধান আপাতত দেখা যাচ্ছে না। কেবল এ প্রক্রিয়ায় চীনকে সম্মত করতে হবে। জাতিসংঘ তাদের অর্থনৈতিক করিডোরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে সেই সম্মতি পাওয়া সম্ভব বলে মনে হয়।