অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের আন্দোলনের ফসল:তারপরও বিতর্ক কেন?

হারুন ইবনে শাহাদাত
১৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:২২

॥ হারুন ইবনে শাহাদাত ॥
অন্তর্বর্তী সরকার দেশ গঠনে কাজ করছে। একটি শক্তিশালী ভিত্তি রচনা করার মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশার আলোকে নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু তাদের এ সংস্কার কর্মসূচি বাধামুক্তভাবে চলছে- এ কথা বলা যাচ্ছে না। পতিত আওয়ামী লীগ প্রতিবেশী ভারতের কলকাতায় অফিস খুলে ষড়যন্ত্র করছে। জনগণের প্রতিরোধের কারণে তারা দেশের মাটিতে প্রকাশ্যে মুখ দেখাতে পারছে না। কিন্তু কিছু কিছু রাজনৈতিক দল ও নেতা পতিত ফ্যাসিস্টের সেই শূন্যতা পূরণে ভূমিকা পালন করছে। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচিত নয়Ñ এমন ফাঁকা আওয়াজ তুলছে। তারা এক মুহূর্ত বিলম্ব করতে চাচ্ছে না। কিন্তু সংস্কার ছাড়া দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আরেকটি নির্বাচন, তারপর সরকারের গঠনের পরিণতি কী হয়, তা এদেশের মানুষ প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে দেখছে। বার বার রক্ত দিয়ে সেই ভুলের সংশোধন করে আবারও ভুল পথেই হাঁটছে। এবার আর সেই ভুল করতে চায় না মানুষ। তারা ব্যালটে নয়, ফ্যাসিস্টের বুলেটে বুকের রক্ত ঝরিয়ে জীবন দিয়ে যে সরকার নির্বাচিত করছে, সেই সরকারকে কেউ অনির্বাচিত বলুক তা মানতে পারছে না। তারা চায় জীবন আর রক্তের বিনিময়ে তারা যাদের নির্বাচিত করছেন, তারা একটি রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শেষ করবে, বিপ্লবের দাবির পক্ষে একটি ঘোষণাপত্র জারি করবেÑ এরপর তার ওপর ভিত্তি করে শক্তিশালী কাঠামো দাঁড় করানোর পরই আসুক ব্যালটে নির্বাচিত নতুন সরকার। এ পর্বে তাদের সামনে আছে এ দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকার ইতিহাস। দেশটির প্রতিষ্ঠাতা জর্জ ওয়াশিংটনের বিখ্যাত উক্তি ও সামনে চলার ইতিহাস।
জর্জ ওয়াশিংটনের উক্তি ও সামনে চলা
জর্জ ওয়াশিংটনের বিখ্যাত উক্তি, ‘নতুন সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন অসীম যত্ন এবং সীমাহীন মনোযোগ। কারণ যদি ভিত্তি খারাপভাবে স্থাপন করা হয়, তাহলে মূল কাঠামো অবশ্যই খারাপ হয়ে যাবে।’ তিনি তার এ কথার বাস্তবায়ন করে যথাযথ ভিত্তির ওপর স্বাধীনতা-সংগ্রামে বিজয়ের নতুন সরকার গঠনের মাধ্যমে আমেরিকার পথচলা শুরু করতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো আজও পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে টিকে আছে দেশটি।
জর্জ ওয়াশিংটনের পথচলা সহজ ছিল না। ১৭৭৪ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ফিলাডেলফিয়ায় ১২টি আমেরিকান উপনিবেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে প্রথম কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস হয়। এ কংগ্রেসে যোগ দেন জর্জ ওয়াশিংটন। কংগ্রেসে অধিকারের ঘোষণাপত্র (ডিক্লারেশন অব রাইটস) গৃহীত হয়।
১৭৭৫ সালের ১৯ এপ্রিল আমেরিকান বিপ্লবী যুদ্ধ (স্বাধীনতাযুদ্ধ) শুরু হয়। ১৭৭৫ সালের ১৪ জুন ফিলাডেলফিয়ার দ্বিতীয় কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস ‘কন্টিনেন্টাল আর্মি’ গঠনে ভোট দেয়। জর্জ ওয়াশিংটনকে এ আর্মির ‘কমান্ডার-ইন-চিফ’ হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। প্রায় আট বছর যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলোও জড়িয়ে পড়ে। জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বাধীন কন্টিনেন্টাল আর্মি ১৭৮৩ সালে ব্রিটিশ আর্মিকে পরাজিত করে। ১৭৮৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্যারিস চুক্তি (ট্রিটি অব প্যারিস) সই হয়। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে আমেরিকান বিপ্লবী যুদ্ধ শেষ হয়। আমেরিকার স্বাধীনতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় ব্রিটেন। স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্র। ১৭৮৩ সালের নভেম্বরে জর্জ ওয়াশিংটন কন্টিনেন্টাল আর্মি ভেঙে দেন। একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর তিনি কন্টিনেন্টাল আর্মির ‘কমান্ডার-ইন-চিফ’ পদ থেকে পদত্যাগ করেন। একটি নতুন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণের ক্ষেত্রে তার এ পদক্ষেপ দেশ-বিদেশে ভূয়সী প্রশংসা কুড়ায়।
জর্জ ওয়াশিংটন স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের একটি জাতীয় সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা খুব করে অনুভব করছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, জাতীয় সংবিধান একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন অঙ্গরাজ্যগুলোকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে। কংগ্রেস ১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়ায় একটি সাংবিধানিক সম্মেলন (কনস্টিটিউশনাল কনভেনশন) করতে সম্মত হয়। এ সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জর্জ ওয়াশিংটন। সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান তৈরি হয়। ১৭৮৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান স্বাক্ষরিত হয়। অনুমোদিত হয় ১৭৮৮ সালে। আর ১৭৮৯ সালে কার্যকর হয়।
নতুন সংবিধানের অধীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ১৭৮৯ সালে নির্বাচিত হন জর্জ ওয়াশিংটন। ৬৯ ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে তিনি সর্বসম্মতভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৭৮৯ সালের ৩০ এপ্রিল তিনি শপথ নেন। মেয়াদ শেষে অবসরে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল জর্জ ওয়াশিংটনের। কিন্তু উপদেষ্টাসহ রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের অনুরোধে, পরিস্থিতি বিবেচনায়, দেশের স্বার্থে তিনি শেষ পর্যন্ত আরেকবার নির্বাচনে লড়তে রাজি হন। ১৭৯২ সালের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জর্জ ওয়াশিংটন সর্বসম্মতভাবে পুনর্নির্বাচিত হন। ১৭৯৩ সালের ৪ মার্চ তিনি দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। ১৭৯৭ সালের ৪ মার্চ পর্যন্ত তিনি দায়িত্বে ছিলেন। জর্জ ওয়াশিংটন তার দুই মেয়াদকালে সব আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার ব্রত নিয়ে কাজ করেন। তিনি জাতীয় ঐক্যের ওপর জোর দেন। একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানামুখী পদক্ষেপ নেন।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার (রিপাবলিকানিজম) প্রচলন ও চর্চার একজন অগ্রগণ্য রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে তিনি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। রাষ্ট্রপ্রধানকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ ডাকার ধারা তিনি চালু করেন। এক ব্যক্তির সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার রীতির প্রচলন তার হাত ধরেই হয়। (তথ্যসূত্র : বিবিসি, ব্রিটানিকা, হোয়াইট হাউস ডট গভ, হোয়াইট হাউস হিস্টোরিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন)।
একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়তে ঐক্যবদ্ধভাবে বিপ্লবের ঘোষণাপত্র এবং সেই আলোকে তৈরি সংবিধান কতটা জরুরি, তা উপরোক্ত ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে খুব সহজেই বোঝা যায়। বিপ্লবোত্তর সরকারকে ধৈর্যের সাথে কাজ করার পরিবেশ দিতে হবে। সেই সরকারের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে ঝগড়া করা বৃথা।
এখন প্রশ্ন হলো- সময়ের প্রয়োজনে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচিত করে তাদের অভিষিক্ত করেছে। তারপরও কেন এ বিতর্ক।
তারপরও কেন নির্বাচিত-অনির্বাচিত বিতর্ক
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বিএনপির পক্ষ থেকে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করা হয়। কিন্তু সরকার নির্বাচিত নাকি অনির্বাচিত- এমন প্রশ্ন ওঠেনি। তবে গত ১৩ এপ্রিল রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে সালাহউদ্দিন আহামদ অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে ‘নির্বাচিত সরকারের বিকল্প তো আপনারা হতে পারেন না। আপনারা অবশ্যই অনির্বাচিত। সেটা প্রতিদিন আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে।’ এমন মন্তব্য করার পর বিষয়টি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। অবশ্য ৩৬ জুলাইয়ের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনকারীরা প্রথম থেকেই বলছেন, এ সরকার এদেশের জনগণের চাহিদা-প্রত্যাশা পূরণে তারাই নির্বাচিত করেছে। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন, ‘শুধু ভোটের মাধ্যমেই নির্বাচিত সরকার হয়Ñ এ ধারণা ভুল’ । তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানই গণতন্ত্র। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়ারাই জনগণ। তাদের অভিপ্রায়ে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে। সুতরাং এটি নির্বাচিত সরকার।’
এ সরকার জনগণের আন্দোলনের ফসল
কথায় আছে- ‘তোমরা ঝগড়া করো কোন সরকার শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে, আমি করি বিচার জনগণের প্রতি সরকারের আচরণ দিয়ে।’ সরকারের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণের এ বহুর প্রচলিত কথাটি আসলে রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের চিন্তার নির্যাস। জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচন, নির্বাচিত সরকার, ব্যালট ও ভোটের কথা বললেও তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন, সবসময় ব্যালটেই জনমতের প্রতিফলন ঘটে না। ব্যালট জনগণের হাতে তুলে দেয়ার আগে তাদের যথাযথভাবে প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হলে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যালটে নির্বাচিতরা সরকার গঠন করে জনগণের অধিকার হরণের লাইসেন্স পেয়ে যায়। তাই গণতন্ত্রের সাফল্যের সাথে জনগণকে তার জন্য প্রস্তুত করার গুরুত্ব অস্বীকার করা মানে নির্বাচিত সরকারের নামে কতিপয় তস্করের হাতে রাষ্ট্র ও জনগণের ভাগ্য ছেড়ে দেয়া হয় বলে মনে করেন আধুনিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। ‘নির্বাচিত সরকার অনির্বাচিত সরকারের চেয়ে ভালো।’ এ বিতর্কের দিন শেষ। কারণ দেশের মানুষ দেখেছে কীভাবে জনগণকে প্রস্তুত করার আগে নির্বাচনের নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। তারপর নির্বাচিত সরকারের লেবেল লাগিয়ে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র ধ্বংস এবং নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠিয়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতো জনগণের ঘাড়ে চেপে বসে ফ্যাসিস্টরা। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিদিনই যারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন তারা অনির্বাচিত, তাদের প্রতি জনগণের উষ্মা প্রতিদিনই বাড়ছে। কারণ এ সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আন্দোলনের ফসল। তাদের প্রত্যাশা পূরণ করা এ সরকারের এক নম্বর কাজ। এ প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতার পথে হেঁটে সংস্কারের আগে নির্বাচনের আয়োজন করলে জনগণ তাদের ওপর থেকে ম্যান্ডেট প্রত্যাহার করবে, নতুন কাউকে ডাকবে, যা দেশ ও জনগণের জন্য মঙ্গলজনক হবে না বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।