প্রশাসনে ধীরগতি, নেপথ্যে কী?
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:৫১
ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানে হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছয় মাস ধরে দেশ পরিচালনা করছে। এ ছয় মাসে সরকারের ইতিবাচক অনেক পদক্ষেপ প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু ভঙ্গুর দশা থেকে প্রশাসনে কর্মরতদের লাইনে তোলার চেষ্টা পুরোপুরি সফল হয়নি, অর্থাৎ সরকারি দফতরগুলোয় কাজের গতি বাড়েনি। অনেকটা ‘স্লো’ গতিতে চলছে দাফতরিক সব কাজ। অন্তর্বর্তী সরকারকে অনেকটাই অসহযোগিতা করে যাচ্ছেন আমলাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। যারা হাসিনা সরকারের সময় দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিলেন, তারা একদিকে ধরা পড়ার শঙ্কায় কাজে মনোবল হারাচ্ছেন; অন্যদিকে নিজেকে সেইফ রাখতে নতুন সরকারের তোষামোদে সময় ব্যয় করছেন। আর ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুগত আমলারা চাচ্ছেন না, সরকার ইতিবাচক কোনো কিছু করুক। ফলে তারা নানা কৌশল-অপকৌশলে কাজের গতি কমাচ্ছেন। এছাড়া প্রশাসনে রয়েছে নেতৃত্বের দুর্বলতা। এ দুর্বলতা তখনই সবার কাছে দৃশ্যমান হয়, যখন প্রশাসনে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে বার বার ভুল হয়। বিশেষ করে পদায়ন ও পদোন্নতিতে বার বার ভুল নেতৃত্বের কোয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়। আর এসব কারণেই প্রশাসনে কাজের গতি বাড়ছে না।
পদোন্নতি ও বদলিতে বার বার ভুল
টানা সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ এবং এর আগের দুই বছর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ পরিচালনা করেছে। ফলে প্রশাসনে প্রায় দেড় যুগ ধরে আওয়ামী আধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে। হঠাৎ করেই সেই আধিপত্য ভেঙে যাচ্ছে না। প্রশাসনে যেখান থেকে যাকেই আনা হচ্ছে, এদের বেশিরভাগই গত সরকারের সুবিধাভোগী। দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. ইউনূস সরকার প্রশাসনে কিছু রদবদল করেছে। এসব রদবদল নিয়েও নানা সমালোচনা হয়েছে। সমালোচনার মুখে অনেককে পদোন্নতির পর ওএসডি করতে হয়েছে। অনেকের পদায়ন বাতিল করতে হয়েছে। এসবই নেতৃত্বের দুর্বলতা হিসেবে দেখছেন অভিজ্ঞরা। যেমন আমরা উদাহরণ সামনে নিয়ে আসতে পারি।
সরকারের শিক্ষা খাতের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান যাকে করা হয়েছে, তিনি হাসিনা সরকারের সময়কার অত্যন্ত সুবিধাভোগী একজন আমলা। ২০১৮ সালের ২৫ মার্চ এনসিটিবিতে সদস্য (প্রাথমিক) পদে দায়িত্ব বাগিয়ে নেন অধ্যাপক রিয়াজুল হাসান। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি যখন শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন, তখন তিনি সাড়ে চার বছর এ পদে চাকরি করেন। জানা গেছে, অধ্যাপক রিয়াজুল হাসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে কর্মজীবনে তিনি সবসময় আওয়ামী লীগের পরিচয়ে লোভনীয় ও লাভজনক পদ বাগিয়েছেন। তিনি শেরপুর সরকারি কলেজ ও ঢাকার মিরপুর বাঙলা কলেজের অধ্যক্ষ পদেও ছিলেন। তাছাড়া তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবুর আপন মামাতো ভাই। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে বিশেষ সখ্যের কারণে একাধিকবার বিদেশ সফরের সুযোগও বাগিয়ে নেন। হাসিনার আমলে লোভনীয় পদ বাগিয়ে নেওয়া এ কর্মকর্তাকেই এনসিটিবির চেয়ারম্যান বানাল অন্তর্বর্তী সরকার। এখানে কৌশলটা কী ছিল? পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম ও সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ানোয় ২০২৩ সালে এপ্রিল মাসে রিয়াজুল হাসানকে ওএসডি করা হয়। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে তিনি নিজেকে ‘বৈষম্যের শিকার’ দাবি করে এনসিটিবির চেয়ারম্যান পদ বাগিয়ে নিতে তদবির চালান এবং সফলও হন। অথচ মূল ব্যাপারটি ছিল ফরহাদুল ইসলাম ও মশিউজ্জামানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব। এনসিটিবির চেয়ারম্যান হওয়ার পর এ নিয়ে নানা বিতর্ক হয়। একপর্যায়ে বিতর্কিত চেয়ারম্যান ড. একেএম রিয়াজুল হাসানকে গত ২৬ জানুয়ারি ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত) করা হয়। চমৎকার বিষয় হলো ড. একেএম রিয়াজুল হাসানকে প্রেষণ প্রত্যাহারক্রমে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তিনি এখনো এনসিটিবির চেয়ারম্যানের চেয়ারেই বহাল রয়েছেন। জানা গেছে মার্চ পর্যন্ত তাকে ওই পদেই রাখছে সরকার। অথচ পাঠ্যবইয়ের সংশোধন ও পরিমার্জন নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে তার সময়ে। বইয়ে আদিবাসী গ্রাফিতি নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে। এছাড়া বইয়ে ট্রেন্ডার প্রক্রিয়ার ইচ্ছাকৃত দেরি করে নিজের মেয়াদ বৃদ্ধি করার চেষ্টা হয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে। কিন্তু তিনি বহাল এখনো। এমন অসংখ্য ঘটনা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে।
রয়েছে নেতৃত্বের দুর্বলতা-অজ্ঞতা
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই প্রশাসনে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তে নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রকাশ্যে এসেছে। সেই পরিস্থিতি থেকে এখনো উত্তরণ ঘটানো যায়নি। দায়িত্ব নেওয়ার শুরুতেই জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে নিয়োগে প্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি ও হাতাহাতিতে জড়ান, যা রীতিমতো নজিরবিহীন বলছেন সংশ্লিষ্টরা। পরে বিতর্ক ও সমালোচনা এবং প্রতিবাদের মুখে ১১ সেপ্টেম্বর ডিসি হিসেবে ৯ কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল করা হয়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) এ কে এম মতিউর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু ৩ অক্টোবর তাকে ওএসডি করা হয়। গত ১৩ জানুয়ারি বিতর্ক ওঠায় বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) ছয়জন সদস্যের নিয়োগ বাতিল করা হয়। এর আগে গত ২ জানুয়ারি তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত, উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে কয়েকশ’ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়। অভিযোগ ওঠে, এদের মধ্যে অনেকেই বিতর্কিত কর্মকর্তা রয়েছে। অতীতে দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন কর্মকর্তারাও। বিভাগীয় মামলায় শাস্তি পাওয়ারাও পদোন্নতি পেয়েছেন। পতিত আওয়ামী সরকারের নানা অপকর্মের সহযোগী থাকা আমলাদেরও পদোন্নতি পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞরা বলছেন, এসব পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে যারা ভূমিকা রাখছেন, তাদের একটি অংশ গত সরকারের অনুগত, ফলে তারা ও তাদের মতাদর্শের লোকেরা পদোন্নতি পাচ্ছেন; অন্যদিকে যারা আওয়ামী অনুগত নন, তারা অজ্ঞতার কারণে না বুঝে ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছেন। আর এ কারণে প্রয়োজনীয় গতি ফিরছে না সরকারি দাপ্তরিক কাজে।
টেনশনে থাকছেন দুর্নীতিবাজরা
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) বেনজীর আহমেদ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য সামনে আসায় তারা দুর্নীতিবাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। কিন্তু এমন শত শত আমলা রয়েছেন, যারা অর্থ পাচার করেছেন, দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এমন দুর্নীতিবাজরা সবাই এখনো প্রশাসনে বহাল রয়েছেন। এরা সম্পদ ও নিজেদের রক্ষায় ব্যস্ত, ফলে দাপ্তরিক কাজে মনোযোগ নেই। বিশেষ করে দুদক বিভিন্ন সরকারি দফতরের দুর্নীতি অনুসন্ধানে যাচ্ছে, ফলে এ আতঙ্কটা আরও বেশি। কাজে মন বসছে না এ দুর্নীতিবাজদের। খবর নিয়ে জানা গেছে, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন আতঙ্কে আছেন। কখন কার আমলনামা গণমাধ্যমে উঠে আসে, সেই আশঙ্কায় দিন কাটছে অনেকের। অপকর্মের তথ্য ফাঁস হওয়া ঠেকাতে অনেকেই অধীনস্থ কর্মচারীদের সমীহ করে চলছেন। পুলিশ, কাস্টমস ও প্রশাসনের পাশাপাশি প্রকৌশল সম্পর্কিত বিভিন্ন ক্যাডারেও এমন পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছেন। সরকারি কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদ নিয়ে দেশের মানুষ খুবই ক্ষুব্ধ। শুধু ঊর্ধ্বতন নয়, সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীই অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত। ফলে একজনের দুর্নীতি ধরা পড়লে স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা যায়। তবে এবারের মতো এত বড় দুর্নীতি আগে কখনো প্রকাশ হয়নি। ফলে কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাধারণ কর্মচারীরাও মহা টেনশনে আছেন। কে কখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন, অনেকেই সেই শঙ্কায় আছেন। অনেকে ভীতির কারণে এড়িয়ে চলছেন গণমাধ্যম।
সাবেক সচিব আবদুল আউয়াল মজুমদার মনে করেন, যারা ক্যাডার হয়েছে কিংবা সরকারি চাকরি পেয়েছেন, তারা নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান। লাখ লাখ প্রার্থীর মধ্যে হাতেগোনা কিছু লোক সরকারি চাকরি পান। সুতরাং রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এছাড়া যারা প্রশাসনের শীর্ষ পদে যান, তাদেরও সততার পরীক্ষা দেওয়া জরুরি। কারণ সবাই শীর্ষ পদে যেতে পারেন না।
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্ধবছর ধরে দায়িত্ব পালন করছে। এ সময়ের মধ্যে প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগে যে সংস্কার এবং যে ধরনের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল, সেটা মনে হয় মানুষ দেখতে পাচ্ছে না। সরকারে যারা দায়িত্বে আছেন, তারা যেভাবে নেতৃত্ব দেবেন, যেভাবে সরকারি কর্মচারীদের সুরক্ষা দিয়ে কাজে নামিয়ে দেবেন, সরকারের কাজকে গতিশীল করবেন- সেটা দেখা যাচ্ছে না। তাই এ জায়গায় তাদের আরও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার বিপ্লবে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ওইদিনই বিলুপ্ত হয় মন্ত্রিসভা। পরদিন ৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি। এরপর গত ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওইসময় নিয়োগ পান ১৬ উপদেষ্টা। ঢাকা ও দেশের বাইরে থাকায় তিন উপদেষ্টা ওইদিন শপথ নিতে পারেননি। তারা পরে শপথ নেন। সর্বশেষ ১০ নভেম্বর তিনজন উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তিন বিশেষ সহকারী যুক্ত হন অন্তর্বর্তী সরকারে। অন্যদিকে ২০ ডিসেম্বর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং ভূমি উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ মারা যান। এখন এ সরকারে প্রধান উপদেষ্টাসহ মোট উপদেষ্টা রয়েছেন ২৩ জন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিজের কাছে রেখেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় প্রধান উপদেষ্টার অধীনে রয়েছে। সাতজন ছাড়া বাকি উপদেষ্টারা একাধিক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সামলাচ্ছেন। উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের কোনো দপ্তর নেই।