অর্থনীতির ক্ষত অন্তর্বর্তী সরকারকেই সারাতে হবে
২৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:০০
ভঙ্গুর অবস্থায় খাদের কিনারায় রেখে যাওয়া অর্থনীতি থেকে গত ৬ মাসে অর্থ পাচার ও আর্থিক অনিয়মের মতো বিষয়গুলো বিদায় হতে শুরু করেছে নতুন নেতৃত্ব হাল ধরায়। সেখান থেকে অর্থনীতি ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার হতে শুরু করেছে। এজন্য প্রবৃদ্ধিও গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেছে সম্প্রতি। এটি অর্থনীতির জন্য একটু খটকা লাগলেও সবচেয়ে বড় সুখবর হলো, অর্থের সঠিক ব্যবহার শুরু হয়েছে। অর্থনীতির সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠা অর্থ পাচার বন্ধ হয়েছে। বিদেশ থেকে রপ্তানি আয় আগের চেয়ে বেশি আসতে শুরু করেছে- এর বিপরীতে রপ্তানিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানি একই হারে থাকার পরও। আগে কাঁচামাল আমদানি বেশি দেখিয়ে অর্থ পাচার সবচেয়ে বেশি হয়েছে। ভোগ্যপণ্য ও সবজির যথেষ্ট সরবরাহ এবং ডলারের দর স্থিতিশীল থাকাও অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বেশি স্বস্তির জায়গা। এখন অর্থনীতিতে চাঙাভাব অর্থাৎ পুুনরুজ্জীবিত করে প্রাণচাঞ্চল্য ফেরাতে একটি রোডম্যাপ প্রয়োজন। যেখানে আগামী ৫ বছরে অর্থনীতির চেহারা কেমন হবে, কোথায় কোন নীতিটি কীভাবে কাজ করবে, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার, এডিপি, জ্বালানি, ভ্যাট ও কর হারে কোনো ধরনের পরিবর্তন হবে ইত্যাদি বিস্তারিত থাকবে।
এটি করলে ব্যবসায়ীরাও স্বস্তিতে অর্থনীতির প্রাণভোমরা নামে পরিচিত নতুন বিনিয়োগে যেতে পারবেন। এতে ব্যবসা করতে সরকারের পক্ষ থেকেও প্রতিশ্রুতি পাওয়া যাবে বলে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ব্যবসায়ী সামিটকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে রোডম্যাপের বিস্তারিত জানাতে পারে সরকার। রোডম্যাপে অর্থ পাচার, ঘুষ, অপচয় ও দুর্নীতি বন্ধে নগদ টাকার ব্যবহার কমিয়ে শূন্যে নিয়ে আসার একটি পরিকল্পনা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও সাংবাদিকরা। এজন্য অনলাইনে আর্থিক লেনদেনে ব্যবহৃত ইন্টারনেটসহ প্রযুক্তি খরচ শূন্য করতে হবে- যাতে সহজলভ্য হয় সবখানে।
নির্বাচনী ডামাডোলে সিদ্ধান্তহীনতায় ব্যবসায়ীরা
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হয় ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লবে। এরপরই দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যার নেতৃত্বে আসেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতায় থাকা বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞরা। সব পর্যায়ের জনগণের আকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে গঠিত সরকার শুরু থেকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসছে অর্থনীতির রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে। এজন্য আওয়ামী লীগ সরকারের আর্থিক লুটপাটের পরিকল্পনাগুলো যাচাই-বাছাই করে সংশোধন, বাতিল ও স্থগিত করেছে। এতে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ক্ষতটিতে মেরামত শুরু হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ব্যাংক খাতও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পেরেছে। ডজনের বেশি ব্যাংকের তারল্য সংকট এখন বলা যায় পুরোটাই পুনরুদ্ধার হয়েছে। টাকা দিতে না পারা ব্যাংকগুলো সমস্যা উতরে গেছে। বড় গ্রাহকদের কিস্তি করে ফেরত দিতে পারছে আমানতের অর্থ।
এমন অবস্থায় ধীরগতিতে চলা অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফেরাতে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় সংসদ নির্বাচন দাবি। দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় দলটি বাংলাদেশ জাতীয়বাদি দল (বিএনপি) এ দাবি করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও অন্য ইসলামী দলগুলো প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যথাসময়ে নির্বাচন দেওয়ার পক্ষে নিজেদের মতামত দিয়েছে। বিএনপির এ সুরের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে প্রতিবেশী ভারতও, যেখানে পালিয়ে রয়েছে শেখ হাসিনা। সেখানে বসেই তিনি বাংলাদেশে চলমান সংস্কারের বিপক্ষে গিয়ে বিএনপি ও কিছু বুদ্ধিজীবী তড়িঘড়ি করে নির্বাচন দেওয়ার পক্ষে তদবির করছে বলে গুঞ্জন রয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
এসব কারণেই নতুন করে বিনিয়োগে যেতে খুবই সতর্ক হয়ে গেছেন ব্যবসায়ীরা, ফলে বিনিয়োগ মন্থর গতিতে চলছে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখে নতুন বিনিয়োগ। দেশের অর্থনীতিতে নতুন বিনিয়োগ দুই ধাপে হয়। প্রথমত, কারখানা সচল রাখতে প্রতিনিয়ত কিছু যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়, মেয়াদ শেষ হয়। এসব বদলাতে আমদানি করতে হয় যন্ত্রাংশ। অন্যদিকে একটি কারখানা সম্প্রসারণ, পুরো মেশিনারিজকে বদলে সক্ষমতা বাড়ানো ও সম্পূর্ণ নতুন প্রকল্প নিয়ে কারখানা স্থাপন।
শেষের বিনিয়োগ চলমান থাকা মানে অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য বা চাঙাভাব রয়েছে। অন্যদিকে প্রথম বিনিয়োগ চলমান থাকা মানে অর্থনীতি ঢিমেতালে চলছে শুধু, কিন্তু সম্প্রসারণ বা বড় হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ভোগ্যপণ্য আমদানি বাড়লেও বিনিয়োগের প্রাণভোমরা মূলধনী যন্ত্রাংশ আমদানি এখনো বাড়েনি।
এর প্রধান কারণ হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা মনে করছেন সরকারের ধারাবাহিকতা নিয়ে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের প্রস্তাবগুলো কতটুকু বাস্তবায়ন করবে। আদৌ করবে কিনা, পরের রাজনৈতিক সরকার এলে সংস্কার হওয়া নীতিগুলোর ধারবাহিকতা থাকবে কিনাÑ এসব প্রশ্ন তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, একটি গ্রুপ বা ব্যবসায়ীরা এক দিনের জন্য বিনিয়োগ করেন না। কমপক্ষে ১০ থেকে ২০ বছরের জন্য বিনিয়োগ পরিকল্পনা করে থাকেন। এর মধ্যে যদি ঘন ঘন সরকারি নীতিমালা বদলে যায়, তাহলে ব্যবসার খরচ উঠানো সম্ভব হয় না। ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়। যার বড় উদাহরণ হচ্ছে, অর্থবছরের মাঝপথে এসে খাদ্যসহ কিছু জরুরি পণ্যে সরকারের ভ্যাট বাড়িয়ে দেওয়া।
বিভিন্ন পর্যায় থেকে আন্দোলনের কারণে সরকার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে। কিন্তু নতুন করে ফের যে আগামী জুন মাসে ভ্যাট ও কর বাড়বে না, তার নিশ্চয়তা নেই। এজন্য নির্বাচনী বিষয়টি অতিদ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট ঘোষণা আসা প্রয়োজন, সংস্কার প্রস্তাব পুরোটা বাস্তবায়ন, অর্থনীতি ও প্রশাসনে তার প্রভাব দেখা ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সংস্কারের বিষয়টি দৃশ্যমান হওয়ার পরই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশে কোনো জাতীয় নির্বাচন হবে না। আর নির্বাচন শুধু একটি রাজনৈতিক দল চেয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষ ও অন্য রাজনৈতিক দলগুলো এখন নির্বাচন চাচ্ছে না।
কেন রোডম্যাপ প্রয়োজন
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির গত তিন মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধীরগতিতে রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এমন আচরণ খুব সহসা করেনি। করোনা মহমারিতে অর্থনীতি এর চেয়ে খুব ধীরগতি দেখা দিয়েছিল। সেই ক্ষত পুরনো হলেও এখনো সারেনি। এখন অর্থনীতির ধীরগতি দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে। এমন শঙ্কা করেছে। এজন্য আর্থিক খাতের অভিভাবক হিসেবে পরিচিত সংস্থাটি পরামর্শ দিয়েছে, অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফেরাতে।
অন্যদিকে সরকার পরিচালনা করতে ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নেও অর্থ প্রয়োজন। এ অর্থের জোগানদাতা হচ্ছে জনগণের দেওয়া ভ্যাট ও কর, যা সংগ্রহ করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফেরালেই সেটি সম্ভব। এজন্য সরকারের কাছ থেকে আগামী ৫ বছরের জন্য একটি রোডম্যাপ দেওয়া আবশ্যক হয়ে দেখা দিয়েছে। এ রোডম্যাপ পেলে ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা একটি আইনি ভিত্তি পাবেন।
বিনিয়োগ পরিকল্পনা করে নতুন হিসাব-নিকাশ করতে পারবেন। ব্যবসায়ীরাও বিদেশি ক্রেতাদের সামনে সেই পরিকল্পনা জানিয়ে দিয়ে নতুন নতুন বিনিয়োগ আনতে পারবেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি আস্থা বৃদ্ধি পাবে। একটি বার্তা যাবে যে, সরকার ব্যবসায়ীদের ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত একটি অর্থনৈতিক পরিবেশ দিতে শুরু করেছে। যেখানে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা খরচ কমে যাবে।
যা থাকবে রোডম্যাপে
গত ১৫ বছরের বেশি সময়ে দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার করে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। উন্নয়নের নামে ২৮ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে আওয়ামী লীগ সরকার, জাতীয় শ্বেতপত্র কমিটি সেই তথ্য দিয়েছে। এসব সম্ভব হয়েছে, নগদ টাকার ব্যবহার বেশি হওয়ায়। অর্থ পাচার করতে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে চলে গেছে ব্যবসায়ীরা। সেই টাকার জোগান দিতে সরকার নতুন করে টাকা ছাপিয়েছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে এখনো পিষ্ট হয়ে আছে সাধারণ মানুষ। এর নেপথ্য কারণ হচ্ছে, নগদ টাকার অবাধ ব্যবহার। পুরো বিশ্ব থেকে আর্থিক খাতের দুর্নীতি, ঘুষ ও চাঁদাবাজি বন্ধ করে কর আদায় জোরদার করার স্বীকৃত উপায় হচ্ছে নগদ টাকার ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া।
রোডম্যাপে সেই বিষয়টি উল্লেখ করে কবে নাগাদ নগদ টাকার ব্যবহার শূন্যে নেমে আসবে, তার একটি পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। এটি হলে দেশের আর্থিক খাতের চিত্রই বদলে যাবে। এছাড়া আগামী ৫ বছরে করহার কেমন হবে, ভ্যাট কোন কোন খাতে কতটুকু থাকবে, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার কোন পর্যায়ে থাকতে পারে, সুদহার কেমন হবে ও জ্বালানি দর এবং সরবরাহ নিয়ে সরকারের পকিল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটি সম্ভাব্য ধারণাপত্র থাকতে পারে। নতুন বিনিয়োগে রাষ্ট্রীয় কী সুবিধা দেওয়া হবে, দেশের অর্থনীতি ও জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া চিহ্নিত ২০টি গ্রুপের অবস্থা সর্বশেষ কী হবে, তাও জানার অপেক্ষায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এটিই ঠিক করবে আগামী দিনের অর্থনীতি কোন পথে যাবে। এজন্য রোডম্যাপ দেওয়ার আগে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক করে আলাপ-আলোচনা করে নেওয়া প্রয়োজন। এভাবেই ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিনিয়োগের আস্থা বৃদ্ধি পাবে।
অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের মতে, দীর্ঘসময়ে টালমাটাল হয়ে থাকা অর্থনীতি এখন অনেকটাই মূল সড়কে ফিরেছে। এখন সেই পথ টেকসই করতে দিতেও একটু সময় প্রয়োজন। এটি কমপক্ষে তিন থেকে চার বছর হওয়া উচিত। এ সময়ে অর্থনীতির সংস্কারের ফল দেখা যাবে। এর আলোকেই আগামী দিনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এজন্য এখনই অর্থনীতির একটি ভিত রচনা প্রয়োজন। এটি এ সরকারই করতে পারবে। অন্যদিকে এক হাজার কোটি টাকার বেশি নির্বাচনী ব্যয় সামাল দেওয়ার অর্থ এখন অর্থনীতির জোগান দেওয়া কষ্টকর। সেই ব্যবস্থাতেও সংস্কার প্রয়োজন। এজন্য সময় নিয়ে, বুঝে ধীরগতিতে নির্বাচনের দিকে যাওয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোকেও বোঝানোর উদ্যোগ নেওয়া যে, গত ১৫ বছরে অর্থনীতির যে ক্ষতগুলো তৈরি হয়েছে, তা ঠিক করা রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এজন্য অর্থনৈতিক রোডম্যাপ প্রয়োজন।