নতুন জবানে ভারতীয় বয়ান
১০ জানুয়ারি ২০২৫ ০০:০০
শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। এতে দেশের মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস নিচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই স্বাধীনচেতা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের হৃদয়জুড়ে ভারত। তারা ব্রাহ্মণবাদী বর্ণ সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠীর পদলেহন করে পুতুল শাসক হিসেবে দেশের মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালানোর দাসখত দিয়েছে। যতবার ক্ষমতায় এসেছে, ততবারই এর প্রমাণ দিয়েছে। এবার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ ও ভারত উভয়ই চরম হতাশ। ভারত ভরসা করতে পারছে না, খুব সহজে আওয়ামী লীগ আবার ফিরে আসতে পারবে। তাই তারা পাগলের মতো নতুন দাস খুঁজতে ব্যস্ত। যে বয়ান তৈরি করে তারা এতদিন বাংলাদেশের মানুষকে শাসন করেছে, সেই প্রশ্নপত্র আগ্রহীদের কণ্ঠে বসিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ভারত তার গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ এন্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) অধীনে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে নতুন দাস হিসেবে স্বীকৃতি এবং ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশের রাজনীতিতে ইতোমধ্যে সেই লক্ষণ সুস্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
কী সেসব লক্ষণ
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে কী সেসব লক্ষণ- ১. ভারতের শেখানো জাতীয় সংহতি নষ্ট করার বয়ান, যা চালানো হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বয়ান হিসেবে। ২. দলের প্রতিষ্ঠাতার আদর্শ ভুলে ১৯৭২-এর সংবিধানের জন্য কান্না। ৩. দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান। ৪. সমমনা মিত্রদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার। ৫. পতিত ফ্যাসিবাদীদের পুনর্বাসনের অপতৎপরতা। উল্লেখিত বিষয়গুলো উদাহরণসহ তুলে ধরার আগে বয়ান কী কীভাবে জনমত গঠনের মাধ্যমে আবার ভারতীয় আধিপত্যবাদ ফিরিয়ে আনার পথ তৈরি করে, যা জানা দরকার।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, রকেটের চেয়ে দ্রুতগতিতে চলে মানুষের মন। তাই আগ্রাসী ও আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো কোনো জাতিকে গোলামে পরিণত কবার আগে চিন্তা-চেতনা ও মননে আঘাত হানে। সেখানে আঘাত কোনো বস্তুগত অস্ত্র দিয়ে করা সম্ভব নয়। আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো এ কাজে যে অস্ত্র ব্যবহার করে, তার নাম ‘বয়ান’। সংবাদমাধ্যম বা মিডিয়াকে ব্যবহার করে চিন্তা চেতনা ও মননে আঘাত করে ঈমান বা বিশ্বাসে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়। তারা মন্তব্য প্রতিবেদন, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গল্প কবিতা, গান, নাটক, সিনেমার মাধ্যমে তাদের বয়ান ছড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বয়ান সম্প্রচারের অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম। এর মোকাবিলা নিজস্ব শক্তিশালী বয়ান তৈরি এবং উল্লেখিত মাধ্যম বা মিডিয়া ব্যবহার করেই সম্ভব।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল। শুরু থেকেই ভারতের সাম্প্রদায়িক বর্ণহিন্দু নেতারা পাকিস্তানের স্বাধীন অস্তিত্ব মেনে নিতে পারেনি। তারা কথিত ধর্মনিরপেক্ষতার বয়ান তৈরি করে বাঙালি সংস্কৃতির নামে পৌত্তলিকতা চাপিয়ে দিয়ে পূর্ব বাংলার মুসলানদের ঈমান বা বিশ্বাসে ফাটল ধরায় এবং চিন্তার বিভ্রান্তির বীজ রোপণ করে। ইতোপূর্বে এ প্রতিবেদকের একাধিক লেখায় এ কথা তুলে ধরা হয়েছে, সদ্য পতিত আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের লক্ষ্য ছিল ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে দেশ গড়া। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক জেল থেকে ফেরার পর গুম হন। কে বা কারা করেছিল, তা সেই সময় কেউ বুঝতে না পারলেও শেখ মুজিবের হাত ধরে আওয়ামী লীগের বাঁকবদল এবং ভারতের চক্রে পড়ে কথিত ধর্মনিরপেক্ষতার নামে তাদের পৌত্তলিক আদর্শ গ্রহণ করায় বিষয়টি এখন অনেকটা পরিষ্কার। তারপরের ইতিহাস কারো অজানা নয়। ক্ষমতায় থেকে এবং ক্ষমতার বাইরে থেকে উভয় অবস্থায়ই আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদ ও সন্ত্রাসবাদকেই তাদের রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছে। দেশের জনগণ রক্তের বিনিময়ে তাদের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের পতন ঘটিয়ে স্বাধীনতার নতুন সূর্য ছিনিয়ে এনেছে। এতেই অস্থির হয়ে পড়েছে ভারত। তারা আওয়ামী লীগের বিকল্প খুঁজছে মরিয়া হয়ে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, ফ্যাসিবাদের সেই শূন্যস্থান পূরণে মরিয়া হয়ে উঠেছে দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল। ভারতের শেখানো আওয়ামী বয়ান এখন তাদের জবানে শোনা যাচ্ছে।
ভারতের শেখানো আওয়ামী বয়ান অন্য জবানে
ভারতের শেখানো জাতীয় সংহতি নষ্ট করার বয়ান: ১৯৭১ পক্ষ-বিপক্ষ বিষয়টি মীমাংসা হয়ে গেছে সেই ১৯৭২ সালের ২-৩ জুলাই এ দুদিনব্যাপী আলোচনার পর ছিল শিমলা চুক্তির স্বাক্ষর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ সেই শর্ত ভঙ্গ করে ভারতের আধিপত্যবাদীদের পরামর্শে। তারা ১৯৭১ সালে কার কী ভূমিকা, সেই বিতর্ক জিইয়ে রেখেছিলো অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়। ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবে ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’। স্লোগানের মাধ্যমে ছাত্র-জনতা তার কবর রচনা করেছে। কিন্তু ভারতের প্রিয়ভাজন সেবাদাস হওয়ার দৌড়ে জিততে একটি বড় দলের প্রথম সারির কয়েকজন নেতা বলতে শুরু করেছেন, ‘১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে… রাজনৈতিক ভূমিকা কী ছিল, কোনো সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।’
অথচ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম গত ১৫ ডিসেম্বর রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আয়োজিত আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আওয়ামী লীগ শুধু ব্যবসা করেছে, তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল নয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল হলো মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের দল।’ পর্যবেক্ষকদের প্রশ্ন হলোÑ আওয়ামী লীগের সেই চেতনার নতুন এজেন্ট যারা সাজতে চাচ্ছেন, তারা কি ভারতের বি-টিম হিসেবে নিজেদের অবস্থা পাক্কা করার অব্যর্থ চেষ্টা করছেন। অথচ জনগণ অতীত নয়, বর্তমানের পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক শক্তিকে সাথে নিয়ে দেশ গড়তে চায়। তারা চায় কাদা ছোড়োছুড়িমুক্ত রাজনৈতিক বিতর্ক। যাতে জাতীয় ঐক্য নষ্ট হবে না, গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে। তারা চায় জনগণের পক্ষের কথা শুনতে। চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক নেতাদের বলিষ্ঠ অবস্থান চায় জনগণ।
দলের প্রতিষ্ঠাতার আদর্শ ভুলে ১৯৭২-এর সংবিধানের জন্য কান্না: ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র ও এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ চেতনার বিরোধী। বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব আবুল ফতেহ মনে করেন, বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা একটি বাধ্যতামূলক নীতি হিসেবে ভারতীয় প্রভাব থেকে এসেছে।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে শহীদ রাষ্ট্রপতি মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম ও আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা এবং সম্পদের সুষম বণ্টন ও বৈষম্যমুক্ত অর্থে সমাজতন্ত্রসহ বেশকিছু বিষয় সংযুক্ত করে মূলধারায় ফিরিয়ে এনেছিলেন।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান : ইসলামী ওয়াজ-মাহফিলে বাধা সৃষ্টি এবং বক্তাদের বক্তব্যকে রাজনৈতিক দলের ট্যাগ দেয়ার চেষ্টাও ভারতীয় এজেন্ডার অংশ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। অথচ ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের অনেক নেতার জবানে এখন এমন কথা শোনা যাচ্ছে।
সমমনা মিত্রদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার : আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ফিরিয়ে আনতে ভারত তার গোয়েন্দা সংস্থাকে মাঠে নামিয়েছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী সমমনা দলগুলোর মধ্যে ফাটল ধরাতে। তাদের সেই ষড়যন্ত্র ক্ষমতার লোভে অনেক রাজনৈতিক দল ও নেতা লুফে নিচ্ছে।
পতিত ফ্যাসিবাদীদের পুনর্বাসনের অপতৎপরতা: পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের তৎপরতায় যারা তৎপর, তারা আর পর্দার আড়ালে নেই বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। কারণ সচেতন জনগণ যারা হাসিনার মতো স্বৈরাচারকে হটিয়েছে, তারা খুব ভালো করেই বুঝে কার জবানে ভারতীয় বয়ান বিবৃত হচ্ছে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আধিপত্যবাদ থেকে মুক্ত হতেই হবে। কারণ আধিপত্যবাদ মেনে নেয়া মানে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দেয়া। দেশ ও জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে ভারতীয় আধিপত্য মেনে নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার দুঃস্বপ্ন যারা দেখছেন, তারা হয়তো হাসিনার পরিণতি থেকে শিক্ষা নেননি। ভারত হাসিনাকে রক্ষা করতে পারেনি, জনগণেরই বিজয় হয়েছে। এ বিজয় রক্ষা করতে জনগণের ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে লড়াই অব্যাহত রাখবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্য অতন্দ্রপ্রহরীর ভূমিকায় সদা জাগ্রত আছে বাংলাদেশের কোটি কোটি তরুণ।