উন্নয়ন চাইলে দুর্নীতি দমন করতে হবে

উসমান ফারুক
১০ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:০০

ভ্যাট বৃদ্ধি নয়, বরং পুনর্বাসনে সহযোগিতা প্রয়োজন দেশপ্রেমিক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের

দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাকের বড় কারখানাগুলোর একটির উদ্যোক্তা রেদওয়ান আহমেদ দেশে ফিরেছেন গত আগস্ট মাসে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর। এক যুগ আগে যখন বিএনপির এ সাবেক নেতা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন, তখন ৩০ কোটি টাকা বেতন পরিশোধ করে সচল চারটি কারখানা বন্ধ করতে হয়। তার রাজনৈতিক পরিচয়কে ব্যবহার করে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন, দেশ ছাড়েন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি দেশে ফিরে ব্যবসায় ফেরার চেষ্টা করছেন। রেদওয়ান আহমেদ তৈরি পোশাক খাতের কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতিও। এখন নতুন করে কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন কিনা, সেই ভাবনা ঘিরে ধরেছে তাকে।
চট্টগ্রামের হিমায়িত মাছ রপ্তানিকারক সোলাইমান ১৩ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ মঞ্জুরের পরও ছাড় করাতে পারেননি। রাজনৈতিক মামলায় সর্বস্বান্ত হয়ে দেশ ছাড়েন কারখানা ফেলে রেখে। দীর্ঘ ১২ বছর পর দেশে ফিরে জানতে পারেন ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে নেওয়া ৩ কোটি টাকার ঋণ এখন কয়েকগুণ বেড়েছে। নতুন করে শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানটি সচল করতে প্রয়োজন অন্তত ৩০ কোটি টাকার ঋণ। দেশে এসে এখন ব্যাংকের পেছনে ঘুরছেন অবকাঠামো ও জমি বন্ধক রেখে ঋণ পেতে।1
বিদেশে না গেলেও ধানমন্ডির নিজের বাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আত্মাগোপনে থাকতে হয়েছে ওষুধ খাতের উদ্যোক্তা আনিসুর রহমানকে। হাতছাড়া হওয়া কারখানা ফিরে পেতে এখন চেষ্টা করছেন তিনি। রেদওয়ান আহমেদ, আনিসুর ও সোলাইমানের মতো ওষুধ, আবাসন, নির্মাণ, প্রযুক্তি, ভোগ্যপণ্য, সিমেন্ট, বস্ত্র খাতের শত শত ব্যবসায়ী শুধু রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে ব্যবসা করতে পারেননি গত দেড় দশকে।
তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশের মতো প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মীদের লেলিয়ে দিয়ে ব্যবসা গুটাতে বাধ্য করা হয়। নিত্যনতুন উপায়ে দাবিকৃত চাঁদা দিয়েও দেশে থাকতে পারেননি তারা। ব্যবসা বন্ধ করে চলে যেতে হয়েছে আত্মগোপনে। এভাবে স্বৈর শাসকের গত ১৫ বছরের বেশি সময়ে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় লাখ লাখ পরিবারের ব্যক্তিরা কর্মসংস্থান হারায়।
গত জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে দেশ নতুন করে গণতন্ত্রের পথে হাঁটা শুরু করলে বিদেশে চলে যাওয়া ও আত্মগোপনে থাকা উদ্যোক্তরা ব্যবসায় ফিরতে শুরু করেছেন। তারা বলছেন, এখন নীতি সহায়তা দিতে পারলে সচল করতে পারবেন কারখানাগুলো। তৈরি হবে লাখ লাখ ব্যক্তির কর্মসংস্থান। এজন্য প্রয়োজন বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নীতি সুবিধা।
ব্যাংক ও এনবিআরের বকেয়া পাওনা কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ। তারা বলছেন, সরকার যদি এনবিআরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের চুরি বন্ধ করতে পারলে নীতিসহায়তা দেয়ার পরও রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থাকবে না। নতুন করে মূসক বা ভ্যাট হার না বাড়িয়ে আদায় সহজ করা প্রয়োজন।
মূসক হার বাড়ালে তা শেষ পর্যায়ে সাধারণ ভোক্তাকেই দিতে হয়। এতে ব্যবসার খরচ ও পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতির চাপে বাংলাদেশকে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতির দায় এখন দেশের জনগণকে বহন করতে হচ্ছে। তার ওপর মূসক হার বাড়লে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে গিয়ে জনপ্রিয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপদে ফেলতে পরিকল্পনা করছে সাবেক সরকারের রেখে যাওয়া আমলারা। এখন ব্যবসায়ীদের নীতিসুবিধা দিয়ে অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফেরানোর সময়। ভিন্নমতের ব্যবসায়ীরা কারখানা সচল করতে পারলে সেই কাক্সিক্ষত পরিবেশ ফিরে আসবে।
নতুন করে ভ্যাট নয়, বন্ধ করতে হবে চুরি
আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থ পাচারের কারণে ডলার সংকট সামাল দিতে ঋণ চুক্তিতে যাওয়ার পরে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আর্থিক খাতে সংস্কার ও বাজেট ঘাটতি কমাতে শর্তটি দেয় তারা। সেই শর্তের মধ্যে রয়েছে মূসক বা মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানোর। সব পণ্যে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে তারা। শর্ত মানতে গিয়ে ৪৩টি পণ্যে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসানোর পরিকল্পনা করেছে এনবিআর। যেগুলোয় বর্তমানে ভ্যাট ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ।
এর আগেও ২০০৭ সালে একই প্রস্তাব দিয়েছিল আইএমএফ। তখন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ছিলেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি জাতীয় গণমাধ্যমে ২০১৭ সালে সেই ঘটনার স্মৃতি আওড়িয়ে বলেছিলেন, আইএমএফের সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা এখনো প্রস্তুত হইনি এক হারে মূসক দিতে।
তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে সমঝোতার মাধ্যমে মূসক হার ঠিক না করা হলে জটিলতার তৈরি হবে। আমাদের একটি হারে মূসক নিতে হবে, কিন্তু এখনো প্রযুক্তি ও দক্ষতায় সেই অবস্থানে যেতে পারিনি। মূসক হতে হবে রেয়াতিভিত্তিক। যে পণ্য উৎপাদন হচ্ছে, এর ওপর মূসক নির্ধারিত হবে। তবে ওই পণ্য বানাতে কাঁচামাল কেনার সময় যে মূসক দেয়া হয়, তা চূড়ান্ত হিসাব করার সময়ে বাদ দিতে হবে। অর্থাৎ এই মূসক-ব্যবস্থা পুরো হিসাব-নিকাশের ওপর নির্ভর করে। এখন ব্যবসায়ীদের যদি হিসাব ঠিক না থাকে, তবে আরও জটিলতা তৈরি হবে।
সব পর্যায়ে ১৫ শতাংশ মূসক অনেক দেশের তুলনায় বেশি মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমাদের সার্বিক মাথাপিছু আয়ও কম। আর মূসক শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপরই পড়ে। তাই মূসক হার ১০ শতাংশ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এনবিআরের নতুন মূসক হার বাস্তবায়ন করলে হোটেল, রেস্তোরাঁ ও পোশাকের দাম বেড়ে যাবে। বর্তমানে সাধারণ মানের এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) রেস্তোরাঁয় খাওয়ার জন্য ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয় ভোক্তাকে। মূসক আদায়ে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান খাবারের সঙ্গে মূসক যোগ করে দাম ঠিক করে রাখে। ভোক্তা মূসক দিলেও অনলাইন চালান না হওয়ায় হোটেলগুলো সরকারি কোষাগারে তা জমা দেয় না। এতে হোটেল মালিকের পকেটে চলে যায় ভোক্তার দেওয়া মূসক। নতুন করে এটি বেড়ে সাড়ে ৭ শতাংশ হতে পারে।
এছাড়া নন-এসি হোটেলের ভ্যাট ৭.৫ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ করে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আর স্থানীয় ব্র্যান্ডের পোশাকের ওপর বর্তমানে ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। এটিও দ্বিগুণ হতে পারে। শুধু ব্র্যান্ডেড নয়, সাধারণ মানের যেকোনো পোশাক কিনলেই ক্রেতাদের এ হারে ভ্যাট পরিশোধ করতে হতে পারে।
ওষুধ, ব্যবসায়ও ভ্যাট বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কেনার ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ ট্রেড ভ্যাট কার্যকর আছে, সেটি ৭.৫ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সাবান, ডিটারজেন্ট, পেইন্ট, সুপারি ও আরও ৭টি পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপর বর্তাবে।
দেশের ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা রাষ্ট্রীয় সব সেবায় কর দিতে আগ্রহী। এনবিআরের কর্মকর্তাদের হয়রানি থেকে বাঁচতে অনেকেই কর দিতে চায় না। তার প্রমাণ হচ্ছে, আয়কর রিটার্ন অনলাইনে দাখিলের সুযোগ দেয়ার পর গত এক বছরে তা দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে আসছেন, প্রতিষ্ঠানের কর ও শুল্ক বাবদ সরকারি যে হার ঠিক করা হয়, তার একটি অংশ নগদ হিসেবে ঘুষ দিতে হয় এনবিআরের একশ্রেণির কর্মকর্তাদের। এটি না দিলে হয়রানির শিকার হন তারা। আবার ঘুষের অংক পছন্দ না হলে পণ্য আটকে দেয়া হয় বন্দরে। কর্পোরেট কর দিতে গেলেও একই অবস্থা। যে পরিমাণ কর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যায়, তার অন্তত এক-তৃতীয়াংশ চলে যায় কর্মকর্তাদের পেছনে।
অন্যদিকে ঘুষের এ অংক কখনো কখনো মূল করের তিনগুণ পর্যন্ত বেশি হয়। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার বিনিময়ে সরকারি কর হার কমিয়ে দেয় কর্মকর্তারা। এতে প্রকৃত করের চেয়ে অনেক কম অর্থ জমা পড়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। এভাবে প্রতি বছরই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতিতে পড়ে আছে বাংলাদেশ। বছর ঘুরলেই ঘাটতি আদায়ে নিয়মিত কর দিয়ে আমাদের ওপর নতুন করে কর হার বাড়িয়ে চলছে আমলারা। অথচ কর দেওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে কোনো মনোযোগ নেই এনবিআরের।
এনবিআরের কর্মকর্তাদের ঘুষ নেয়ার ওপর একটি জরিপ চালানো হয়েছিল ২০২৩ সালে। শুধু এসএমই খাতের ব্যবসায়ীরা কোনো ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যান, তা জানতে গবেষণা জরিপটি করেছিল সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলা হয়, এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা) খাতে ব্যবসা পরিচালনায় ৭৭.৯ শতাংশ ব্যবসায়ীকে ঘুষ দিতে হয়। আর ব্যবসায়ীদের ৬০.১ শতাংশ রাজনৈতিক প্রভাব এবং ৪৬.৩ শতাংশ চাঁদাবাজির শিকার।
হার বাড়ানোর চেয়ে এনবিআরের আদায় সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কর আদায়ে ড্রেনেজ হচ্ছে। সেই ফুটো বন্ধ করতে সৎ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে হবে। দুর্নীতির ফুটো বন্ধ করলেই উন্নয়নের ফুল ফুটবে। ব্যবসা সহজ করতে হবে ব্যবসায়ীদের জন্য। আগের সাড়ে ১৫ বছরে দুর্নীতি লুটপাটের সহযোগীরা এখন ব্যবসা করবে না। যাদের বিএনপি-জামায়াত বলে অর্থনীতি থেকে দূরে রাখা হয়েছিল, নতুন ভ্যাটের খড়গ পড়বে তাদের ওপর। এতে অর্থনীতি নতুন করে সংকটের মুখে পড়ে যেতে পারে। ফিরবে না অর্থনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্য। পুরনো ব্যবসায়ীদের যারা রাজনৈতিক মতপার্থক্যর কারণে ব্যবসা করতে পারেনি, তাদের পুনর্বাসন করার সময় হয়েছে। তাদের ব্যবসায় ফেরাতে পারলে গতি পাবে অর্থনীতি। সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে চাইলে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হবে।