ঐকমত্যের ভিত্তিতেই হোক বিপ্লবের ঘোষণাপত্র
১০ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:০০
এক অস্থির সময় পার করছে বাংলাদেশ। দেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ব্যক্তি। শুধু তাই নয়, তিনি একজন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ব্যক্তি। তেমন একজন অরাজনৈতিক কিন্তু পণ্ডিত হিসেবে জগদ্বিখ্যাত ব্যক্তি বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশের হাল ধরেছেন। বিপ্লবের পর মাত্র ৫ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে প্রো-ইন্ডিয়ান এবং আওয়ামী লীগের উচ্ছিষ্টভোগীরা ছাড়া ভারত ও আওয়ামীবিরোধী শক্তিসমূহের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া শুরু করেছে। একদিকে ইউনূস সরকারের সাথে বিএনপির দূরত্ব; অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথেও বিএনপির দূরত্ব। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে দ্বিতীয় রাজনৈতিক শক্তি হলো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সেই জামায়াতের সাথেও বিএনপির দূরত্ব ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান। এমন একটি জটিল কিন্তু বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারকে দিয়েছে আলটিমেটাম। আলটিমেটামে বলা হয়েছে যে, আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে বিপ্লবের ঘোষণাপত্র বা প্রোক্লামেশন অব রেভ্যুলেশন জারি করা না হলে বিপ্লবী ছাত্ররা নিজেদের পথ বেছে নেবে। বিপ্লবের এ প্রোক্লামেশনের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। আপাতদৃষ্টে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত হওয়ার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সম্ভবত আগামী ১৫ জানুয়ারি বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা শহীদ মিনারে একটি বড় সমাবেশ করবেন। কী হবে সেই সমাবেশে? কী বলবেন তারা সেই সমাবেশে? এসব প্রশ্ন এখন শুধুমাত্র রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মাঝেই নয়, শিক্ষিত সচেতন সাধারণ মানুষকেও আলোড়িত করছে। শিক্ষিত সচেতন মানুষসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দের চোখ এখন আগামী ১৫ জানুয়ারির দিকে। তবে জনগণের প্রত্যাশা ঐকমত্যের ভিত্তিতেই হোক বিপ্লবের ঘোষণাপত্র।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কয়েকদিন আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষণা করেছিল, গত বছরের শেষ দিনে অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের প্রোক্লামেশন বা ঘোষণাপত্র ঘোষণা করা হবে। এ ঘোষণাপত্রের বিরোধিতা করে বিএনপি। ৩১ ডিসেম্বরের দুদিন আগে রাত ৮টার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় ড. ইউনূসের সাথে দেখা করেন। সেখানে তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে স্পষ্ট বলে দেন- আলোচ্য প্রোক্লামেশন বিএনপি সমর্থন করে না। বিএনপি চায়, ছাত্ররা ঐ প্রোক্লামেশন জারি থেকে বিরত থাকুক। বিএনপি মহাসচিবের এ অবস্থানের পর ড. ইউনূস বুঝতে পারেন, আওয়ামী এবং ভারতবিরোধী শিবিরে অনৈক্য সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা শুরু থেকে বলে আসছেন, তিনি যা কিছুই করবেন, সকলের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই করবেন। মির্জা ফখরুলের এ অবস্থানের পরদিন প্রধান উপদেষ্টার তরফ থেকে তার প্রেস সচিব এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সরকার নিজেই একটি প্রোক্লামেশন দেবে। তবে সেই প্রোক্লামেশন দেওয়ার আগে প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে কথা বলবেন। অতঃপর ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি প্রোক্লামেশন জারি করা হবে।
সরকারের এ ঘোষণা বৈষম্যবিরোধীদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে। কারণ ৩১ ডিসেম্বরের সমাবেশের জন্য যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং তাদের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটি। এখানে আরো উল্লেখ করা যেতে পারে যে, জাতীয় নাগরিক কমিটি বৈষম্যবিরোধীদের পলিটিক্যাল প্ল্যাটফর্ম হলেও এটি তাদের রাজনৈতিক দল নয়। গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, নাগরিক কমিটি নয়, তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছেন। এই দল গঠনের কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
যাই হোক, সরকারের আলোচ্য বিবৃতির পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা এবং নাগরিক কমিটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে। কারণ পরের দিনের সমাবেশে যোগদান করার জন্য নাইট কোচে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তাদের সমর্থকরা ঢাকায় রওনা হন। এ অবস্থা সরকারে অন্তর্ভুক্ত তিন ছাত্র উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ এবং মাহফুজ আলমকেও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে। ৩০ ডিসেম্বর রাত ১০টার পর দুই ছাত্র উপদেষ্টা নাাগরিক কমিটির কাওরানবাজার অফিসে আসেন। উপদেষ্টারা নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী নেতাদের বলেন যে, যদি আগামীকাল (৩১ ডিসেম্বর) প্রোক্লামেশন জারি হয় এবং সেটিকে কেন্দ্র করে যদি বিএনপির সাথে একটি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সবচেয়ে বড় বিপদে পড়বেন। সেক্ষেত্রে তিনি সরকার থেকে সরেও যেতে পারেন। পক্ষান্তরে বৈষম্যবিরোধীরা বলেন, যদি প্রোক্লামেশন না দেওয়া হয়, তাহলে তাদের জন্যও খুব বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। সেক্ষেত্রে তারাও মাঠ ছেড়ে যেতে পারেন।
এমন একটি ত্রিশঙ্কু অবস্থায় পড়ে দুই উপদেষ্টা এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও নাগরিক কমিটি একটি মধ্যমপন্থা বের করেন। এ পন্থা অনুযায়ী ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে সমাবেশ ঠিকই হবে। তবে ঐ দিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর কোনো প্রোক্লামেশন ঘোষণা করা হবে না। তদনুযায়ী উপদেষ্টারা ফিরে যান এবং ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সমাবেশে বৈষম্যবিরোধীদের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ সরকারকে একটা আলটিমেটাম দেন। তিনি ঘোষণা করেন, আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে যদি সরকার প্রোক্লামেশন জারি না করে, তাহলে পরবর্তীতে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।
গত ৪ জানুয়ারি শনিবার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের তরফ থেকে বলা হয় যে, প্রোক্লামেশন জারির কোনো তৎপরতা’ এমনকি কোনো প্রাথমিক তৎপরতাও দৃশ্যমান নয়। এ পরিস্থিতিতে তারা ৬ থেকে ১১ জানুয়ারি- এ ৬ দিন সারা দেশব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই ৬ দিন বৈষম্যবিরোধী নেতৃবৃন্দ এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা সফর করবেন এবং সম্ভব হলে উপজেলা পর্যায়েও সফর করবেন। সর্বত্র তারা প্রোক্লামেশনের সপক্ষে জনমত সৃষ্টি করবেন। একই সাথে তারা কমিটিও করে যাচ্ছেন। এসব কমিটি গঠনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো নতুন রাজনৈতিক দল গঠন। নতুন দল গঠনের লক্ষ্যে নাগরিক কমিটি এ পর্যন্ত সারা দেশে ১৬০ টি প্রতিনিধি কমিটি গঠন করেছে বলে পত্রিকান্তরের খবরে প্রকাশ। ঐ বাংলা সহযোগী সোমবার ৬ জানুয়ারি তাদের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত লিড নিউজের শিরোনাম করেছে, ‘২৪ দফার ইশতেহার নিয়ে সামনে আসছে তরুণদের দল’। বলা হয়েছে যে, যেহেতু বিপ্লব বা অভ্যুত্থান ঘটেছে ২৪ সালে, তাই নতুন দলের মেনিফেস্টোতেও থাকছে ২৪ দফা।
সম্ভবত এসব ডেভেলপমেন্টই বিএনপির মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। তারা দ্রুত নির্বাচনের জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে ৫ আগস্ট। আর ৭ আগস্টেই বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করে। এই সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান। এই সমাবেশ থেকে ৩ মাসের মধ্যে নির্বাচন দাবি করা হয়। তবে বিএনপি শিগগিরই বুঝতে পারে যে, ৩ মাসের মধ্যেই নির্বাচন দাবি করাটা অপরিপক্ব পদক্ষেপ হয়েছে। তাই তারা ৩ মাস বাড়িয়ে ৬ মাস করে। এখন তারা ৬ মাসের কথা বলছে না। কিন্তু তারা চাচ্ছে নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ। তারা আশঙ্কা করছে যে, প্রতিটি বিপ্লব বা অভ্যুত্থান নতুন দল বা নতুন নেতা সৃষ্টি করে। তারা সাথে সাথেই জনপ্রিয় হয়ে যায় এবং পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ করে।
৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিল প্রধানত বিএনপি এবং ছাত্রদল। ৯১-এর নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব আসলে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়নি। যদি নেতৃত্বের কথা ওঠে, তাহলে কঠিন সত্য হলো এই যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ঐ অভ্যুত্থান ঘটে, যে অভ্যুত্থানে শেষের দিকে সব রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন তাদের দলীয় পরিচয় পাশে রেখে যোগ দেয়। কিন্তু ঢাকাসহ সারা দেশ দেখতে পায়, এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এখন তারা যদি কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করে, তাহলে আগামীতে যে নির্বাচন হবে, সে নির্বাচনে তারা জয়লাভ করতে না পারলেও একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে উত্থিত হবে। এমনও হতে পারে যে, সেটি হবে একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট। সেখানে কে কার সাথে জোট বাঁধে, তার ওপরই নির্ভর করবে পরবর্তী সরকার গঠন।
এখানেই বিএনপির সাথে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস প্রভৃতি দলের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে।
ড. ইউনূস সরকার গঠিত হয়েছে সংবিধানবহির্ভূত পন্থায়। গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব কোনোদিন সংবিধানের পথ ধরে আসে না। কিন্তু সরকার গঠনের পর এ সরকার দেশে বিদ্যমান সংবিধানের মধ্যে ঢুকে গেছে। এটি নিয়ে আগামীতে একটি বিরাট জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। সেজন্যই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং নাগরিক কমিটি বিপ্লবের ঘোষণাপত্র বা প্রোক্লামেশন অব রেভ্যুলেশন জারি করতে চায়। সেটি করতে পারলে বলা হবে যে বিপ্লবী সরকার যা কিছুই করবে, সেটিই বৈধ হবে। কারণ সরকারের ক্ষমতার উৎস হলো সার্বভৌম জনগণ। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। এ দিকটা খেয়াল রেখেই বৈষম্যবিরোধীরা এবং নাগরিক কমিটি প্রোক্লামেশনের ওপর এত জোর দিচ্ছে। পরিস্থিতির নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ এবং নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া খবর থেকে মনে হচ্ছে যে, বৈষম্যবিরোধীরা এবং নাগরিক কমিটি প্রোক্লামেশনের দাবি থেকে সরে যাবে না। আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে সরকার যদি প্রোক্লামেশন জারি না করে, তাহলে ছাত্ররাই একতরফাভাবে সেই প্রোক্লামেশন জারি করবে। সেই প্রোক্লামেশনকে ভয় পাচ্ছে বিএনপি। তাই তারা ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথাবার্তা বলছে।
তবে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির বিরুদ্ধে কোনো নেতিবাচক কথা বলেনি। তারপরও জামায়াতের সমালোচনা করতে গিয়ে বিএনপি আওয়ামী লীগের ভাষায় কথা বলছে। তবে ভালো দিক হলো এই যে, জামায়াত বিএনপির বিরুদ্ধে কোনো নেতিবাচক ভাষা ব্যবহার করছে না। তারা দেশব্যাপী তাদের দলীয় আদর্শ প্রচার করার জন্য জনসভা এবং সমাবেশ করে যাচ্ছে। এসব সমাবেশে হাজার হাজার; এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে লাখ লাখ লোক হচ্ছে। আর এ অবস্থা বিএনপির মধ্যে অস্থিরতার সৃষ্টি করছে।
এ সবকিছুর একটি স্পষ্ট দিকদর্শন পাওয়া যেতে পারে ১৫ জানুয়ারিতে, যদি এর মধ্যে সরকার নিজ থেকে কোনো প্রোক্লামেশন জারি না করে।