ঘুষ ও চাঁদাবাজি কমছে না || বন্ধে করতে প্রয়োজন যৌথ উদ্যোগ

ফেরদৌস আহমদ ভূইয়া
১০ জানুয়ারি ২০২৫ ০০:০০

বাংলার এ ভূখণ্ডের সাধারণ মানুষের ভাগ্যটা এতটাই খারাপ যে, তারা বিগত দিনে সুখ-শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তা বলতে যা কিছু আছে তার নাগাল পাইল না। বিগত পাঁচ দশক ধরে বার বার তারা রক্ত দিল জীবন দিয়ে কত সংগ্রাম ও আন্দোলন করল, কিন্তু তারা না পাইল ব্যক্তিগত সুখ-সমৃদ্ধি শান্তি ও নিরাপত্তা আর না পাইল একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। এদেশের মানুষ ১৯৭১ সালে রক্ত দিল, জীবন দিল, ১৯৯০ সালে রক্ত দিল, আবার ২০২৪ সালে এসে কয়েক হাজার ছাত্র-যুবক, শ্রমিক-জনতা জীবন দিল, আহত হলো। এভাবে বার বারই জীবন দিচ্ছে, রক্ত দিচ্ছে কিন্তু তাদের কাক্সিক্ষত সমাজ সরকার ও রাষ্ট্র পাচ্ছে না। ১৯৭১ সালে জীবন দিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ল, কিন্তু যে উদ্দেশ্যে নতুন একটি দেশ গড়েছিল, তা পায়নি। এককথায় বিগত ৫৩ বছর যাবৎ এদেশের মানুষ একদল দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসী মানুষের দ্বারা অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তারা নির্বিঘ্নে শান্তিতে বাস করতে পারেনি। বিগত পাঁচ দশক ধরেই সাধারণ মানুষ দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের ঘুষ-চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়েই জীবন অতিবাহিত করছে। সাধারণ জনগণ একটি সুখী-সমৃদ্ধ নিরাপদ রাষ্ট্র গড়তে প্রতিবারই জীবন দিয়েছে, রাজপথে রক্ত দিয়েছে। প্রতিবারই রাষ্ট্রটি এমন একদল লোকের কাছে বন্দী হয়ে যায়, যারা দেশের সাধারণ মানুষকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশে উঁচু-নিচু, আমলা-কামলা, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, কৃষক-শ্রমিক যে মহলই বলেন না কেন, ঘুষ দিতে বাধ্য হয়নি এমন কোনো ব্যক্তি বা পরিবার বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ ঘুষ বাণিজ্য যে পাঁচ দশক আগে থেকে শুরু হয়েছে, তা বন্ধ না হয়ে অব্যাহত রয়েছে এবং তা কমার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
ঘুষ ও চাঁদাবাজির কাগজে-কলমে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এসব অনৈতিক কাজে কোনো প্রমাণ পাওয়া যাবে- এমন প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়েই ঘুষখোর ও চাঁদাবাজরা ঘুষ ও চাঁদা নেয়ার কাজটি করে থাকে। ঘুষের কাজটা সবসময়ই গোপনে হয়ে থাকে অবশ্য চাঁদাবাজিটা এতটা গোপনে করা সম্ভব হয় না। তবে বাংলাদেশে ঘুষের কাজটাও প্রায় প্রকাশ্যেই চলছে। বিশেষ বড় ধরনের ঘুষের লেনদেনটা অত্যন্ত সংগোপনেই হয়ে থাকে।
তারপরও বিভিন্নভাবে এসব ঘুষ লেনদেন ও চাঁদাবাজির বিষয়টি শেষ পযন্ত প্রকাশ হয়ে পড়ে। লোকমুখে জানাজানি হওয়ার পাশাপাশি গণমাধ্যমে কোনো কোনো সময় খবরও প্রকাশিত হয়ে পড়ে। তন্মধ্যে ঘুষ নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো, কালবেলা ও অনলাইন পত্রিকা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত তিনটি খবর এখানে তুলে ধরা হলো।
‘ঘুষ ছাড়া কাজ করেন না সাব-রেজিস্ট্রার মেহেদী’ এ শিরোনামে কালবেলা পত্রিকা গত ২৫ অক্টোবর এ খবরটি প্রকাশ করে। খবরটিতে বলা হয়েছে, ভোগান্তির আরেক নাম গাইবান্ধা জেলা রেজিস্ট্রার অফিস। এ অফিসে সেবা নিতে এলেই নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। প্রতিটি দপ্তরে ঘুষ দিয়েও মাসের পর মাস এ অফিসের বারান্দায় বসে থেকে সময় পার করছেন জেলার শত শত মানুষ। তবুও মিলছে না কাক্সিক্ষত সেবা। এমন অভিযোগ সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষদের। অন্যদিকে দলিল লেখকদের অভিযোগ, বর্তমান খণ্ডকালীন অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত সদর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার মেহেদী হাসান ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ করেন না। শুধু ঘুষ দিলেই কাজ করেন, না দিলে করেন নানা টালবাহানা। এতে হয়রানি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
জানা যায়, গাইবান্ধা জেলায় নিয়মিত সদর সাব-রেজিস্ট্রার না থাকায় সেবা পাচ্ছেন না এখানকার জমির সেবাগ্রহীতারা। গাইবান্ধাবাসীর সেবা নিশ্চিতের জন্য ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর অতিরিক্ত দায়িত্ব পান সাব-রেজিস্ট্রার মেহেদী হাসান। তার কার্যকাল শেষ ছিল ২০২৩ সালের ২২ জুন। পরে তিনি আবার সদর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পান। তিনি সপ্তাহের পাঁচ দিনের মধ্যে তিন দিন সদরে ও দুদিন সাদুল্যাপুর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে খণ্ডকালীন দায়িত্ব পালন করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সদরে নিয়মিত তিন দিনও অফিস করেন না এবং তিনি যখন ইচ্ছা তখন অফিসে যান। নিয়মিত সাব-রেজিস্ট্রার না থাকায় বেশিরভাগ সময় ভোগান্তিতে পড়েন জমির ক্রেতা-বিক্রেতারা।
এছাড়া দলিল রেজিস্ট্রির যাবতীয় ফি, কর, ট্যাক্স যথারীতি সোনালী ব্যাংক, এনআরসি ব্যাংকে পে-অর্ডারসহ সব শর্ত পূরণ করে জমি দলিল নিবন্ধন করার পরও দলিল সরবরাহ দিচ্ছেন না তিনি। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সেবাগ্রহীতারা।
এদিকে তার বিরুদ্ধে দলিল লেখকদের জিম্মি করে দলিল সম্পাদন করারও অভিযোগ রয়েছে। দলিল লেখকদের একটি চক্র, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কিছু কর্মচারীর যোগসাজশে পে-অর্ডার জালিয়াতি করে এক দলিলের পে-অর্ডার আরেক দলিলে ব্যবহার করে রেজিস্ট্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছও হয়েছেন অনেকে। এসব নিয়ে বিভিন্ন সময় সচেতন মহল থেকে আন্দোলনও করেছেন সচেতন মানুষ ও দলিল লেখকরা।
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, শুধু তিনি নন, এ অফিসের প্রতিটি দপ্তরে পিয়ন থেকে শুরু করে সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ঘুষ ছাড়া সেবা দেন না। বিশেষ করে ভলিউম দেখার কথা বলেই ১৭০ টাকা থেকে শুরু করে যেমন খুশি তেমন অর্থ নিচ্ছেন এখানকার কর্মচারী-কর্মকর্তারা। তাদের সঙ্গে আবার ভাগাভাগি করে খাচ্ছেন নকলনবিশরাও। এমন অর্থ নেওয়ার নিয়ম না থাকলেও সাধারণ মানুষকে বাধ্য করে অর্থ নিচ্ছেন তারা। এছাড়া মাসের পর মাস সেবার নামে নানাভাবে হয়রানি করছেন এই রেজিস্ট্রার অফিস-সংশ্লিষ্ট কর্মচারী ও কর্মকর্তারা।
দলিল লেখক কমিটির সাবেক সভাপতি রুবেল মল্লিক অভিযোগ করে জানান, ২০১৪ সাল থেকে নানা অনিয়মে চলছে গাইবান্ধা জেলা সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিস। পুরোনো অনেক দলিল এখনো সরকারের কোষাগারে জমা করেননি বর্তমান সাব-রেজিস্ট্রার মেহেদী হাসান। দলিল তুলতে গেলে আজ না কাল বলে সেবাগ্রহীতাদের বিদায় করেন তিনি। ১৫০৮/২১দ, ৪৮৩৭/২১দ, ৫২৩৫/২১দ, ২২১৮/১৪দ, ৯৯০০/১৬দ, ৯০৬৭/১৭দ, ৩২৪০/১৯দ, ৩২৪১/১৯দ, ৩২৪২/১৯দ নং দলিলসহ এমন হাজার হাজার দলিল জমা করেননি মেহেদী হাসান বলে অভিযোগ এ দলিল লেখকের।
আরেক দলিল লেখক বলেন, গত ২০২২ সালে সব থেকে বেশি দুর্নীতি হয়েছে এ রেজিস্ট্রার অফিসে। এমন নানা ভোগান্তির সমাধানে কেউ কোনো গুরুদায়িত্ব নেয় না বা দলিল লেখকদের নিয়ে কোনো সমস্যা সমাধানের বৈঠক হয় না। এতে করে সাময়িকভাবে দলিল লেখক কমিটিও স্থগিত রয়েছে। সেবা নিতে আসা বকুল মিয়া বলেন, প্রতিদিন আসি আর ঘুরে যাই। নিয়মিত সাব-রেজিস্ট্রার না থাকায় দলিলের কাজ সম্পন্ন হয় না। আরেক সেবাগ্রহীতা শাহজাহান আলী বলেন, ‘দিনের পর দিন ঘুষ দিয়েও হয়রানি হতে হয়, তবুও সেবা পাই না। আমরা দুর্নীতিমুক্ত সেবা চাই।’
দুর্নীতির বিষয়ে অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত সদর সাব-রেজিস্ট্রার মেহেদী হাসান প্রথমে কথা বলতে রাজি না হলেও পরে কালবেলাকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে, এসব ভুয়া ও বানোয়াট।
‘নৌপথে দিনে চাঁদাবাজি, রাতে ডাকাতি’ এ শিরোনামে প্রথম আলো গত ২৬ ডিসেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটির ইন্ট্রোতে বলা হয়েছে, ‘মেঘনা থেকে পদ্মা ও শীতলক্ষ্যা হয়ে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত নৌপথে পণ্যবাহী নৌযানে ডাকাতি ও চাঁদাবাজির ঘটনা কয়েক মাস ধরে বাড়ছে। বিভিন্ন স্থানে নোঙর করা নৌযান থেকে দিনের বেলায় চাঁদাবাজি করছে দুর্বৃত্তরা। রাতের বেলা এসব নৌযানে হানা দিয়ে অস্ত্রের মুখে টাকা, মুঠোফোনসহ দামি জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে ডাকাতেরা। কিছু ঘটনায় মামলা হলেও বেশিরভাগ আড়ালে থেকে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন নৌযান শ্রমিকরা।
গত চার মাসে কেবল শরীয়তপুর ও চাঁদপুরের বিভিন্ন স্থানে নৌপথে অন্তত ৩২টি ডাকাতির ঘটনার অভিযোগ করেছে দুই জেলার বাল্কহেড মালিক সমিতি। চাঁদপুর, শরীয়তপুর, মুন্সীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে নৌপথের বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন শ্রমিকরা। প্রতিবেদনটির ‘পথে পথে চাঁদা না পেলে হামলা’ উপশিরোনাম দিয়ে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম, মোংলা বন্দরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নারায়ণগঞ্জে পণ্য নিয়ে আসে জাহাজসহ বিভিন্ন ধরনের নৌযান। এছাড়া চাঁদপুরসহ বিভিন্ন বালুমহাল থেকে বালু বাল্কহেডযোগে (ইঞ্জিনচালিত ট্রলার) নারায়ণগঞ্জের পূর্বাচলসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে আসা হয়। এসব পথে দেড় হাজারের বেশি মালবাহী জাহাজ এবং সহস্রাধিক বাল্কহেড চলাচল করে।
নৌযান মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা জানা গেছে, শীতলক্ষ্যা-ধলেশ্বরীর মোহনা, কাঁচপুর, ডেমরা, সোনারগাঁয়ের বৈদ্যের বাজার, মেঘনার চর, কিশোরগঞ্জ, গজারিয়া, শায়েস্তা লালখাড়াবাদ, আশুগঞ্জ, ষাটনল-মোহনপুর, দশআনি, মানিকগঞ্জ, মাওয়া, বাজিতপুরÑ এসব এলাকায় প্রায়ই মালবাহী নৌযানে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। এছাড়া চাঁদপুরে মেঘনা নদীর চর ভৈরবী, ষাটনল, ইলিশা, মল্লিকপুর, দড়িরচর এলাকায় সব জাহাজকে চাঁদা দিতে হয়। শরীয়তপুরের ওয়াপদা, চরআত্রা, খাজুরতলা, বাবুরচর, পাইনপাড়া এলাকায় কিছু লোক ট্রলার দিয়ে নৌযান থেকে চাঁদা আদায় করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নৌযান মালিক ও শ্রমিকরা বলছেন, ট্রলার ও স্পিডবোটে করে এসে ১০ থেকে ১৫ জনের দল আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে নৌযানে হানা দেয়। কোথাও চাঁদা দিতে হয় দুই থেকে তিন হাজার টাকা। কোথাও দিতে হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। চাঁদা না পেলে তারা নৌযান শ্রমিকদের মারধর ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে রক্তাক্ত জখম করে সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়। ডাকাতি ও চাঁদাবাজির ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় নৌযান মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
সিলেট, সুনামগঞ্জ ও ভোলার ইলিশা থেকে বাল্কহেডে করে পাথর ও বালু আনেন মুন্সীগঞ্জের সাদেক হোসেন। প্রতিবার তাকে বিভিন্ন স্থানে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয় বলে জানান তিনি। চাঁদা না দিলে তার বাল্কহেডের শ্রমিকদের মারধর, বাল্কহেড আটকে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে কয়েকবার। সাদেক হোসেন বলেন, ছাতক, সুনামগঞ্জ, বৈদ্যের বাজার, সারুলিয়া, মুন্সীগঞ্জের কাঠপট্টি, কালিরচর, ষোলআনি এলাকায় চাঁদা দিতে হয় তাঁদের।
এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েও কোনো সুরাহা হয়নি বলে অভিযোগ বাংলাদেশ জাহাজি শ্রমিক ফেডারেশন ও নৌযান শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সবুজ সিকদারের। তিনি বলেন, ‘নৌযান ঘিরে ডাকাতি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধে ১৭ ডিসেম্বর নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ডকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তারা ব্যবস্থা না নেওয়ায় চাঁদপুরে এত বড় ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করেন তিনি।’
‘ঘুষ’: পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জিএমসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে দুদক’-এ শিরোনামে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম গত ৭ জানুয়ারি একটি খবর প্রকাশ করে। খবরটিতে বলা হয়েছে, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে ‘আর্থিক অনিয়ম ও ঘুষ’ নেওয়ার মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির একজন মহাব্যবস্থাপক ও তিনজন উপমহাব্যবস্থাপকসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর তথ্য দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এর অংশ হিসেবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে চিঠি দেওয়ার কথা বলেছেন, অনুসন্ধান দলের নেতৃত্বে থাকা দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমান।
চিঠিতে আগামী ২৭ ও ২৮ অক্টোবর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের কমিশনে হাজির থাকতে বলা হয়েছিল। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তারা হলেন বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর মহাব্যবস্থাপক (জিএম) প্রকৌশলী মো. হুমায়ুন কবীর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) আসাদুজ্জামান ভূইয়া, মানিকগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ডিজিএম (কারিগরি) সামিউল কবীর ও বিপাশা ইসলাম, মুন্সীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সহকারী ডিজিএম (ইএন্ডসি) রাজন কুমার দাস।
ঘুষ ও চাঁদাবাজির মতো দুর্নীতি নিয়ে যে তিনটি খবর ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে, এ তিনটি খবর রাষ্ট্র কর্তৃক রেজিষ্ট্রিকৃত তিনটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর। এ ধরনের খবরের পাশাপাশি আমরা ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবেও জানতে পারছি সরকারি দফতরগুলোয় ঘুষ যেমন চলছে, তেমনি সারা দেশে চাঁদাবাজিও চলছে। ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সাধারণ জনগণের মধ্যে একটি প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল যে, রাষ্ট্র সরকার ও প্রশাসনে কিছুটা পরিবর্তন আসবে। কিন্তু সরকার ও প্রশাসন আগের মতোই চলছে। ওপরে উল্লেখিত তিনটি খবরই প্রমাণ করে দেশে ঘুষ ও চাঁদাবাজি কমে নাই। লেখকের ব্যক্তিগত অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে যে, সরকারের সেবা খাতের অফিস যেমন ভূমি অফিস, সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস, বিদ্যুৎ অফিসসহ অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানগুলোতেই পূর্বের মতোই নীরবে ঘুষ লেনদেন চলছে।
বর্তমান সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দেশকে সঠিক পথে নিয়ে আসার ব্যাপারে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অন্তর্বর্তী সরকার বিগত সরকারের দুর্নীতি লুটপাটের মাধ্যমে যে লাখো কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে তা চিহ্নিত করে উদ্ধারের চেষ্টা করে যাচ্ছে। ঘুষ, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজের কারণে দেশের সাধারণ মানুষের জন্য রাষ্ট্রের যে সেবা আছে, তা ব্যাহত হচ্ছে এটা সর্বজনস্বীকৃত। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের দামের ওপর ঘুষ ও চাঁদাবাজির একটি বিরাট প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির কারণে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়, এটা সরকারের কর্তাব্যক্তিরা জানেন। তাই মূল্যস্ফীতি হয়, বিগত ডিসেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৩-র কাছাকাছি পৌঁছেছে। এ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনধারণ আরো কঠিন হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ জার্নাল অব পলিটিক্যাল ইকোনমিতে তৌফিক রহমান চৌধুরী ও মাজহারুল হাসান মজুমদার ‘বাংলাদেশ দুর্নীতির অবিমিশ্র অভয়াশ্রম’ এক প্রবন্ধের উপসংহারে লিখেছেন, ‘আামাদের অর্থনীতির অগ্রগতি নয়, বরং আরো অবনতি যেন না ঘটে, সে জন্যই দুর্নীতির বিরূদ্ধে ব্যাপক যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার গুরু দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারকে এবং সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরের মানুষকেই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করানোর মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রস্তাবিত যুদ্ধকে জনমানুষের যুদ্ধে রুপ দিতে হবে।’
দেশের সরকারি ও রাষ্ট্রের সেবা খাত সম্পর্কিত অফিসগুলোয় ঘুষ দুর্নীতি বন্ধে সরকারের উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পরিষদকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশের সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ, সরকারের প্রশাসন, পুলিশ বাহিনী, উপদেষ্টা পরিষদ কেহই চায় না দেশে ঘুষের লেনদেন হোক। ক্ষুদ্র শতাংশ লোক ঘুষের এ অনৈতিক কর্মটি করে থাকেন। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে যদি বিশেষ ক্যাম্পেইন শুরু করা হয় যে, সরকারি অফিসগুলো থেকে সেবা নিতে কেউ, ঘুষ দেবেন না এবং সরকারের কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঘুষ নেবেন না, তখন তা একেবারে বন্ধ না হলেও কমে আসবে অবশ্যই। ‘আমরা ঘুষ দেব না আর কেউ ঘুষ নেবে না- এ ধরনের একটি স্লোগান তৈরি করে আওয়াজ তুলতে হবে। ঘুষ দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি বন্ধের কাজটি কোনো অসম্ভব বা অবাস্তব নয়। বিশ্বের অনেক দেশই আছে যেখানে সরকারি অফিসগুলোয় ঘুষ ও দুর্নীতি হয় না। তাই আমরা মনে করি, বাংলাদেশেও ঘুষ দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব। যে জাতি রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারকে হটাতে পারে সে জাতি দেশকে ঘুষ দুর্নীতিমুক্ত করতে পারবে অবশ্যই। তার জন্য দরকার সরকার, প্রশাসন ও জনগণের যৌথ উদ্যোগ। সরকারকে গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্র এবং রেডিও টেলিভিশনসহ সামাজিক মাধ্যমেও প্রচার শুরু করতে হবে ঘুষ বন্ধের। এককথায় একটি আওয়াজ তুলতে হবে, বাংলাদেশ হবে ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশ।