সূচক নিয়ে ছিল কারসাজি, ছিল হাঁসফাঁস

স্থবির অর্থনীতিতে গতি ফেরানোর চেষ্টা

ফেরদৌস আহমদ ভূইয়া
২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:৪৮

২০২৪ সালটা বিদায় নিয়েছে একটা মহা ওলট-পালটের মধ্য দিয়ে। বছরের শুরুতে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বিরোধীদলকে বাদ দিয়ে। তারপর জুনের শেষের দিকে ছাত্রদের কোটা আন্দোলন, কোটা আন্দোলনটি জুলাই মাসে দেশব্যাপী সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। সবশেষে এক দফার আন্দোলন গড়ে ওঠে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের একপর্যায়ে দেশব্যাপী গণঅভ্যুত্থান ঘটে। ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যান, পতন ঘটে এক ফ্যাসিস্ট রেজিমের। তারপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এমন একটি অস্থিতিশীল পরিবেশে দেশের অর্থনীতি গতিশীল থাকতে পারে না। বরং পুরো বছর ধরে অর্থনীতিতে হাঁসফাঁস অবস্থাই বিরাজ করছিল।
একটি দেশের অর্থনীতির জন্য যতগুলো সূচক ছিল, বিগত বছরে তার মধ্যে মাত্র দুটি সূচক ছিল ইতিবাচক- সে দুটি হচ্ছে রেমিট্যান্স আর রফতানি বৃদ্ধি। বাকি সব সূচকই ছিল নেতিবাচক ও বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেতে পেতে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে, ব্যাংকে তারল্য সংকটের কারণে বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে, খেলাপি ঋণ বাড়ছেই, উচ্চ সুদহার, শিল্প কারখানায় শ্রমিক অস্থিরতা, রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড না থাকায় কয়েক লাখ শ্রমিক বেকার, পুঁজিবাজারের সূচক ক্রমশ কমছে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি ছিল বিশৃঙ্খল ও স্থবির।
সূচক নিয়েও কারসাজি
একটি দেশের অর্থনীতি কেমন আছে এবং কেমন চলছে, তা বোঝা যায় তার সূচক দিয়ে। আর সূচক নির্ধারিত হয় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে। এ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও তৈরি করে দেশের রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান বিভাগ। কিন্তু বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি কেমন ছিল তার যথাযথ চিত্র জানা ও বোঝার কোনো উপায় নেই এবং ছিল না। কারণ বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের ১৫ বছরের অর্থনীতির সূচকে যেসব তথ্য-উপাত্ত তথা পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়েছে তার স্বচ্ছতা ও সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র এখনো পাওয়া কঠিন। ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়েও করেছেন চরম মিথ্যাচার। দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র আড়াল করে রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য-উপাত্তকে পরিবর্তন করে কমবেশি করতে দেখাতে বলতেন তারা। বিগত অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট সরকার জনসংখ্যা থেকে শুরু করে জিডিপির আকার মাথাপিছু আয় সবকিছুতেই গরমিল করে তথা মিথ্যা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সূচক তৈরি করে প্রকাশ করেছে। তাই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট সরকারের তথ্য-উপাত্ত ও সূচকে বেশ গরমিল হতো। এক কথায় ফ্যাসিস্ট সরকার অর্থনীতির সূচক নিয়েও কারসাজি করে বিশ্বকে দেখাতো বাংলাদেশে ব্যাপক উন্নয়ন হ”্ছ,ে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক বড় এবং এগিয়ে যাচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বিবিএস কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়েছে। জিডিপি, মূল্যস্ফীতি ও মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যানে গোঁজামিল পেয়েছেন তারা। কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, সরকারের নির্দেশে অনেক ক্ষেত্রে মনগড়া তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। মাথাপিছু আয়, জিডিপি এবং মূল্যস্ফীতির প্রতিবেদন তৈরি হওয়ার পর সাবেক ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন না নেওয়া পর্যন্ত প্রকাশ করা হতো না। প্রধানমন্ত্রী বিদেশে থাকলে প্রতিবেদন প্রকাশে লম্বা সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করার নজির আছে।
বিবিএসের বিভিন্ন উইংয়ের একাধিক কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সব সরকারের সময়ই বিবিএসের পরিসংখ্যানে সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন থাকত। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে এ প্রবণতা বেড়ে যায়। এ কারণে উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পূর্বাভাসের সঙ্গে বিবিএসের পরিসংখ্যানে অনেক পার্থক্য থাকত। বিবিএস পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা। এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেওয়ার পর এ পরিসংখ্যানের গোঁজামিলটা প্রকট আকার ধারণ করে।
পুঁজিবাজারের সূচক সর্বনিম্নে
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশের পুঁজিবাজারে ধস নামে। বলা যায় পুঁজিবাজার প্রায় ধ্বংসের পথে। ডিএসসির পরিসংখ্যানে জানা গেছে, বিগত চার বছরের মধ্যে ২০২৪ সালে পুজিবাজারের সূচক ছিল সর্বনিম্ন। ২০২০ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ৫ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে এসেছিল। চার বছর পর ২০২৪ সালে ২৭ অক্টোবর তা আবার চার হাজার ৯৬৫ পয়েন্টে নেমে আসে। পুঁজিবাজারের এ করুন অবস্থার জন্য বিনিয়োগকারীরা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ও তার সরকারের সাবেক মন্ত্রী আ হ ম কামাল ও হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে দায়ী করছেন। তাদের কারসাজির কারণেই বিগত ১৫ বছর ধরে পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত হয়েছে। পুঁজিবাজার একটি দেশের শিল্পায়নে সরাসরি জনগণের বিনিয়োগ সৃষ্টি করে। এতে করে দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে সঞ্চয় প্রবণতা বাড়ে, শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ে, উৎপাদন বাড়ে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং সাধারণ জনগণের আয় বৃদ্ধি পায় ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে।
অস্থিতিশীল মার্কিন ডলারের দাম
মার্কিন ডলারের দাম বিগত বছরের শুরু থেকেই বাড়তে থাকে, ডিসেম্বর মাসে এসেও ডলার মূল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। বছরের শুরুতে মার্কিন ডলারের দাম ছিল ১০৯ টাকা আর সেটা ডিসেম্বর মাসে পৌঁছে যায় ১২০ টাকা। অবশ্য খোলাবাজারে দাম আরো বেশি। এমনি এক পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন একটি উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। নতুন বছরের শুরু থেকে ডলারের দাম আরও বাজারমুখী করার উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিদিন দুপুরের মধ্যে ডলার কেনাবেচার তথ্য সংগ্রহ করবে। এরপর ডলারের মধ্যবর্তী দাম প্রকাশ করা হবে। ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে কেনাবেচা করলে জরিমানা আরোপ করার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশে ব্যাংক। জরিমানার পরিমাণ ১০ লাখ টাকা থেকে লেনদেনের ৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করলে তার জন্য নিলাম করবে। আগে শুধু পছন্দের ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করত।
নিত্যপণ্যের বাজারে মার্কিন ডলারের প্রভাব
বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ। জনসংখ্যার তুলনায় খাদ্য শস্যের উৎপাদন কম হওয়ায় একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানিকৃত পণ্যে দাম বৃদ্ধি পায়। আর এটা প্রভাব পড়ে নিত্যপণ্যের বাজারে। এতে করে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায়। ২০২৪ সালে জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশে পৌঁছে যায়। তবে বছর শেষে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে আসে।
অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর অক্টোবরের মূল্যস্ফীতি ছিল গত তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে সেপ্টেম্বরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৯.৯২ শতাংশ ও আগস্টে ছিল ১০.৪৯ শতাংশ। বিবিএস বলছে, অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাড়িয়েছে ১২.৬৬ শতাংশে, যা জুলাইয়ে ছিল ১০.৪০ শতাংশ। অক্টোবরে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৯.৩৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা এক মাস আগে ছিল ৯.৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ প্রায় দুই বছর ধরে ক্রমবর্ধমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করছে। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। আর ওই বছরের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিলো ৯.৯৩ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ৯.৯২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, তারা দায়িত্ব নেয়ার আগে মূল্যস্ফীতির হিসাব নিয়ন্ত্রিত ছিল। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে কৃত্রিমভাবে দেওয়া হতো হিসাব। বর্তমান সরকার মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হিসাব দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের অভ্যন্তরে সিন্ডিকেটের কারণেও নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে যে, উৎপাদক পর্যায়ে ও ভোক্তা পর্যায়ে দামের পার্থক্য অনেক। অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্য বাজার সিন্ডিকেট দমন করতে পারছে না। তাই নিত্যপণ্য নিয়ে ভোক্তা তথা সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ক্ষোভ পরিলক্ষিত হচ্ছে। জনগণের প্রত্যাশা বর্তমান সিন্ডিকেট দমন করে নিত্যপণ্যের বাজার ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে।
রিজার্ভের হ্রাস বৃদ্ধি
বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি)’র সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ২৪.৩ বিলিয়ন ডলার। এটি আইএএফ-এর বিপিএম-৬ ক্যালকুলেশন স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার।
রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ছে উল্লেখ করে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ‘রেমিট্যান্স বাড়ছে বলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজর্ভ হ্রাস রোধ করা সম্ভব হচ্ছে। রিজার্ভে গত অর্থ বছরের তুলনায় এ অর্থবছরে ৬০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আগস্ট ও জুলাই মাসের প্রবৃদ্ধি একত্রে বিবেচনা করলে এই প্রবৃদ্ধি প্রায় ৯০ শতাংশ। আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন সচল করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো চাইলে নিজেরা নিজেদের মধ্যে লেনদেন করতে পারে এবং বিনিময় হার হবে বাজারভিত্তিক।’ বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে এ রিজার্ভ অনেক কমে গিয়েছিল। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর প্রবাসী রেমিট্যান্সযোদ্ধারা ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানোর কারণে দেশের রিজার্ভ ক্রমশ বাড়ছে।
রেমিট্যান্স
দেশের এক কোটিরও অধিক শ্রমজীবী মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাকরি করেন। তারা প্রতি মাসেই কয়েক কোটি ডলার দেশে প্রেরণ করেন। ডিসেম্বরে রেমিট্যান্সে ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা গেছে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম ২৮ দিনে দেশে এসেছে ২৪২ কোটি ৫ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স। এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে দেশে এসেছে ৮ কোটি ৬৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স। গত রোববার (২৯ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিসেম্বর মাসের প্রথম ২৮ দিনে দেশে এসেছে ২৪২ কোটি ৫ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স, যা গত নভেম্বর ও অক্টোবরের একই সময়ের অনেক বেশি। গত নভেম্বর ও অক্টোবরে একই সম্যে রেমিট্যান্স এসেছিল যথাক্রমে ২০৫ কোটি ২৪ লাখ ও ২১৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলার।
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবাসী আয় এসেছিল প্রায় ১৯১ কোটি মার্কিন ডলার, যা ছিল গত ১০ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। তবে অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ায় ক্রমান্বয়ে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়ছে।
রফতানি আয় বাড়ছে
জুলাই-আগস্ট মাসে উৎপাদন খাতে যে ধাক্কা লেগেছিল, তা কাটিয়ে দেশের পণ্য রফতানি বাড়তে শুরু করেছে। গত অক্টোবরে রফতানি আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ বেড়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ১ হাজার ৫৮৮ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১১ শতাংশ বেশি।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের তিনটি বড় উৎস হলো রফতানি, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এবং বিদেশি বিনিয়োগ ও ঋণ। রফতানি ও প্রবাসী আয় বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কমে। অক্টোবরে প্রবাসী আয় বেড়েছে ২১ শতাংশ।
রফতানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি, বিপরীতে আমদানি ব্যয় সেভাবে না বাড়ায় সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি দূর হয়েছে। আর্থিক হিসাবে ঘাটতি কমছে।
ব্যাংক ব্যবস্থা
দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার বেহাল অবস্থা এখনো চলছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে লুটেরার দল ব্যাংকগুলো থেকে লাখো কোটি টাকা ঋণের নামে পাচার করেছে। সরকারের শীর্ষমহলের সহযোগিতায় গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে জোর জবরদস্তি করে অনেক ব্যাংক দখল করা হয়েছে। বিশেষ করে দেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে ধ্বংস করতে লাখো কোটি টাকা ঋণের নামে পাচার করা হয়েছে। যার কারণে এক ডজন ব্যাংক চরম তারল্য সংকটে রয়েছে। তারা গ্রাহকদের আমানতের টাকাই ফেরত দিতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা সরবরাহ করেই লুটের শিকার ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। বর্তমান সরকার অবশ্য প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
বিগত ১৫ বছর ফ্যাসিস্ট সরকার ও তার আমলাতন্ত্র দেশের রাজনীতির সাথে অর্থনীতি নিয়েও স্বৈরাচারী কায়দায় ব্যাংকের টাকা লুটপাট, টাকা পাচার, শেয়ারবাজার ধ্বংস থেকে শুরু করে জ¦ালানি খাতে উৎপাদনসহ সকল খাতেই চরম অনৈতিক ও অপকর্ম চালিয়েছে। লুটপাট ও অর্থনীতিকে ধ্বংস করার অপকর্মকে ঢেকে রাখতে তারা সাধারণ জনগণের কাছে দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্রকে আড়াল করে অনেক কারসাজি করেছে। তথ্য-উপাত্তের কমবেশি করে ভুল পরিসংখ্যান প্রকাশ করে দেশ বিদেশে দেখিয়েছে যে, বাংলাদেশের উন্নয়ন হচ্ছে। জনসংখ্যা কম দেখিয়ে জিডিপির আকার বেশি দেখিয়ে মাথাপিছু আয় বেশি দেখাতো। সব মিলিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকার তথ্য-উপাত্তকে কমবেশি করে সূচকেও কারসাজি করেছে। আর এতে করে জনগণ ও বিদেশিরাসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশে অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র জানতে পারতো না। ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতনের পর সব অপকর্মের চিত্র বের হয়ে আসছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এসব কারসাজি প্রকাশ হতে শুরু করেছে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের অর্থনীতিতে গতি আনতে হলে বিবিএসর মাধ্যমে খাতওয়ারী সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র নিরূপণ করতে হবে। তারপর অর্থনীতির খাতওয়ারী সমস্যা নির্ধারণ করে সংকট নিরসন করতে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে সব ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সাথে নিয়ে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে জরুরি ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নিতে হবে। জনগণের প্রত্যাশা অন্তর্বর্তী সরকার স্থবির অর্থনীতিকে গতিশীল করতে যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করছে।