ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত চলবে

হারুন ইবনে শাহাদাত
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৫:০১

এদেশের দরিদ্র রিকশা ও সিএনজিচালকরা রাস্তায় বা তার বাহনে কুঁড়িয়ে লাখ লাখ টাকা পেয়ে আসল মালিকের কাছে ফেরত দেয়। সেই দেশে বিশুদ্ধ রক্তের মানুষের অভাব- এ কথা কি বিশ্বাসযোগ্য? অবশ্যই, না। কিন্তু তারপরও কেন ক্যান্সারের মতো এদেশের গরিবের রক্ত কুঁরে কুঁরে খাওয়ার সুযোগ পায় কতিপয় চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ এবং অসৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট? ‘আমরা কি বার বার প্রতারিত হতেই থাকবো, মরীচিকার পেছনে আর কতদিন ঘুরতে হবে?’ ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগে গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর অনেকের মধ্যে এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কার দিকে তাদের এ প্রশ্নের তীর? আশা করি, তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। ছাত্র-জনতা বার বার রাজপথে স্লোগান তুলেছে, ‘We want justice (আমরা ন্যায়বিচার চাই)।’ ছোট্ট এ স্লোগানের মাঝে লুকিয়ে আছে এদেশের জনগণের মাত্র কয়েকটি চাওয়া, কী সেই চাওয়া- ১. ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত আইনের শাসন। রাজা বা সরকারের স্বার্থে করা তাদের আইনের শাসন নয়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রাজবন্দির জবানবন্দির ভাষায়, ‘সে (তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের বিচারক) ন্যায়ের নয়, সে আইনের। সে স্বাধীন নয়, সে রাজভৃত্য। তবু জিজ্ঞাসা করছি, এই যে বিচারাসন- এ কার? রাজার না ধর্মের? এই যে বিচারক, এর বিচারের জবাবদিহি করতে হয় রাজাকে, না তার অন্তরের আসনে প্রতিষ্ঠিত বিবেককে,..?’ ২. ঘুষ-দুর্নীতি, চাঁদাবাজিমুক্ত দেশ, ৩. জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার চাহিদা পূরণ হোক তার উপার্জন করা হালাল অর্থেই। এককথায় জীবন-জীবিকা, সম্পদ ও ইজ্জতের নিরাপত্তা চায়। দেশের মানুষ তাদের এ জন্মভূমিকে নিজের করে ভাবতে চায়, ভালোবাসতে চায়। তাই তো দুইশত বছর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ১৯৪৭-এ লাভ করেছিল স্বাধীন আবাস ভূমি পাকিস্তান, এরপর ১৯৭১ সালে অস্ত্র হাতে জীবনবাজি রেখে লড়েছে সাম্য (ইনসাফপূর্ণ সম্পদ বণ্টন), সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য।

১৯৭০ সালে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার দাবিতে এদেশের যুদ্ধ করে লাভ করেছে বাংলাদেশ, কিন্তু তাদের ভোটের অধিকার তারা ৫৩ বছরেও ফিরে পায়নি। তাদের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতো সওয়ার হয়েছিল শেখ মুজিবের একদলীয় বাকশালী দুঃশাসন। তারপর নানা চরাই-উৎরাই পেরিয়ে বায়ান্ন বছর পর ৫ আগস্ট অনেক রক্তের বিনিময়ে পেল দ্বিতীয় স্বাধীনতা। কিন্তু তারপরও সংশয় কাটছে না। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত ‘মরীচিকা’ কবিতার প্রতিধ্বনি সর্বত্র- ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না ॥/বক্ষ হইতে বাহির হইয়া আপন বাসনা মম/ফিরে মরীচিকা সম।/বাহু মেলি তারে বক্ষে লইতে বক্ষে ফিরিয়া পাই না।/যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না ॥’

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার দীর্ঘ দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন থেকে মুক্তির পরও কেন শোনা যাচ্ছে এমন সংশয় ও হতাশার বাণী, যা কারো কাম্য নয়। কারণ দুর্নীতি এখনো বন্ধ হয়নি। বাজার সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয়, চাঁদাবাজরা পোশাক বদল করে আবারও দখলবাজি, তোলাবাজি করছে। তবে কি এ সমাজ ও দেশ দূষিত রক্তমুক্ত হবে না। যে দেশের দরিদ্র রিকশাচালক, সিএনজিচালকরা কুঁড়িয়ে লাখ লাখ টাকা পেয়ে আসল মালিকের কাছে ফেরত দিতে পাগলের মতো তাকে খুঁজতে থাকে, সেই দেশের চিত্র তো এমন হওয়ার ছিল না।

তাহলে সমস্যটা কোথায়? বড় বড় বই পড়ে, দেশ-বিদেশের ডিগ্রি নিয়ে সরকারের উচ্চ আসনে বসা আমলা-ফইলা এবং রাজনীতির মতো মানবসেবামূলক মহৎ মানবিক কাজের ড্রাইভিং সিটে যারা বসে আছেন, তারাই কি সমস্যা? একবাক্যে এ কথা স্বীকার করাও হবে মহাপাপ। কারণ অনেক আমলা এবং রাজনীতিবিদ আছেন যারা সততার সাথে কাজ করতে গিয়ে জীবনবাজি রাখেন। ক্যারিয়ারের তোয়াক্কা করেন না। সদ্ভাবে বেঁচে থাকার প্রত্যয়ে রাষ্ট্রের দুষ্ট ক্ষতগুলোর সাথে যুদ্ধ করতে করতে মেঘে ঢাকা তারার মতো নীরবে ঝরে পড়েন। পরিবার, দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের কীভাবে মূল্যায়ন করল তা নিয়েও ভাবেন না। এদের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু দুর্নীতিবাজদের দাপটে তাদের অনেকেই ড্রাইভিং সিটে বসার সুযোগবঞ্চিত।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশে প্রচলিত রাজনৈতিক পদ্ধতি এবং সরকার ব্যবস্থাই এজন্য দায়ী। তাই ছাত্র-জনতার দাবি রাষ্ট্র সংস্কার করতে হবে। সংস্কারের মাধ্যমে বৈষম্য দূর করতে হবে। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ঘুষের সাথে কোনো আপস নয়। ফ্যাসিবাদের সাথে কোনো আপস নয়। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো ত্যাগী ও সাহসী মানুষের হাতে রাজনীতির স্টেয়ারিং হুইল দিতে হবে। এবারের বিপ্লবের ফসল ধরে রাখতে সংস্কারের মাধ্যমে এমন ব্যবস্থা করতে হবে, সততা ও যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণরাই যেন বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারে। সেই ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে হবে সংস্কারের মাধ্যমে। কারণ লক্ষণ বলছে, এ জাতির মাথায় পচন ধরেছে। প্রশ্ন হলো পচন ধরলো কবে থেকে এবং কেমন করে?

পচনের শুরু
কথায় আছে, মাথায় পচন ধরলে তার মৃত্যু অনিবার্য। রাজনীতিবিদরা হলেন জাতির মাথা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা জাতি শ্রদ্ধার সাথে চিরদিন মনে রাখবে। রাজনীতি করতে গিয়ে তারা দেশের প্রয়োজনে জমিদারি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়েছেন, আর এখন নিঃস্বরা রাজনীতি করে মহারাজার মতো বিত্তশালী হচ্ছেন। এজন্যই পাশ্চাত্যের গবেষকরা বলেন, এশিয়া-আফ্রিকায় রাজনীতি হলো বিনা পুঁজির ব্যবসা। অতি সম্প্রতি এদেশের প্রবীণ গবেষক রেহমান সোবহান মন্তব্য করেছেন, এদেশের সংসদ সদস্যরা জমিদারের মতো আচরণ করেন।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান আরো বলেন, একসময় দেশের নির্বাচনব্যবস্থা এমন একটা রূপ পেয়েছিল, যেখানে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া উচ্চ লাভজনক হয়ে উঠেছিল। খুব সহজেই সংসদ সদস্য হতে বড় অংকের টাকা খরচ করতে রাজি ছিলেন অনেকে। এ ব্যবস্থা রাজনীতির স্বরূপকেও প্রভাবিত করে। মূল রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক সংগঠন হয়ে পড়েছে, যেখানে সব ক্ষমতা দলের নেতৃত্ব পর্যায়ে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামোগত এ সমস্যা প্রশাসনিক ব্যবস্থায় প্রতিফলিত হয়েছে। ধীরে ধীরে প্রশাসনিক ব্যবস্থাও ব্যবসায়ীদের তোষণের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্রের মুষ্টিমেয় ব্যক্তি উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করেছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি বেড়েছে, প্রশাসনে রাজনীতি ঢুকেছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হারিয়েছে, আইন প্রয়োগের অস্ত্রের অবাধ ব্যবহার হয়েছে এবং সর্বোপরি সংসদীয় ব্যবস্থা কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছিল। সর্বশেষ তিনটি সংসদে কোনো বিরোধীদল ছিল না। সংসদ ছিল শুধু আইন প্রণয়ন করতে। অতিরিক্ত সময় কাটানোর সংসদ সদস্যদের কিছু না কিছু উপায় খুঁজে বের করা দরকার ছিল। তারা দুটি পথ বেছে নিয়েছিলেন। প্রথমত, ব্যবসা এবং দ্বিতীয়ত, নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় জমিদার হয়ে ওঠা। সংসদ সদস্যরা ক্রমে স্থানীয় সরকারের এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের কাজকে নিজেদের করে নিয়েছিলেন। ফলে উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে বড় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। জমিদারি দখল করতে তারা একে অপরকে রক্ত ঝরাতেও দ্বিধা করতেন না। উপজেলা চেয়ারম্যানরা বুঝেছিলেন, যদি তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছাতে না পারেন, তবে তার লাভ নেই। এ সমস্যা সংসদ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যবসায় অংশগ্রহণ করছিলেন। রেহমান সোবহান মনে করেন, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অদক্ষতার কারণে দেশের সঠিক ও টেকসই উন্নয়ন হয়নি।

নৈতিকতার বিচারে একজন রিকশাচালকের কাছে কেন অনেক রাজনৈতিক নেতা হেরে যাচ্ছেন? সেই বিচার করতে গেলে একটু পেছনে তাকাতে হবে।
পেছন ফিরে দেখা

১৯৪৭-এ পাকিস্তান সৃষ্টির পরও এ অঞ্চলের মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, তারা খেলাফতে রাশেদার সোনালি যুগে ফিরে যাবে। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন ভঙ্গে তৎপর উইপোকা চিহ্নিত করার ব্যর্থতার দায় আজও শোধ করতে হচ্ছে। তৎকালীন পাকিস্তানে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। তিনি এবং তার সাথে যারা এ রাজনৈতিক দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাদের স্বপ্ন ছিল ইসলামের সুমহান রাজনৈতিক দর্শনের আলোকে এ ভূখণ্ডে একটি কল্যাণরাষ্ট্র বা ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। তাদের সেই চিন্তার আলোকেই প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাকালে ‘মূল দাবি’ নামে ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সম্মেলনে একটি ম্যানিফেস্টো (ঘোষণাপত্র) উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি অখণ্ড পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ ও পাকিস্তান) মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের জন্য যে কল্যাণরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্নে শরিক হয়েছিলেন অন্য নেতারাও। তাদের সেই স্বপ্নের রাষ্ট্রের যে বৈশিষ্ট্য দলটির প্রথম ম্যানিফেস্টোতে যা উল্লেখ করা হয়েছিল, তা হলোÑ ১. পাকিস্তান খেলাফত অথবা ইউনিয়ন অব পাকিস্তান রিপাবলিক ব্রিটিশ কমনওয়েলথের বাইরে একটি সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র হইবে। ২. পাকিস্তানের ইউনিটগুলোকে আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার দিতে হইবে। ৩. রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আল্লাহর প্রতিভূ হিসেবে জনগণের ওপর ন্যস্ত থাকিবে। ৪. গঠনতন্ত্র হবে নীতিতে ইসলামী গণতান্ত্রিক ও আকারে রিপাবলিকান। (সূত্র : স্বাধিকার আন্দোলন ও শামসুল হক পৃষ্ঠা-৫৮, লেখক : মোহাম্মদ হুমায়ুন করীর)। কিন্তু আওয়ামী মুসলিম লীগের কয়েকজন নেতা ভারতের চক্করে পড়ে নিখিল ভারত কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে এদেশে আওয়ামী লীগকে বিকশিত করার মিশনে নামেন। সেই সকল নেতা ভারতের পরামর্শপত্র অনুসরণ করে প্রথমে ফ্যাসিবাদ কায়েম করে দলটির অভ্যন্তরে।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের অভিযোগে শামসুল হক গ্রেফতার হন এবং কারাবরণ করেন। তিনি গ্রেফতার হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়। শামসুল হক ১৯৫৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। তিনি অসুস্থ ও মানসিক ভারসাম্যহীন- এমন প্রচারণা চালিয়ে তার হাতে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া থেকে বিরত থাকেন শেখ মুজিবুর রহমান। অভিযোগ আছে, তাকে দলের আশপাশে আসতে দেয়া হতো না। তার সুচিকিৎসার জন্যও দল থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এরপর ১৯৫৩ সালের ৩ থেকে ৫ জুলাই মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনেও সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক পদটি পান শেখ মুজিবুর রহমান।
শেখ মুজিবুর রহমানের প্ররোচনায় প্রচার করা হয় কারাবন্দি হওয়ার পর শামসুল হকের ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছিল। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তার মস্তিষ্ক বিকৃতি এবং তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। গবেষকরা মনে করেন, কারানির্যাতনের কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ তৎকালে রাজবন্দিদের নির্যাতন করা হতো না। গবেষকরা মনে করেন, শামসুল হক ছিলেন মনেপ্রাণে একজন মুসলিম। তার লেখা আওয়ামী মুসলিম লীগের ম্যানিফেস্টোতে ইসলামী আদর্শের প্রতিফলন ছিল। কিন্তু ততদিনে আওয়ামী মুসলিম লীগ ভারতের খপ্পরে পড়ে গেছে। এর প্রমাণ পেতে বেশি অপেক্ষা করতে হয় না। প্রথমে ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগের নামের সাথে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া তথা আওয়ামী লীগকে ধর্মনিরপেক্ষ দলে রূপান্তরিত করার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। অবশ্য ১৯৫৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ সেক্যুলার দলে পরিণত হয়। দলটি শুধু সেক্যুলার চরিত্র গ্রহণই করে না, এদেশে যেন ইসলামী আদর্শ নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল জনগণের সামনে দাঁড়াতে না পারে, সেই লক্ষ্য পূরণে অলিখিত কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে ফ্যাসিবাদী কায়দায় হত্যা সন্ত্রাসের পথ। ভারতের অর্থ ও সহযোগিতায় ইসলামী নীতিনৈতিকতার শিকড় কেটে সন্ত্রাসবাদ আর প্রতারণাকে রাজনীতির মূল পুঁজিতে পরিণত করার মিশনে নামে ফ্যাসিবাদী দলটি।

সুন্দর সুন্দর মোড়কে এদেশের তরুণদের সামনে উপস্থাপন করে ইসলামীবিরোধী মতবাদ, কমিউনিজম, সেক্যুলারিজম ইত্যাদি। শিক্ষিত তরুণদের দাঁড় করায় এদেশের মানুষের মননে-মগজে প্রতিষ্ঠিত চিরায়ত নীতি-নৈতিকতার বিরুদ্ধে। এর ফলে তাদের এত অধঃপতন ক্যান্সারের মতো বিস্তার করে। যার ফলে এমন রাজনৈতিক নেতা ও আমলা তৈরি হতে থাকে যাদের সততা ও নৈতিকতার মান এদেশের অশিক্ষিত রিকশাচালকদেরও নিচে। এ কারণেই ক্ষুধার্ত রিকশাচালকরা লাখ টাকার লোভ সামলাতে পারলেও তারা পারে না। তাদের কথিত জাতির পিতা যেমন করে শামসুল হকে ক্লিকবাজি করে রাজনীতি থেকে সরিয়ে মহারাজা হয়েছিলেন, তারাও সে পথেই হাঁটতে থাকে। মানবকল্যাণের সবচেয়ে বড় মিশন চলে যায় শয়তানের দখলে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের তুলনামূলক রাজনীতির  অধ্যাপক  ভ্লাদিমির তিসমানেনুর গবেষণায়। তিনি তার এ গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেছেন The Devil in History: Communism, Fascism, and Some Lessons of the Twentieth Century’ নামের গ্রন্থে।

এখানে তিনি দেখিয়েছেন ‘ইতিহাসের দুই শয়তান: ফ্যাসিজম ও কমিউনিজম’। সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করে এমন দর্শনের ওপর ভিত্তি করে যে রাজনীতি ও রাষ্ট্র গড়ে উঠবে, তা কোনোদিনই মানবিক হবে না। তা হবে শয়তানের রাজনৈতিক মতবাদের মূলসূত্র: মিথ্যা, প্রতারণা, হত্যা-সন্ত্রাসের ভিত্তিতে গড়া এক অমানবিক মাফিয়ারাষ্ট্র। রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্ব যারা পালন করছেন, তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে- ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যে মাফিয়াতন্ত্রের পতন হয়েছে, তা ফিরে আসার সকল পথ বন্ধ করতে হবে। এবারের ছাত্র-জনতার আন্দোলন সেই পথ থেকে ফিরে আসার তীব্র বাসনা থেকেই শুরু হয়েছিল। তারা রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে, বাজার সিন্ডিকেট, দুর্নীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজি, মাস্তানি, সন্ত্রাস ও বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার এক বুক স্বপ্ন নিয়ে। তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণে যারাই বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। এ আন্দোলন-সংগ্রাম লক্ষ্যে পৌঁছার আগে শেষ করা যাবে না, বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।

ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত চলবে হারুন ইবনে শাহাদাত

সংক্ষিপ্ত বিশ্ব সংবাদ
১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ২১:৪৩

অর্থনীতি গতি পাবে
১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ২১:৩৫

আরো

সম্পর্কিত খবর