সরকারের প্রশাসনে সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি

একেএম রফিকুন্নবী
১৫ মে ২০২৫ ১৫:৪০

লেখক : একেএম রফিকুন্নবী ,সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

॥ একেএম রফিকুন্নবী ॥
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে সরকারের প্রতিটি বিভাগে চলছে সংস্কার ও পুরনো নিয়মকানুন ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নতুন উদ্যমে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করা। ইতোমধ্যে পুলিশ বিভাগ, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশনসহ সব জায়গায় চলছে সংস্কার ও পরিবর্তন-পরিবর্ধন।
প্রায় সব সংস্কার কমিশন তাদের সুচিন্তিত অভিমত প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে চলছে মতবিনিময়। এছাড়া প্রশাসনিক সরকারের ওপরও সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের জন্য বিভিন্ন দলের সাথেও তাদের মতবিনিময় অব্যাহত আছে।
নির্বাচন কমিশন ভবিষ্যতের নির্বাচনের জন্য তাদের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে। ভোটার তালিকা আপডেট করার জন্য ইতোমধ্যেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ভোট নেয়ার জন্য নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রেই পরিবর্তন আনার কাজ এগোচ্ছে।
দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য গ্রাম থেকে শহর-বন্দর সবক্ষেত্রে সরকারের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। গত ৫৪ বছরে দেশ চালাতে গিয়ে কোনো দলই তাদের দলের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। সর্বশেষ স্বৈরাচার হাসিনা স্থানীয় নির্বাচনেও দলীয় প্রতীক চালু করে দেশটাকে দলীয় ক্যাডার বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল। দেশে সাধারণ মানুষের সব অধিকার কেড়ে নিয়ে একদলীয় বাকশালের আদলে দেশ চালিয়ে স্বৈরাচারের উচ্চশিখরে নিয়ে গিয়েছিল। জনগণ সুযোগ পেয়ে স্বৈরাচার হাসিনার মূলোৎপাটনের পদক্ষেপ নিয়ে দেশ থেকে পালানোর পরিবেশ তৈরি করে। ফলে হাসিনা প্রাণ বাঁচাতে তার প্রিয় মোদির দেশে চলে যেতে বাধ্য হয়।
আসে বর্তমান ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার। এ সরকার অভিজ্ঞতার অভাবে তৎক্ষণাৎ যেসব পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল, তা নিতে ব্যর্থ হয়। কালক্ষেপণ করার কারণে স্বৈরাচারী হাসিনার দোসররা বিভিন্ন পদে লুকিয়ে থেকে আবার চুরি করা টাকা দিয়ে সুবিধাভোগী লোকদের দিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা করার পাঁয়তারা করার সুযোগ পায়।
বাকশালী প্রেতাত্মা আওয়ামী লীগকে ৯ মাস পূর্বেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দরকার ছিল। তারপরও হাসনাত আব্দুল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্রশিবির প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে শাহবাগকে উত্তাল করে তোলে। হাসিনার দোসর আবদুল হামিদের পালানোকে কেন্দ্র করে দেশদরদি দলগুলো মাঠে নেমে পড়ে। সময় বেঁধে দিয়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কাজ সম্পন্ন হয়, আলহামদুলিল্লাহ।
ড. ইউনূস সরকারও নড়েচড়ে বসে। সময়ক্ষেপণ না করে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। নির্বাচন কমিশনও আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করে। মোট কথা আওয়ামী লীগ আর তার প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচন করতে পারছে না। হুমকি-ধমকি দিলেও আওয়ামী লীগের লোকেরা গ্রামগঞ্জে প্রকাশ্যে কথা বলার অবস্থায় নেই। পালিয়ে থেকে জনগণের সেবা করা যায় না। বিএনপির প্রত্যক্ষ মদদে আওয়ামীদের পুনর্বাসন প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। বেকায়দায় পড়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল সাহেব আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন সমর্থন দিতে বাধ্য হয়। দেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে দেশের কল্যাণ করা যায় না। ফখরুল সাহেবদের বোধোদয় দেশের জন্য কল্যাণই বয়ে আনবে।
বর্তমানে যেহেতু নির্বাচিত এমপি, মেয়র, চেয়ারম্যান, কমিশনার, মেম্বার নেই, তাই গ্রাম থেকে শহর স্থানীয় সরকার পর্যন্ত প্রশাসনের লোক দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। সরকারের প্রশাসনের লোকদের তাদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করে বাড়তি দায়িত্ব পালনে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। জনগণও সঠিকভাবে তাদের সেবা পাচ্ছে না। তাই ভোটার তালিকা আপডেট হওয়ার সাথে সাথে স্থানীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা নেয়া আশু প্রয়োজন। স্থানীয় নির্বাচন যেহেতু একদিনে সব এলাকায় হবে না, তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা খুবই সহজ হবে। স্থানীয়ভাবে প্রতিদিন দুই জেলার মেয়র, ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, কমিশনার ও মেম্বার নির্বাচনের আয়োজন করলে সহজে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব। এতে করে জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি পাবে। এলাকার সৎ, যোগ্য, চাঁদাবাজমুক্ত মানুষকে তারা নির্বাচিত করতে পারবে। দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যেকোনো ভালো মানুষকে তারা তাদের প্রতিনিধি বানাতে পারবে।
দলীয় নমিনেশন বাণিজ্য থেকে দেশের মানুষ মুক্তি পাবে। জনগণ তাদের ভালো নেতা পাবে। দেশের প্রশাসন ভালো লোকের সমন্বয়ে এলাকার সেবা নিশ্চিত করতে পারবে। ফলে আমাদের দেশের নির্বাচনব্যবস্থার পরীক্ষা হয়ে যাবে। তারা ভালো নির্বাচন দিয়ে ভবিষ্যতের নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হবে।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে তাদের কোনো প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে না। এমপিদের এলাকায় আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসররা প্রকাশ্যে নেই। তাই আওয়ামী দোসররা নির্বাচিত হয়ে আসবেÑ প্রশ্নই আসে না।
গত ১১ মে রোববার পাবনার সাঁথিয়ায় শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ওপর আলোচনা ও দোয়ার আয়োজন করেছিল সাঁথিয়া ও বেড়া জামায়াতে ইসলামী স্থানীয় সাঁথিয়া কলেজ মাঠে। প্রধান অতিথি ছিলেন শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান। রোদের তাপের মধ্যেও লক্ষাধিক জনগণ উপস্থিত হয়ে শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের বয়ান শুনে অভিভূত হয়েছেন। তার জন্য কায়মনোবাক্যে দোয়া ও মোনাজাত করেছেন নিজামী সাহেবের সুযোগ্য ছেলে জনাব ব্যারিস্টার ড. নাজিব মোমেন। জনগণ তৃপ্তির সাথে আমিন আমিন বলে মহান আল্লাহর দরবারে নিজামী সাহেবের জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান জান্নাতুল ফেরদাউস কামনা করেছেন।
দেশের মানুষ ১৬ বছর পর স্বাধীনভাবে তাদের মতামত দেয়ার পরিবেশ পেয়েছে। তাই ড. ইউনূস সরকারের কাছে জোর দাবি, অতিসত্বর স্থানীয় নির্বাচন দিয়ে এলাকার সেবার মান বাড়াতে উদ্যোগী হবেন এবং জনগণের সেবার মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। স্বৈরাচারের দোসররা এলাকায় আর বিশৃঙ্খলা করতে পারবে না। যারা ভালো মানুষ, তাদের কোনো ভয় নেই, সে যে দলের হোক না কেন?
বর্তমানে আরেকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। এলাকার নিরীহ ব্যক্তিদের নামে যাতে কোনো হয়রানিমূলক মামলা দেয়া না হয়। যারা দোষী, তাদের নামে মামলা হবে। বিচার হবে, বিচারের আলোকে ফাঁসিও হতে পারে। তাদের কর্মফল তারা ভোগ করবে।
ইতোমধ্যেই হাসিনার গড়া মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালে হাসিনা ও তার দোসরদের নামে কয়েকশত মামলা হয়েছে, বিচারের অপেক্ষায়। কয়েকদিন পূর্বে হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলার তদন্ত রিপোর্ট ট্রাইব্যুনালে জমা হয়েছে। বিচারিক আদালতে তার সঠিক বিচার হবে, কোনো সন্দেহ নেই। হাসিনা যে গুম, হত্যা, আয়নাঘরের মূল হুকুমদাতা, তার যথেষ্ট প্রমাণ আদালতে জমা পড়েছে। আমাদের বিশ্বাস, দোষী এমপি, মন্ত্রীসহ টাকা পাচারকারী সব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে, তার যথাযথ সঠিক বিচার হবে, দৃষ্টান্তমূলক সাজা হবে, কোনো সন্দেহ নেই।
বিচার বিভাগ ও দেশের প্রশাসনে সৎ, যোগ্য লোকের নিয়োগ হলে জনগণ ভালো সেবা পাবে, কোনো সন্দেহ নেই। হাসিনার আমলে বিচার বিভাগ তো ফরমায়েশি বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলার শুনানি শেষ হয়েছে। রায় আগামী ২৭ মে। শুনানিকালে তার আইনজীবী এডভোকেট শিশির মনির অত্যন্ত সহজ-সরলভাবে ফরমায়েশি বিচারের সব তথ্য প্রধান বিচারপতিসহ সাতজন বিচারপতির সামনে তুলে ধরেছেন। বিচারপতিরাও অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে এডভোকেট শিশির মনিরের যুক্তিসঙ্গত বক্তব্য শুনেছেন। আমরা আশা করি, ন্যায়বিচার পেয়েই তিনি মুক্তি পাবেন এবং দেশ-দশের খেদমত করার সুযোগ পাবেন, ইনশাআল্লাহ।
আমরা এদেশের নাগরিক অল্পে তুষ্ট। মাটি, পানি ভালো। দেশের মানুষ কর্মঠ। দেশে ও বিদেশে কাজ করে তারা প্রচুর আয় করছে। দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রফতানি বাড়াচ্ছে। পত্রিকায় দেখলাম, পোশাক খাতে রফতানিতে বাংলাদেশ এগিয়ে। বৈদেশিক রিজার্ভ সর্বকালের সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছেছে। তাই আমরা আশা করতে চাই, ভালো লোকের দ্বারা দেশ শাসিত হলে ভালো দেশ গড়া সম্ভব।
আমরা আশা করব, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন দ্রুত করতে পারলে দেশের লোক ভালো সেবা পাবে। দেশের উন্নয়নে ভালো ভূমিকা রাখবে। তাই স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের ব্যাপারে কালবিলম্ব না করে এ সময়ে নির্বাচন দিয়ে স্থানীয় লোকের ভালো সেবা নিশ্চিত করি। এমপিরা দেশের আইন প্রণয়ন করবেন। আর স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত সদস্যরা এলাকার উন্নয়নের কাজ করবেন। এলাকার উন্নয়ন হলেই দেশের উন্নয়ন হবে।
আমরা একজন যোগ্য, অভিজ্ঞ রাষ্ট্রনেতা জনাব ড. ইউনূসের মতো লোক পেয়েছি। তার নেতৃত্বেই আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। তার যেহেতু দল নেই। টাকা কামাই ও বিদেশে পাচারের কোনো দুরভিসন্ধি নেই। তার নেতৃত্বেই মহান আল্লাহ আমাদের এ জন্মভূমি বাংলাদেশকে গোটা দুনিয়ার মধ্যে আদর্শ দেশ গড়ে তোলার সুযোগ করে দেবেন। প্রতিবেশী দেশের চোখরাঙানি ও দাসত্ব আর আমাদের করতে হবে না। যারা দাসত্ব করেছে, আজ তারা মোদির দেশে দাসী হিসেবে বাস করছে। ভাগ্যের এ অমোঘ পরিণতি। ২০ কোটি মানুষের দেশ। প্রায় সবাই এক আল্লাহয় বিশ্বাসী। তাই মহান আল্লাহর ওপর নির্ভর করেই আমরা এগিয়ে যাব, ইনশাআল্লাহ।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।