মুসলমান হওয়ার জন্য অপরিহার্য গুণাবলি

অতিথি লেখক
৮ মে ২০২৫ ১৪:৫০

॥ প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী ॥
আল্লাহপাকের দরবারে লাখো শুকরিয়া যে, তিনি দয়া করে আমাদের মুসলিম পিতা-মাতার ঘরে জন্মদান করেছেন। প্রাকৃতিক নিয়মে মহাবিশ্বের সকল সৃষ্টিই মুসলিম অর্থাৎ আল্লাহপাকের দেয়া নিয়মে সৃষ্টি, বেড়ে ওঠা এবং একসময়ে সমাপ্তি। এমনকি আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও আল্লাহপাকের দেয়া নিয়মের ওপর পরিচালিত এবং সে হিসেবে এরাও মুসলিম অর্থাৎ আল্লাহর অনুগত। হাদিসের ভাষায় বলা হয়েছে, সকল মানবশিশু ইসলামের ওপর জন্মগ্রহণ করে অর্থাৎ মুসলিম অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে। পিতা-মাতার সংস্পর্শে কেউ মুসলিম, কেউ ইহুদি, কেউ হিন্দু ও কেউ খ্রিষ্টান আবার কেউ নাস্তিক হিসেবে বেড়ে ওঠে। আমরা যারা মুসলিম পিতা-মাতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেছি, তারা ইসলামকে জানা ও বোঝার ক্ষেত্রে যে সুবিধা পেয়েছি, অন্যরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ফলে আমাদের বাড়তি দায়িত্বও রয়েছে। আমরা এটাও জানি, আল্লাহপাক মুসলমানদের ক্ষমা করে জান্নাতে দেবেন এবং কাফেরের জন্য কোনো ক্ষমা নেই, তাদের পরিণতি জাহান্নাম।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, মুসলমান ও কাফেরের মধ্যে কী মৌলিক পার্থক্য, যার জন্য আল্লাহপাক মুসলমানকে জান্নাতে দেবেন এবং কাফেরের জন্য রয়েছে জাহান্নাম। নামে পার্থক্য বা বংশীয় পার্থক্য এটি কোনো বিষয় নয়, বরং পার্থক্য হলো উভয়ের ইলম ও আমল এবং গুণাবলির। একজন মুসলমান তার রব হিসেবে আল্লাহকে জানে, তাঁকে ভয় করে এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁকে মেনে চলে। মানুষ আল্লাহপাকের বান্দা এবং তাকে সৃষ্টিই করা হয়েছে তাঁর আনুগত্য করার জন্য। আল্লাহপাকের বাণী, ‘আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবল আমার ইবাদতের জন্য’। সূরা যারিয়াত ৫৬। মনিবের হুকুমের বাছ-বিচার করার অধিকার গোলামের নেই। আল্লাহপাকের কাছে মনোনীত একমাত্র দীন হলো ইসলাম। (আলে ইমরান : ১৯)। মানবজাতির হিদায়াতের জন্য সর্বশেষ নবী ও রাসূল হলেন মুহাম্মদ (সা.)। মুসলমান হওয়ার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য শর্তহীনভাবে পালন করতে হয়। যে ব্যক্তি পালন করে, তারই নাম মুসলিম (অনুগত) এবং যে করে না, তার নাম কাফের (অমান্যকারী)। আল্লাহপাকের বাণী, ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো ও রাসূলের আনুগত্য করো’। সূরা নিসা : ৫৯। শর্তহীনভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্য ছাড়া মুসলমান হওয়ার সুযোগ নেই।
মানুষ আল্লাহর গোলাম। গোলামী করার নিয়ম-কানুন শেখানোর জন্যই নবী প্রেরণ এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে শর্তহীনভাবে অনুসরণ করা ঈমানের অপরিহার্য শর্ত। রাসূলুল্লাহ (সা.) উপস্থাপিত দীন পরিপূর্ণভাবে মানতে হবে। আল্লাহপাকের নির্দেশ, ‘তোমরা পরিপূর্ণ ইসলামে দাখিল হও, শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না’। সূরা বাকারা : ২০৮। আল্লাহপাকের দেয়া নিয়ম যতটুকু অমান্য করা হয়, ততটুকু শয়তানকে অনুসরণ করা হয়। আল্লাহকে মানার পাশাপাশি তাগুতকেও মানা মূলত আল্লাহর সঙ্গে শিরক ও কুফরি। আল্লাহর বাণী, ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং তাগুতকে অস্বীকার করো’। সূরা আন নহল : ৩৬। সমাজে দীন পরিপূর্ণভাবে মানার ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে রয়েছে নানা মত। মানুষের জীবনকে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক নানাভাবে বিভক্তি টেনে এনে এমন অনেক পরহেজগার মানুষ পাওয়া যায় যাদের সামাজিক, রাজনীতিক ও অর্থনৈতিক জীবন বড় কদর্যপূর্ণ। ইসলামী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বাইরে অধিকাংশ মানুষ দীনকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলেছে। তাদের সম্পর্কেই আল্লাহপাকের সাবধান বাণী, ‘তোমরা কি দীনের কিছু অংশ মানবে এবং কিছু অংশ অমান্য করবে, তাহলে দুনিয়ার জীবনে রয়েছে জিল্লতি ও আখিরাতে রয়েছে ভয়াবহ আজাব’। সূরা বাকারা : ৮৫। হ্যাঁ, আজকে বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা জিল্লতির জীবনই যাপন করছে। আখিরাতে যে ভালো কিছু হবে না আল্লাহ তায়ালা তাও স্পষ্ট করে অগ্রিম জানিয়ে দিয়েছেন।
দুনিয়ার আদম শুমারিতে আমরা মুসলমান ঠিকই, কারণ আমাদের বাবা-মা মুসলমান এবং আমাদের নাম রাখা হয়েছে আরবি নামের সাথে মিল রেখে। কিন্তু আল্লাহপাকের একটি দপ্তর রয়েছে যেখানে মানুষকে পরিমাপ করা হয় ঈমান ও আমলের মানদণ্ডে। সেখানকার হিসেবে একজন মুসলিম সেই যে ইসলামকে একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা (আদদীন) হিসেবে বিশ্বাস করে এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামকে মেনে চলে। সেই সাথে আল্লাহর জমিনে দীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা চালায় এবং এর বিজয় কামনা করে। একজন ব্যক্তির সবকিছু আছে, কিন্তু ইসলাম বিজয়ী হোক, তা সে চায় না, তাহলে বুঝতে হবে সেই নরাধম মুসলিম নয়; বরং কাট্টা মুনাফিক। মুনাফিক সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই-এরই উত্তরসূরি।
আল্লাহপাক আমাদের সতর্ক করেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো ভয় করার মতো এবং তোমরা আত্মসমর্পণকারী না হয়ে কোনো অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো না।’ (আলে ইমরান : ১০২)। ঈমানদার ব্যক্তিমাত্রই আল্লাহকে ভয় করে, কিন্তু সেই ভয় করার মাত্রা কতটুকু। সন্তান তার বাবা-মাকে ভয় করে, অফিসের কর্মচারী তার বসকে ভয় করে এবং বস তার মালিককে ভয় করে, মানুষ র‌্যাব, পুলিশ, মহল্লার মাস্তানকে ভয় করে- এই ভয় কেন করে? এককথায় জবাব হলো, তাদের কিছু ক্ষমতা রয়েছে এবং ভয় করে না চললে ক্ষতির আশঙ্কা করে। এখন আল্লাহপাকের ক্ষমতা এখতিয়ার উপলব্ধি করে কোন মাত্রায় তাঁকে ভয় করতে হবে, সেটা উপলব্ধি করা দরকার। পিতা-মাতা, অফিসের বস, পাড়ার মাস্তান দুনিয়ার জীবনে ভয় দেখাতে পারে বা ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু আল্লাহপাকের ক্ষমতা-এখতিয়ার পরিমাপযোগ্য নয়। কেউ ক্ষতি করতে চাইলে সেটি তখনই সম্ভব যদি আল্লাহপাক চান। মান-ইজ্জত-সম্মান, সুস্থতা, রিজিক, জীবন সবই আল্লাহপাকের মর্জির ওপর নির্ভর করে, সর্বোপরি মৃত্যুর পরে জান্নাত অথবা জাহান্নাম সেটিও নির্ভর করে আল্লাহপাকের ইচ্ছার ওপর। সর্বময় ক্ষমতা (সার্বভৌম ক্ষমতা) মূলত আল্লাহপাকের এবং মুসলমান কেবল আল্লাহকেই ভয় করবে।
‘মুসলমান থাকা অবস্থা ছাড়া যেন তোমাদের মৃত্যু না হয়’Ñ এই বাক্যে বোঝা যায় জীবনে একবার ঈমান এনে মুসলমান হওয়া বা মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করে ইসলামের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করি বা না করি ইসলাম সর্বদা আমাদের সাথে লেগে থাকবেÑ বিষয়টি এমন নয়। একজন চাকর যেমন সদা-সর্বদা সতর্ক জীবনযাপন করে, যাতে তার মনিব অসন্তুষ্ট না হয় তেমনি একজন মুসলমান মহান আল্লাহপাকের সকল বিধিবিধানের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে যাতে তার কোনো আচরণে আল্লাহপাক সামান্যতম অসন্তুষ্ট না হন। একজন অনুগত চাকরের একদিনের আচরণ বা মনিবকে অমান্য করার পরিণতি পেছনের সকল ভালো আচরণ মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে আল্লাহপাক পরস্পরের বন্ধু বলে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তারপরও পারিবারিক শৃঙ্খলা বিধানের জন্য স্বামীকে কর্তৃত্বশীল করেছেন। স্বামীকে স্ত্রী কর্তৃক একদিনের অমান্য বা স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে অসম্মান দীর্ঘদিনের সংসারজীবন ভেঙে যেতে পারে। ফলে সংসার সুখময় রাখার জন্য বা মনিব-চাকরের সম্পর্ক সঠিক রাখার জন্য সতর্ক থাকা যতটুকু দরকার তার চেয়েও অনেক গুণ বেশি সতর্ক থাকা প্রয়োজন মহান আল্লাহপাকের ব্যাপারে তাঁর অনুগত বান্দার অর্থাৎ একজন মুসলমানের। একজন মুসলমান সজ্ঞানে আল্লাহ তায়ালার নাফরমানি করতে পারে না। কারণ সে আল্লাহকে জানে এবং আল্লাহপাক নিজেও তাঁর গুণাবলি, ক্ষমতা, এখতিয়ার ব্যক্ত করেছেন। বিশেষ করে আয়াতুল কুরসি, সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত ও সূরা ইখলাসে আল্লাহপাক নিজেকে এমনভাবে প্রকাশ করেছেনÑ যাতে তাঁর বান্দারা তাঁকে উপলব্ধি করতে পারে এবং ভক্তি, ভয় ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে পারে।
আল্লাহপাকের একটি গুণ হলো, তিনি গোপন ও প্রকাশ্য সকল বিষয়ে জ্ঞাত। লোকচক্ষুর আড়ালে কোনো ভালো বা মন্দ কাজ করলে কেউ না দেখলেও আল্লাহপাক দেখছেন- বান্দাকে এ উপলব্ধি দানের জন্য আল্লাহপাক দীর্ঘ এক মাসব্যাপী রোজা পালন ফরজ করেছেন। একজন মুসলমানের পক্ষে গোপনে বা প্রক্যাশ্যে সুদ, ঘুষ, অর্থ পাচার, গুম-খুন বা আল্লাহপাকের নাফরমানির পর্যায়ে পড়ে এমন কিছু করা কি আদৌ সম্ভব? এককথায় জবাব, না। কারণ সে পরকালের জবাবদিহি ও আল্লাহপাককে ভয় পায়। মুসলমান কোনো বংশ, গোত্র বা মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করাকে বলা হয় না। বরং ঈমান (আল্লাহ, রাসূল, কিতাব, আখিরাত, ফেরেশতা, তকদির ও মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান) আনা এবং ঈমানের দাবি অনুসারে নেক আমল করার মাধ্যমেই কেবল মুসলমান হওয়া বা থাকা সম্ভব।
উপরোক্ত আলোচনায় স্পষ্ট যে আল্লাহপাক প্রদত্ত মুহাম্মদ (সা.) প্রদর্শিত একমাত্র বিধান হলো ইসলাম এবং যে ব্যক্তি ইসলাম মেনে চলে তাকেই বলা হয় মুসলিম (আত্মসমর্পণকারী বা অনুগত)। আল্লাহর বান্দাদের অবশ্য পালনের জন্য ইসলামের কিছু বিধান রয়েছে ফরজ। যেমন- ইসলামের বুনিয়াদ হিসেবে গণ্য নামাজ, জাকাত, রোজা ও হজ অবশ্য পালনীয়; এর কোনো একটি ছেড়ে দিলে আর মুসলমান থাকা যায় না। যেমন- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নামাজ হলো মুসলিম ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্যকারী। কুরআনে নামাজ না পড়াকে সরাসরি জাহান্নাম (সূরা মুদ্দাসসির) ও পরকাল অবিশ্বাসী (সূরা বাকারা) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জাকাত প্রদান না করাকে মুশরিকদের কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহপাকের সকল সৃষ্টি; বিশেষ করে মানুষের প্রতি জুলুম করাকে পরকাল অবিশ্বাসীদের কাজ বলা হয়েছে। কোনো মুসলমান জুলুম করতে পারে না। এতিমের সাথে দুর্ব্যবহার ও মিসকিনের খাবার দিতে উৎসাহিত না করা এবং নামাজে গাফিলতি করাকে সূরা মাউনে পরকাল অবিশ্বাসীদের কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার মানুষকে সামনা-সামনি গালাগাল ও পেছনে দোষ প্রচারকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিশ্চিত ধ্বংস ও হুতামায় নিক্ষিপ্ত হবে বলে সূরা হুমাজায় বলা হয়েছে। এগুলো দৃষ্টান্ত মাত্র। মানুষের সম্মানহানি, গুম-খুন, চাঁদাবাজি, জুলুম-নির্যাতন, গীবত বা যে কোনো উপায়ে মানুষকে কষ্ট দেয়া কবীরা গুনাহ। তাওবা ছাড়া কবীরা গুনাহ নিয়ে কবরে যাওয়া মানে জাহান্নামে যাওয়ার টিকিট নিয়ে যাওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) স্পষ্ট করেই বলেছেন, যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্যরা নিরাপদ নয় সে মুমিন নয়, মুমিন নয়, মুমিন নয়। আর যে মুমিন নয় তার মুসলমান হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
মানুষকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়া আমার অভিপ্রায় নয়। বরং ইসলামের রঙে রঙিন হয়ে প্রকৃত মুসলিম হয়ে একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা আমার উদ্দেশ্য। একজন মুসলমানের কাছে সমগ্র সৃষ্টি নিরাপদ। শুধু মানুষ নয়, পশু-পাখি-গাছপালা সবই নিরাপদ। ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত উদার ও ক্ষমাশীল। মানুষকে ক্ষমা করেই তাঁর যতো আনন্দ। সৃষ্টির প্রথম মানুষ আদম (আ.) ও ইবলিস দুজনেই ভুল করেছিল। কিন্তু আদম (আ.) ভুল করার সাথে সাথে ফিরে এসেছিলেন (তাওবা করেছিলেন)। ফলে আল্লাহপাক তাঁকে শুধু ক্ষমাই করেননি বরং নবী করে সম্মানিত করেছেন। বান্দা যদি অপরাধ করে ক্ষমা চায় এবং সেই অপরাধের পুনরাবৃত্তি না করে, তাহলে সে আর শাস্তিযোগ্য থাকে না। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাকে হতাশ হতে নিষেধ করেছেন। ভাবছেন, আপনার বয়স ৫০ এবং জীবনে নামাজ পড়েননি। শুনেছেন প্রতি ওয়াক্ত নামাজ কাজা যাওয়ায় এক হোব্বা দোযখ এবং এক হোব্বা মানে ২ কোটি আটাশি লাখ বছর। এমন অংক করে ভাবছেন যে আপনার আর কোনো মুক্তি নেই। এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। আপনি তাওবা করুন এবং একাগ্রচিত্তে নামাজ শুরু করুন; আশা করা যায় আল্লাহপাক আপনার পেছনের গুনাহ সব মাফ করে দেবেন। বান্দাকে মাফ করার মাঝেই তাঁর বড়ত্ব, মহানত্ব; শুধু প্রয়োজন বান্দার তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করা।
আল্লাহর কাছে ক্ষমা পাওয়ার সহজতম উপায় তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করা। রাসূলুল্লাহ (সা.) স্পষ্ট বলেছেন, যে তার ভাইয়ের অপরাধ ক্ষমা করবে আল্লাহপাক কিয়ামতের দিন তার অপরাধ ক্ষমা করবেন। কতবড় সুসংবাদ! ক্ষমা করা নিজের পরিবার থেকেই শুরু করুন। স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, পিতা-পুত্র, বস-অধীনস্থ, মালিক-কর্মচারী পরস্পরকে ক্ষমা করুন। আজকাল স্বামী/স্ত্রী বিচ্ছেদ, ভাইয়ে-ভাইয়ে বিরোধ, পিতা-পুত্র বিরোধ প্রায়ই শোনা যায়। সূরা তাগাবুনে আল্লাহপাক বলেছেন, তোমাদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির মধ্যে কতিপয় শত্রু, তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাক। আর যদি ক্ষমা ও সহনশীলতার আচরণ করো এবং ক্ষমা করে দাও, তাহলে আল্লাহপাক অতীব ক্ষমাশীল ও অতীব দয়ালু। আমরা লূত (আ.)-এর স্ত্রী সম্পর্কে জানি, সে একজন নবীর স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কুফরিতে অবিচল ছিল এবং যখন গজব নেমে এসেছিল, তখন স্ত্রীকে সাথে নেয়ার ক্ষেত্রে লূত (আ.)-কে আল্লাহপাক স্পষ্ট না করেছিলেন। লূত (আ.)-এর স্ত্রীকে তালাক দেয়ার কথা আমাদের জানা নেই। আবার আছিয়া (আ.)-এর মতো একজন ঈমানদার মহিলার স্বামী ছিল ফেরাউন, তার মতো জালেম আর নেই। আছিয়া (আ.) তাঁর অসীম ধৈর্য ও আল্লাহর ওপর নির্ভরতার পুরস্কার হিসেবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম রমণীদের একজন হয়েছেন। আমরা বেশি বেশি ক্ষমার সংস্কৃতি চালু করি, তাহলে সমাজটা হবে হিংসা ও বিদ্বেষমুক্ত এবং শান্তিপূর্ণ। মুসলমান আখিরাতের প্রতিদানের আশায় সহজেই ক্ষমা করতে পারে।
আল্লাহপাক কুরআন মজিদে ঈমান ও নেক আমলের বিনিময়ে জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। শিরকমুক্ত ঈমান ও নেক আমল জান্নাতে যাওয়ার জন্য ন্যূনতম শর্ত। মানুষের বিভিন্ন শ্রেণিভাগ রয়েছে। সবাইকে একই মানদণ্ডে বিবেচনা করা ইনসাফের খেলাপ। এক বেদুইন এসে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ঈমানের সাথে নামাজ, রোজা পালন এবং সামর্থ্য থাকলে জাকাত ও হজ পালনের কথা বলেন। সেই বেদুইন চলে যাওয়ার সময় বলে, আমি এর বেশিও করবো না আবার কমও করবো না। চলে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, লোকটি যদি তার কথায় সত্যবাদী হয়, তাহলে সে জান্নাতি। জান্নাতে যাওয়ার জন্য এটি হলো সর্বনিম্ন যোগ্যতা। তবে এটি স্পষ্ট, ইসলাম ছাড়া কেউই যদি অন্য কিছু চায় বা কেউ যদি রাজনীতিতে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী বলে দাবি করে, তখন আর তাকে মুসলমান বলার সুযোগ থাকে না।
মানুষ যেটা বিশ্বাস করে সাধারণত সেটি কায়েমের জন্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালায় এবং সেটার বিজয় কামনা করে। একজন মুসলমান যেহেতু জীবনাদর্শ হিসেবে ইসলামে বিশ্বাস করে তাই স্বাভাবিকভাবে সে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা চালায় এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হোক মনেপ্রাণে চায়। দীন কায়েমের মাধ্যমে একজন মুমিনের মর্যাদা অনেক বেড়ে যায়। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহকে আল্লাহপাক সর্বোত্তম আমল বলেছেন এবং এর মাধ্যমে প্রকৃত ঈমানদার ও কাফেরের পার্থক্যও তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাকের বাণী, ‘যারা ঈমানের পথ অবলম্বন করেছে, তারা লড়াই করে আল্লাহর পথে। আর যারা কুফরির পথ অবলম্বন করেছে, তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। কাজেই শয়তানের সঙ্গী-সাথীদের সাথে লড়াই করো আর বিশ্বাস রেখো, শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল’। সূরা নেসা : ৭৬। এখানে আল্লাহপাক স্পষ্ট করেছেন যে একজন প্রকৃত মুমিন বা মুসলিম তাগুতের অধীনে সন্তুষ্ট জীবনযাপন করতে পারে না। কালেমা তাইয়্যেবার দাবিই হলো তাগুতকে সরিয়ে মহান আল্লাহপাকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করা এবং দীন কায়েমের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের জন্য আল্লাহপাকের স্পষ্ট ঘোষণা যে তিনি তাদের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতে দাখিল করবেন। আল্লাহপাকের ভাষায় এটিই সবচেয়ে বড়ো সাফল্য (সূরা সফ)।
আল্লাহপাক শেষ নবী (সা.)-এর অনুসারীদের বিশ্বশাসনের দায়িত্ব প্রদান করেছেন। আল্লাহপাকের বাণী, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠতম জাতি, তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য, তোমরা মানুষকে সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে বিরত রাখবে’। সূরা আলে ইমরান : ১১০। মানবজাতিকে কল্যাণের পথে নিয়ে আসা এবং অকল্যাণকর যা কিছু আছে তা থেকে দূরে রাখার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রশক্তি। আশার দিক হলো, ইসলামকে রাষ্ট্রীয় দীন হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠার এক প্রেরণা তরুণ প্রজন্মের উপলব্ধিতে এসেছে। জাহেলিয়াত যেমন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তার মোকাবিলায় ইসলাম প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গ করার প্রেরণাও বাড়ছে। দীন কায়েমের দায়িত্ব আল্লাহপাকের। আল্লাহপাক প্রদত্ত শর্ত প্রতিপালিত হলে সেই জনপদে তিনি তাঁর দীনকে বিজয়ী করে দেবেন। আল্লাহপাকের বাণী, ‘আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎকাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খিলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদের দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দীনকে মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, যে দীনটি আল্লাহ তাদের জন্য পসন্দ করেছেন এবং তাদের (বর্তমান) ভয়ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা যেন শুধু আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে কাউকে শরিক না করে। আর যারা এরপরও কুফরি করবে তারাই ফাসেক’। সূরা নূর : ৫৫।
মুসলমানদের বর্তমান আমল-আখলাক বড়ই কদর্যপূর্ণ। আল্লাহপাক যে মানের মুসলমান দাবি করছেন আমরা তা থেকে অনেক দূরে। ব্যবহারিক জীবনে ইসলাম অনুসরণ না করার কারণেই আজ আমাদের এত জিল্লতি। আমরা মর্যাদার আসনে নেই। আল্লাহপাকের শর্ত খুব বড় নয়- শর্ত হলো ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ হওয়া। সততা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারি, প্রতিশ্রুতি পালন, সদাচার- মৌলিক মানবিক গুণাবলি আজ আমাদের মাঝে বড় অভাব বরং এসব গুণাবলি কাফের-মুশরিকদের মাঝে বেশি দৃশ্যমান। যার ফলে আজ তারা আমাদের ওপর বিজয়ী। পরিপূর্ণ মুসলমান হওয়া আল্লাহর চাওয়া এবং সেটি হতে পারলে অবশ্বম্ভাবী আল্লাহর সাহায্যও আমাদের চলে আসবে। আল্লাহপাক আমাদের পরিপূর্ণ মুসলিম হওয়ার তাওফিক দান করুন আমিন।
লেখক: উপাধ্যক্ষ (অব), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ।