‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বেই মজুরি দিয়ে দাও’
৮ মে ২০২৫ ১৪:৪৭
॥ একেএম রফিকুন্নবী ॥
মহান আল্লাহর শেষ নবী মুহাম্মদ সা. বলেছেন, শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বেই মজুরি দিয়ে দাও। কারণ শ্রমিক-মালিক একে-অপরের ওপর নির্ভরশীল। মালিকের উৎপাদনের গতি ঠিক রাখতে হলে শ্রমিকের সহযোগিতা একান্তই জরুরি। আবার মালিক বা উদ্যোক্তা না হলে শ্রমিক কাজ করার সুযোগ পাবে না। এ বিষয়ে উভয়ে একের উপর অন্যজন নির্ভরশীল।
আমাদের দেশসহ সব দেশে ধনী হোক বা গরিব দেশ হোক, শ্রমিক-মালিক একে-অন্যের সম্পূরক না হয়ে একে-অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। মালিক চেষ্টা করে শ্রমিককে কত কম টাকায় খাটিয়ে নিতে পারে। আর শ্রমিকরা তাদের কাজের সময় পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। মালিক-শ্রমিক একে-অপরের সহযোগী মনে করে না। তাই প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য একে-অপরের সহযোগী মনে না করে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে।
মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে উপরোক্ত নির্দেশ দিয়ে একে-অপরের সহযোগী বানিয়ে দিয়েছেন। মালিক না থাকলে যেমন শ্রমিক কাজ করার সুবিধা পেত না। আবার শ্রমিক না থাকলে মালিক তার প্রতিষ্ঠান চালাতে পারত না। শ্রমিকের সংজ্ঞা কিন্তু ঘরের কাজের বুয়া, ড্রাইভার, পিয়ন থেকেই শুরু হয়। আপনার কাছে এরা যারা কাজ করে, তাদের কাজের ধরন যেমন আলাদা, দায়িত্বও আলাদা আবার মজুরি বা বেতনও আলাদা। তাদের প্রত্যেককেই কাজের পরিমাণ ও ধরন বুঝে মজুরি নির্ধারণ করা দরকার। তারা যাতে তাদের ঘরের ছেলেমেয়ে, মা-বাবা, স্ত্রীদের নিয়ে নিম্নতম খরচ চালাতে পারে, তা নির্ধারণ করা দরকার। আমাদের বড় ভাই সরকারের সাবেক একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মরহুম শাহ আব্দুল হান্নান ছোট-বড় সবাইকে আপনি বলে ডাকতেন, আবার তাদের বেতন-ভাতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে কমপক্ষে চলার মতো করে নির্ধারণ করতে বলতেন। আবার আমি যে প্রতিষ্ঠানের সাথে দীর্ঘ ৪৫ বছর জড়িত, সেখানেও বেতন দেয়ার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই মাসের ৩০ বা পরের মাসের ১ ও ২ তারিখের মধ্যেই দিয়ে দেওয়া হয়। ছোট প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে এখন প্রায় ১২ হাজার কর্মকর্তা কাজ করেন। সেবা মোটামুটি ভালো, আলহামদুলিল্লাহ।
গত ১ মে আমাদের দেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস শ্রমিক সমাবেশে দায়িত্বের সাথে ঘোষণা দিলেন, শ্রমিকদের জন্য গঠিত কমিশনের সুপারিশ যথাযথভাবে কার্যকর হবে এবং শ্রমিকরা উপকৃত হবে। শুধু মে দিবস পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। যথাযথভাবে কার্যকরী করা হবে। আমরা এর ফল পেতে চাই।
বেশ কিছুদিন পূর্বে একটি আন্তর্জাতিক সমাবেশে যোগ দেওয়ার সময় তুরস্কের ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রধান জনাব ইরর এনড ইররের সাথে আলাপে জানতে পারলাম তুরস্কের ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের সমন্বয়ে পরিচালনা পরিষদ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উন্নতির গল্প। তিনি জানালেন, কামাল আতাতুর্ক ক্ষমতায় এসে সব মিল-কারখানা জাতীয়করণ করেছিল। কিন্তু ভালোভাবে চালাতে পারেনি। তিনি বললেন, আমরা ব্যবসায়ীরা শ্রমিকদের নিয়ে বন্দর শিল্পগুলো কিনে নিয়েছি। মালিক ও শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ ভাগাভাগি করে নেবে। শ্রমিকরা তো শ্রমিকের বেতন পাবেই। লাভের অংশ উপরি। তিনি জানান, প্রায় সব প্রতিষ্ঠান কিনে নিয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। আধুনিক তুরস্ক বিনির্মিাণে এ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
আমি মালিকপক্ষকে বলব, যা আমি নিজেও অনুসরণ করি, তা হলো শ্রমিক হোক আর অফিসার হোক, তাদের বেতন তো দিতেই হবে, তাই লোন করে হলেও মাসের বেতন বা মজুরি দ্রুত দিয়ে দিলেই এক আল্লাহ ও নবীর অনুসরণ হলো। অন্যদিকে শ্রমিক-কর্মচারীদের মাসিক বাসা ভাড়া, প্রাথমিক খরচ মেটানোর কাজ করতে পারলে শ্রমিক-কর্মচারীদের মন ভালো থাকে। কাজে উৎসাহ পায়। কাজে বরকত হয়।
আমি আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এ বক্তব্য দিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আমরা যারা মালিকপক্ষ আছি, তারা তাদের কাজের মূল্যায়ন সবটা করতে পারব না। আমাদের সুযোগ-সুবিধার আলোকে তোমাদের বেতন-ভাতা দিচ্ছি। তোমরা যদি অতিরিক্ত কাজ কর, তবে পরকালেও এর বিনিময় পাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাড়তি কাজ সাদকায় পরিণত হবে। আমরা এর মূল্যায়ন বহুগুণে পাব, ইনশাআল্লাহ।
মালিকপক্ষের দায়িত্ব বেশি। তাদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাজে আগ্রহ সৃষ্টি করা। আমরা যদি বছরে একবার হলেও কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পরিবারসহ গেটটুগেদারের ব্যবস্থা করতে পারি অথবা পিকনিকের ব্যবস্থা করতে পারি তবে আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রতি গোটা পরিবারের আগ্রহ বাড়বে। তারাও তাদের পরিবারের কাজে প্রতিষ্ঠানের ভালো কাজের ফল দেখাতে পারবে। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি দরদ বাড়ানোর জন্য বছরে কিছু হলেও বেতন-ভাতা বাড়াতে হবে। কারণ নিত্যপণ্যের দাম সবসময়ই কিছু না কিছু বাড়তে থাকে।
আগস্ট বিপ্লবের পর একে একে বের হচ্ছে স্বৈরাচারের চোরতন্ত্রের লাখকোটি টাকা পাচারের দুর্ধর্ষ দুর্নীতির খতিয়ান। ইতোমধ্যেই ১০টি কোম্পানির বিরুদ্ধে মালামাল বিক্রয়ের ওপর বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছে। তাদের কোটি কোটি টাকার মিল-ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হওয়ার উপক্রম। হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী বেকার হত চলেছে। বর্তমান সরকার দৃঢ়চিত্তে চোর-বাটপারদের ধরার চেষ্টা করছে। বিদেশেও চোরদের টাকা, ঘরবাড়ি বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। শেখ হাসিনা তার পরিবারসহ এমপি-মন্ত্রী সবাই পালিয়েছে। জেলে আছে, বিচারের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। আমরা দেশের টাকার হিসাব চাই। দেশে অথবা দেশের বাইরে নিয়ে যাক, তা উদ্ধারের সব পথ বের করতে হবে। দেশের সম্পদের হিসাব নিতেই হবে, এর সাথে যারা জড়িত তাদের বিচার করে ফাঁসির ব্যবস্থা করতে হবে।
অন্যদিকে চোরদের রেখে যাওয়া মিল-কারখানার শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেকার না করে প্রশাসক অথবা আমাদের দেশের ব্যবসায়ী সমিতিগুলোকে দায়িত্ব দিয়ে চালু রাখতে হবে। হাজার হাজার শ্রমিক ও কর্মচারীকে বেকার করা যাবে না। কারণ আমাদের অভ্যন্তরীণ সরবরাহ এবং বিদেশে রফতানি বন্ধ করে দেশকে ক্ষতির মধ্যে ফেলা যাবে না। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কারো বেকারত্ব বাড়ানো যাবে না। এখানেও আল্লাহর নবীর অনুসরণে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। সাথে সাথে দেশের শিল্প-কারখানা চালু রেখে দেশে ও বিদেশে পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে।
গত ১ মে শ্রমিকদের সমাবেশে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কঠোরভাবে বলেছেন, নতুন বাংলাদেশ গঠন করতে শ্রমিকদের সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি এবং তাদের সংসার চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিকদের প্রয়োজন সামনে রেখে শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার জন্য সরকার ব্যবস্থা নেবে।
জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান শ্রমিকদের জন্য ইসলামী শ্রম আইন কার্যকর করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। মালিক-শ্রমিক একে অপরের সম্পূরক। উভয়ের প্রয়োজনেই শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা তাদের দিতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে হবে। মালিকসহ দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্য শিল্প-কারখানা সচল রাখতে হবে। মালিক-শ্রমিক যৌথভাবেই দেশের উন্নয়নের কাজ চালাতে হবে, সাথে সাথে প্রত্যেকের প্রয়োজনীয় জীবনধারণের জন্য যার যার মতো টাকা উপার্জনের ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশে গত ৫৪ বছর দেশের ভাবমর্যাদা সঠিকভাবে আমরা অক্ষুণ্ন রাখতে পারিনি। যার যার মতো নিজের আখের গোছানোর কাজ করেছে। ফলে দেশের এবং দেশের জনগণের কল্যাণে তেমন কোনো কাজ হয়নি। বড় বড় প্রকল্প নিয়ে বড় বড় চুরির ব্যবস্থা হয়েছে। দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতি খালি করে দেয়া হয়েছে।
আগস্ট বিপ্লবের ফলে দেশের স্বৈরশাসক পালিয়েছে, তাদের দোসরদের নিয়ে এবং টাকা-পয়সা যা ছিল সব নিয়ে গেছে। বর্তমান সরকার এ অব্যবস্থা বন্ধ করে সামনের দিকে এগোচ্ছে। স্বৈরশাসকদের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য নানা ফন্দিফিকির করছে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে। দেশের জনগণ সচেতন আছে এ স্বৈরশাসকদের আর এদেশে জায়গা হবে না। দেশের মালিক-শ্রমিকরা দেশের স্বার্থেই কাজ করবে। দেশের উন্নয়ন হবে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া পূরণ হবে। আমরা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে দাঁড়াতে পারব। সংস্কার হবে, বিচার হবে, নির্বাচনও হবে, কোনো সন্দেহ নেই।
দেশকে স্বাবলম্বী করতে হলে মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক সুমধুর করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ কর্মঠ। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশে এবং বিদেশে নিয়োগ দিতে পারলে দেশের লাভ হবে, শ্রমিকরাও ভালো বেতন-ভাতা পাবে। আমাদের দেশে বিনিয়োগ করার জন্য ইতোমধ্যেই ৫০টি দেশের বিনিয়োগকারীদের সম্মেলন হয়ে গেল বাংলাদেশে। দেশকে স্বাবলম্বী করতে হলে বিনিয়োগকারী যেমন দরকার, তেমনি দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ, শ্রমিক প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা দরকার। বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে সচেতন। আমরা আশা করতে পারি, আমাদের প্রচুর জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ন্যায্যমূল্যে দেশের শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা আর ভিক্ষুকের জাতি থাকব না। উন্নয়ন আর স্বাবলম্বী দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে পারব, ইনশাআল্লাহ। ইতোমধ্যেই দেশের রিজার্ভ বাড়তে শুরু করেছে। মিল-কারখানার উৎপাদন বাড়ছে। বিদেশি বাণিজ্য বাড়ছে। রফতানির পরিমাণ বাড়ছে। মালিক-শ্রমিক বিনিয়োগকারী মিলেই আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।