আমার প্রিয় শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা রাহিমাহুল্লাহ

অধ্যাপক মুজিবুর রহমান
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৯:০৩

আলহামদুলিল্লাহি ওয়া কাফা ওয়া সালামুন আলা ইবাদিহিল্লাযি নাস্তাফা, আম্মাবাদ- আমার সাংগঠনিক জীবনের শ্রদ্ধেয় ও একান্ত প্রিয় মোল্লা ভাইয়ের সাথে শেষ দেখা হয় পুরান ঢাকার সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে। জেলজীবনের অবসর সময়, কুরআন-হাদীস পাঠ করার সময়, কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনার সময় অভিভাবক নেতৃবৃন্দের অবিস্মরণীয় সুন্দর সুন্দর কথা ও কাজগুলো মনে পড়ে। তাদের ব্যাপারে কিছু লিখলে তাদের জীবনের একঝলক কাজের দৃশ্য ও কথাগুলো আন্দোলনের ভাই-বোনেরা কিছু খোরাক পাবে, তাদের জন্য একটু দোয়া করতে পারবে। যারা কারাগারে কষ্টে আছেন, তাদের জন্য দোয়া করি, “আল্লাহুম্মা ইন্না নাজআলুকা ফি নুহুরিহিম অনাউজুবিকা মিন সুরুরিহিম”, ‘হে আল্লাহ! তোমাকে রেখে দিলাম দুশমনদের ঘাড়ের ওপর এবং তাদের ক্ষতি থেকে তোমার কাছে আমরা আশ্রয় চাচ্ছি’। যারা পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে চলে গেছেন, তাদের জন্য দোয়া করি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে তাদের সকল গুনাহ-খাতা মাফ চাই এবং সাইয়েয়াত (গুনাহ)গুলোকে হাসানা (নেকী)-তে পরিণত করে দেয়ার জন্য দোয়া করছি। সেই সাথে সংশ্লিষ্ট শোকসন্তপ্ত পরিবারসমূহের সকল সদস্যের জন্য দোয়া করি- মহান রাব্বুল আলামিন যেন তাদের সকলকে সবরে জামিল দান করেন।
মৃতদের জন্য সবর করলেই নেকী।

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল সা. বলেছেন, আল্লাহ বলেন, আমার মুমিন বান্দার জন্য আমার নিকট জান্নাত ছাড়া আর কোনো পুরস্কার নেই, যখন আমি দুনিয়া থেকে তার প্রিয়জনকে নিয়ে যাই আর সে সাওয়াবের আশায় সবর করে। (বুখারী)। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ঠিকানা হিসেবে জান্নাতুল ফেরদাউস কবুল করুন- আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামিন, আমীন। আখিরাতে কারো জান্নাতে প্রবেশ করা নিছক তার সৎকর্মের ভিত্তিতে হতে পারবে না, বরং এটি আল্লাহর রহমতের ওপর নির্ভর করেই হবে। হাদীসে বলা হয়েছে, “একবার নবী সা. বলেন, তোমাদের কারো নিছক আমল তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে না।” বলা হলো, “আপনার বেলায়ও কি এ কথা খাটে? জবাব দিলেন, “হ্যাঁ, আমিও নিছক আমার আমলের জোরে জান্নাতে প্রবেশ করবো না, যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর রহমত দিয়ে আমাকে ঢেকে নেবেন।”

রাসূল সা. বলেন, ‘‘তোমরা একে অপরের প্রশংসা করা থেকে দূরে থাকো। কারণ সম্মুখ প্রশংসা হচ্ছে কাউকে জবাই করার শামিল’’। (মু’আবিয়া (রা.) ইবনে মাজাহ্, হাদীস ৩৮১১)।

আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী সা.-এর সম্মুখে অন্যজনের প্রশংসা করছিল। তখন নবী সা. প্রশংসাকারীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘‘তুমি ধ্বংস হও! তুমি ওর ঘাড় ভেঙে দিয়েছ। তুমি ওর ঘাড় ভেঙে দিয়েছো। এ কথা রাসূল সা. কয়েকবার বলেছেন। তবে যদি তোমাদের কেউ অবশ্যই কারোর প্রশংসা করতে চায়, তাহলে সে যেন বলে, আমি ধারণা করছি, তবে আল্লাহ্ তায়ালাই ভালো জানেন। আমি তাঁর ওপর কারোর পবিত্রতা বর্ণনা করতে চাই না। আমি ধারণা করছি, সে এমন এমন। সেও ব্যক্তির ব্যাপারে ততটুকুই বলবে, যা সে তার ব্যাপারে ভালোভাবেই জানে’’। (বুখারী, ২৬৬২, ৬০৬১ মুসলিম, ৩০০০)। এমনকি রাসূল সা. কাউকে কারোর সম্মুখে প্রশংসা করতে দেখলে তার চেহারায় মাটি ছুড়ে মারতে নির্দেশ দিয়েছেন।

হাম্মাম (রাহিমাহুল্লাহ্) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা জনৈক ব্যক্তি উসমান (রা.)-এর সম্মুখে তাঁর প্রশংসা করলে মিকদাদ (রা.) তার চেহারায় মাটি ছুড়ে মারেন এবং বলেন, রাসূল সা. এরশাদ করেন, ‘‘যখন তোমরা প্রশংসাকারীদের দেখবে, তখন তোমরা তাদের মুখে মাটি ছুড়ে মারবে’’। (মুসলিম, হাদীস ৩০০২ আবু দাউদ, হাদীস ৪৮০৪ ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৮১০)।

রাসূল সা. কারোর সম্মুখে তার ভূয়সী প্রশংসা করতে এজন্যই নিষেধ করেছেন- যেন তার প্রশংসায় কোনোরকম অমূলক বাড়াবাড়ি করা না হয় এবং সেও ব্যক্তিগতভাবে নিজ আত্মাহমিকা থেকে বেঁচে থাকতে পারে।

দুনিয়ায় মুমিনগণ আল্লাহ তায়ালার সাক্ষী। ইবরাহীম (আ.) দোয়া করেছিলেন, আমার পর কিয়ামত পর্যন্ত যারা পৃথিবীতে আসবে, তারা আমাকে উৎকৃষ্ট ভাষায় স্মরণ করবে। (সূরা শুআরা : ৮৪)। নেকীর বদলা দুনিয়ায় মহান আল্লাহ প্রশংসা, সুনাম ও সুখ্যাতির মাধ্যমে দিয়ে থাকেন। ইবরাহীম (আ.)-কে প্রত্যেক জাতিই ভালো নামে স্মরণ করে থাকে। কেউ তার মহানুভবতা ও মর্যাদাকে অস্বীকার করে না।

একজন মুমিন আর একজন মৃত মুমিন ব্যক্তির ভালো গুণের আলোচনা করতে পারে। যারা দুনিয়া থেকে চলে যায়, তাদের কল্যাণের জন্য তাদের ভালো আমলগুলোর উল্লেখ করলে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় তার সাক্ষী হিসেবে কবুল করেন। এ হাদিস সামনে রেখেই এ কথা জানা যায়।

‘আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাহাবায়ে কেরাম একবার এক জানাযায় গেলেন। সেখানে তারা মৃতের প্রশংসা করতে লাগলেন। নবী সা. তা শুনে বললেন, ওয়াজিব হয়ে গেছে। এভাবে তারা আর এক জানাযায় গেলেন সেখানে তারা তার বদনাম করতে লাগলেন। তিনি সা. শুনে বললেন, ওয়াজিব হয়ে গেছে। এ কথা শুনে ‘ওমর রা. জানতে চাইলেন। কি ওয়াজিব হয়ে গেছে? হে আল্লাহর রাসূল! তিনি সা. বললেন, তোমরা যে ব্যক্তির প্রশংসা করেছ, তার জন্য জান্নাত প্রাপ্তি ওয়াজিব হয়ে গেছে। আর যার বদনাম করেছ, তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গেছে। তারপর তিনি সা. বললেন, তোমরা জমিনে আল্লাহর সাক্ষী। (বুখারী, মুসলিম; অন্য আর এক বর্ণনার ভাষা হলো তিনি বলেছেন, মুমিন আল্লাহ তায়ালার সাক্ষী)। সহীহ : বুখারী ১৩৬৭।

এখান থেকে বোঝা যায়, দুনিয়ায় মুমিনগণ আল্লাহ তায়ালার সাক্ষী। একজন মৃত ব্যক্তির ভালো গুণের আলোচনা করতে পারে। যারা দুনিয়া থেকে চলে যায় তাদের কল্যাণের জন্য তাদের ভালো আমলগুলোর উল্লেখ করলে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় তার সাক্ষী হিসেবে কবুল করেন। এ হাদিসকে সামনে রেখেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা রাহিমুল্লাহর বিষয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করব- ওমা তাওফিকী ইল্লা বিল্লাহি আলাইহি তাওয়াক্কালতু ওয়া ইলাইহি উনিব।

১৯৪৮ সালের ২ ডিসেম্বর আবদুল কাদের মোল্লা ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার চরবিষ্ণুপুর ইউনিয়নের জরিপের ডাঙ্গী গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। দাদা আবু মোল্লা, বাবা সানাউল্লাহ মোল্লা, মা-বাহেরুন্নেসা বেগম, ৯ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তার জন্মের কিছুকাল পর তার পিতা-মাতা সদরপুরেরই আমিরাবাদ গ্রামে এসে বাড়ি করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

তিনি মেধাবী একজন ছাত্র হিসেবে ১৯৫৯ ও ১৯৬১ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাবৃত্তি লাভ করেন। ফরিদপুরের বিখ্যাত রাজেন্দ্র কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে বিএসসি পাস করেন। ফরিদপুরের শিবসুন্দরী (এস এস) একাডেমি নামক একটি স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেন কিছুকাল।

১৯৭৫ সালে তিনি শিক্ষা প্রশাসনের ডিপ্লোমায় অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরে আবার ১৯৭৭ সালে শিক্ষা প্রশাসন থেকে মাস্টার্স ডিগ্রিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। এমএড পরীক্ষার রেজাল্টের পরে তিনি বাংলাদেশ রাইফেলস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে তিনি একই প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।

কে জানতো সময়ের ব্যবধানে এদেশের ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবেন আবদুল কাদের মোল্লা। কে জানতো এ আবদুল কাদের মোল্লা হবেন বিপন্ন মানবতার মুক্তির কাণ্ডারি, তিনি হবেন অন্ধকার পৃথিবীতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ।

শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা অসাধারণ মেধাবী ছাত্র হিসেবে গ্রামে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি ১৯৫৯ সালে প্রাথমিক বৃত্তি এবং ১৯৬১ সালে মাধ্যমিক শিক্ষাবৃত্তি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনস্টিটিউট থেকে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৬ সালে ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৬৮ সালে একই বিদ্যাপীঠ থেকে বিএসসি পাস করেন।
জীবনের ঊষালগ্ন থেকেই শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা আর্থিক সংকট মোকাবিলা করে জীবন সংগ্রামে এগিয়ে যান। চরম অর্থ সংকট তাকে সদরপুরেরই বাইশরশি শিবসুন্দরী (এস এস) একাডেমি নামক একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতে বাধ্য করে। একজন আদর্শ, জ্ঞানী, চরিত্রবান শিক্ষক হিসেবে তার সুনাম হতে থাকে।

অসাধারণ মেধার অধিকারী আবদুল কাদের মোল্লা উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে ফরিদপুরের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালরে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে এমএসসিতে ভর্তি হন। তখন গণঅভ্যুত্থানের সংগ্রামী চেতনা মানুষের প্রাণে প্রাণে সঞ্চারিত হচ্ছে। ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা তার আকর্ষণীয় চরিত্র দিয়ে আকৃষ্ট করেন শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারীদের, হয়ে ওঠেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয়মুখ। ১৯৭১ এ সমগ্র বাংলা উত্তাল হয়ে উঠলে আবদুল কাদের মোল্লা বসে থাকলেন না। ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলে তিনি বন্ধুদের সাথে প্রায় বসতেন, তাদের মুক্তির পথ কীভাবে উন্মুক্ত হবে, তার উপায় খোঁজার চেষ্টা করতেন। তিনি বুঝতে পারলেন মুক্তির জন্য রক্ত ঝরাতে হবে, দিতে হবে প্রাণ, শহীদ হতে হবে। ২৫ মার্চ কালো রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয় শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের কারণে তিনি মাস্টার্স পরীক্ষা দিতে না পেরে বাড়ি চলে গেলেন।
মনে করলেন বাড়ি ফিরে গিয়ে সংগঠিত করবেন এলাকার যুবক বন্ধুদের, দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য তিনি যুদ্ধ করবেন। ফরিদপুরের বাড়িতে ফিরে এলেন। প্রতি রাতে বের হতেন সহপাঠীদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। ইতোমধ্যে এলাকার যুবকরা সংগঠিত হয়ে গেছে। শহীদ আবদুল কাদের যোগ দিলেন মুক্তিবাহিনীতে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জেসিও মফিজুর রহমান এসব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের ট্রেনিং শুরু করলেন। পহেলা মে পাক-হানাদার বাহিনী ফরিদপুরে প্রবেশ করল। পহেলা মে হানাদার বাহিনী ফরিদপুরে ঢুকলে শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা ও তার সঙ্গীগণ আর প্রকাশ্যে যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে পারলেন না।
১৯৭৪ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর (ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল রিসার্চ) বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে তিনি শিক্ষা প্রশাসনের ডিপ্লোমায় অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। ১৯৭৭ সালে তিনি শিক্ষা প্রশাসনে মাস্টার্সেও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন ।
১৯৭৫ সালে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি রাইফেলস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি রাইফেলস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৭৮ সালে ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এ রিসার্চ স্কলার হিসেবে যোগ দেন।
শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা রাহিমাহুল্লাহ সাংবাদিক হিসেবে ভুমিকা পালন করেন। এটা আশির দশকের কথা। দেশ তখন সামরিক জান্তা স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট এরশাদের কবলে। সামনে এগিয়ে এলেন শহীদ আবদুল কাদেরের মতো সাহসী ব্যক্তিরা। তিনি সাংবাদিকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট হন। সাধারণ মানুষের মাঝে সত্য ছড়িয়ে দেয়ার জন্য একজন নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে আবদুল কাদের মোল্লার নাম বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ।
১৯৮১ সালে সাব-এডিটর পদে ‘দৈনিক সংগ্রাম’ পত্রিকায় যোগ দেন শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা। অল্পসময়ের মধ্যে তার দক্ষতা এবং দূরদর্শিতার কারণে পত্রিকাটির প্রথমে সহকারী সম্পাদক ও পরে নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পান। সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে সকল পত্রিকা গণতন্ত্রের অতন্দ্রপ্রহরীর ভূমিকা পালন করেছিল, ‘দৈনিক সংগ্রাম’ তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা ‘বীক্ষণ’ ও ‘সহজ বচন’ ছদ্মনামে কলাম লিখতেন। তার লেখা আর্টিকেলগুলো সচেতন পাঠক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার ক্ষুরধার ও বস্তুনিষ্ঠ, রসালো লেখা প্রকাশ হতে থাকে দেশের জাতীয় দৈনিকসমূহে। দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংগ্রাম, সোনার বাংলা, পালাবদল, মাসিক পৃথিবী, কলম ইত্যাদি নানা দৈনিক, মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে তিনি লিখেছেন।
আবদুল কাদের মোল্লা ‘দৈনিক সংগ্রাম’ পত্রিকাটি আরো আকর্ষণীয় করে পাঠকপ্রিয় করে তোলেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্যপদ লাভের পাশাপাশি ১৯৮২ ও ১৯৮৪ সালে পরপর দুবার তিনি অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। শিক্ষক আবদুল কাদের মোল্লা একজন আপসহীন সাংবাদিক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার রসময় গল্পকথার সজীবতায় ভরে উঠত গণমানুষের চেতনার প্রতীক জাতীয় প্রেস ক্লাব। সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণে এক সময় সাংবাদিকতা পেশায় ঢিল পড়ে যায়। কিন্তু যে পেশা তার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, এর মহত্তকে তিনি ধারণ করতেন সবসময়। তাই তো তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের একজন সম্মানিত সদস্য হিসেবে ছিলেন সাংবাদিক সমাজের অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে। দৈনিক সংগ্রাম অফিসের রুমগুলো এখনো বহন করে বেড়াচ্ছে কাদের মোল্লার স্মৃতি।
অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালেই তিনি কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকার পর তাফহীমুল কুরআনের হৃদয়স্পর্শী ছোঁয়ায় ইসলামীর প্রতি প্রবলভাবে আকর্ষিত হন এবং ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে তিনি ছাত্রসংঘে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে তিনি এ সংগঠনের সদস্য হন। ছাত্রসংঘের শহিদুল্লাহ হল শাখার সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি, ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারি ও একই সাথে কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতের রুকন হন। তিনি অধ্যাপক গোলাম আযমের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি এবং জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য হন। ১৯৮২ সালে তিনি ঢাকা মহানগরী জামায়াতের সেক্রেটারি ও ১৯৮৮ সালের শেষ ভাগে তিনি ঢাকা মহানগরী আমীর ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯১ সালে কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও ২০০০ সালে জামায়াতে ইসলামীর এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে মনোনীত হন। জনাব মোল্লাকে বিভিন্ন মেয়াদে চারবার জেলে যেতে হয়।
আবদুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের সাথে প্রায় সিকি শতাব্দী একসাথে কাজ করেছি। অনেক ইতিহাস, অনেক কথা। শ্রমিকদের কাজে বেশ উৎসাহী ছিলেন। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় অফিসে অনেকবার এসেছেন, বক্তব্য রেখে আমাদের উৎসাহীত করেছেন। আবদুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের সাথে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল পুরান ঢাকার সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলগেটে।
১. ব্যক্তিগতভাবে একজন সাহসী এবং দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন আবদুল কাদের মোল্লা ভাই। আল্লাহর প্রতি ছিল তার অগাধ বিশ্বাস, আস্থা এবং নির্ভরশীলতা। দীনের জন্য জীবন দিতে সবসময় তিনি প্রস্তুত ছিলেন…। তিনি বলতেন, জীবনে মরতে হবে একবারই। শহীদ হয়ে মরতে পারলে জীবন সার্থক হয়ে যাবে। এ বিশ্বাসের ওপরে নির্ভর করে তিনি নির্ভয় জীবনযাপন করতেন। বিশ্বের অগণিত মানুষের হৃদয় ফাটানো কান্না ও করুণ আর্তনাদের মধ্য দিয়ে বাংলার সবুজ জমিনকে নিজের শহীদি রক্তে রঞ্জিত করে জান্নাতের পথে পাড়ি জমান বাংলাদেশের ইসলামপ্রিয় মানুষের নন্দিত নেতা ইসলামী আন্দোলনের সাহসী সৈনিক শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা।
২. হাজার হাজার মানুষের ভালোবাসা ও চোখের পানিতে বাবা-মার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হন জামায়াতের সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা। তার মা-বাবাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। শহীদ হবার আগে বলে গেলেন- তাকে যেন বাবা-মার কবরের পাশে দাফন করা হয়।
৩. একজন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিভিন্ন বিতর্ক সভা, আলোচনা সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও জনসভায় যুক্তিভিত্তিক বক্তব্য রাখতেন। ছাত্রজীবন থেকে তিনি বুদ্ধিজীবী হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত হতে থাকেন।
শহীদ হওয়ার আগ মুহূর্তেও হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন আবদুল কাদের মোল্লা। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১০টা ১ মিনিটে তার ফাঁসির রায় কার্যকর করে জালেম সরকার কর্তৃক মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশকে কলংকিত করা হয় ।
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ বলেছেন, সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে সরকার তাকে হত্যা করে নিজেদের রাজনৈতিক মৃত্যু ডেকে এনেছে। তিনি বলেন, শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণ এ হত্যার বদলা নেবে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরকে একটি লজ্জাজনক ঘটনা হিসেবে অভিহিত করে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানবাধিকার আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে বিচারের নামে খুন করেছে। কাদের মোল্লা ন্যায়বিচার পাননি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা যেন ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দেয়। আবদুল কাদের মোল্লা বলেছেন, “আমার শাহাদাতের পর যেন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা চরম ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে আমার রক্তকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য কাজে লাগায়। কোনো ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে যেন জনশক্তি নিয়োজিত না হয়। কত বড় হৃদয় ও মন থাকলে এবং আন্দোলনকে ভালোবাসলে জীবনের শেষ মুহূর্তে এ ধরনের কথা বলে যেতে পারেন, চিন্তা করার বিষয়। আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসের উচ্চ মাকাম দান করুন- আমীন।
২০২৪ সালের গোড়ার দিকে বরিশাল সফর ছিল। ইসলামী ছাত্রশিবিরের একটি প্রশিক্ষণ বৈঠকে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে বরিশালের গৌরনদীতে এবং ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলায় সাংগঠনিক কাজ উপলক্ষে তাদের অফিসে গিয়েছিলাম। বহুদিন পর শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা রাহিমাহুল্লাহর কবর জিয়ারত করতে মানসিক সান্ত্বনা লাভ করলাম। কবর জিয়ারত করলাম সাবেক কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য আকর্ষণীয় কুরআন পাঠক সাবেক ক্বারী হযরত মাওলানা সরদার আব্দুস সালাম রাহিমাহুল্লাহর। তাদের বেঁচে থাকা আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বললাম। চোখের পানিতে ভিজে তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম। আল্লাহহুম্মাগ ফিরলাহু ওয়ারহামহু, ওয়া আফিহি ওয়া ফু আনহু; ওয়া আকরিম নুযুলাহু, ওয়া ওয়াসসি মাদখালাহু; ওয়াগসিলহু বিল মায়ি ওয়াস সালজি ওয়াল বারাদি, ওয়ানাক্কিহি মিনাল খাতা-ইয়া কামা ইউননাককাস সাওবুল আব ইয়াযু মিনাদদানাসি; ওয়াবদিলহু দা-রান খায়রান মিন দারিহি, ওয়া আহলান খাইরান মিন আহলিহি; ওয়া যাওজান খাইরান মিন যাওজিহি। ওয়া আদখিলহুল জান্নাতা, ওয়া আইজহু মিন আযাবিল কাবরি ওয়ামিন আযাবিন নার।
“হে আল্লাহ্, তাকে ক্ষমা করুন এবং তাকে দয়া করুন। শান্তিতে রাখুন এবং তার থাকার স্থানটিকে মর্যাদাশীল করুন। তার কবর প্রশস্ত করে দিন। বরফ ও তুষারের শুভ্রতা দিয়ে, তাকে গুনাহ থেকে এমনভাবে পরিচ্ছন্ন করে দিন- যেমন ময়লা থেকে সাদা কাপড় পরিষ্কার হয়। তাকে দুনিয়ার বাসস্থানের চেয়ে উত্তম বাসস্থান, পরিবার ও সঙ্গী দান করুন, হে মাবুদ! তাকে জান্নাতে দাখিল করুন, তাকে কবর আর দোজখের আজাব থেকে রক্ষা করুণ।” (মুসলিম, হাদিস : ২/৬৩৪)।
আমার সাথে সেই এলাকার জামায়াতের ২০-২৫ জননেতা এবং কর্মী ছিলেন। তাদের নিয়ে বসলাম, প্রশ্নোত্তর দিলাম এবং দীর্ঘদিন একসাথে যাদের সাথে কাজ করেছিলাম তাদের জন্য সকলে মিলে প্রাণভরে দোয়া করলাম। চিন্তা করলাম, হয়তো এটাই এ জেলায় আমার জীবনের শেষ সফর! এর পরবর্তী সময় সেখানেই যেতে হবে, যেখানে আমাদের ভাইয়েরা শুয়ে আছেন। হে আল্লাহ! রহমানুর রহিম, গাফুরুর রহিম, তুমি আমাদের সকলকে মাফ করে দাও। আমাদের গুনাহকে নেকিতে পরিণত করে জান্নাতুল ফেরদাউসে একই সাথে বসবাস করার তাওফিক দাও। আমিন ইয়া রব্বাল আলামিন।
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত, আগামীকালের জন্য সে কী প্রেরণ করে, তা চিন্তা করা। আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করতে থাক। তোমরা যা কর, আল্লাহ তায়ালা সে সম্পর্কে খবর রাখেন।” সূরা হাশর : ১৮।
You who have believed! Fear Allah, and let every soul look to what it has sent forth for tomorrow. Yea, fear Allah. for Allah is well-acquainted with (all) that ye do.Ó Hasore Ô-18
সুবহা নাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লা আনতা আস্তাগফিরুকা ওয়া আতুবু ইলাইকা।
লেখক : সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য।